অভীক মুখোপাধ্যায়
রঘু আর সুলতার তিনটে ছেলেমেয়ে। বড়টা ছেলে, আর দুই মেয়ে। মেয়ে দুটো যমজ। ছেলে সদ্য স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল। এখন লকডাউনে স্কুল বন্ধ।
সুলতা ভোর-ভোর ওঠে। সাতটার মধ্যে রান্নাবাড়া সব রেডি। রঘুকে সারাদিনের জন্য টিফিন গুছিয়ে দেয়। রঘু একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। বাড়ি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে। আগে ফ্যাক্টরির গাড়িতে তুলে নিয়ে যেত। লকডাউনের পরে সব বদলে গেছে। গাড়ি তো দূরের কথা, ওর কাজটাই এখন নেই। ইদানিং আবার পথেঘাটে লোক নামছে। এদিকটায় অনেক মাটি-কাটার গাড়ি চলে। সেরমই একটা গাড়িতে করে লাস্ট দুদিন ও ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে -আসছে। যেতে দশ টাকা, ফিরতে আবার দশ — মোট কুড়ি। কিন্তু ওই যাওয়া-আসাই সার। কাজ নেই। আরও ঊনসত্তর জনের সঙ্গে ও-ও ছাঁটাই হয়ে গেছে। মালিক নোটিস দিয়েছে বাজার মন্দা। কিচ্ছু করার নেই।
আজ আবার যাচ্ছে রঘু। সুলতা খাবারের ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল—‘এই নাও টিপিনটা।’ রঘুর হাতে সে দুটো দশ টাকা কয়েন দিল। ভাড়া বাবদ। বড়-বড় চাকতি দুটোকে রঘু সটান বুক পকেটে চালান করে দিতেই হাঁই হাঁই করে উঠল সুলতা—‘এক জায়গায় রাখবে না। যদি যাওয়ার সময় ভাড়া দিতে গিয়ে অন্য কয়েনটাও পড়ে যায়? ফেরার টাকা থাকবে না। ওই অতটা রাস্তা কি পরিযায়ী শ্রমিকদের মতো হেঁটে ফিরবে নাকি?’
‘হ্যাঁ, এমনিতেই টাকাগুলো ফালতু যাচ্ছে। পরশু থেকে বেরোচ্ছি। কাজ নেই। জমা টাকা শেষ হয়ে আসছে। কী যে হবে?’
‘মায়ের দয়ায় সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ঘরের কোণে বসানো মা লক্ষ্মীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে কপাল ঠোকে সুলতা।
রঘু বেরিয়ে যেতেই বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে দেয় সুলতা। বিছানা ঝাড়ে। ঘর পরিষ্কার করে। জল তোলে। পাড়ায় সে মাথা উঁচু করে চলে। সে জানে, অন্য পুরুষেরা মদ খেয়ে, মেয়েবাজি করে টাকা নষ্ট করে; কিন্তু তার বরের ওসব রোগ নেই। সন্ধে হলে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে রঘুকে ফিরতে হয় না। রঘুর কাছে পরিবারই সব। ফ্যামিলি ফার্স্ট। সব পরিশ্রম, সব কষ্ট মুহূর্তে মুছে যায় সুলতার মন থেকে। জলের ঘড়াটাকে রান্নাঘরের তাকের নীচে ঢুকিয়ে মুখটা চাপা দিয়ে সে ভাবে, ‘সবই তো মায়ের দয়া।’
কাজ না-পেয়ে দুদিন রঘু বেলা দুপুর থাকতেই ফিরে পড়ছিল। ছ’টা বেজে গেছে, তবুও আজ ফেরেনি। সুলতা ভাবে, ‘মনে হয় কাজ পেয়েছে।’ এখন ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে খুব দরকার না-পড়লে রঘু বাইরে মোবাইল ব্যবহার করছে না। তাই জানায়নি। অবশেষে রঘু ফিরল। যেভাবে কোনোদিন বাড়ি ফেরেনি, সেভাবেই ফিরল। দুজনের কাঁধে ভর করে। সুলতা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। লকডাউনে ফ্যাক্টরি টানা বন্ধ ছিল বলে মেইনটেনেন্স হয়নি। কোনো একটা ট্যাঙ্ক থেকে গ্যাস লিক হয়ে কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একজন মারা গেছে। তিনজন হসপিটালাইজড। রঘুর কন্ডিশন সিরিয়াস নয়। তাই বাড়ি দিয়ে গেল। ফ্যাক্টরির মালিক বলেছে, যে মরে গেছে, তার পরিবারকে দু’লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। অসুস্থদের পরিবারপিছু দেবে কুড়ি হাজার করে। সুলতা মনে মনে মা লক্ষ্মীকে প্রাণ্ম জানায়—‘যাক, প্রাণটা বেঁচে গেছে, আবার কুড়ি হাজার টাকাও আসবে। সবই তোমার দয়া, মা!’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অনেক পরিবারের এটাই বাস্তব পরিস্থিতি। এই ছোট্ট গল্পটাই একটা জীবন কাহিনী বলে গেল।