micro-story-jiboner-anko

জীবনের অঙ্ক 
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি


মধুমিতার বয়স ৬৫। বেডসাইড টেবিলের সামনে বসে আছেন। দৃষ্টিতে অপার শূন্যতা। চোখেমুখে ক্লান্তি আর অনিদ্রার ছাপ। অগোছালো ঘরে এককোণে এলোমেলো হয়ে একরাশ বইপত্র, তারই পাশে ক’টা জামা-কাপড়, জলের বোতল, থালা-বাটি-এইসব। একটা বড়সড় জানালা থাকলেও সেটা বন্ধ। লোডশেডিং হয়েছে একটু আগেই। এত গরম, তাও জানলা খুলতে ইচ্ছে করছে না মধুমিতার। টেবিলের উপর একটা কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলছে। তারই মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে টেবিলের উপরেই পড়ে আছে এক পাতা কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। মধুমিতার ডানহাত সামান্য ইতস্তত করেও সেদিকে না এগিয়ে পারে না। দু’মাস আগে বারীন, মধুমিতার স্বামী হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন। একসঙ্গে এতগুলো বছর কাটানোর পর হঠাৎ এভাবে ফাঁকা হয়ে যাওয়া জীবনটা আজকাল দুর্বিষহ লাগে মধুমিতার। তিনি যে অজান্তে একটু একটু করে এক ভয়াবহ অবসাদের শিকার হয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা বুঝতেও পারছিলেন না।

মুঠোভর্তি ওষুধগুলো নিয়ে গ্লাসে জল ঢালতে গিয়েও হাত কেঁপে উঠল মধুমিতার। কারণ গিলে ফেলার মুহূর্তেই দরজায় একটা মৃদু টোকা পড়েছে।

“মিতা আন্টি… আছ? দরজাটা একবার খুলবে, প্লিজ?”

চমকে উঠলেন মিতা ওরফে মধুমিতা। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটা এসেছে, নাম সুজয়; ক্লাস ফাইভে পড়ে। আগে মাঝেমধ্যেই আসত সে, আন্টির কাছে অঙ্ক বোঝার জন্য। কিন্তু ইদানীং আসছে না অনেকদিন যাবৎ। মধুমিতা অঙ্কে এম.এস.সি। সংসারের চাপে চাকরির পিছনে আর ছোটা হয়নি। কিন্তু বাচ্চাদের পড়াতে তাঁর খুব ভাল লাগে।

দরজা খুলতেই সুজয় অঙ্ক খাতাটা বাড়িয়ে দিল।
— “আন্টি, এই ভগ্নাংশের অঙ্কটা কিছুতেই পারছি না। কাল স্কুলে টেস্ট আছে, একবার বুঝিয়ে দেবে প্লিজ?”

মধুমিতা প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও গ্লাসের জলটা সরিয়ে রেখে বললেন, “এখন তো লোডশেডিং চলছে। তার মধ্যে… ঠিক আছে, দেখি! কোথায় আটকাচ্ছে তোর। আয় ভিতরে।”

খুশিমুখে খাতা-পেন নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে ছোট্ট সুজয়। ল্যাম্পের আলোতেই চলতে থাকে অঙ্ক কষা। ল.সা.গু, গ.সা.গু-র মধ্যে বুঁদ হয়ে গিয়ে মধুমিতা যেন একটু আগের ওই অন্ধকার চিন্তা বেমালুম ভুলে যান। সুজয় বরাবরই খুব বাধ্য ছেলে, মন দিয়ে শুনে চটপট শিখে নিচ্ছে অঙ্কগুলো। একটার পর একটা মিলে যাচ্ছে। হাসিতে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার মুখ। মধুমিতার ঠোঁটেও তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠছে। কোথা দিয়ে আধ ঘণ্টা কেটে গেল। সব অঙ্ক শেষ। সুজয় খাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল।
— “থ্যাঙ্ক ইউ, আন্টি। তুমি না থাকলে কী যে হত আজ, এবার আমি কাল পরীক্ষায় সব পারব!”
— “ঠিক তো? বেশ, বেশ। আচ্ছা, এবার যা। নইলে তোর মা চিন্তা করবে আবার। কাল ভালো করে দিস পরীক্ষাটা।”

ছেলেটা ঘাড় নেড়ে চলে গেল নিজেদের ঘরের দিকে। হতচ্ছাড়া কারেন্টটা এখনও এল না। ঘরে ফিরে মধুমিতা টেবিলের দিকে তাকালেন। গ্লাস আর তার পাশে ট্যাবলেটগুলো এখনও অক্ষত। হঠাৎ কী যেন হল, তিনি দ্রুত এগিয়ে সেই সবক’টা বড়ি নিয়ে ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে দিলেন। তারপর আরেকটু জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন।

রাতের ঘুমটা দারুণ হল তাঁর। কিন্তু পরদিন সকালে কীসব চেঁচামেচি, কান্নাকাটি, শোরগোলে ঘুমটা বিচ্ছিরিভাবে ভেঙে গেল। কী হয়েছে? দরজা খুলেই দেখেন সুজয়দের ফ্ল্যাটের সামনে লোকে লোকারণ্য। কৌতূহলে সেদিকে এগিয়ে যেতেই কানে এল, লোকজন বলাবলি করছে, “আহা রে, মাত্র দশ বছর বয়স। কী হাসিখুশি বাচ্চা ছিল!”

– “হ্যাঁ, ভাগ্যের ফের ছাড়া আর কী বলি? ইংলিশ পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল ছেলেটা, আজ অঙ্ক হবার কথা ছিল, কিন্তু অঙ্ক নিয়ে এমন ভয়-ভীতি ছিল ওর, যে সেই চিন্তা নিয়ে রাস্তা পার হতে গেছিল।”

– “আর ওটা ষোল চাকার ট্রাক। ব্রেক কষলেও কিছু করা যেত না।”

– “সত্যিই মর্মান্তিক। ওর মায়ের যে কী অবস্থা!”

 সুজয় নাকি আগের দিন বিকেলেই এক ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মারা গেছে! বডির ময়নাতদন্ত সেরে এবার তার দাহকার্য সারার পালা। কিন্তু এই সবকিছু শুনে মধুমিতা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাহলে কালরাতে কে এল? কাকে পড়ালেন তিনি? টেবিলের উপর একটা রাফ খাতায় তাঁর নিজের হাতে করা সমাধানগুলো এখনো টাটকা রয়েছে।

ভয় নয়, সুজয় চলে যাওয়ার এক অপরিসীম দুঃখ আর তার মধ্যেই ওর এই ব্যাখ্যাতীতভাবে তাঁর কাছে আসা এবং ভয়াবহ কাণ্ডটা ঘটানোর থেকে তাঁকে বিরত রাখার মতো কাজে এক অদ্ভুত আনন্দে তাঁর চোখ ভিজে এল। মাথা নিচু করে দীর্ঘক্ষণ বসে রইলেন মধুমিতা। তারপর ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত নিলেন—
— “আমি আবার ছোটদের অঙ্ক শেখাতে শুরু করব। হয়তো সেভাবেই জীবনের না মেলা অঙ্কের হিসেবটা আবার মেলাতে পারব।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *