সুমী সিকানদার
চুপচাপ চেয়ারশুদ্ধ পড়ে গেলেন মা। বসে বসে পেপার পড়ছিলেন। ঠিক দুপুরে আমরা কেউ তখন স্যরের বাসায় যাই, কেউ ঘুমাই। মা যে পড়ে গেলেন কেউ টের পায়নি। বিকেল চারটার দিকে ভাইয়ের বন্ধু আরিফ ছোট ভাই টুটুল কে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকে দেখে মা চেয়ার সমেত মেঝেতে অচেতন পড়ে আছেন।
এরপরের কয়েক ঘন্টা খুব হুড়োহুড়ি গেল। হাসপাতাল, ডাক্তার, শেষ চেষ্টা। মা আমার সময় দেননি। কার্ডিয়াক এটাকেই চলে গেছেন। যে যেভাবে খবর পেয়েছে চলে এসেছে। তাকে মুঠো মুঠো মাটি দিয়ে ঢেকে রেখে এলাম। উপরে খেজুর গাছের একটা তাজা ডাল। শীতল থাকুক আমার মা।
সকালে মায়ের হাতের পিঠায় কামড় দিয়েই ভার্সিটি গেছিলাম। সন্ধ্যায় বাসার কোথাও মা নেই। আমি বড় ছেলে, ছোট দুইভাই এবং অনেক ছোট বোন। এই চারজন নিয়েই ছিলো মায়ের রান্নাবাটি সংসার। সংসারের চোটে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই পড়া ছেড়ে দিলেন। আসলে সংসার এক নেশা। বেগুন, টমেটো, কাঁচামরিচ গাছ লাগানোর মতো। রোজ পানি দেবার মতো। দেয়ালের পাশে চিলতে জমি, তাতেই এসব সালাদ, সবজি লাগাতেন মা। মহানন্দে তরকারীতে দি্তেন সদ্য ছেঁড়া ধনেপাতা।
দ্রুত রাতের ট্রেনে চড়ে বসেছেন বিপুল। বিনতা তার বন্ধু হলেও ভাবী। ফোনে শোনা মাত্র টিকিট কেটেছে। বিনতা- বিপুল সহপাঠী ছিলো। ট্রেনের জানালায় পথ ঘাট প্রান্তর পার হচ্ছে সে। বিপুল জানে না বিনতাকে ম্যটিঘরে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। যে হঠাৎ যেতে চায় তাকে কে রোখে।
প্রতিটা থেমে থাকা স্টেশনে বিপুল বিনা কারণে বিনতাকে খুঁজছে। তার মাথা কাজ করছে না। পাক্কা তিন বছর প্রেম ছিলো তাদের।. বিয়েটা জাস্ট ভেন্যুর অপেক্ষায় ছিলো। কিন্তু হুট করে বিপুলের বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল বিনতার।
অর্নাস না দিয়ে একের পর এক সন্তান নিয়ে মহা খুশী হবার প্রবল ভাণ করে জীবন কাটাতে থাকলো সে । মাঝে মাঝে স্বামী বাড়িতে না থাকলে হারমনিয়াম টেনে বসে যেত। ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণা ধারায় এসো।‘। বাড়ি ফেরার আগে আগেই হারমনিয়াম অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে যেত। বিনতা গান শিখেছিলো বিপুলের প্রবল উৎসাহে।
ভোরের স্টেশন নানা হাঁকডাকে জমজমাট। পেপার, তিলের খাজা, চকলেট, চিপস, ডিমসেদ্ধ। বিপুলের এতক্ষণে মনে হলো ক্ষিদে পেয়েছে। পেট চনমন করছে। সে ঝাল লবন ছিটিয়ে দু’টা ডিমসেদ্ধ খেলো। ধীরে ধীরে তার মাথা পরিস্কার হয়ে আসতে থাকলো। মার্বেল চোখের বিনতা বহু আগেই তার হাত ছেড়েছে। আজ ছেড়েছে দেহ। বিপুলের চোখ বিকেলের হুড তোলা রিকশায় বেগুনী শাড়ি পরা বিনতার গুনগুন সহ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিপুল বাসায় আসা মাত্রই সবাই চুপ। বিনতার স্বামী বিপ্লব হাত বাড়িয়ে ভাইকে ডাকলেন। বিপুল আস্তে আস্তে তার মাথার কাছে বসলো। বিপ্লব, বিপুলের হাতজোড়া বুকের মাঝে আটকে ধরে কাঁদতে লাগলেন। দুইভাই এখন একা। বিপ্লব বলছেন , ‘আমাকে মাফ করবি না?’ বিপুল হাল্কা গলায় বললো, ‘দাদা এসব কথা এখন আমরা না বলি। সে চলে গেছে।’
‘না, তোকে বলা দরকার। বিনতা প্রচুর মনোকষ্টে চলে গেছে। আমি তাকে বিয়েতে বাধ্য করেছিলাম।‘ চমকে তাকালো বিপুল।
” তুই ঢাকার বাইরে থাকার সুযোগে তাকে কৌশলে ডেকে রাতভর আটকে রেখেছিলাম। সকালে বিনতা মামার সংসারে আর ফিরতে পারবে না জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছে। ‘’ ভাই কাঁদছেন হাউমাউ করে।
‘’বিপুল আমি তো তোর থুথুর অযোগ্য। মানসিক ভাবে তাকে আগেই মেরে ফেলেছি, কাল তার দেহ গেছে। ‘’ ফিরছে বিপুল, বিনতা আরেক প্রান্তে। তারা সারারাত গল্প করতো ট্রেনের শব্দের ফাঁকে ফাঁকে। এখনই বিপুল ফোন দেবে। রিং টোন বাজছে…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন