micro-story-khurodhar-bikolpo

ক্ষুধার বিকল্প
শফিক হাসান


লোকাল বাস থেকে নেমে বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে যেতে কত যে তড়পাতে হয় আবু সালেককে! প্রশস্ত রাস্তার দুই দিকেই নিত্যনতুন খাবার দোকান গড়ে উঠছে। কাবাব-নানরুটি, হরেক রকম হালিম, চাপ-চপসহ কত রকমের লোভনীয় মশলাদার আইটেম। তেলে ভাজা, ঘিয়ে ভাজা, মাংসের চর্বি দিয়ে ভাজা কত পদ্ধতিতেই না ভুরভুরে গন্ধটা নাকে এসে ধাক্কা মারে। নাক হয়ে সোজা কলিজায় গিয়ে বাড়ি খায়। ঠিক ধাক্কা বা বাড়িও না— মোচড়। হাহাকার।

খাবারের গন্ধে আবু সালেকের জিহ্বায় পানি এসে যায়। আশপাশের হাঁটা-চলারত মানুষগুলো এটা বুঝতে পারলে বেইজ্জতি কাণ্ড হবে, এমন আশঙ্কা থেকে থুতুগুলো গিলে ফেলে আবু সালেক। কতদিন মন চেয়েছে কোনো একটা দোকানে বসে ভরপেট খেয়ে নেয়। দোকানের ভেতরে তৃপ্তিসহকারে ভক্ষণরত খদ্দেরদের দিকে তাকিয়ে থেকে লোভাতুর দৃষ্টিতে। নিজেও যদি এমন খদ্দের পরিচয় অলংকৃত করতে পারত— একদিনের জন্য হলেও শান্তি পেত রুগ্ণ জিহ্বা, জীর্ণশীর্ণ পেট ও বুভুক্ষু চোখ। কিন্তু পকেটের ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কখনোই রসনার ঘোড়াকে বেশি দূর দৌড়াতে দিতে পারেনি। শ’দুয়েক টাকা তো অন্তত দরকার হবে।

আজ বাস থেকে নামার পর শরীরটা যেন চলছে না। অন্ধকার রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার চোখ দুটোও হয়ে পড়ছে আলোহীন। অথচ চারদিকে কত বৈদ্যুতিক বাতি, আলোর রোশনাই! দুই-তিনবার হোঁচট খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিল আবু সালেক। দুপুরে খাওয়া হয়নি। অফিসে সবার জন্য রান্না হয়। দুপুরের ঠিক আগ মুহূর্তে ম্যানেজার স্যার তাকে পাঠালেন আরমানিটোলায়। ফিরতে ফিরতে বিকাল। এসে দেখে সব সাবাড় হয়ে গিয়েছে, কেউই দয়াপরবশ হয়ে তার জন্য প্লেটে খাবার বেড়ে রাখার গরজ বোধ করেনি। কেনইবা রাখবে, অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সে; এমডি বা ম্যানেজার স্যার যদি বাইরে থাকতেন অনেকেই অতিউৎসাহী হয়ে সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করত।

ক্ষুধাটা ভেতর থেকে রামমোচড় দিলে এবার পড়েই গেল আবু সালেক। উঠে দাঁড়িয়ে শার্ট-প্যান্টের ধুলো ঝাড়ল। আর পারা যাচ্ছে না। চোখের সামনে বিভ্রম সৃষ্টি করে যাচ্ছে সাদা সাদা ভাতদানাগুলো। একটু পরেই সাইনবোর্ডে গরু ছাগল মুরগির ছবি সংবলিত একটা দোকান সামনে পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল আবু সালেক। অর্ডার করল চাপ ও নানরুটি। সাদা ভাতের ছবি সরে গিয়ে একমাত্র ছেলেটার মুখ ভাসল চোখের সামনে। ছেলেটা আজ সকালেও বলেছে— আব্বা, রাইতে আইবার সময় আইসক্রিম নিয়া আইবা। আমি খামু।

চকলেট বা আইসক্রিম মাসে কয়টা দিনেইবা কিনতে পারে! পেট-পিঠের পেছনেই অল্প উপার্জনের সব টাকা খরচ হয়ে যায়। ঘাটতি বাজেট পূরণ করারও বিকল্প কিছু থাকে না। অথচ যদি ক্ষুধার বিকল্প কোনো ট্যাবলেট থাকত, কী ভালোটাই না হতো! মাস বা বছরমেয়াদি একটা ট্যাবলেট খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারত আবু সালেক! ক্ষুধার বিকল্প ট্যাবলেট নেই, ভ্যাকসিনও নেই। আবার নুন-সাদাভাতও সহজে ধরা দিতে চায় না।

আবু সালেক যখন বাসায় ফিরল, মায়াকাড়া চেহারা নিয়ে ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রত্যাশার উজ্জ্বল মুখ তার। আজ নিশ্চয়ই আব্বা তাকে বিমুখ করবে না! আবু সালেক যে আইসক্রিম আনতে পারেনি। ব্যবহার্য ক্ষয়ে যাওয়া বাটন মোবাইল ফোনসেটটাও সঙ্গে নিয়ে ফিরতে পারেনি মা-ছেলে কেউই সেটা খেয়াল করে উঠতে পারে না…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *