micro-story-jungle-safari

জঙ্গল সাফারি
সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়


বর্ষাকালেই পালামৌ আসার কথা ছিল স্বর্ণালীর। কিন্তু নিজের করোনা পজিটিভ হওয়ায় এবং জঙ্গল বন্ধ থাকায়, তখন আসতে পারেনি। অবশেষে এই ডিসেম্বরে জঙ্গল খোলায় পালামৌ আসার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে হাওড়া থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে ডালটনগঞ্জ, তারপর সেখান থেকে গাড়িতে বেতলা। এই ট্রেনটা ডালটনগঞ্জে ঢোকে রাত দেড়টা নাগাদ। সাহিত্যে এখানকার ঠাণ্ডা বর্ণিত হয়েছে ‘কাঁড়িয়া পিরেত মারা শীত’ বলে। সত্যিই তাই, ডিসেম্বরের ঠাণ্ডায় স্টেশনে নেমে একেবারে কেঁপে উঠেছিল স্বর্ণালী। বাকি রাতটা ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে গাড়িতে উঠল সকাল ছ’টায়। তারপর চলল বেতলা ফরেস্ট রেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে।

কিছুক্ষণ চলার পরেই শহরের কংক্রিট ছাড়িয়ে পৌছে গেল পলাশ-মহুয়াগাছ ঘেরা রাস্তায়। তখন সবেমাত্র সূর্য উঠেছে। কুয়াশা আর গাছগাছালি ভেদ করে রাঙা আলো মাটি স্পর্শ করছে। পুবদিকে তাকিয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতেই স্বর্ণালী পৌছে গেল বেতলার বনবাংলোয়। এই বাংলোটা একেবারে উপন্যাসে বর্ণিত বনবাংলোর মতোই। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে বাংলোর দিকে চেয়ে রইল স্বর্ণালী। তারপর ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়ল বেতলা ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে।

১৯৭৪ সালে গঠিত এদেশের প্রথম ৯টা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের মধ্যে অন্যতম এই বেতলা ন্যাশনাল পার্ক। এই ব্যাঘ্রপ্রকল্পের মোট আয়তন ৯৭১ বর্গকিমি, যার মধ্যে কোর বনাঞ্চল ২০০ বর্গকিমি। ১৯৩২ সালে এই বনেই বিশ্বের সর্বপ্রথম ব্যাঘ্রশুমারি হয়েছিল। পলাশ আর মহুয়াগাছে ঘেরা বেতলার এই জঙ্গলের প্রধান আকর্ষণ বাঘ, গাউর, লেপার্ড আর হাতি। এছাড়া আছে অসংখ্য চিতল, নীলগাই, বুনো শুয়োর, ভালুক, নেকড়ে সহ অন্যান্য প্রাণী আর আছে বিভিন্ন প্রজাতির চেনা-অচেনা পাখি।

জঙ্গল সাফারিতে চেপে খানিক এগোতেই বাঁদিক থেকে কেয়া কেয়া ডাক শুনতে পেল স্বর্ণালী। তাকিয়ে দেখল, একটা ময়ূর পেখম মেলে ডাকছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একদল হাতি দেখল, বুনো মোষও দেখল। তারপর গভীরে পৌঁছতেই জঙ্গলে একটা থমথমে আবহ তৈরি হল। সাফারির ড্রাইভার লছমনভাই ব্যাপারটা ঠাহর করে সন্তর্পণে গাড়ি এগোচ্ছিল। খানিক এগোতেই হঠাৎ ব্রেক কষল। চারপাশে বাঁদরের তাড়স্বরে চিৎকার আর পাখিদের কলরবের মাঝে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্বর্ণালীদের সাফারি জীপ। লছমনভাই খানিকটা উত্তেজিত আর অনেকটা ভয়ার্তভাবে চেয়ে রইল সামনের দিকে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে স্বর্ণালীও সামনের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। লছমনভাইকে জিজ্ঞেসা করল, “কী হয়েছে?”

লছমনভাই মুখে কিছু না বলে, শুধু দু’পাশে মাথা নাড়াল। আরও ঘন্টাদুয়েক সাফারিতে ঘুড়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাংলোয় ফিরল স্বর্ণালী। একেই এতোগুলো মাস চারদেওয়ালে আটকে থাকাই মনখারাপ ছিল তার। আবার স্বর্ণালী ভীষণ আশা করেছিল, এবার নিশ্চয় বাঘ দেখতে পাবে। কেননা সে কিছুদিন ধরেই শুনছিল লকডাউনের ফলে বেতলায় প্রায়ই বাঘের দেখা মিলছে। কিন্তু আজ সে দেখা দিল না। সবমিলিয়ে ভীষণ মানখারাপ বাসা বাঁধল স্বর্ণালীর মনে।

খানিকবাদে বাইরে বেরিয়ে স্বর্ণালী দেখে, বনদপ্তর থেকে দুটো জিপ তড়িঘড়ি জঙ্গলের দিকে ছুটল। বনদপ্তরের আপিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, আজ নাকি খুব কাছেই একটা বাঘের দেখা মিলেছে। সে ফরেস্ট অফিসারকে তার জঙ্গল সাফারির অভিজ্ঞতা বলল। সব শুনে ফরেস্ট অফিসার বললেন, “আপনি যদি ১০০ বার জঙ্গলে যান, তাহলে হয়তো ১ বার বাঘ দেখতে পারেন। কিন্তু এটা মনে রাখবেন, বাঘ কিন্তু আপনাকে ৯৯ বার দেখেছে।”

কথাটা শুনেই মুখে হাসি ফুটল স্বর্ণালীর। তার মানে সে বাঘকে দেখেনি ঠিকই, তবে বাঘ তাকে ঠিক দেখেছে। স্বাগত জানিয়েছে জঙ্গলে। বনদপ্তর থেকে খুশি মনে বেরিয়ে এল স্বর্ণালী। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে, ইউক্যালিপটাসের শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। করোনার আবহে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদেওয়ালে আটকে থাকতে হয়েছিল স্বর্ণালীকে। কিন্তু আজ জঙ্গল আবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে মুক্তির স্বাদ। মাস্কটা খুলে প্রাণভরে শ্বাস নিল স্বর্ণালী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *