micro-story-kal-tumi-aleya

কাল তুমি আলেয়া
চুমকি ভট্টাচার্য


আর মাত্র দুটো দিন! তারপরই বাড়ীটার এক একটা অংশ ভেঙে পড়বে হাতুড়ির ঘায়ে। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে শেষবারের মত ছাদে উঠে এলাম, স্মৃতিরা একে একে এসে ভিড় করে।

-রূপা, লাটাইয়ে ঢিল দে,ঢিল!
আমার দুহাতে আঙুলের ওপর হাল্কাভাবে ধরে থাকা লাটাই ঘুরতে শুরু করল। লাটাই থেকে মোমসুতো দ্রুত বেরিয়ে চলে যাচ্ছে দাদার হাত ঘুরে দূর আকাশে, তারপর টুপ করে নীচের একটা পেটকাটির ওপর পড়ল আমাদের ঘুড়িটা; শুধু একটা টান, খতম!
পেটকাটি হাওয়ায় ভাসার সংগে সংগে আমাদের ছাদও ভেসে গেল বিজয়ের উল্লাসে,
-ভোকাট্টাআআআ!
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশে নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ে, শেষ বিকেলের আকাশ প্রায় ঢেকে যায় ঘুড়িতে। সেই কোন ছোট থেকে দাদার সঙ্গী আমি! বিশ্বকর্মা পুজোর প্রায় একমাস আগে থেকেই চলে ঘুড়ি ওড়ানোর তোরজোর। দাদাকে মাঞ্জা দিতে সাহায্য করার সময় কতবার যে হাত কেটেছে কাঁচে! তবুও দাদার সর্বক্ষণের সঙ্গী হই। এই বছর দাদা সবে কলেজে ঢুকেছে, দাদার কলেজের বন্ধুরাও আজ আমাদের বাড়ী নিমন্ত্রিত। তারাও এনেছে রকমারী ঘুড়ি আর মাঞ্জা, কিন্তু ফেরদৌসদার মত কারোর নয়। সেও নিজে বানিয়েছে যে…

-রূপা না বসরা!
– হাসলে তোমায় কী সুন্দর লাগে বসরা!
– উফফ এই এক ছেলে! আমার সবকিছুই কি সুন্দর? আমি কালো, আমি পড়াশোনায় অতি সাধারণ, কোনো বিশেষ শিল্পকলায়ও পারদর্শী নই, আর পাঁচটা গড়পড়তা মেয়ের ভিড়ে মিশে যাওয়া একটা মেয়ে। তবে?
তবু শুনতে ভালো লাগে ফেরদৌসের কথাগুলো, নিজেকে মনে হয় অচিনপুরের রাজকন্যে।
আগে আমি ফেরদৌসকে “দাদা” বলতাম, এখনও সবার সামনে তা-ই বলি, আড়ালে নাম ধরে ডাকি, বারবার; ফেরদৌস আমার ফেরদৌস!
আগেই বলেছি ফেরদৌস আমার দাদার বন্ধু, মেডিকেল কলেজে একই সংগে পড়ে। সেই সুবাদেই আমাদের বাড়ী যাতায়াত ওর। লেখাপড়ায় যেমন তুখোড়, তেমনই ভালো ক্রিকেট খেলে; আর দেখতে রাজপুত্রর মত। বাড়ীর সবাই ফেরদৌসকে খুব পছন্দ করে। সেই ফেরদৌস এক গোধূলিবেলায় এই ছাদেই যেদিন প্রপোজ করল, তখন হাজারো দ্বন্দ্ব মনের ভেতর ঝড় তুললেও তাকে ফেরাতে পারিনি।
সুখের সময় দ্রুত বয়ে চলে। এই ছাদ সেই সুখযাপনের সাক্ষী।
ফেরদৌস বলেছিল,
-আমার নামের অর্থ জানো কি? “ফেরদৌস” মানে স্বর্গোদ্যান, আর সেই স্বর্গোদ্যানের একটিমাত্র বসরাই গোলাপ তুমি, আমার বসরা!
অন্ধকারে দুটো শরীর আরো ঘন হয়ে আসে…
হঠাৎ একটা চড়া আলো এসে পড়ায় দুজনে ছিটকে যাই দুদিকে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ছোটকা বুঝি আগেই আন্দাজ করেছিল কিছু, শুধু হাতেনাতে ধড়ার অপেক্ষায় ছিল। আলোয় চোখ সয়ে গেলে দেখলাম ছোটকার পেছনে দাঁড়িয়ে বাবা আর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাদা!

এরপরের কয়েকমাস প্রায় গৃহবন্দী করে রাখা হল আমায়, স্কুলে পাঠানো হতো ঠিকই কিন্তু মা স্কুলের বাইরে রাস্তায় বসে থাকতো। আমার জন্য মাকে কী হেনস্থাই না হতে হয়েছে!
সেই ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল আমাদেরই সমগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। ওবাড়ীর প্রতি আমার ভেতরের জমে থাকা অভিমান, দুঃখ তখন বারুদে পরিণত হয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকলাম শ্বশুরবাড়ীতেই, বাপেরবাড়ীতে ভুলেও আসতাম না।
আমার শাশুড়ী মানুষটি বেশ সহজ সরল, বড় মুখ করে সবার কাছে আমার গুণগান করতেন। বলতেন,
-আমার বৌমা আমাদের ছেড়ে একটিবারের জন্যও বাপেরবাড়ী যায় না, বড় ভালো মেয়ে।
তাঁর পুত্রটিও স্বামী হিসেবে মন্দ ছিলেন না, শান্ত স্বভাবের মানুষ। ধীরে ধীরে এই পরিবারের প্রতি মায়া জন্মাতে লাগল।
কিন্তু বিধি বাম, আমার স্বামীর গলায় ক্যানসার ধরা পড়ল। প্রায় এক বছরের কঠিন লড়াই শেষে মৃত্যুরই জয় হল। এরপর আজ প্রায় পনেরো বছর আমার সংসার বলতে আমি ও আমার অশীতিপর শাশুড়ীমা, একে অপরের মধ্যে খুঁজে পাই ভরসা, অবলম্বন।

গতকাল হঠাৎ দাদার ফোন এসেছিল,
-রূপা আমাদের বাড়ীটা আর থাকবে না রে, প্রমোটারকে দেওয়া হয়েছে, ভাঙা হবে। তুই একবার আয় না বোন!
ভেবেছিলাম না বলে দেব, কিন্তু কেন জানি না মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল,
-যাব
আজ তাই, প্রায় এক যুগ পর সেই মফস্বল শহর থেকে এই বাড়ীতে আসা। ফাঁকা বাড়ীটায় কেউ নেই কিচ্ছু নেই; মানুষজনের মধ্যে অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছে। সেসব দুঃসংবাদ ফোনে পেয়েছি, ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি কিন্তু এই বাড়ীতে পা রাখিনি। আজ রংচটা পুরোনো বাড়ীটার দৈন্যতা বুঝি আমার কাছেও হার মানছে। শেষ বিকেলের আলোয় শেষবারের মতো চোখ বলিয়ে নেওয়ার সময় চোখের কোল ভিজে গেল অজান্তেই।
-বসরা!
চমকে পিছন ফিরে তাকাতেই ঝাপসা দৃষ্টিতে অস্পষ্ট অবয়ব অচেনা ঠেকলেও পরিচিত কণ্ঠস্বরে যে শত জন্মের আহ্বান…ওই নামে যে একজনই ডেকেছিল!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-kal-tumi-aleya

  1. সোনাদি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তোমায়🙏❤️💐

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *