micro-story-chithi

চিঠি
সহেলী রায়


সুতপা ঝলমল করে অফিসে ঢুকল। না না বলা ভালো সুতপা ঢুকতেই অফিসের ঝিমঝিমে ভাবটা মিলিয়ে গেল। কর্পোরেট কেতা। নিভু নিভু আলো। ছোট ছোট কেবিন। যেন একান্নবর্তী সংসারগুলো ভেঙে টুকরো করা হয়েছে। সুতপা সেই গল্পের অবিবাহিতা পিসিমা যে সব বাড়িতেই ঢুঁ মারে, চেষ্টা করে ঘরগুলো জুড়ে দিতে। এক্ষেত্রে একটাই অমিল, সুতপা বিবাহিতা।

সাঁঝ পুরু কাজল পরা চোখে গিলে খায় সবটা। মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই, সাঁঝের টেবিল। ওর কেবিন নেই। খোলামেলা কিছুটা জায়গা ওর দখলে। অফিসটি ফটোকপিয়ার যন্ত্র বেচে ও তার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে। এককথায় সেলস অ্যান্ড সার্ভিস। পশ্চিমবঙ্গ ছাপিয়ে সারা ভারতেই ছড়িয়েছে এদের শেকড়বাকড়। সাঁঝ সেলস, সার্ভিস দুইয়েরই যোগসূত্র। অনেকটা মূলমঞ্চের ব্যাকস্টেজের মতো। সরাসরি কুশীলব না হয়েও পর্দার পেছনের ছড়ি তার হাতেই।

‘আমি আর নিরঞ্জন সার্কাস দেখতে গেছিলাম জানো?’

 কথার ফাঁকে উচ্চৈঃস্বরে হাসে সুতপা। এমন শরীরসর্বস্ব হাসির জন্যই অফিসের কেন্দ্রবিন্দু সে। সুতপার কেন্দ্রবিন্দু অবশ্য ওর বর, নিরঞ্জন। নিরঞ্জন সবজান্তা, যা সারা পৃথিবীর লোকের অজানা, তাও নিরঞ্জন জানে এবং নিরঞ্জনই ধ্রুব সত্য, সুতপার এমনটাই দাবী। গোটা অফিস নিরঞ্জনকে চাক্ষুষ না দেখলেও নিরঞ্জনকে সবাই চেনে। সুতপার ভাষ্য খঞ্জনী বাজিয়ে সারাক্ষণ নিরঞ্জনের নামগান গায়।

 সাঁঝের ভাবুক মন। সুতপার পঞ্চম মধুচন্দ্রিমায়, ইউরোপ ভ্রমণে কগ হুইল ট্রেনে জুংফ্রাউহক অর্থাৎ টপ অফ ইউরোপে পৌঁছে বরফ ঢাকা সাদা চাদরে হাঁটু গেড়ে বসে নিরঞ্জন কীভাবে সুতপাকে একশ’তম প্রেম নিবেদন করেছিল তাই ফুটিয়ে তোলে মনস্ক্রিনে। সাঁঝ একা নয়, এম ডি রাহুল স্যরও কাজের কথার ফাঁকে হাল্কা করে রাস্তা বদলে নেন,

‘কী সুতপা ম্যাম, নিরঞ্জন স্যর বঢ়িয়া তো?’

পিওন এসে ঝপ করে চিঠির তোড়া টেবিলে ফেলে। এ যেন চলচ্চিত্রের চরম মুহূর্তে বিজ্ঞাপন বিভ্রাট বা চলতি গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষলে যেমন ধাক্কা লাগে তেমনই চমক।

‘উফ! মলয়দা একটু আস্তে।’

 মলয়দা কান এঁটো করা হাসিতে এড়িয়ে যায়। অগত্যা সাঁঝ ঝাঁপি খোলে। কয়েকটা খাম খুলে নির্দিষ্ট ফাইলে চিঠিগুলো সাজায়। কিছু অদরকারী চিঠি ছুঁড়ে দেয় বিনে। এমনই একটি সাদা খাম ফস করে ছিঁড়ে ফেলার মুহূর্তে হঠাৎ খেয়াল হল খামের ওপর কোম্পানী বা রাহুল স্যরের নাম দেখল না তো? সুতপা দাস? প্রেরকের নাম নেই। কারো ব্যক্তিগত চিঠি তো অফিসে আসে না। মুখটাও ছিঁড়ে ফেলে মুশকিলে পড়ল সাঁঝ। সুতপাকে কে চিঠি পাঠাবে? সুতপা মেশিনের সার্ভিসিং বিভাগের কল ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ করে। সরাসরি কোন কাস্টমারের সঙ্গে কথা হয় না ওর। কল লগ করার বিভাগটি অন্যরা দেখে। সাঁঝ কৌতূহল রাখতে পারে না।

‘সুতপা ম্যাম, আপনার নিরঞ্জন বালিগঞ্জের একটি কম্পলেক্সে নির্দিষ্ট একটি ফ্ল্যাটে রোজ দুপুরে আসে। আমার জানলা দিয়ে সেই ফ্ল্যাটের ভিতরটি দেখা যায়। মহিলা একা থাকে, চরিত্র ভালো নয়। কম্পলেক্সের সবাই জানে। নিরঞ্জন কোন বিপদে পড়তে পারেন। আপনি একটি ব্যবস্থা নিন।’

 সাঁঝের হাতের তালু ঘেমে ওঠে। কী করবে? দেবে চিঠিটা সুতপাকে? সুতপা নিশ্চয়ই ঝরঝর করে কাঁদবে। পরদিন থমথমে মুখে অফিসে আসবে। এক কোণে চুপচাপ পড়ে থাকবে। সমস্ত সুনামির চিহ্ন নিয়ে শান্ত হবার অভিনয় করবে। একে একে সবাই কৈফিয়ত চাইবে, ক্ষতটা কতটা গভীর? অফিসটা নিভু নিভু আলোয় জবুথবু হয়ে বসবে।

‘অ্যাই সাঁঝদি আজ তাড়াতাড়ি কাটব, নিরঞ্জন মেইনল্যান্ড চায়নায় টেবল বুক করেছে, আজ নাকি আমাদের প্রপোজ ডে। আমার ছাতা ওসব মনেও থাকে না।’

 ঝরনার মতো নিষ্পাপ জলকণায় ঝরে পড়ছে সুতপা। সাঁঝ হাঁ করে ব্লটিংপেপারের মতো শুষে নিচ্ছে সুতপাকে। অজান্তেই চিঠিটা শত টুকরো করে ফেলল সাঁঝের হাত।

আসলে সত্যি মিথ্যে শব্দ দুটি একে অপরের গায়ে ঝুলে থাকে সম্পর্কের মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *