পার্থ দে
“তোমার আগে আমি চলে যেতে চাই।”
“কেন বলছ এ কথা?”
“আমি না থাকলে তোমার যা দশা হবে, নিজের হাতে তো কুটোটিও নাড়তে পারো না। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়েও রাখতে পারো না। তখন হাতের সামনে সবকিছু কে এগিয়ে দেবে, শুনি?”
“আর যদি, ধরো, আমি আগে চলে যাই? তুমি পারবে সবকিছু সামলাতে? বউমার সঙ্গে তো একদম পটে না তোমার…”
“চুপ করো তো! ওইটুকুন একটা দুধের শিশু, তার পিছনে সারাদিন লেগে আছে। বই, টিউশন, সাঁতার শেখা, কারাটে শেখা, তারপর এখন কিসব হয়েছে… ডান্স বাংলা ডান্স না কি যেন… আচ্ছা, ওইটুকুন বাচ্চা এত কিছু পারে বলো তো?”
“তাতে তোমার কী? যাদের ছেলে তারা বুঝবে, তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”
“আমার নাতি আর আমি মাথা ঘামাব না! এ কথা তুমি বলতে পারলে!”
“শোনো, এই অধিকারবোধটা এবার ছাড়ো তো। তুমি সব কিছুতে এত অধিকারবোধ ফলাতে যাও বলেই এত গন্ডগোল…”
“অ্যাই শোনো, তুমি আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবে নাতো… অধিকারবোধ ফলাবো না মানেটা কী, অ্যাঁ? আমার বাড়ি, আমার আলমারি, আমার হেঁশেল, আমার বাগান, আমার ছেলে, আমার নাতি… “
“এবার একটু ত্যাগ করতেও শেখো। অনেক তো হল, জানো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ত্যাগ করতে শিখতে হয়।”
“শোনো, ওসব ত্যাগট্যাগের কথা আমাকে একদম বলবে না। অধিকারবোধ ছাড়তে আমি পারব না। এ বাড়িতে আমার হুকুম ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না। তুমিও যে ওসব চলে যাওয়ার কথাটথা বলছিলে, তা বলছি, আমার হুকুম ছাড়া এখান থেকে এক পা-ও নড়ে দেখাও দেখি তোমার কত ক্ষমতা!”
“আহা, রাগ করছ কেন, আমি কি ও কথা বলেছি নাকি? আমি বলতে চেয়েছি, অনেক তো হল, এবার ওদের ছেড়ে দাও না, ওরা ওদের মতো থাকুক আর আমরা আমাদের মতো থাকি।”
“অ্যাই বুড়ো, তুমি সবসময় বউমার পক্ষ নিয়ে কথা বলো কেন বলো তো? আমার ছেলেটার কথা না হয় বাদ দিলাম, আমার নাতিটার কষ্টটা কি তোমার কখনও চোখে পড়ে না?”
“আমি কারও হয়ে কথা বলছি না। তুমি একটু শান্ত হও, তোমার শরীরটা তো খারাপ, তাই না? চলো তোমাকে রাতের ইনস্যুলিন ইঞ্জেকশনটা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”
“অ্যাই বুড়ো, খুব যে বড় বড় কথা বলছ, বলি, তোমার নিজের শরীরটা ঠিক আছে তো…”
বৃদ্ধ একপ্রকার জোর করেই বৃদ্ধাকে দোতলার ব্যালকনি থেকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। আকাশী নীল দোতলা বাড়িটার বারান্দাজোড়া জ্যোৎস্নায় দুটো বেতের চেয়ার সারারাত মুখোমুখি পড়ে রইল।
পরদিন সূর্য উঠল, কাজের পরিচারিকাটি এল না। বারান্দায় পড়ে রইল দৈনিক সংবাদপত্র, দুধের প্যাকেট। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। দুপুর গড়িয়ে রাত নামল। পরদিন ফের সূর্য উঠল। কাজের মেয়েটি এদিন এল। একতলার চাবি খুলে ভিতরে ঢুকতেই পচা গন্ধে তার শ্বাসরোধ হয়ে এল, একছুটে সে বেরিয়ে এল।
একঘন্টা পর লোকাল থানার দারোগা এলেন। দোতলা বাড়িটার শোওয়ার ঘরের ভিতর থেকে দুটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার হল। অস্বাভাবিক মৃত্যু, সরেজমিনে তদন্ত করতেই হয়। দারোগাবাবু পাশেরবাড়ির বউটিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।
“মেসোমশাই তো স্টেজ ফোর প্রস্টেট ক্যান্সারের রোগী ছিলেনই, মাসীমাও হাই ব্লাড শুগারে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন,” পাশেরবাড়ির বউটি বিষণ্ণ মুখে বলল, “তবে, স্যার, উনি আমার ছেলেটিকে বড় ভালবাসতেন।”
দারোগাবাবু : “ওঁদের ছেলেমেয়েদের তো একটা খবর দিতে হয়। তাদের কি এখনও খবর দেওয়া হয়নি?”
বউটি হতাশ গলায় বলে, “কিন্তু স্যার, ওঁরা তো নিঃসন্তান ছিলেন।”
“কেন বলছ এ কথা?”
“আমি না থাকলে তোমার যা দশা হবে, নিজের হাতে তো কুটোটিও নাড়তে পারো না। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়েও রাখতে পারো না। তখন হাতের সামনে সবকিছু কে এগিয়ে দেবে, শুনি?”
“আর যদি, ধরো, আমি আগে চলে যাই? তুমি পারবে সবকিছু সামলাতে? বউমার সঙ্গে তো একদম পটে না তোমার…”
“চুপ করো তো! ওইটুকুন একটা দুধের শিশু, তার পিছনে সারাদিন লেগে আছে। বই, টিউশন, সাঁতার শেখা, কারাটে শেখা, তারপর এখন কিসব হয়েছে… ডান্স বাংলা ডান্স না কি যেন… আচ্ছা, ওইটুকুন বাচ্চা এত কিছু পারে বলো তো?”
“তাতে তোমার কী? যাদের ছেলে তারা বুঝবে, তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”
“আমার নাতি আর আমি মাথা ঘামাব না! এ কথা তুমি বলতে পারলে!”
“শোনো, এই অধিকারবোধটা এবার ছাড়ো তো। তুমি সব কিছুতে এত অধিকারবোধ ফলাতে যাও বলেই এত গন্ডগোল…”
“অ্যাই শোনো, তুমি আমাকে একদম জ্ঞান দিতে আসবে নাতো… অধিকারবোধ ফলাবো না মানেটা কী, অ্যাঁ? আমার বাড়ি, আমার আলমারি, আমার হেঁশেল, আমার বাগান, আমার ছেলে, আমার নাতি… “
“এবার একটু ত্যাগ করতেও শেখো। অনেক তো হল, জানো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ত্যাগ করতে শিখতে হয়।”
“শোনো, ওসব ত্যাগট্যাগের কথা আমাকে একদম বলবে না। অধিকারবোধ ছাড়তে আমি পারব না। এ বাড়িতে আমার হুকুম ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না। তুমিও যে ওসব চলে যাওয়ার কথাটথা বলছিলে, তা বলছি, আমার হুকুম ছাড়া এখান থেকে এক পা-ও নড়ে দেখাও দেখি তোমার কত ক্ষমতা!”
“আহা, রাগ করছ কেন, আমি কি ও কথা বলেছি নাকি? আমি বলতে চেয়েছি, অনেক তো হল, এবার ওদের ছেড়ে দাও না, ওরা ওদের মতো থাকুক আর আমরা আমাদের মতো থাকি।”
“অ্যাই বুড়ো, তুমি সবসময় বউমার পক্ষ নিয়ে কথা বলো কেন বলো তো? আমার ছেলেটার কথা না হয় বাদ দিলাম, আমার নাতিটার কষ্টটা কি তোমার কখনও চোখে পড়ে না?”
“আমি কারও হয়ে কথা বলছি না। তুমি একটু শান্ত হও, তোমার শরীরটা তো খারাপ, তাই না? চলো তোমাকে রাতের ইনস্যুলিন ইঞ্জেকশনটা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”
“অ্যাই বুড়ো, খুব যে বড় বড় কথা বলছ, বলি, তোমার নিজের শরীরটা ঠিক আছে তো…”
বৃদ্ধ একপ্রকার জোর করেই বৃদ্ধাকে দোতলার ব্যালকনি থেকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। আকাশী নীল দোতলা বাড়িটার বারান্দাজোড়া জ্যোৎস্নায় দুটো বেতের চেয়ার সারারাত মুখোমুখি পড়ে রইল।
পরদিন সূর্য উঠল, কাজের পরিচারিকাটি এল না। বারান্দায় পড়ে রইল দৈনিক সংবাদপত্র, দুধের প্যাকেট। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। দুপুর গড়িয়ে রাত নামল। পরদিন ফের সূর্য উঠল। কাজের মেয়েটি এদিন এল। একতলার চাবি খুলে ভিতরে ঢুকতেই পচা গন্ধে তার শ্বাসরোধ হয়ে এল, একছুটে সে বেরিয়ে এল।
একঘন্টা পর লোকাল থানার দারোগা এলেন। দোতলা বাড়িটার শোওয়ার ঘরের ভিতর থেকে দুটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার হল। অস্বাভাবিক মৃত্যু, সরেজমিনে তদন্ত করতেই হয়। দারোগাবাবু পাশেরবাড়ির বউটিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।
“মেসোমশাই তো স্টেজ ফোর প্রস্টেট ক্যান্সারের রোগী ছিলেনই, মাসীমাও হাই ব্লাড শুগারে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন,” পাশেরবাড়ির বউটি বিষণ্ণ মুখে বলল, “তবে, স্যার, উনি আমার ছেলেটিকে বড় ভালবাসতেন।”
দারোগাবাবু : “ওঁদের ছেলেমেয়েদের তো একটা খবর দিতে হয়। তাদের কি এখনও খবর দেওয়া হয়নি?”
বউটি হতাশ গলায় বলে, “কিন্তু স্যার, ওঁরা তো নিঃসন্তান ছিলেন।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ওঃ পার্থ বাবু! অনবদ্য! অনুগল্পের যে ট্যুইস্ট যেন অমর্ত্য স্বাদে ভরিয়ে দিল। “আকাশী নীল দোতলা বাড়িটার বারান্দাজোড়া জ্যোৎস্নায় দুটো বেতের চেয়ার সারারাত মুখোমুখি পড়ে রইল।”…এমন একটি আশ্চর্য লাইন কখন যেন পংক্তি হয়ে উঠল! অপূর্ব! সার্থকনামা অণুগল্পটি আমেজের রেশ রেখে গেল।