মোজাফ্ফর হোসেন
হাতটা ধরবি? বাবার কণ্ঠস্বর শুনি।
আমার হাত কাঁপতে থাকে। বাবাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস হয় না কিছুতেই।
আমরা হাঁটতে থাকি। ওখানে ভালো লাগে না, তাই না বাবা? আমি বলি।
এই এক সুবিধা, যখন তখন চলে আসতে পারি। আগে তো পারতাম না, তুই এতো দূরে থাকিস, নিজেও যেতে পারতি না। এখন তোর শহরে তোর সঙ্গে হেঁটে বেড়াই। অনেক সময় নিই তোর, তাই না বল? সময় তো এখানে জীবনের দরে বিক্রি হয়।
সময় তুমি কখনোই নাওনি, দিয়েই গেছ। তাছাড়া, এই যে আমার সঙ্গে আছো, এটাও তো আমার জন্যই। এখানে তো তোমার মতো করে কারো সঙ্গে এমন করে কথা বলতে পারি না। ছেলে বউ কেউ তো বাংলাটা শিখল না। ওদের ভাষায় ওদের কথা বলি। নিজের কথা কারো সঙ্গে বলা হয় না।
জানিস তো, তোদের মতো সিভিলদের জন্য ভালো থাকা একটা শিল্প, রপ্ত করতে হয়। এমনি এমনি বোকারা কেবল ভালো থাকতে পারে।
বোকা হলেই ভালো হতো বাবা। এভাবে চলে আসার সুযোগ পেতাম না, তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারতাম।
আমরাই আর কতদিন থাকতাম! এখন ওসব ভেবে মন্দ থাকার কোনো মানে হয় না। এই কারণে বললাম, ভালো থাকার কৌশলটা জানতে হবে তোকে।
তুমি আর মা কিভাবে থেকেছ, কি খেয়েছ, কখন ঘুমিয়েছ, কি কথা বলেছ কিছুই জানি না। হাসপাতালে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, না? ছুটিটা কিছুতেই পেলাম না, জানো! খবরটা যখন পেলাম তখন বসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের নোট নিচ্ছি। একটু এদিক সেদিক হলেই সমস্যা।
কেউ তো আর কৈফিয়ত চাচ্ছে না। বাবা বাতাসে গাছের মতো নিশ্বাস ঢেলে বলে।
চাইলে তবু ভালো হতো। নিজের কাছে নিজের কৈফিয়ত ভেতর থেকে দম টেনে ধরে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমি অক্সিজেনভর্তি একটা আলোর বাকশে বন্দি আছি, তলিয়ে যাচ্ছি ক্রমশই, বেঁচে আছি ঠিকই কিন্তু আর কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছি না। তখন তুমি আসো, তোমার উপস্থিতি আমি শুনতে পাই। তোমার কণ্ঠস্বর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তোমার স্মৃতির স্পর্শে আমি জেগে উঠি।
বাবা হাসেন। সমস্ত শব্দের মধ্যে বাবার হাসির নৈশব্দ আমি শুনতে পাই। বাবার শিশুর মতো হাসি দিগন্তের সঙ্গে মিশে পুরো আকাশটা ছড়িয়ে পড়ে। অচেনা গাছ, অজানা পাখি, অপরিচিত মানুষের মাঝে নিজেকে আর আগন্তুক মনে হয় না।
তোমার সঙ্গে মাও যদি আসত, খুব ভালো হতো বাবা। বাবাকে বলি।
আসবে। বেশি দিন আর তোকে অপেক্ষা করতে হবে না। অসুখটা আমিই দিয়ে এসেছি। না মরলে তো আর এত দূর দেশে চাইলেই যখন তখন চলে আসা যায় না। বলেই বাবা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন—বুঝতে পারি বাবা কিছু একটা বলতে চান কিন্তু কিছুতেই পারছেন না, কে বা কারা যেন তার মুখটা চিরকালের মতো এটে দিয়েছে। বাবা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে।
আমি তো কিছু করিনি বাবা, তোমার ধার করা স্বপ্নের পথে নিজেই আমাকে তুলোর মতো ভাসিয়ে দিয়েছ, মনে পড়ে? বাবা, পড়ে মনে? এতটা চিৎকার করে বলি যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ আমাকে অনুকরণ করে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন