আদৃতা মেহজাবিন
যেবারে পদ্মার ঘাটে বানের জল ‘তোকে ছুঁই, তোকে ছুঁই ‘ শব্দ তুলে বিপদসীমা পেরিয়ে গেল। ঠিক সেবারই ছেলেটির অসুখ হলো।
আকাশটা ভেজা মেঘের কালো কাঁথা অন্ধকারে শুকোতে দিয়ে কাজে ফাঁকি দেয়া মানুষের মতো উধাও হয়েছে। ঝরঝর বৃষ্টি পড়ছে ঝর্ণার মতো। তারপর আকাশ আবার নির্বিকার। ছেলেটি আকাশের দিকে তির্যক চোখে তাকায়, মনের মেঘ কী বৃষ্টিতে কমে?
..
বিড়ালটা কালো। সামনের দুপায়ে ভর দিয়ে বসে থাকে। কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। কেমন মায়া ভরা চাহনি। ছেলেটির দ্রুত ভাত খাওয়ার অভ্যাস। এক ফাঁকে খানিকটা মাছভাত আস্তে টেবিলের নিচে ফেলে দেয়। বিড়ালটা আস্তে আস্তে খায় আর মায়াভরা চোখে ছেলেটির দিকে চেয়ে থাকে।
দুপুর পেরিয়ে ভ্যাপসা গরমের রাতটা দ্রুতই আসে।
কেউ না অপেক্ষা করলেও, ছেলেটি রোজকার রুটিনে খেতে বসে। মা বহুদিন নেই। বাবা চুপচাপ রিটায়ার্ড। ঠাণ্ডা ভাত মাঝে মাঝে শক্ত ঢ্যালার মতো লাগে। টেবিলের নিচে একমুঠো ভাত। মাছ পুরোটাই। ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিলের মতো একটুকরো মাছ, ভাগ করতে ইচ্ছে করে না।
‘তুই পুরোটাই খা’। মনে মনে বলে ছেলেটা।
রাত তিনটায় শুকনো ভাত খেতে বসে ছেলেটি। আগ রাত্রেই কেউ ‘ ঠক ‘ করে টেবিলের উপরে রেখে গেছে। ঠাণ্ডা অল্প তরকারি এক কোনায় যেন উপহাস করছে। আজও বিড়ালটি এসেছে। আহ, একমুঠ ভাতই তো! দেই ওকেও একটু।
আহা, ওর বুঝি আমারই মতো কেউ নেই।
কাজের বুয়া ঘর ঝাড়ু দিতে এসে গজগজ করে। “টেবিলের নিচে ভাত ফালায়। তাইনে বড়লুক হইছে। নিমুরাইদ্দা কোনহানকার “।
বড়ভাই আজকাল চোখ রাঙান – এভাবে বসে খেয়ে আর কতদিন? ছেলেটি শুধু চেয়ে দেখে। আচ্ছা ভালোবাসাবাসির দিনগুলি গিটারের তারের মতো বেদনার ঢেউ তুলে কোথায় হারায়?
আজকাল বিড়ালটা আর খাওয়ার সময় আসে না।
রাত ঝেঁপে এলে জানালা দিয়ে এসে চুপচাপ পাশে বসে থাকে।
ছেলেটা ওর ঘাড়ে হাত বুলায় – সবাই ছেড়ে গেছে, তুইও যা। যেন ও সব বোঝে। ‘ জানিস মা তরকারিতে ঝাল কম দিতো। আমি খেতে পারি না তাই। ঘুম না আসলে কী করে যেন টের পেত। আয় খোকা মাথার চুল টেনে দেই। দুফোঁটা তপ্ত জল পড়ে বিড়ালটির পিঠে। বিড়ালটা ফিরে তাকায়।
নানান জায়গায় ধর্ণা দেয় ছেলেটি। পিওনের হাত ধরে কাঙ্ক্ষিত সেই অপূর্ব চিঠি দরজায় ঘা দেয় না। ইচ্ছে চিঠিগুলো মেঘমল্লার হয়ে অভিমানে দূরে থাকে। ঝাউগাছের বুক জুড়ে হাহাকারি বাতাস আফসোসে দৌঁড়ে দূরে চলে যায়।
ছেলেটি বেকারই থাকে। স্বপ্ন বোনা মেয়েটি একদিন চোখের জলে বেনারসির আঁচল ভিজিয়ে দূর শহরে চলে যায়। মেয়েটি ভীষণ ‘পয়া’ ছিল। হু হু করে বয়ে চলা দীর্ঘশ্বাসের সাথে ভাবে ছেলেটি।
আজকাল ছেলেটির খিদেও পায় না। বিড়ালটাও শুকিয়ে গেছে। মানুষের কথা মনে না থাকুক। কেউ কি বিড়ালটাকে একটু এঁটো কাঁটাও দিতে পারে না!
শখে কেনা বইগুলো বিক্রি করে ছেলেটি। ‘আজ ওকে অল্প হলেও দুধ কিনে দেবো।’ খাঁটি দুধে আলাদা মিষ্টি লাগে না, মা বলতেন।
ছেলেটির হাতে বত্রিশটি ‘ক্লোনাজেপাম ‘ বহু কষ্টের টাকায় কেনা। খামটি সামনে রেখে ছেলেটি দুধ গোলায় বাটিতে। তারপর ডাকে ‘ আয় আয়। ‘ বিড়ালটি জুলজুল করে ছেলেটির দিকে চেয়ে থাকে।
পাশাপাশি দুটো জিনিস। বড্ড প্রয়োজনীয়। জীবন ও মৃত্যু।
বিড়ালটি কাগজে মোড়ানো ওষুধের প্যাকেটটা মুখে নিয়ে জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়। ছেলেটি দৌড়ে বাইরে আসে। ‘আমার ওষুধ কই? আমার ওষুধ কই?
আজকাল ছেলেটাকে শেকলে বেঁধে রাখে সবাই। ছেলেটাও যাকে পায় জিজ্ঞেস করে – আমার বিড়ালটা দেখেছেন? ওই যে খামে ভরা ওষুধগুলো মুখে নিয়ে চলে গেল আর আসেনি। আমার বিড়ালটা দেখেছেন?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন