চিরকালই একটু বোকাসোকা মধুজা। বোকাসোকাই বলে তার মত মেয়েদের এখন। সরল সাদাসিধে গোছের। খুব বেশী মেটিরিয়ালিস্টিক হয়ে উঠতে পারেনি এখনও সে। মলে ঘোরার থেকে বাগানে বেড়াতেই তার বেশী ভাললাগে। হোটেলের ধোঁয়া ওঠা খাবারের প্রস্তাব এলে নাকচ করে নিজে হাত পুড়িয়ে লোককে খাইয়ে আনন্দ পায় ঢের বেশী। অত ছক কষে হিসেব নিকেশ করে জীবনে চলতে শেখেনি। তাই বলে সে যে শিক্ষিত নয় –এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। অংকে যা একটু কাঁচা। তাতে অবশ্য জীবনে তার কিছুই আটকায়নি। সে হেসে খেলে সবার সাথে মানিয়ে ভালভাবে থাকার চেষ্টা করেছে। স্বভাবে সে বাধ্য ছিল, তাই যতদিন মাথার ওপর শ্বশুরমশাই শ্বাশুড়িমা ছিলেন কোন অসুবিধে হয়নি তার। তারপর তারা গত হলে সংসারের ভার তার কাঁধে চাপলে একটু মুশকিলে পড়েছিল বটে মধুজা কারণ তাঁকে পরিচালনা করলে সে ঠিক থাকে। স্বাধীনভাবে বড় বেশী চলতে পারে না। তবে তার স্বামী সমীরণের তুলনা নেই। সে সবসময় পাশে ছিল বলে তার তেমন কোন অসুবিধে আর হয়নি।
দিনে দিনে সংসারের বেড়াজালে আটকে পড়ে কিরকম হাঁপিয়ে ওঠে সে আজকাল। এত বড় বাড়ি— তার রক্ষণাবেক্ষণ —কাজকর্ম —আজকাল আর যেন সে পেরে উঠছে না। মেয়াদ ফুরিয়ে এল বুঝি—! একটু অবকাশের জন্য আজকাল তাই হাঁটতে বেরোয়। বাড়ির পূব দিকে গেলে বড় একটা জলাশয় আছে। সে ঐ জলাশয়ের ধারে গিয়ে সিঁড়িতে বসে থাকে আনমনে। প্রকৃতির মাঝে সময়টা বেশ ভালই কাটে।
ওখানে বসে থাকতে থাকতেই মধুজা রোজ দেখতে পেত এক পুরুষ মানুষ হাঁটতে আসেন আর তার দিকে তীব্র কটাক্ষ করেন। দু একদিন চোখে যেন আহ্বানের হাতছানিও নজরে পড়েছে মধুজার। আগে এইসব বুঝতে পারত না কিন্তু আজকাল বয়সের সাথে সাথে তার যেন এই অনুভূতিগুলি তীব্র হচ্ছে। আজকাল আবার একটু সাহস বেড়েছে মহাশয়ের। একদম বিপরীত দিকে বসে মধুজার। জলাশয়ের এপারে যদি বসে মধুজা তো বিপরীত দিকে একটা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসতেন তিনি। শান্ত মধুজাকে অবশ্য বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। তবে তার নতুন অনুরক্ত তার প্রতিটা পদক্ষেপ নিপুণভাবে লক্ষ্য করে। আজকাল তার বেশ কাছেও ঘোরাফেরা করে। তারপর আচমকা একদিন নিজের মোবাইলের ক্যামেরায় তার ছবি তুলে নিয়ে গেল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, —–কোম্পানিটার নাম জানা দরকার। মধুজা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজকাল কেন জানি বেশ ক্লান্ত লাগে তার।
সেদিন বাড়িতে কাজ করতে করতে আচমকা মধুজা কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেল। রোববার ছিল দিনটা। শারীরিক সুখ তেমন দিতে পারে না বলে মধুজা জানে সেদিন সমীরণ একটু ডেটিং এ যায়। ভাল লেগে গেলে একসাথে শোয় দুজনে। বিয়ের আগে থেকে এমন কথা তাঁদের বলাই ছিলও। মধুজার শিক্ষাই এমন যে সে এর বিরুদ্ধে কখনও সোচ্চার হয়ে ওঠেনি। ধীর পায়ে রান্নাঘর থেকে মধুজা বাইরে এল। দেখল তার সেই পুকুরপারের ভক্ত ব্যাক্তি হাজির। তাঁকে দেখেই এক গাল হাসি। মধুজা ভেবে পেল না তার কি করা উচিত। সমীরণও এখন বাইরে। ভদ্রলোক মোবাইল কানে তুলে কাকে যেন ফোন করলেন। দুটো ফোন করলেন পরপর। কিছুক্ষনের মধ্যেই সমীরণ এল গাড়ি ভর্তি কিছু লোকের সাথে।
সমীরণ এবং কোম্পানির লোগো লাগানো কিছু ব্যাক্তি ঢুকতেই ভদ্রলোক বললেন, —– আমার কিন্তু রোম্যান্টিসিসমও কিছু চাই। কোম্পানির লোক জানাল,
—- তাহলে তো চিপ বদলাতে হবে। —- হ্যাঁ আমি শুধু শান্ত শিষ্ট গৃহকর্মে নিপুনা বৌ চেয়েছিলাম। এর বাইরে কিছু তেমন জানে না। তবে ইদানীং যেন একটু কনশিয়াসনেস জেগে উঠছিল। নদীর ধারে বেড়াতে যেতে চাইত। একঘেয়েমি, ক্লান্তি গ্রাস করত। —- ঠিক আছে আমরা দেখে নিচ্ছি।
মুহূর্তে মধুজাকে চেপে ধরে তার কানের পাশে চুলির গুছির কাছে একটা সুইচ টিপতেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। এইবার সেই প্রাণহীন যন্ত্রমানবীর ওপর সবাই ঝুঁকে পড়ল। এবার নতুন গ্রাহকের জন্য হয়তো সে প্রয়োজন অনুযায়ী তপতী বা স্বপ্না হয়ে উঠবে—সব উপাদান দিয়ে সেজে উঠবে মনের মত গৃহবধূ।
—-বৈশাখী ঠাকুর
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন