সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
“কে ফোন করেছে?”
দীপকের বাবা নিখিলেশের ছোট্ট মোবাইলে ঝনঝনে রিংটোনটা বেজে উঠতেই দীপকের মা, সুমিতা খানিক বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে। কয়েকদিন ধরেই সবার মন-মেজাজ খারাপ।
নিখিলেশ কলটা রিসিভ করার আগে ইঞ্চিখানেক মাপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে বললেন, “রাণাঘাটের সমীর ফোন করেছে। হঠাৎ এতদিন পর?“
ফোনটা ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে সমীরের উৎসুক এবং ঈষৎ উত্তেজিত কন্ঠ, “হ্যাঁ রে নিখিলেশ, শুনলাম তোর ছেলে নাকি ডিগ্রি কলেজের পরীক্ষায় ফেল করেছে? আহা, খুব খারাপ খবর রে!”
নিখিলেশ কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, “হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিস। যদিও এই ফলাফল নিয়ে ও নিজে এবং আমরাও যথেষ্ট সন্দিহান। কিন্তু তুই এসব কোত্থেকে জানলি?”
“বাবলুদা সেদিন ফোন করেছিল, তখনই জানাল দীপুর খবরটা। খারাপ তো লাগবেই। তবে শোন, দীপুকে বলবি, এসব ফেল-টেল কোনও ব্যাপারই না। আমি তো বলব, দু’একবার ফেল করা ভালই, ওই যে কী বলে না ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস? ওকে মন-টন খারাপ করতে না করিস, বুঝলি?”
অযাচিত বাণী শুনে নিখিলেশের ভুরু কুঁচকে যায়। বাবলুদা মানে তাঁর বড়ভাই মিথিলেশ। দীপুর পড়াশোনা নিয়ে তাঁকে এর আগে তেমন ভাবতে দেখা যায়নি কখনও। নিখিলেশ গম্ভীর গলায় বলেন, “দীপু যথেষ্ট স্ট্রং ছেলে। পরিশ্রমীও। হ্যাঁ, অপ্রত্যাশিত কিছু হলে তো মন খারাপ স্বাভাবিক। তবে ও হাল ছাড়েনি। ওর আত্মবিশ্বাসই ওকে কঠিন সময় পেরিয়ে যেতে সাহায্য করবে মনে হয়। রাখি এখন তবে?“
ওপারে একটু থতমত খেয়ে যাওয়া সমীরের আপাত ম্রিয়মান স্বরে “আচ্ছা” শব্দটা ভেসে আসার আগেই হ্যাণ্ডসেটের লাল বোতামে চাপ দিয়েছিলেন নিখিলেশ। সুমিতার সঙ্গে চোখাচুখি হয় তাঁর। স্পিকার অন করা ছিল, সুমিতা শুনেছে সব। দুজনে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই টের পান, বুকের ভিতর একটা অস্বস্তি দলা পাকাচ্ছে ফের। তখনই দীপক স্নান সেরে এই ঘরে ঢুকল।
“কী হয়েছে? তোমরা এমন থম মেরে আছ কেন?”
দীপকের প্রশ্নে নিখিলেশ গলাটা স্বাভাবিক করে বলেন, “কিছু না রে। তুই বল, আজ কি ইউনিভার্সিটি যাবি? এক্সাম কন্ট্রোলার অফিস? কাল বলছিলি?”
“হ্যাঁ, যাব তো বটেই। দেখো, আমি যে সেকেন্ড পেপার পরীক্ষায় বসেছিলাম এটা তো তোমরাও জানো। আর মার্কশিটে সেটাতেই কিনা অ্যাবসেন্ট করল! আমার আগে-পরের ছেলেমেয়েরা অনেকেই ড্রপ দিয়েছিল, এটা সত্যি। তাই বলে আমাকেও? কী করে মেনে নেব আমি? কেন মানব? আমি একটু পরেই বেরচ্ছি।”
“কিছু খেয়ে যা দীপু, কখন ফিরবি সেই!” সুমিতা বলেন।
“খাওয়া হবে’খন। আগে কাজটা হোক। ভুল যাদেরই থাক, মাশুল তো আমাকেই গুনতে হচ্ছে, তাই না?”
দীপক ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়।
তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে নিখিলেশ বলেন, “কেন যে ওকে এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে, জানি না।”
সুমিতা বলেন, “আবার এই অবস্থাতেও কেউ কেউ বেজায় উৎসাহিত হচ্ছে! তোমার নিজের দাদার কাণ্ডটা দেখলে?”
“দেখলাম। তবে অবাক হইনি বিশেষ। এটাই বরং প্রত্যাশিত।”
“এ কথা কেন বলছ?”
“প্রত্যাশিত নয়? দেখো দাদার ছেলে, মিঠুনের কোনোদিনই পড়াশোনার দিকে তেমন ঝোঁক নেই। কলেজের মাঝপথে পড়া ছেড়ে এটা-সেটা ব্যবসা ধরেছে। সেখানে আমাদের দীপুর মেধা আর রেজাল্ট নিয়ে বরাবরই চারপাশের সবাই আলোচনা করে। এখন এমন একটা দুর্ঘটনা হয়েছে বলেই না সবাই কথা বলার সুযোগ পেল একটা? সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? খারাপ সময়েই বরং আসল পরিচয়গুলো পাওয়া যায়।”
“মানুষ এমন হয় কেন বলো তো? আবার সমীরদাকে ফোন করে এসব বলেছে! কই, যখন ও ফার্স্ট-সেকেন্ড হত স্কুলে, তখন তো কোনোদিন সেটা জানাতে দেখিনি?”
“সুখবরে তো সবাই আনন্দ পায় না গো। এটাই বাস্তব। আর বাস্তবকে মেনে নেওয়াই ভাল।”
“সে তো তুমি সব সময়ই বলো!”
“বলি কি আর সাধে? এই যে আমি, বাস্তবে নিজেই এক অপদার্থ বাবা! ছেলেটা যখন সবে হায়ার এডুকেশন শুরু করছে, তখনই চাকরিটা খুইয়ে বসলাম!”
“আহা, তাতে তোমার দোষটা কোথায়? তোমাদের জুটমিল বন্ধ হওয়ায় তোমার মতো কত শ্রমিকই তো বেকার হয়ে গেল।”
“চেষ্টা তো করে যাচ্ছি এখনও। কিছু একটা অন্তত… পার্টির অতনুকে বলে রেখেছি। যদি পুরসভায় কোনও…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই নিখিলেশের হাতে ধরা ফোনটা আবার বেজে ওঠে কর্কশ সুরে।
“সতীশের কল। দাদার ভায়রাভাই।”
“যে অ্যাস্ট্রলজি প্র্যাক্টিস করে?” সুমিতার প্রশ্ন।
“হুঁ” বলে নিখিলেশ ফোনটা রিসিভ করলেন – “হ্যালো?”
“নমস্কার নিখিলেশদা, ভাল আছেন তো?”
“চলছে। বলো সতীশ, কী ব্যাপার?”
“হে হে, না মানে, এমনিই আর কি…”
“এমনি যে তুমি ফোন করো না সেটা আমি ভালই জানি ভাই। কাজের কথায় এসো।”
“এ বাবা! কী যে বলেন দাদা। ইয়ে, মানে বলছিলাম ওই আমাদের দীপুর ব্যাপারে…”
“বলো।” নিখিলেশের ভাবলেশহীন গলা।
“দেখুন দাদা, দীপু তো এমনিতে খুব ভাল ছাত্র। ওর সঙ্গে এরকম একটা খারাপ ঘটনা খুব দুর্ভাগ্যের… মানে, আপনারা তো আবার এসব মানেন না, কিন্তু আমার যা মনে হচ্ছে ওর বিদ্যাস্থানে রাহুর মহাদশা চলছে। তবে এটার কিন্তু রিমেডি আছে। আপনারা বললে আমি কিছু সাহায্যও করতে পারি…”
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে নিখিলেশের –“শোনো সতীশ, একটা এডভাইস দিই। আমাকে বলেছ ঠিক আছে, কিন্তু ভুলেও যেন দীপুর কাছে এসব কোনোভাবে বলতে যেও না। ও ভাগ্য নয়, কর্মে বিশ্বাসী। আর ওর মনটাও খুব একটা দুর্বল নয়। যেটা তোমাদের প্রধান অস্ত্র। তুমি ওর বয়োজ্যেষ্ঠ। এমন পরিস্থিতিতে ওকে এসব নিয়ে বলতে গেলে যদি ভাল-মন্দ দু’চার কথা শুনিয়ে দেয়, খামোখা নিজের সম্মানটা হারাবে, তাই না? ভাল থেকো, রাখছি এখন।”
ফোনটা নিজেই কেটে দেন বিরক্ত নিখিলেশ। তবু সুমিতা আর তিনি উৎকণ্ঠা আর প্রত্যাশা নিয়ে সেই ফোনের দিকেই চেয়ে থাকেন, যদি দীপু কোনও আশার খবর দেয়, যদি এই অন্ধকার সময় কেটে যায়, কে জানে!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন