ক্ষমা মাহমুদ
এত ভালোভাবে সবকিছু শেষ হবে, সেটা অনিকেত নিজেও ভাবতে পারেনি। যতজনকে বলেছিলো মোটামুটি সবাই এসেছে। প্রেসের লোকজনকে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে দিতে ভাবলো নামকরা সব পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলো কেউই বাদ যায়নি। প্রথমবারের মত তার একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী শহরে যথেষ্ট শোরগোল ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো অনিকেত।
‘এই অনি, সেই থেকে তোর সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছি, তুই তো এক প্রদর্শনীতেই বিখ্যাত হয়ে গেলিরে!’ হাসতে হাসতে কাছে এসে বললো রাইমা।
অনিকেতও হাসলো এতক্ষণে,‘আসলেই, অনেকদিনের চাওয়াটা আজকে বাস্তবের মুখ দেখলো।’
রাইমা বললো, ‘দেখিয়ে দিলি বটে! এতোকাল ধরে ফটোগ্রাফি নিয়ে যে লেগে আছিস, তার ফল এতদিনে পেলি, কিন্তু রেশমী, দিয়া ওরা কই? আমি তো ভাবলাম, এখানে আজকে সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে!’
‘ওরা আসেনি’- একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো অনিকেত।
‘রেশমী অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আর দিয়ার স্কুল, ছুটির দিন ছাড়া বের হতেই পারেনা। আমি আবার এই গ্যালারির বুকিং ছুটিরদিনে পেলাম না।’
‘দিয়া কোন ক্লাসে উঠলো রে এবার?’ রাইমা বলে।
অনিকেত হেসে বলে, ‘মনে হয় সেভেনে… আমার আসলে এগুলো খোঁজ নেয়ার এত সময় হয়না।’
‘আচ্ছা, শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত! যাহোক খুব ভালো লেগেছে তোর ছবিগুলো, আমি এখন যাই, পরে তোর সাথে ফোনে কথা বলবো।’
রাইমা যেতেই দেখলো ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধু, তুর্য, এদিকেই আসছে। আরে,দোস্ত, ফাটিয়ে দিয়েছিস! বিশেষ করে পাহাড়ী মেয়েদের ছবিগুলো তো অসাধারণ! শোন, আমি একটু ঘুরে আসি। রাতে তো আমরা বসছিই একসাথে। তামীম কিন্তু তোর জন্যে একটা আস্ত টাকিলা রেখে দিয়েছে, ডোন্ট মিস।’
তূর্য যেতেই পাশে তাকিয়ে দেখলো ‘দৈনিক বর্তমান’ পত্রিকার সাংবাদিক মেয়েটা, কি যেন নাম… ওহ! তাপসী রায়, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে!
‘দারুণ দেখালেন অনিকেত ভাই! খুব ভালো কাজ! ঘরে বাইরে মেয়েদের জীবনের নানারকম কাজের প্রতি এত মমতা দিয়ে আলোকপাত করেছেন, অসাধারণ! নিশ্চয়ই লম্বা সময়ের পরিশ্রমের ফসল?
‘হ্যাঁ,তাপসী, তা বলতে পারেন। নারীদের জীবন, নানা প্রতিবন্ধকতা, সবকিছু আমার ভাবনাতে ছিল। মেয়েরা ঘরে বাইরে দশ হাতে সবকিছু সামলায় অথচ কোন স্বীকৃতি নেই। বাইরের কাজের একটা অর্থকরী প্রাপ্তি আছে বটে কিন্তু ঘরের কাজতো পুরাই থ্যাংকলেস জব। তাই শুধু নিছক একটা আলোকচিত্র প্রদর্শনী আমি করতে চাইনি, ফটোগ্রাফির মধ্যে দিয়ে নারীদের জীবনের গল্প বলতে চেয়েছি।’
লম্বা ইন্টারভিউটা শেষ করে একটু হাফ ছাড়ে অনিকেত। ঘড়ি দেখে, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। সব গুছিয়ে অবশেষে তিন বন্ধু যেয়ে বসলো পরিচিত বারে, কিছুক্ষণের জন্যে না বসলে ওর হবেনা, সারা দিনের ক্লান্তিটাতো একটু দূর করা দরকার।
রেশমীকে কিছু জানানোও হয়নি। এতকিছু ঘটে গেল, কালকে হয়তো পেপারে দেখবে। ফোন করে একফাঁকে অবশ্য বলেছিলো ‘ফিরতে একটু রাত হতে পারে, অফিসের একটা অনুষ্ঠানে আছি।’ মিথ্যা বলতে বলতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে। বাসার শান্তির জন্যে একটু আধটু মিথ্যা বলায় যায়!
বাসায় ফিরতে সেই বারোটায় বাজলো, মাল খাওয়াটা একটু বেশীই হয়ে গেছে। রেশমী একবার তাকিয়েই মুখ গম্ভীর করে ফেললো, বুঝে গেছে সে মাল খেয়ে এসেছে। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো অনিকেত। রেশমীও চুপচাপ খেতে লাগলো। হঠাৎ বললো, ‘টিভিতে তোমার এক্সিবিশন দেখালো, আমাকে কিছু জানালেও না?’
অনিকেত প্রমোদ গুনলো, না, মানে তুমি এত ব্যস্ত থাকো, তোমাকে আর বলা হয়নি। আর তুমি তো জানোই যে অনেকদিন ধরে এটা নিয়ে কাজ করছি আমি। তোমার তোলা কয়েকটা ছবিও এই সাথে দিয়ে দিয়েছিতো, … ঐ যে, ঐবার রাঙামাটি যেয়ে তুমি পাহাড়ী মেয়েদের অনেকগুলো ছবি তুললে না? সবাই তো ছবিগুলোর খুব প্রশংসা করলো। কয়েকটা ছবি আমি একটা কনটেস্টেও পাঠিয়েছি, দেখি কি হয়!’
‘তুমি এমন একটা এক্সিবিশন করলে আমাকে না জানিয়ে! আবার আমার অনুমতি না নিয়ে আমার তোলা ছবি তোমার নামে চালিয়ে দিলে?’ রেশমী চাপাস্বরে চিৎকার করে উঠলো!
‘আহা! তুমি তো এখন আর সিরিয়াসলি ছবি তোলনা, ছবিগুলো তো পড়েই আছে পাঁচবছর ধরে, তুমি তো কাজে লাগাওনি… আমি কাজে লাগালাম, এরমধ্যে দোষের কি আছে?’
‘আমি কাজে লাগানোর কোন সময় পাই? সারাদিন চাকরি আর সংসার ঠেলে নিজের শখের দিকে তাকানোর কোন অবকাশ আছে? তুমি বাসার কোনকিছু দেখো? সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্যি নিজের শখ মিটিয়ে যাচ্ছো!’ রেশমীর গলা বাষ্পরুদ্ধ!
ঠিক এইসময় অনিকেতের ফোনটা বেজে উঠলো, বিদেশী নাম্বার। ফোনে কথা বলতে বলতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর মুখ। কথা শেষ করে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো অনিকেত, ‘প্রথম পুরষ্কারটা পেয়ে গেলাম রেশমী! খুব নামকরা একটা ইন্টারন্যাশনাল কনটেস্ট ছিল এটা, অর্থমূল্যও অনেক।’
অনিকেত তাকালো রেশমীর দিকে, ‘আরে বুঝলে না? রাঙামাটিতে তোলা তোমার ঐ ছবিটা, শীতের দিনে, খুব কুয়াশামাখা ভোরে কাঁধের উপরে বাচ্চা আর কাঁখে পানির পাত্র নিয়ে পাহাড়ি ঝিরিতে পানি আনতে যাচ্ছে যে পাহাড়ী মেয়েটা!’ উপচে পড়া খুশীতে রেশমীকে খবরটা জানায় অনিকেত!
রেশমী শূণ্য দৃষ্টিতে অনিকেতে’র দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন