ইলিশ
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

নাও, পাক্কা এক কেজি সাড়ে আটশো। তোমার পছন্দমত চাকা চাকা কাটিয়েছি। গাদা পেটি আলাদা করিনি। তেল, ডিম আলাদা প্যাকেটে দিয়েছে। গোবিন্দ আমার বাঁধা মাছওয়ালা। গিয়ে দাঁড়ালে ঠিক বেস্ট মাছখানা বার করে সামনে রাখে… দামও পড়ল বেশি কিন্তু বউয়ের আবদারের সামনে কবে আর আমার বাজেট টিকতে পেরেছে… বলতে বলতে চওড়া করে হাসতে গিয়ে থমকাল সাম্য।
মহুয়া কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একটু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল – চাকা চাকা কাটিয়েছ?
হ্যাঁ। তুমি তো তাইই বল, রাউন্ড পিস। গাদা পেটি তো পছন্দ কর না, সেসব জানি না নাকি আমি?
“আজ বলেছিলাম?” মহুয়ার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
“না… মানে… বললে তো বড় একটা ইলিশ এনো। অন্তত এক কেজি আটশো মাপের। তাইই তো আনলাম। এই ওয়েদারে, খিচুড়ি তো আজ? বড় বেগুন এনেছি। খিচুড়ি বেগুনি ইলিশ মাছ ভাজা…”
বাবা! পিছন থেকে তোতার গলা পেয়ে ঘুরে তাকাল সাম্য। তোমাকে ইলিশ কাটিয়ে আনতে বলেছিল মা?
ব্যাপার কী! অভিজ্ঞ কানে মা মেয়ে দুজনের গলাই যেন বেসুরে বাজে।
“মাছ তো কাটিয়েই আনি চিরকাল। এ আবার বলার কি আছে?”
সর্বাণী আন্টিকে ফোন করে দিচ্ছি আমি মা… বাবাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তোতা মায়ের দিকে এগিয়ে যায়। বলে ঘাবড়িয়ো না। আজ প্রোগ্রাম ক্যানসেল বলে দিচ্ছি।
না না… তাই আবার হয় নাকি! কমিটমেন্টের দাম নেই? টিম থেকে বার করে দেবে ওরা… মহুয়া ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে।
“কী হয়েছে আমাকে কেউ বলবে? কিসের টিম? কোন কমিটমেন্ট?” সাম্য সাহস সঞ্চয় করে কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করে আবার।
হবে আবার কী? মা, সর্বাণী আন্টি আর বুলাপিসির টিম। একই সঙ্গে একটাই জিনিস ভাগ করে তিনজন রিল বানায়। তাতে খরচটা ভাগ হয়ে যায়। আজ ইলিশ থিম ছিল। সেভাবেই স্ক্রিপ্ট রেডি করা আছে। মায়ের হাতে থাকবে ব্যাগে ভরা গোটা ইলিশ। মা ওটা বার করে বঁটিতে কাটবে ভিউয়ারদের সঙ্গে গল্প করতে করতে। তারপর ইলিশটা সর্বাণী আন্টি নিয়ে গিয়ে কিছুটা ভাপা আর কিছুটা ইলিশের পোলাও বানিয়ে দেখাবে ভিউয়ারদের। সেই ভিডিও তোলা হয়ে গেলে সব নিয়ে যাওয়া হবে বুলাপিসির বাড়ি। সেখানে বুলা পিসি চুড়ো করে এক থালা ইলিশের পোলাও আর ভাপা ইলিশ খাবে। সব ভিডিওই আমি তুলে সবার নিজের একাউন্ট থেকে পোষ্ট করব। এখন তুমি মাছটা কাটিয়ে এনে সব প্ল্যান গুবলেট করে দিলে। মায়ের ভিডিও তো আর করাই যাবে না।
মানে? তিন হাজার টাকা খরচ করে মাছ কিনে আনব আমি আর তা গিলবে বুলি পিসি? সে আবার ভিডিও তুলে লোককে দেখাতে হবে? সাম্যর মাথাটা গরম হয়ে যায়।
মা মেয়ে মিলে এরা সকালের বিছানা ঝাড়া থেকে রাতে গুডনাইট জ্বালানো অবধি ভিডিও করে রিল না কিসব বানায়। দুটো ঘরের একটায় তো ঢোকাই বন্ধ হয়ে গেছে সারাক্ষণ রিং লাইট আর ফোন ক্যামেরার অত্যাচারে। মহুয়া বলে ওটাই স্টুডিও আমার। ওখানে নিজের জিনিসপত্র রেখো না। তাতেও সাম্য আপত্তি করেনি। কিন্তু আজ একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
রাগে বিরক্তিতে মাছের ব্যাগটা বারান্দার কোনো ছুঁড়ে ফেলে দেয় সাম্য আর অমনি পাঁচিল থেকে লাফিয়ে নেমে পাড়াবেড়ানি হোঁতকা বেড়ালটা প্যাকেটটা মুখে তুলে হেলেদুলে উঠোনের কোণে গিয়ে বসে।
চোখের সামনে তিন হাজারের মাছের এই গতি দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ভাবতে ভাবতে সাম্য ঘরে ঢুকে ভেজা পাঞ্জাবিটা ছেড়ে সিগারেটটা সবে ধরাতে যাবে, ওদিকে বাইরে থেকে মহুয়ার গলা ভেসে আসে
– “হ্যালো গাইস, আসুন, আজ আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই আমার ছোট মেয়ে শশীমুখির সঙ্গে।
না না, প্লিজ কমেন্টে কোনো খারাপ কথা লিখবেন না। আপনারা যাকে বেড়াল বলেন সে আমার সন্তানের বাড়া। ছোট থেকে ওকে বড় আদরে মানুষ করেছি আমি। এই বর্ষায় আমরা খাই না খাই, ছুটির দিনে ওর জন্য দু কেজি মাপের ইলিশ ওর বাবা নিজে কিনে কাটিয়ে নিয়ে আসে। আর মেয়ে আমাদের অধীর আগ্রহে চার পা পেতে দরজায় বসে থাকে বাবার ফেরার অপেক্ষায়। আজ ফ্রেন্ডস এই মাত্রই ওর বাবা ব্যাগ নিয়ে ঢুকেছে আর ঐ দেখুন বন্ধুরা… আজ আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পাবেন কেমন করে আমার এই দুষ্টু মিষ্টি শশীমুখি সোনাটা নিজের হাতে…হি হি…মানে নিজের পায়েই প্যাকেট খুলে মাছ খায়। ভিডিওটি ভালো লাগলে লাইক ও শেয়ার করতে ভুলবেন না…”