মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
এ বছর গরম মারাত্মক। খগেনবাবু বাজার থেকে ফিরে রান্নাঘরে ব্যাগ নামিয়ে ঘরে গিয়ে পাখার সুইচ দিলেন। পাখা ঘুরছে না। কারেন্ট তো আছে। তাহলে পাখা বিগড়েছে। মাথা চড়াং করে গরম হয়ে গেল। পাখা বিগড়নোর সময় পেল না? এই ভয়ঙ্কর গরমেই বেটা বিট্রে করল। ঝরনার মতো কুলকুল করে ঘামতে লাগলেন খগেনবাবু। মাথার গরমে আর বাইরের গরমে আগুন হয়ে খগেনবাবু এবার স্বয়ং গরমের দেবতাকে গাল দিতে শুরু করলেন। এই মুহূর্তে দেবতাটি ঠিক কে জানা না থাকলেও গাল বাড়তে লাগল। ‘উচ্চিংড়ে’, উৎপটাঙে’, ‘খটখটে’, ‘কান্ডজ্ঞানহীন’। যত গাল চলল তত ওঁর মাথা গরম বাড়তে লাগল।
ঠিক সেই সময় স্বর্গালোকে গরমের দেবতা হালকা ফুরফুরে মেঘের কোলে গায়ে আয়েশ করে বসে কানখুশকি দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন খগেনবাবু তাঁকে বাপ-বাপান্ত করছেন। কানখুশকি সরিয়ে কান ঝুঁকিয়ে খানিকটা সময় সেই গাল শুনলেন। তারপর মুচকি হেসে দেবতা বলে উঠলেন, “নে ব্যাটা, তোর একটা গরম তুলে নিলুম। এখন থেকে তোর নো ‘মাথাগরম’।”
খগেনবাবুর হঠাৎ মনে হল শরীর গরম থাকলেও মাথার ভিতর কেমন শান্ত-শীতল হয়ে গেল! হালকা, যাকে বলে নো-রাগ!
প্রতিদিনের মতো আজও খগেনবাবু স্নান করতে যাবেন বলে খাবলাখানেক নারকোল তেল মাথায় দিতেই গিন্নি বলে উঠলেন, “আজ সকালে কর্পোরেশনের জল আসেনি। বাথরুমে আধ বালতি জল আছে। চেঁচামেচি না করে ওই জল দিয়ে স্নান সেরে নাও।”
কয়েক বালতি জল মাথায় না ঢাললে খগেনবাবুর শরীর ঠান্ডা হয় না। অন্যদিন হলে বেজায় হট্টগোল শুরু করতেন। আজ কেমন উদাস ভাব জাগল। আহা! এই দুনিয়ায় কত মানুষেরই তো ঠিকমতো খাওয়ার জলই জোটে না।
স্নান সেরে খেতে বসতে মুখে কাঁকর পড়ল। এরকম সময় চিৎকার করে ওঠা স্বাভাবিক।
“তুমি কি দেখে শুনে ভাত বসাতে পার না?”
খগেনবাবুর কথা নস্যাৎ করে গিন্নি বলেন, “পিটপিটে লোকেদের এমনই হয়। কই, আর কারও পাতে তো কাঁকর পড়ে না? তোমার মনটাই কাঁকর।”
ঝগড়ার টেম্পারেচার বাড়তেই থাকে। শেষে খগেনবাবু দেখেন অফিস লেট হতে বসেছে তখন অর্ধেক খেয়ে দৌড় লাগান বাস স্টপের দিকে।
আজ ব্যতিক্রম হল। দাঁতে পড়া কাঁকর তাঁর মাথা গরম করতে পারল না। বরং স্ত্রী লজ্জা পেলেন।
“ইশ্, দাঁতে লাগল?”
“তুমি কী করবে? কাঁকর তো আর তুমি মেশাওনি।”
বাড়ি থেকে গলি পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড হেঁটে দশমিনিট। বাসে ওঠার পর মাথা গরমের আরেক ঘটনা। ভিড় ঠেলে কোনওরকমে দাঁড়াতেই দিল একজন পা মাড়িয়ে। ইচ্ছাকৃত ফাউল। খগেনবাবু ‘আঃ’ করে উঠলেন। যিনি পা মাড়িয়ে দিলেন তিনি খগেনবাবুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাসের ভিতর দিকে এগোতে লাগলেন। অন্যদিন হলে খগেনবাবু একটা কেলেঙ্কারি বাঁধাতেন। হয়তো জামার কলার ধরে টেনে এনে দাঁত কিড়মিড় করতেন। নাহলে… আজ রইলেন নির্বিকার।
অফিসে ঢুকতেই পাশের টেবিলের বিপিনবাবু বললেন, “যান, বড়সাহেব দুবার এসে ঘুরে গেছেন। জরুরি তলব।”
খগেনবাবু পরিষ্কার দেখলেন কথাগুলো বলার সময় বিপিনবাবুর গোঁফের ফাঁকে চাপা হাসি। মানে তিনি জব্দ হলে বিপিনবাবু খুশি হন। অন্যদিন হলে দুশো কথা শুনিয়ে দিতেন। আজ কিছুই বললেন না।
খগেনবাবু যেতেই বড়সাহেব ধমকে ওঠেন, “কাজগুলো মন দিয়ে করুন। নাহলে চাকরি ছেড়ে দিন।”
দোষটা অন্যের। তবু তিনি প্রতিবাদ করলেন না।
এবার অসহায় লাগছে খগেনবাবুর। কী হয়েছে তাঁর! এত কান্ড তাঁর সঙ্গে হয়ে যাচ্ছে, অথচ রাগছেন না! বরং মনে হচ্ছে এমন তো হতেই পারে। এই গরমে মাথাটা কি পুরো গেল?
আজ অফিস বেরোতে দেরি হয়েছে। বাস থেকে নেমে দেখলেন যথারীতি কারেন্ট নেই। সন্ধের পর গলিতে লোক চলাচলও কম। কিছুটা যাওয়ার পর খগেনবাবু দেখলেন উল্টোদিক থেকে সাইকেল চালিয়ে একটি ছোকরা ধরনের ছেলে আসছে। সামনে এসে কিছু বোঝার আগেই তাঁর হাতেব্যাগ ধরে দিয়েছে হেঁচকা টান। কোনওরকমে ব্যাগ চেপে ধরলেন। ছেলেটি বাধা পেয়ে সাইকেল নিয়ে দে ছুট।
অন্য সময় হলে খগেনবাবু চিৎকার করে ধাওয়া করতেন, থানায় যেতেন। আজ কোনওটাই করলেন না। মনে হল কী হবে রাগারাগি করে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে খগেন পালের এবার ভয় করতে শুরু করে। তাঁর কি অসুখ করেছে! কঠিন অসুখ? মাথা কেন গরম হচ্ছে না?
রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে অন্ধকার বারান্দায় বসে বিপর্যস্ত, ক্লান্ত, অসহায় খগেন পাল বিড়বিড় করে বলেন, “হে ভগবান, আমার মাথা গরম ফিরিয়ে দাও। দোহাই তোমার…।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন