শাওন বাগচী
আজ হঠাৎ করে ঠান্ডা পরেছে। কালও এতটা ঠান্ডা ছিল না। আজকের ঠান্ডাটা হচ্ছে অনেকটা সেইরকম ঠান্ডা, যখন অবেলায় তিথি এসে সদর দরজায় কড়া নাড়ে আর গৃহকর্তা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, এই ভেবে যে অতিথিকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করবে। ঠান্ডার এই হঠাৎ হানায় মারুর আজ অবস্থা কাহিল, মাঝে মাঝেই ওর দাঁতে দাঁত লেগে আসছে। মারু দেখল ওর সামনে লাল সোয়েটার পরা একটা বাচ্চা ছেলে অবাক চাহনি নিয়ে ওঁকে হাঁ করে দেখছে। এইসময় গুলো মারুর খুব মজা লাগে, ভালোও লাগে ভীষণ। ও দেখেছে এইসব গ্রামের দিকে ভগবান সাজলে ভালো ইনকাম হয়। কেউ কেউ ভক্তি ভরে কপালে হাতও ঠেকায়। এই আজ যেমন ও খালি গায়ে নীল রং মেখে কৃষ্ণঠাকুর সেজেছে। আর আজই জমিয়ে শীত পড়েছে, কপাল আর কাকে বলে। স্ট্যাচু হয়ে থাকা অবস্থায় চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মারু দেখে নিলো মেলায় আজ প্রচুর ভিড়। ওর অভিজ্ঞতা বলছে এই ভিড় পাতলা হতে কম করে আরো তিন চার ঘন্টা লাগবে। সুতরাং ওঁকে এই শীতে এভাবেই থাকতে হবে। সামনের বাচ্চাটা ততক্ষণে চলে গেছে, আর বাচ্চাটার বাপটা একটাও পয়সা দিয়ে যায়নি। তবে ওর সামনে পাতা চটটায় অনেক খুঁচরো জমা হয়েছে সাথে তিন চারটে দশ টাকার নোটও। দশ টাকার নোটগুলো দেখে মারু আরো শক্ত হাতে বাঁশিটা চেপে ধরল আর ভেতর ভেতর একটা বিড়ি টানার অদম্য ইচ্ছাটাকে গলা টিপে মারলো। ওপাশটায় একটা অন্ধ ফকির দুদিন হলো চট পেতে বসেছে। তবে মারুর মনে হয় অন্ধ ফকিরটা অন্ধ নয়। এসব অ্যাকটিং মারুর খুব ভালো করে জানা আছে। ও নিজেও আগে অনেক সময় লোকের করুণা পাওয়ার জন্য অন্ধ সাজতো। একবার ধরা পরে গিয়ে বেদম প্যাঁদানি খেল। আজও অবশ্য তাই, লোকে ওর আসল পরিচয় জানতে পারলে কেষ্ট ঠাকুর সেজে বাঁশি বাজানোর বারোটা বাজিয়ে দেবে।
একসময় শীতের রাত প্রকৃতির নিয়মে দ্রুত শেষ হতে থাকে। কুয়াশার ওড়না চাঁদকে আড়াল করে ক্লান্তির রাত ঘন হয়ে আসছিল। মেলা একসময় নিঝুম হতে থাকে। ক্রমশ মেলায় আলোর চাকচিক্য কমে আসে। আনন্দের আবেশ মেখে সেদিনের মতো ঝিমুনি নেমে আসে মেলার মাঠের চারিদিকে। বহু দূরের গ্রাম থেকে যারা পসরা নিয়ে আসে, মেলায় একমাস এখানেই তাদের বাড়িঘর। এখানেই থাকা খাওয়া। এখানেই আত্মীয়তা, এখানেই অচেনা সবার পরিবার হয়ে ওঠা। এভাবেই চলতে থাকে মেলার কটা দিন। একসময় রাত শেষ হয়। রাতের ঘুম চোখ লেগে থাকে সকালের অগোছালো মেলার গায়ে। রাত শেষ হয়ে ভালো করে আলো ফোঁটার আগেই মেলার সবাই পেছনের নদীর ধারে সকালের কাজকর্মটুকু সেরে নেয়। খুব ভোরে মারুও হাতে জলের পাত্র নিয়ে সেদিকে যায়। কিন্ত তখনই দেখল সামনের ঝোঁপটা থেকে কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যোদয়কে পিছনে রেখে উঠে আসছে অন্ধ ফকিরটা।
ঠিক ও যা ভেবেছিল তাই। এই ব্যাটা অন্ধ নয়। মনে মনে একটা ফাজিল হাসি হেসে মারু বলল “একি কত্তা করেছো কী ?” কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে ফকির বলল ” আরে দূর, এতো সবাই করে। ” মারু বুঝল এই লোককে ধরশায়ী করতে ওকে অন্য দান চালতে হবে তাই মারু ফকিরকে বলল ” তাতো বুঝলাম, তা কানে এখনো পৈতেটা ঝুলিয়ে রেখেছো কেন? সকালের কাজ তো সারা হয়ে গেছে, নাকি আবার গিয়ে বসবে?” এবার ফকির অপ্রস্তুত। এই অপ্রস্তুত হওয়ার কোন প্রস্তুতি থাকে না। সুতরাং কী উত্তর দেবে দ্রুত সেটা মস্তিষ্কের ভাঁজে পাটপাট করে গুছিয়ে নিচ্ছে। খুব সামান্য কয়েক সেকেন্ড, তারপরেই লোকটা হেসে মারুর পিঠ চাপড়ে বলল ” আরে ব্যটা তুই পরশু থেকে আমার ভাত মারছিস। পরশুদিন মেলায় এসে দেখলাম তুই কেষ্ট সেজে আগেই দাঁড়িয়ে আছিস। আমি এদিকে দুই যুগ ধরে শিব। আর জানিসই তো শিবের মেজাজ, দিলাম নিজের বেশভূষা ত্যাগ করে, পরে নিলাম আলখাল্লা। আর আলখাল্লার নিচে সব পেটেই এক। কী বলিস ঠিক করেছি কিনা বল?” মারু একগাল হেসে বলল “একদম ঠিক কাজ করেছো কাকা আমি হলেও তাই করতাম। ”
সকালের খাবারে দুটো স্পেশাল গরম চা আর ডিম পাউরুটি মাঝে রেখে দুজন অসম বয়সী পুরুষের সুখদুঃখ এক হতে বেশী সময় লাগল না। কথা এগোতে থাকে, পেটও ভরতে থাকে।
ফকির বলল “তা তোর নামটা কী যেন বললি?”
মারু উত্তর দিল ” মারুফ হোসেন “।
এরপর কয়েক সেকেন্ড দুজনের মাঝে নৈঃশব্দ্য। শুধু দুজনের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হল।
মারুফের মুখের ভাবটা এমন, যেন শেষ দানটা কেমন দিলাম কাকা? তুমি কী ভাবো এই দুনিয়ায় তুমিই এক আছ যে পৈতের ওপর আলখাল্লা পরে?
তারপরেই দুজনের একটানা দ্বৈতস্বরে হাসির আওয়াজে মেলার আশেপাশের সাধারণ অনুসন্ধিৎসু মানুষঘুরে তাকাল। ঠিক সেইসময় মেলা থেকে খানিকটা দূরে নদীর চরে আবার আরেকটা আশ্চর্য দিন অদ্ভুতভাবে নতুন করে শুরু হচ্ছে। বহুদিন ধরে সমগ্র বিশ্বচারাচর এমনই একটা দিনের অপেক্ষায় ছিল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন