micro-story-indur

ইঁদুর
মৌসুমী মুখোপাধ্যায়


রেললাইনের ধার ঘেঁষে মাঠ আর পুকুর। পুকুর পার হয়ে মস্ত বড় স্কুল বাড়ি। হলুদ রঙের তিনতলা দালান কোঠা। সারি দেওয়া ঘর, লম্বা টানা বারান্দা। সারাদিন বাচ্চাদের সম্মিলিত কলরবে গমগমে থাকে। কিন্তু এখন, এই নিঝুম রাতে সব নিশ্চুপ, শুনশান। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া নীলচে মেঘ। পঞ্চমীর শীর্ণ ক্ষয়াটে চাঁদ পর্যাপ্ত আলো দিতে না পারার ব‍্যর্থতায় মাঝে মাঝেই মুখ লুকোচ্ছে মেঘের আড়ালে। চারপাশ নিকষ কালো। গেটের ধারের ছোট্ট ঘরটায় ভোজপুরি দারোয়ান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খেয়াল করলে এই দূর থেকেও তার নাসিকা গর্জন আবছা আবছা শোনা যায়। টানা বারান্দার ধারে সারি সারি ঘরের একদম শেষে, রান্নাঘর আর বাগান পার হয়ে, এই বড় ঘরটা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলের এক্কেবারে গা ঘেঁষে। বছর কয়েক হল তৈরি হয়েছে। ইটের দেওয়ালের গায়ে প্লাস্টার পড়েনি এখনও। মাটির মেঝে আর নীল রঙের টিনের চাল। লম্বা টানা ঘরটার দেওয়ালের গায়ে সারি সারি বস্তা রাখা; চালের বস্তা। এই ঘরের মেঝেতেই ইঁদুর‌টা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত বানিয়েছিল একটা। ওখানে ওর ছানারা আছে। গর্তের সামনেই চালের বড় একটা বস্তা। ইঁদুর‌টা তাতে ফুটো করছিল কিচ্ কিচ্ আওয়াজ তুলে। ফুটো থেকে ঝুরঝুরে চাল নিচে পড়লেই তা নিয়ে ঢুকে যাবে গর্তে। সারা রাত পরিশ্রম করতে পারলে অনেকটা চাল জমিয়ে ফেলা যাবে। হঠাৎই পাশে খচমচ শব্দ। ইঁদুর‌টা কান খাড়া করে। কাজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে; স্থাণু, যন্ত্র‌বৎ। তারপর বুঝতে পারে, একে সে চেনে। এ তো পবন! মাঝে মাঝেই দেখা হয় তাদের। পবনের তেল চুকচুকে খালি গা। পরনে আঁটোসাঁটো ধুতি মালকোঁচা দিয়ে পরা। মাথার চুলেও তেল মাখানো। পবনের মাথার উপর কাঠের পাটাতন। পাটাতন সরিয়ে মেঝের বড় গর্ত দিয়ে পবন ভিতরে আসে। ইঁদুর‌টা কাজ বন্ধ করে পুঁতির মত বড় বড় চোখ তুলে ওকে দেখে; হয়ত মতলবটা কী মেপে নিতে চায়। জানতে চায় আজও পবন ওর ফুটো করে রাখা বস্তা থেকে চাল সরাবে কিনা। ইঁদুরে-কাটা বস্তায় নাড়া পড়তেই চাল ঝরে পড়ার সরসর শব্দ হয়। পবন সেই শব্দ শোনে কান খাড়া করে। ইঁদুর‌টাও শোনে। পবন অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এগোয়। ইঁদুর‌টা ভয়ে সরে দাঁড়ায় একটু। পবন বড় কাপড়ের থলেটা ভর্তি করে চাল নেয়। ইঁদুর‌টা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকে। ও জানে চাল নিয়ে পবন পাঁচিলের গর্ত দিয়ে চুপচাপ বাইরে চলে যাবে আবার। পাঁচিল পার হয়ে একটু এগোলেই পবনের মাটির ঘর। পাঁচিলের বাইরে বুনোকুল ঘাগরাকাঁটা আর বিছুটির জঙ্গল। এদিকে কেউ আসে না। পবন গাছ চেনে, পথও চেনে। এ তার পূর্ব পুরুষের থেকে অধীত বিদ‍্যা। সিঁধকাঠিটিও তার বাবার আমলের। যদিও এই কাজ পবনের পেশা নয়। পবন ভ‍্যান গাড়িতে করে সবজি বিক্রি করে। সারাদিনের বেচাকেনার পর যেটুকু যা পড়ে থাকে তাতে সব মিলিয়ে বড় একটা চচ্চড়ি রেঁধে ফেলা যায়। পবনের বউ কখনোসখনো তাতে ভাজা বড়ি কিংবা এক খাবলা কুচো চিংড়ি ফেলে দেয়। টিফিনের ঘন্টা পড়লে উঁচু ক্লাসে‌র ছেলেপুলে‌রা বেশ কয়েকজন দল বেঁধে পবনের বাড়িতে খেতে আসে। ইস্কুলে‌ তো উঁচু ক্লাসে উঠলেই দুপুরের ভাত দেওয়া বন্ধ! কিন্তু উঁচু ক্লাসের ছেলেদের খিদে যে বেশি! বাড়িতেও সবার পেটপুরে খাওয়া জোটে না। পবনের বাঁজা বউটা ওদের রেঁধে খাওয়ায়। মাটির দাওয়ায় বসে কলার পাতায় ওরা সপ্ সপ্ আওয়াজ করে এক তরকারি দিয়ে ফ‍্যানভাত খায়। ইঁদুর‌টা সব জানে। পবন চাল নিয়ে চলে যেতেই ইঁদুর‌টা নতুন উদ‍্যমে নতুন একটা বস্তায় দাঁত বসায়। আওয়াজ ওঠে কিচ্ কিচ্ কিচ্ কিচ্।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “micro-story-indur

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *