কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সবে শীতটা চলে যাচ্ছে। রাতের দিকে এখনও শিরশিরে একটা হাওয়া দেয়। গায়ে পাতলা একটা চাদর দিলে ভালো লাগে। কিন্তু সকালবেলাতেই আবহাওয়া যেন একেবারে ডিগবাজি খেয়ে বদলে যায়। কী আশ্চর্য ব্যাপার! রোদে তো দাঁড়ানোই যায় না, এমনকি রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় পুরোপুরি গ্রীষ্মকাল এসে গেছে।
সেকেন্ড ব্রীজ পেরিয়ে রেসকোর্সের সামনে বাস থেকে নেমে শুভেন্দুর তাই মনে হচ্ছিল। কতকাল পরে আবার বাসে চাপল শুভেন্দু। দশ মাস তো হবেই। কোভিড মহামারীর কারণে সেই যে মার্চের শেষে লকডাউন শুরু হল, তারপর থেকে আর বাসে-ট্রামে চড়া-ই হয়নি। যদিও এই দীর্ঘ দশ মাস ধরে সে ঘরে বসে ছিল না। দু-মাসের মাথাতেই অফিস খুলে গিয়েছিল। তবে বাইরে তাকে যেতে হয়নি। ওর অফিস বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। তাই স্কুটারটা নিয়েই সে অফিসে যাতায়াত করেছে এতদিন। মার্কেটিং-এর কাজে যেসব ক্লায়েন্টের অফিসে তাকে মাঝে মাঝে যেতে হত, সেইসব অফিসগুলোও প্রায় খোলেনি, আর খুললেও লোকজনের আসা-যাওয়া খুবই কম ছিল। বেশির ভাগ অফিসেই ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম।
অবশেষে এতদিন পরে কলকাতায় কোভিডের প্রকোপটা কমেছে। অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সবকিছু। বাস-ট্রাম তো অনেকদিন আগে থেকেই চলছে। ট্রেনও চালু হয়েছে দীর্ঘদিন পর। আর মোটামুটি সব অফিসই খুলে গেছে। সুতরাং কাজের চাপও বেড়েছে। আর তারই ফলে শুভেন্দুর আবার বেরোনোর পালা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা হেঁটে বড়রাস্তার মোড়ে এলে তবেই বাস ধরতে পারে শুভেন্দু। আজও তাই করেছে। ক্লায়েন্টের অফিসটা আলিপুরের কাছে। ওখানে যেতে গেলে তাকে দুটো বাস পাল্টাতে হয়। তা হয়েছে কি, প্রথম বাসটায় উঠেই সে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল। এ কী রে বাবা! সবকিছু যেন হঠাৎ অচেনা মনে হচ্ছে! সেই প্রাণান্তক ভিড় কোথায়? এই অফিসটাইমে যেখানে বাসে পা গলানোর জায়গা পাওয়া যেত না, সেখানে ফাঁকা বাসটায় সবাই সীটে বসে যাচ্ছে। প্রত্যেকের মুখে মাস্ক পরা। শুধু চোখদুটো খোলা। তা দেখে কাউকে চেনা যাচ্ছে না। যেন একদল ডাকাত একসঙ্গে ডাকাতি করতে যাচ্ছে কোথাও।
অবশ্য একটু পরেই ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেল শুভেন্দু। তাই রেসকোর্সে নেমে পরের বাসে উঠে আর কিছু মনে হয়নি তার। প্রায় একইরকম দৃশ্য, বরং এই বাসটায় হাল্কা ভিড় আছে। দু-চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়েও আছে।
পরের স্টপেজেই বাসে উঠল এক মহিলা, সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে, হয়তো তারই মেয়ে। ছেঁড়া ময়লা পোশাক, গলায় ঝোলানো একটা বাক্সের মতো যন্ত্র। উঠেই যন্ত্রটা চালু করল মহিলাটি। তাতে রেকর্ড করা গান বেজে উঠল, সেই সঙ্গে গলা মেলালো মহিলা। আর বাচ্চা মেয়েটি ঘুরে ঘুরে হাত পাততে লাগল সবার কাছে।
পরিচিত দৃশ্য। এইভাবে ভিক্ষা চাওয়া বহুদিন ধরেই দেখে আসছে শুভেন্দু। তাই তার প্রথমে কিছু মনে হয়নি। বাচ্চা মেয়েটা ওর কাছে এসে পৌঁছলে পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিল সে। ওর পাশে মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একবার তাকিয়ে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বাচ্চা মেয়েটি একবার তাঁর জামার হাতায় টান দিল। ভদ্রলোক হাত সরিয়ে নিলেন।
শুভেন্দুর কাছে এটাও খুব পরিচিত দৃশ্য। তাই খুব একটা অবাক হয়নি। কিন্তু এর পরের ঘটনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
বাসটা তখন দুটো স্টপেজ পেরিয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়েটি এগিয়ে গেছে পেছনের দিকে। সেই ভদ্রলোকটির বোধহয় নামার সময় হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তড়বড় করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুক মহিলাটি তখনও গান গেয়ে চলেছে। হঠাৎ ভদ্রলোক বুকপকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বার করলেন, তারপর পেছন থেকে বাঁ হাত দিয়ে মহিলাটির গায়ে হাত বোলালেন, আর ডান হাত দিয়ে এগিয়ে দিলেন কয়েনটা।
মহিলাটি চমকে উঠে তার গান বন্ধ করল, তারপর এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোন অসহায়তা নেই, আছে চরম ঘৃণা আর ক্রোধ। তীব্র ক্রোধে ভদ্রলোকের কয়েন ধরা হাতটায় একটা ধাক্কা মারল মহিলাটি, তারপর এগিয়ে গেল পেছনের দিকে।
শুভেন্দুর মনে হল, মহামারী এখনও যায়নি, সে আছে, থাকবেও।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারণ একটা গল্প
ভালো লাগলো l