সঞ্জয় কর্মকার
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে নিভু আলোর স্তম্ভ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে নরম মাটি। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে ঝুপ্ করে। জ্যোর্তিময়বাবু হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালেন সদানন্দ বয়েজ হাইস্কুলের ঠিক সামনে। হ্যাঁ, ঐ তো স্কুলের তেরো নম্বর রুমটা এখান থেকে স্পষ্ট দ্যাখা যাচ্ছে। নাইন বি। গলার স্বর চড়িয়ে প্রশ্ন করছেন জীবন বিজ্ঞানের সুভাষ স্যার, ‘এই রনিত, বেঞ্চের নিচে মাথা ডুবিয়ে কী করছিস রে? বল তো, ইমিউনোলজি কাকে বলে?’ প্রশ্নটা শুনেও রনিত মাথা নিচু করে আছে দেখে সুভাষ স্যার হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘জানতাম পারবি না। শিগগির উঠে আয় এখানে। আজ তোর পা থেকে মাথা অবধি ঝাড়ব।’
সুভাষ স্যারের হাতে লিকলিকে সরু বেতটা দেখে কাতর স্বরে রনিত বলছে, ‘জীবন বিজ্ঞান বইটা আমার কাছে নেই স্যার। সত্যি বলছি। বাবাকে অনেকবার বলেছি বইটা কিনে দিতে। কিন্তু বাবা এখনও কিনে দিতে পারেনি। তাই…’
নাঃ, সুভাষ স্যারের হাত থেকে সেদিন ছাড় পায়নি রনিত। বড় নিষ্ঠুরভাবে আস্ত একটা কঞ্চি ভেঙেছিলেন রনিতের পিঠে।
হাঁটতে হাঁটতে জ্যোতির্ময়বাবু এবার এসে দাঁড়ালেন মাহান্ত পাড়ার ক্রিকেট খেলার মাঠে। মাঠটা আগের থেকে অনেকটা ছোট হয়ে গ্যাছে। চারদিক থেকে একটা একটা করে বাড়ি মাথা তুলে খেলার মাঠটাকে গিলে খেয়েছে প্রায়। এই মাঠেই খেলতে এসে সদ্য কিনে আনা ক্রিকেট ব্যাটটা ভেঙে গেছিল সন্দীপের। কিন্তু ভাঙল কী করে সেই ব্যাট! বুঝতে পারেনি ও। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল সন্দীপ। সব্বাই সন্দেহ করেছিল, ব্যাটটা অম্লানই ভেঙেছে। খেলার মাঠে সন্দীপের সঙ্গে অম্লানের ঝগড়ার কথাটা তরুণ-বিমলরা জানত।
পালিতদের খেজুর বাগানটার সামনে এসে আকস্মিক থমকে দাঁড়ান জ্যোতির্ময়বাবু। একবার এই খেজুর বাগানেই জয়ন্ত, মাধব, পলাশরা পিকনিক করছিল পাঁচ টাকা করে চাঁদা তুলে। সবার থেকে বেশি উৎসাহ ছিল বিধানের অথচ পিকনিকের দিন হঠাৎই গায়েব হয়ে গেছিল ও। শেষমেশ পলাশ খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিল, বিধান একা একা বসে আছে কলিপুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে। পলাশ ডাকতে গেলে চোখ দুটো ছলছল করে বিধান বলেছিল, ‘পিকনিকের টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি রে। গেল সপ্তায় ঘোষবাবুদের বাড়িতে মাটি কোপানোর কাজ করেছিলাম। ঘোষবাবু বলেছিল এই সপ্তাহেই জন-লেবারের টাকাটা দিয়ে দেবে। কিন্তু… ‘
সন্ধ্যার ঘোর লেগেছে চারদিকে। তবু দূর থেকে একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন জ্যোতির্ময়বাবু। বড় বড় আগাছার জঙ্গলে ঢেকে আছে বাড়িটা। জ্যোতির্ময়বাবু শুনতে পাচ্ছেন একটা মায়াবী কন্ঠস্বর, ‘বেশি দূরে যাস না-আ-আ খোকা। হারিয়ে যাবি। আর বাড়ি ফিরতে পারবি না। তোকে ছাড়া আমি যে…’
‘ছুটতে ছুটতে আমি যে অনেক দূরে চলে গেছি মা। অনেক দূরে। এই গ্রামের মাটি ছেড়ে বিদেশে। বড় কোম্পানিতে চাকরি করে পেনসিলভেনিয়ার মত শহরে আমি আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটে থাকি।
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, খুব মারার পরেও রনিতের বইটা কিনে দিয়েছিলেন সুভাষ স্যারই। নিজে থেকেই সন্দীপকে নতুন একটা ব্যাট কিনে দিয়েছিল অম্লান। অথচ অম্লান ব্যাটটা মোটেও ভাঙেনি। পিকনিকের টাকাটা জোগাড় করতে না পারলেও বিধানকে ডেকে এনে পেট ভরে খাইয়েছিল পলাশরা। কিন্তু মা, এই বাড়িটা, এই উঠোন, তোমার গায়ের গন্ধ কেউ কি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? অথচ ফিরে পাওয়ার জন্য আমি যে কত কাঁদি এখন রোজ!’
কথাগুলো মনে মনে উচ্চারণ করতে করতে অন্ধকার গলিটা ধরে আবারও হাঁটতে শুরু করলেন জ্যোতির্ময়বাবু। ফেলে আসা আলোর পথটা কিছুতেই যে খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
দারুণ লিখলে সঞ্জয়। সমাপ্তি অসাধারণ। মন ছুঁয়ে গেল।
মন ভ’রে গেল লেখাটা পড়ে।