“মণিদীপা….”? সামনের সারিতে বসা সবুজ পাড়ের, অফ হোয়াইট হ্যান্ডলুম শাড়ির বয়স্ক মহিলাকে লক্ষ্য করে কাঁপাকাপা গলায় কথাটা ছুঁড়ে দিলেন সুবিনয়বাবু। যার উদ্দেশ্যে কথাটা বলা তিনি শুনতে পেলেন কিনা বোঝা গেলো না। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আবার বললেন সুবিনয় “মণিদীপা, কেমন আছো ?” “কে?” “মণি,আমি…।“ কথাটা শেষ করতে পারেন না সুবিনয়বাবু। বয়স্ক মহিলাটি এবার একটু চমকেছেন মণি ডাক শুনে, অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে মোটা কাঁচের আড়ালে লুকোনো ফ্যাকাসে দুটি চোখ তুলে তাকিয়েছেন। অপার বিস্ময় জড়ানো দৃষ্টি মেলে ধরেছেন সুবিনয়বাবুর মুখের ওপর। চোখ এবং স্মৃতি দুয়েরই সামনে ঝোলানো ঝাপসা পর্দা সরিয়ে চেনার চেষ্টা করছেন প্রশ্নকর্তাকে।
শহরের সবচাইতে নামী আই স্পেশালিষ্ট ডঃ ভার্গবের চেম্বারে এসেছেন মণিদীপা। কিছুদিন আাগে দুই চোখে অপারেশন হয়েছে তাঁর। প্রায় নিভে যাওয়া চোখে কিছুটা আালো ফিরেছে ডাক্তারের দক্ষতা আর যত্নে। আজ শনিবার। ছেলের অফিস ছুটি। সেই নিয়ে এসেছে মণিদীপাকে, ডাক্তারের কাছে।
সুবিনয় রায় পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কেরিয়ার যখন মধ্যগগনে, সেসময় চোখের কঠিন অসুখে দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য হন। বেতের লাঠি হাতে বহু কষ্টে একাই এসেছেন ডাক্তারের কাছে।
ডক্টর ওয়েটিং হল ভিড়ে ভিড়াক্কার। অনন্ত অপেক্ষা। মণিদীপার ছেলে মৃন্ময় এই ভিড় পছন্দ করে না একেবারেই। মাকে বসিয়ে রেখে বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করে। চা-সিগারেট খায়। ঠিকঠাক সময়ে চলে আসে।
সুবিনয়বাবুও অপেক্ষায়। তাঁর নাম একেবারে শেষের দিকে। এই অপেক্ষা বড় বিরক্তিকর। চুপচাপ বসে থাকা, ঘড়ির আবছা সময়টুকু ছুঁয়ে দেখা, আর মাঝেমধ্যে রিসেপশনিস্টকে “কত নম্বর গেলো একটু বলবেন?“ বলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এ যেন নিজের কাছেই নিজের ধৈর্য্যের পরীক্ষা। ফাইলটা কোলে নিয়ে চেয়ারে গুছিয়ে বসলেন সুবিনয়বাবু। ধৈর্য পরীক্ষার খাতা খুললেন।
হঠাৎ কানে এলো, “হ্যাঁ বাবা, কোনো অসুবিধে নেই…আমি অপেক্ষা করবো…তুমি ঠিক সময়ে চলে এসো…।“
যেন বহু যুগের ওপার থেকে খুব চেনা এক স্বর সুবিনয়বাবুর কানে এসে ধাক্কা মারলো। শুধু চেনা নয়। ঠিক এই কথাগুলোই তাঁকে একদিন বলেছিল কেউ। হুবহু একই কথা। সুবিনয়বাবু কথাও দিয়েছিলেন তাকে, ফিরে আসবেন ঠিক সময়ে।
সুবিনয় মণিদীপার সম্পর্কের কথা ওদের দুবাড়িতেই জানত। মণিদীপা যেবার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করলেন। সুবিনয় ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢুকলেন। বিয়ের কথা উঠলো। মণিদীপা সুন্দরী, লেখাপড়ায় ভালো, মিশুকে ব্যবহার। ওদিকে ঝকঝকে তরুণ সুবিনয়ের সামনে তখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। দু’পক্ষই খুশি এ বিয়েতে। বিয়ের প্রস্তুতি, কেনাকাটা, সব যখন প্রায় শেষ…দমকা হাওয়ার মতো এলো খারাপ খবর। এলোমেলো হয়ে গেলো সবকিছু। সুবিনয়ের কোম্পানি দেড়বছরের জন্য একটি প্রজেক্টের কাজে তাকে বিদেশে পাঠাতে চায়। নতুন চাকরী। না বলার উপায় নেই। বিদেশ যাওয়ায় সুযোগ পেলে বলা হয় সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে হলো উল্টো। সুবিনয়ের সুবর্ণ সুযোগের ঝাপটায় মণিদীপার জীবন একেবারে বিবর্ণ হয়ে উঠলো।
খবরটা ফোনে প্রথম জানিয়েছিলেন সুবিনয়। সত্যি বলতে কি, হঠাৎ করে তার এই বিদেশযাত্রার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি মণিদীপার বাড়ির কারোরই। বিয়ের সব আয়োজন শেষ। শুধু নেমন্তন্নটাই যা বাকি।
“মাত্র দেড় বছর মণি। অপেক্ষা করতে পারবে আমার জন্য”? ফোনের ওপ্রান্তে সুবিনয়। “হ্যাঁ পারব। কোনও অসুবিধে নেই। আমি অপেক্ষা করবো। তুমি ঠিক সময়ে ফিরে এসো”। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মন নিয়ে দৃঢ় উত্তর ছিলো মণিদীপার।
অপেক্ষা করেছিলেন মণিদীপা। ফেরেননি সুবিনয়। কোনও যোগাযোগও করেননি আর। পাগলের মতো খুঁজেছে মণিদীপা। ছুটে গিয়েছে সুবিনয়ের মায়ের কাছে। ছেলের এই নীরব প্রত্যাখানের কোনও সদুত্তর পায়নি তাঁর কাছেও। কষ্টে বুক ভেঙে গিয়েছে মণিদীপার। তারপর অভিমান…তারপর…..
“একটা কথা তোমাকে বলতে চাই মণি। বড্ড ভার বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এ বুকে এতকাল ধরে”। ভার কি মণিদীপার বুকেই কম নাকি? এতগুলো বছরে শতসহস্র বার তাঁর মনে ঘুরেফিরে এসেছে প্রশ্ন, কেন এই প্রত্যাখান? কেন এমনভাবে পালিয়ে যাওয়া? কি দোষ সে করেছিল?
“সেদিন রাতে চোখে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা। চোখের শিরা ফুলে, ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। পরদিন শুরু হয় ব্লিডিং। ডক্টরের কাছে গিয়ে জানতে পারি, বিরল রোগ বাসা বেঁধেছে চোখে, যার কোনো প্রতিকার নেই। ধীরেধীরে কমে আসবে দৃষ্টিশক্তি। অন্ধত্ব অনিবার্য। একজন অন্ধ মানুষের সঙ্গে তোমার জীবন জড়াতে চাই নি। নিজেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ছাড়া সেদিন আর কোনও পথ খুঁজে পাইনি”।
কথাগুলো বলে থামলেন সুবিনয়বাবু। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ানো কষ্ট নিমেষে উপশম হয় যেন! পালকের মতো হালকা হালকা লাগে শরীর, মন। মুখ তুলে তাকান মণিদীপার মুখের দিকে। একটুও ঝাপসা লাগে না। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর চোখের সামনে।
বাহ
বাহ