অনুভা নাথ
জানুয়ারীর তীব্র ঠান্ডায় দুপুরবেলা রফিকুল লালচকের জনবহুল দোকানগুলোকে দ্রুত পায়ে পার করছিলো, এখানে বেশীরভাগ দোকানে ভারতের পতাকা বিক্রি হচ্ছে, স্থানীয় মানুষের ঢল নেমে পড়েছে রাস্তায়, যেন কোনও উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা শহর। আজ ওস্তাদের সাথে ওদের ক’য়েকজনের বিশেষ মিটিং আছে, আগামী ছাব্বিশ তারিখে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে রফিকুলদের সংগঠন কাশ্মীরে আতঙ্কবাদী হামলা করবার ছক কষছে।
চারিপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে রফিকুলের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। দেশভক্তি! আজও নিভৃতে থাকলে রফিকুলের মনে পড়ে যায় ওর শৈশবের সেইসব দিনগুলির কথা। আব্বু, আম্মির অসহায় মুখগুলো, ভারতে দীর্ঘদিন থাকার পরও শুধুমাত্র মুসলিম বলে ওদের কি ভীষণ অপমানিত হতে হয়েছিলো, ওর অসুস্থ আব্বুকে যেদিন শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার অপরাধে কোনও প্রতিবেশী হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি, প্রায় বিনা চিকিৎসায় উনি মারা গেলেন, সেইদিনই রফিকুল নিজের মায়ের অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়া দেখতে দেখতে শপথ নিয়েছিলো, নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ভারতের শত্রুতা করবে। তারই ব্লু প্রিন্ট তৈরীর উদ্দেশ্যে রফিকুল আজ ওস্তাদের কাছে যাচ্ছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগলো রফিকুল, একটু বুঝি অন্যমনস্কও হয়ে পড়েছিল,তখনই চারিদিকের বাতাস মুচড়ে একটা তীব্র আওয়াজ কানে এল, যেন কয়েকশো বাজি একসাথে ফেটে উঠল। তারসাথেই কেউ যেন ওকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে বেশ একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কয়েক সেকেন্ড লাগলো পরিস্থিতি বুঝতে, প্রচন্ড ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে করতে রফিকুল শুনতে পেল অনেক মানুষের গোঁঙানোর শব্দ।
ঘটনার আকস্মিকতায় রফিকুল জ্ঞান হারাল। জ্ঞান ফিরে এলে সে নিজেকে আবিষ্কার করল হসপিটালের বেডে। এর পরের ঘটনাগুলো ও নিজের স্ত্রীর কাছে শুনেছিল। কাশ্মীরের লালচকে কোনও আতঙ্কবাদী গোষ্ঠী গ্রেনেড হামলা করে, ভিড়ে ঠাসা লালচকের নিরীহ মানুষ মারাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। আক্রমণের মূহুর্তে কর্মরত একজন জওয়ান ওকে সেই মুহূর্তে ঠেলে সরিয়ে না দিলে হয়তো আজ ও বেঁচে থাকতো না। স্ত্রীর অঝোরে কান্না, নিজের একমাত্র সন্তানের অসহায় দৃষ্টির মধ্যে রফিকুল নিজের ছেলেবেলার অসহায়তার কোথাও যেন মিল পাচ্ছিল।
রফিকুল মনস্থির করলো জওয়ানটির সাথে ও দেখা করবে। তার ঠিকানা জোগাড় করে ও স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে তার কোয়াটারে পৌঁছালো, জওয়ানের নাম ইকবাল, তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শ্রীনগরের আর্মি হসপিটালে ভর্তি। ইকবালের স্ত্রীকে রফিকুলের স্ত্রী জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ পর রফিকুল দেখলো ইকবালের পাঁচ বছরের ছেলে রফিকুলের ছেলেকে খেলতে খেলতে ভারতের পতাকা দিয়ে বলছে ‘জয়হিন্দ’, ইকবালের স্ত্রী গর্বের সাথে ওদের বলল, “আমার ছেলের খুব ইচ্ছা ওর বাবার মতো দেশের জন্য লড়বে।”
রফিকুলের সব হিসাব ভুল হয়ে যাচ্ছিলো, মনের মধ্যে চিন্তা করলো ও এতটা স্বার্থপর, শুধু নিজের আব্বু আম্মির কথা চিন্তা করে গেছে এতগুলো দীর্ঘ বছর? আজ ইকবালের পরিবারের কাছে নিজেকে ওর খুব ছোট মনে হল।
ইকবালের কোয়াটার থেকে স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে যে বেরিয়ে এলো সে এক নতুন রফিকুল,সে বুঝেছে,মানুষের কাছে তার কর্তব্যই হলো প্রকৃত ধর্ম,কতটা মানসিক জোর থাকলে একজন জওয়ান তার স্ত্রী, সন্তানের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত অবলীলায় দিয়ে দিতে পারে,কতটা উদারতা থাকলে একজন মা গর্বের সাথে নিজের সন্তানের জীবনের পরোয়া না করে দেশের জন্য তাকে নিবেদন করতে পারে।রফিকুলের দীর্ঘদিনের লালিত ধ্যানধারণা হেরে গেল একজন জওয়ানের কর্তব্যের কাছে,তার স্ত্রীর ভালেবাসার কাছে,তার সন্তানের সারল্যের কাছে।ছেলের হাতে ধরা দেশের পতাকাটা পরম মমতায় রফিকুল আঁকড়ে ধরল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অনুভা, গতকাল রাতেই গল্পটা পড়েছি। এককথায়, খুব খুব সুন্দর অণুগল্প তোমার ! উপস্থাপনের মুনশিয়ানায় আগাগোড়া সাসপেন্স বজায় রাখতে পেরেছ । গল্পটির আবেদন শাশ্বত… চিরকালীন । তোমার জন্যে থাকছে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
বেশ লাগলো৷
Khub sundor chintavabna lekhikar.