ইনডেক্স কেস

ইনডেক্স কেস
ইন্দ্রনীল সান্যাল

কপাল ভাল যে ফ্লাইটে আইল সিট পেয়েছে সবিতা মেনন। ত্রিশ ঘন্টা প্লেনের পেটের মধ্যে কাটাতে গেলে অনেকবার টয়লেটে যেতে হয়। উইন্ডো সিট হলে পাশের প্যাসেঞ্জার বিরক্ত হয়। মুখে কিছু না বললেও বডি ল্যাঙ্গোয়েজে বুঝিয়ে দেয় যে অসুবিধে হচ্ছে।
সস্তার এয়ারলাইন্‌সে খাবার নিয়ে খুব ঝকমারি। ইন্টারনেটে ফ্লাইটের টিকিট বুক করার সময় ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনারেরর ক্ষেত্রে ‘নন ভেজ’ সেকশানে টিক দিয়েছিল সবিতা। ভারতীয় যাত্রী দেখলেই এরা নিরামিষ খাবার গছানোর চেষ্টা করে।
বাইশ বছরের সবিতা মেনন কেরালার কোচি শহর থেকে চিন দেশে পড়াশুনো করতে গিয়েছিল। কেরালায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা এত কঠিন যে মেধাবী স্টুডেন্ট না হলে পছন্দের সাবজেক্ট পাওয়া অসম্ভব। সবিতা মেধাবী নয়। বাবা সুরেশ মেননের ট্যাঁকের জোর আছে বলেই ক্যাপিটেশান ফি দিয়ে বিদেশের কলেজে পড়তে যেতে পেরেছে।
যে শহরে সবিতা পড়াশুনো করে, সেখান থেকে কোচি ফেরার ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই। বাধ্য হয়ে ট্রেনে করে সে এসেছে চাংশা এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে কোচির ডাইরেক্ট ফ্লাইট। মাঝখানে স্টপওভার ছিল। যাত্রাপথের ধকল সবিতার সহ্য হয়নি। ঠান্ডা লেগে গলা ব্যথা। সঙ্গে গলা খুসখুস আর গা ছ্যাঁকছ্যাঁক।
গত বছর সবিতা যখন ভারত থেকে চিনে গিয়েছিল, তখন মাথার মধ্যে বিজবিজ করছিল টেনশান, ডিপ্রেশান, বিদেশের কলেজ জীবন নিয়ে আশঙ্কা। এক বছর ওখানে কাটিয়ে সে সব দূর হয়েছে। ফেরার সময়ে দীর্ঘ যাত্রা পথে একটাই বাসনা। বাড়ি ফিরে সলিড ঘুম দিতে হবে।
প্লেন কোচি এয়ারপোর্টে টাচডাউন করেছে। খুকখুক করে কেশে মোবাইল অন করল সবিতা। আজ একুশে জানুয়ারি, দু’হাজার কুড়ি সাল। এখন সকাল সাড়ে নটা বাজে।
প্লেন দাঁড়ানো মাত্র লফ্‌ট থেকে হ্যান্ড লাগেজ নামাল সবিতা। অন্য যাত্রীরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই সে প্লেনের জঠর থেকে নামতে চাইছে। আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনল মোবাইল বাজছে। ফোন কানে দিতেই সুরেশের গলার আওয়াজ। “আমি গাড়ি নিয়ে এসে গিয়েছি। তুই ক্যাব রোডে দাঁড়া।”
“আচ্ছা!” বিমানবালার যান্ত্রিক হাসি উপেক্ষা করে সিঁড়ি দিয়ে নামল সবিতা। অ্যারাইভাল লাউঞ্জের ভিড় ঠেলে, ইমিগ্রেশান পর্ব চুকিয়ে দ্রুত হাঁটছে সে। তার হ্যান্ড লাগেজে কাজের জিনিস ছাড়া একগাদা আচারের প্যাকেট রয়েছে। কদিন আগে স্থানীয় বাজার থেকে সে এগুলো কিনেছে। সুরেশ আচার খেতে খুব ভালবাসেন।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে, ক্যাব রোডে দাঁড়িয়ে সবিতা দেখল সূর্য এর মধ্যেই মধ্য গগনে। কোচি শহর এর মধ্যেই দৌড় শুরু করেছে। বাস, অটো, প্রাইভেট গাড়ি, টু হুইলার চেপে লোকজন অফিস যাচ্ছে। রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে গভীর শ্বাস নিল সবিতা। নারকেল তেল, ব্যানানা চিপ্‌স আর মাছ ভাজার গন্ধ মিশে যে গন্ধটা সে পাচ্ছে, সেটা আসলে দেশের গন্ধ।
সুরেশ গাড়ি নিয়ে চলে এসেছেন। ডিকিতে ব্যাগ রেখে থেকে একটা আচারের প্যাকেট বার করল সবিতা। সুরেশের পাশে বসে বলল, “এই নাও। তোমার প্রিয় আচার।”
সুরেশ বললেন, “তোদের পাড়ার দোকানদারদের সর্দিকাশি হচ্ছে বলে বাজার নাকি বন্ধ করে দিয়েছে! তুই কিছু জানিস?”
গাড়ির সামনে একগাদা বাচ্চা। ওরা গাড়ি সাফ করতে এসেছে। ‘হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো’ করে দু’বার হেঁচে সবিতা বলল, “তুমি যে বাজারের কথা বলছ, তার নাম হুবেই মিট মার্কেট। আমি ওখান থেকেই আচার কিনেছি। আমি কেনার কয়েকদিন পরেই বাজার সিল করা হল।”
রাস্তায় দাঁড়ানো বাচ্চাগুলো সবিতাকে নকল করে হাঁচছে। ওদের কান্ড দেখে সবিতা হাসতে হাসতে বলল, “এবার বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে কয়েকদিন ঘুমোব। শান্তির ঘুম!”
সুরেশ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ওয়েলকাম হোম ফ্রম উহান সিটি, মাই সুইটহার্ট!” তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।
বিমানবন্দর থেকে গাড়ি এগোচ্ছে কোচি শহরের দিকে।

পুনশ্চঃ ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের প্রথম কোভিড ১৯ কেস বা ইনডেক্স কেস ধরা পড়ে কেরালার কোচি থেকে। তিনি উহানের কলেজের ছাত্রী। ভারতের মতই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একটি করে ইনডেক্স কেস আছে। কোনও ব্যক্তি, রাজ্য বা সম্প্রদায়কে অসম্মান করা এই গল্পের উদ্দেশ্য নয়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “ইনডেক্স কেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *