নীলা নাথদাস
কত দিন হয়ে গেছে অমিতকে দেখেনা শরণ্যা৷ শেষবার যখন এসেছিল তখন চেনা যাচ্ছিল না ওকে৷ একমুখ দাঁড়ি, এলোমেলো চুল, মুখে ক্লান্তির ছাপ৷ শুধু চোখদুটো আগের মতই উজ্জ্বল! রাতে জানলায় টোকা পড়তেই বুঝেছিল অমিত এসেছে৷ বাবা মা পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তাই,সন্তর্পণে দরজা খুলেছিল ও৷ অমিত দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারের সঙ্গে এক হয়ে৷ দরজা খুলে দিতেই নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ঢুকেছিল অমিত৷ “কিছু খেতে দাও শরো, খুব খিদে পেয়েছে৷” বলে ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়েছিল ও৷ রান্নাঘর থেকে চুপিসাড়ে ভাত, ডাল, তরকারী প্লেটে সাজিয়ে খেতে দিয়েছিল৷ মাছ অথবা অমলেট ভেজে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ সাহসে কুলোয়নি, পাছে শব্দ পেয়ে বাবা মা জেগে ওঠেন! সাগ্রহে ভাত খাচ্ছিল অমিত৷ খেতে খেতে নিচু স্বরে কথা বলছিল৷ তখনই শরো শুনেছিল পালামৌতে মাওবাদীদের সঙ্গে এতদিন ছিল৷ এখন, এদিকে কোথায় কাজ রয়েছে তাই এসেছে৷ অযাচিত ভয়ে শঙ্কিত শরণ্যা ভয়ে কেঁদে ফেলেছিল৷ দুচোখ জলে ভরে উঠেছিল৷ “কেন, অমিতদা, কেন? কি দরকার তোমার বিপ্লবের? জানো না, এই বিপ্লবের কোন দাম নেই? এত কষ্ট সয়ে কি পাচ্ছ? সন্ত্রাসবাদীর তকমা!” প্রত্যুত্তরে অমিত বলেছিল, “তুমি জানো না শরো, আমাদের দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের কথা, যারা এখনো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের বেসিক অধিকার থেকে বঞ্চিত! জানো বনবাসী মানুযদের কথা? ওরা ভাত পায় না শরো, পিঁপড়ের ডিম খেয়ে খিদে মেটায়! ওরা ভাবে, এটাই ওদের প্রাপ্য৷ তাই, এদের জাগাতে বিপ্লব দরকার৷ আর, বিপ্লবই চেতনা আনবে, দেখে নিও শরো৷ আমরাই পারব তা আনতে! “বলতে বলতে উত্তেজনায় চোখ দুটো জ্বলে উঠেছিল অমিতের৷
মনখারাপি স্বরে শরো বলেছিল, “তুমি কি কোনদিনই বাড়ি ফিরবে না অমিতদা?”
“ফিরব কিনা জানি না৷ তবে, শরো, সব পাখি বাড়ি ফেরে না৷ আমিও হয়তো…….”এটুকু বলে থেমে গিয়েছিল অমিত৷
পরক্ষণেই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হয়তো বলে উঠেছিল—–ইফ য়্যু লভ আ বর্ড সেট ইট ফ্রী/ইফ ইট কামস ব্যাক টু য়্যু ইট ইজ য়োরস!
শেষ শব্দটি বলেই কোমরে গোঁজা মাউজারে হাত রেখে চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল৷ দরজা খুলে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল শরো৷ অস্পষ্ট এক ছায়ার মত রাতের আঁধারে মিশে গিয়েছিল অমিত৷ সেই শেষ দেখা৷ তারপর, বহুদিন কোন খোঁজ-খবর পায়নি অমিতের৷ তাই যোগাযোগও হয়নি৷
শরণ্যার দাদা বাসব পালামৌতে সিসিএলে ইঞ্জিনিয়ার৷ পুজোয় দাদা বাড়ি এলে কথাচ্ছলে ওদের ওখানকার মাওবাদীদের হালচাল জিজ্ঞেস করেছিল ও৷ দাদা, বলেছিল এম.সি.সিরা নাকি পালামৌতে একটা প্ল্যান্ট উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছিল গত মাসেই৷ কিন্তু সফল হয়নি৷ এ বাদে তেমন কিছু জানে না৷ তবে ফ্র্যাসট্রেটেড আইডিয়ালিজমের কোন মূল্যই নেই, বলে মন্তব্য করেছিল দাদা৷ তারপর, অদ্ভূত চোখে বোনের দিকে তাকিয়েছিল৷ যেন, বলতে চাইছিল, তোর আবার কবে থেকে মাওবাদীদের কার্যকলাপের উপর ইন্টারেস্ট হল? ব্যাপারটা আঁচ করে অন্যভাবে উত্তর দিয়েছিল ও৷ বলেছিল, “দাদা, তুই এমন জায়গায় থাকিস যে খুব স্ট্রেস হয় আমাদের৷
তারপর মায়ের ডাকে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই দাদার চিৎকার শুনেছিল৷
দৌড়ে যেতেই টিভিতে স্ক্রোলিং করা নিউজের দিকে চোখ পড়েছিল ওর৷
লাল জঙ্গলে পুলিশ ও আধা কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ হানায় মৃত বাংলার ছেলে অমিত রায়৷
ওকে দেখে ওর দাদা বাসব বলে উঠেছিল আমার বন্ধু রাণার ভাই অমিত মারা গেছে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে৷ ও মাওবাদী ছিল!!! জানতাম নাতো! ছবি দেখে চিনলাম৷
দাদার কথা গুলো আর শুনতে পাচ্ছিল না শরণ্যা৷ চলে গেছে অমিতদা চিরদিনের জন্য৷ আর কোনদিন রাতের অন্ধকারে ওর জানলায় টোকা পড়বে না৷ কোনদিনও বিপ্লবের স্রোতে আসা চেতনার কথা কেউ বলবে না৷ ঘরে ফিরবে না আর কোনদিন ওই পাখি৷ মুক্ত হয়ে গেছে সে অসীম চৈতণ্যে আসলে ঠিকই বলেছিল অমিতদা৷ সব পাখি ঘরে ফেরে না৷
সাড়হীন হয়ে বসে রইল শরণ্যা৷ সময় বয়ে চলল সময়ের পথে অন্তহীনভাবে৷
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগল, আপনার লেখাটি, সত্যি ই,সব পাখি ঘরে ফেরেনা, পরের গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম
অশেষ ধন্যবাদ৷শুভেচ্ছা রইল৷৷