micro-story-mohanlaler-gero

মোহনলালের গেরো
সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়


প্রথম যেদিন মালিনী কথাটা বলল মোহনলাল পাত্তাই দেয়নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বউয়ের কল্পনাশক্তির তারিফও করেছিল একটু। কিন্তু মাসখানেক পর আবারও সেই একই কথা।

মোহনলাল একজন প্রতিথযশা লেখক। সারাদিন সভাসমিতি, গল্পপাঠ, উদ্বোধন ইত্যাদিতে কাটে তার। শুধু রাতের খাওয়া সেরে একটি ঘন্টা তার একার। হাতে বিলিতি পানীয়, কানে বিসমিল্লার সানাইয়ে সারং, পিলু, খাম্বাজ। সুরের চলনের সাথে সাথে গল্পের প্লট বোনে সে। সুর ওঠে নামে। মীড়ের কাজের মত গল্পে মোচড় তৈরি হতে থাকে। এসময় মালিনী আসেনা। কিন্তু সেদিন এল। তপতপে গলায় বলল “তুমি বন্দিনীর গান নামে একটা গল্প লিখেছ?”
“হ্যাঁ লিখেছি”
“তাতে নায়কের শালির বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কথা আছে?”
“হুম্‌, আছে”
“সোহিনী ফোন করেছিল। ওদের বিয়েটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। তোমাকে বলেছিলাম আজেবাজে লেখা বন্ধ কর। দেখলে তো? এজন্য তুমিই দায়ী, তুমিই”
মোহনলাল অবাক হয়ে যায়। সোহিনীর বর একটা যাচ্ছেতাই লোক। বিয়েটা এমনিই ভাঙত। আর ডিভোর্স এখন ঘরে ঘরে। মাঝখান থেকে সে দায়ী মানে!
কদিন পরেই আবার টেবিলে একটা ম্যাগাজিন আছড়ে পড়ল – “নাও। আর কত প্রমাণ চাই তোমার?” মালিনী একটু ভারিক্কি সুন্দরী। রাগ রাগ মুখে এসে দাঁড়ালে কেমন একতাল শক্ত মাখনের মত লাগে। মোহনলালের ইচ্ছে করে বউকে বুকের কাছে টেনে একটু সোহাগতাপ দিয়ে মাখন গলিয়ে দিতে। সাহস হয় না। জিজ্ঞেস করে “কিসের প্রমাণ?”
“এই যে, তুমি যা লিখছ তাইই আমাদের জীবনে ঘটছে, সেই প্রমাণ”
“আরে! এরকম হয় নাকি! কী বাজে বকছ কদিন ধরে!”
“হচ্ছে তো! তবে ভালোগুলো হচ্ছে না। সেই যে “আকাশ পাড়ি” গল্পের ছেলেটা কেমন বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল প্রেম করে তেমনটা রিন্টুর হচ্ছে কই। তবে খারাপ সবই মিলছে। এই যে এখানে লিখেছ নায়ক এটিএম কার্ড হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছে, এবার বোঝ। রিন্টু সকাল থেকে এটিএম কার্ড খুঁজে পাচ্ছে না। এখনও বিশ্বাস করবে না?”
মোহনলাল নড়ে বসে। লেখার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করছে ভেবে হাসিও পেয়ে যায়। তবে দেখা গেল মালিনীর আশঙ্কা সত্যি করে আরও দুবার এমনটাই ঘটল। একবার গল্পের নায়িকা পুজোয় বসে আঁচলে আগুন লাগিয়ে ফেলল, তার দুদিন পরেই মালিনীর ম্যাক্সি কি করে যেন আগুনে একটু পুড়ে গেল রান্নাঘরে। মোহন অবশ্য বলছিল শাড়ি আর ম্যাক্সি এক নয়, ঠাকুরঘর আর রান্নাঘরও না। কিন্তু ধোপে টিকল না।
পরেরটি আরও মারাত্মক। মোহনের এক গল্পে নায়িকার মা ঘুমের ওষুধ ভুল ডোজে খেয়ে ফেলে শয্যাশায়ী। কদিন পরেই মালিনীর মায়ের হাইপার টেনশনের জন্য ডাক্তার তাঁকেও ঘুমের ওষুধ লিখে দিলেন। মালিনী নিশ্চিত গল্পের মতই তার মাও শেষে শয্যাশায়ী পঙ্গু হয়ে যাবে।
মোহন উপায় বাতলালো, ওষুধ না খেলেই তো হয়! তার চেয়ে রাতে তিরিশ মিলি পানীয় বা আফিম দেওয়া যাক। তেলেবেগুনে জ্বলে মালিনী এবার কড়া পদক্ষেপ নিল। সব লেখা আগে সে পড়বে তারপর প্রেসে যাবে। ভুলভাল বিপদজনক যা থাকবে সব বাদ।
শুনে তো মোহনের মাথায় হাত। এভাবে লেখা যায় নাকি? ক’দিন বিমর্ষ লেখাহীন কাটল। কিন্তু লেখা গেলে জীবনে রইল কী? শেষে একদিন দুত্তোর বলে মোহনলাল আবার বারান্দায় গিয়ে বসে।
রাতের আঁধার, করুন সুরে সানাই, আর বিলিতি তরলের মেলবন্ধনে ধীরে ধীরে মোহনলালের পিঠ সোজা হয়, মস্তিষ্ক জাগতে থাকে।
সারা রাত ধরে সে লিখে চলে এক পতিব্রতা নারীর প্রশ্নহীন আনুগত্যের গল্প। এক নারী, যার কাছে স্বামীর ইচ্ছাই শেষ কথা, স্বামীকে খুশি রাখাই একমাত্র কর্তব্য, স্বামীর প্রতিটি বাক্যই বেদবাক্য তেমন এক নারীর গল্প লিখতে লিখতে ভোর হয়ে আসে। সকালের চা টুকুর অপেক্ষাও করে না মোহনলাল। আলো ফুটতেই লেখাটি নিয়ে পত্রিকা দপ্তরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মনে ক্ষীণ আশা। হয়ত মালিনীর কথাই ঠিক। দেখাই যাক শেষ চেষ্টা করে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-mohanlaler-gero

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *