micro-story-kobi-o-roddur

কবি ও রোদ্দুর
বিমল লামা


কবি বৃদ্ধ হয়েছেন। এবার তিনি দেহ রাখবেন। যেমন সবাইকেই রাখতে হয়।

কিন্তু দেহই রাখবেন, মন নয়। মন তার এখনও বেদুইন। এখনও তরুণ তুর্কী!

সেকথা কবি বোঝেন। বোঝে তার মনও। কিন্তু শরীর বোঝে না। অনেক ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করেও বোঝানো যায়নি তাকে।

অগত্যা, কবি দেহ রাখবেন।

পৈতৃক পকেট ঘড়িটা হাতে নিয়ে বসে আছেন বন্ধ ঘরে। ঘড়িটা তার হাতে দিয়ে তার বাবা বলেছিলেন– এর ভেতর থেকে সময় চুরি হয়ে যায় বার বার। তোমার কাজ চুরি আটকানো। এতদিন আমি আটকালাম। এবার তুমি আটাকাও।

সারা জীবন তাইই করেছেন কবি। সময়ের চুরি আটকেছেন।

কিন্তু আজ আবার ভোর রাত থেকে টিক টিক করে অভিযোগ জানাচ্ছে ঘড়ি। নাহলে সে তো নীরবে ঘুমিয়েই থাকে, মড়ার মতো।

বাবা বলেছিলেন– ঘড়ি এক নাগাড়ে অভিযোগ জানিয়ে গেলে, তোমার সন্তানকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে দেবে। এটাই বাড়ির পরম্পরা।

কিন্তু কবির কোনও সন্তান নেই!

তাঁর শীর্ণ হাতের আঙুলে অদৃশ্য সূক্ষ্ম ছুঁচের মতো আঘাত করে যাচ্ছে ঘড়ি, ভোর রাত থেকে– টিক টিক! টিক টিক!!

বৃদ্ধ কবি দুর্বল শরীরে উঠে গিয়ে জানলা খোলেন। খড়খড়ি দেওয়া কাঠের জানলা। বাইরে নবীন আলোয় ভরে গেছে পৃথিবী। সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ বিড় বিড় করে বলেন, “আর কি সময় আছে?”

উত্তর কেউ দেয় না। তবু বৃদ্ধ রোজকার মতো শুনে নেন পছন্দের উত্তর– আছে। সময় আরও আছে।

লেখার টেবিলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধ ভাবেন, তাহলে কবিতাটা শেষ করে নিই।

আধ লেখা পাতায় আর একটা লাইন জুড়তেই রোদ এসে লুটোপুটি খায় তার পায়ে। আরও দুটো লাইন লেখেন বৃদ্ধ কবি। লাফ দিয়ে রোদ তার কোলে উঠে বসে। বসেই থাকে, যেন সে আদুরে বেড়াল একটা। চাইলে কবি তাকে পুষতে পারেন। না চাইলে দুষতে পারেন।

সে কিছু মনে করবে না। কারণ সে নিরুপায়। তার কাজ তো তাকে করতেই হবে। সে চোর। সময় চোর। সবার সময় চুরি করে বেড়ানোই তার কাজ।

কবিরও সময় তাকে চুরি করতেই হবে। কারণ কবিরাও তো জন্মায়। ওয়ার্কশপে তৈরী হয় না।

এসব কথা রোদ কবিকে বলে না। কবিও কিছু বলেন না রোদকে। তবু তাদের মাঝের ব্যবধানটুকু ফাঁকা পড়ে থাকে না। থেকে থেকে সেখানে শব্দ ওঠে — টিক টিক! টিক টিক!!

কবি জানেন ঘড়ি এমনটা করে না। যদি না গুরুতর কোনও কারণ থাকে।

হয়ত আজ কারণ আছে। তাই অসম্পূর্ণ কবিতা আজ আর ছেড়ে রাখা যাবে না কালকের জন্য। শেষ লাইনের শেষ শব্দ লিখে রেখে যেতে হবে তাকে। আজই।

হয়ত রোদও তাই চায়। সম্পূর্ণ হোক কবিতা। তাই সে এতক্ষণ ধরে চুপটি করে বসে আছে তার কোলে। যেন সে এক সকালেই কবিকে ধরে দেবে অনেক সকাল। এক দুপুরেই ধরে দেবে অনেক দুপুর। যাতে ভোর থেকে রাতে পৌঁছতে তাকে পেরোতে হয় অসংখ্য সকাল। অসংখ্য দুপুর।

কারণ, কবিকে অমর হতেই হবে…, হতেই হবে! মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছে রোদ্দুর!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *