মনের স্যুটকেস

মনের স্যুটকেস
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়

ডক্টর সরকার আমার চোখের সামনে থেকে আতস কাঁচটা সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখে প্রেসক্রিপশনের কাগজগুলো দেখতে থাকলেন।
আমি জানি এরপর উনি কী বলবেন। ভবিতব্য তো আর উনি আজ আমাকে প্রথম শোনাবেন না। ভেলোর থেকে পুণে, অনেক বড় বড় হাসপাতালের নামি দামি ডাক্তাররা আগেই নিদান দিয়ে দিয়েছেন। চোখের নার্ভ ক্রমশ শুকিয়ে যেতে যেতে আমি প্রায় অন্ধত্বের চৌকাঠে পৌঁছিয়ে গিয়েছি। আর কয়েকটা দিন মাত্র। পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে ডক্টর সরকারের ফিজটা বার করে এগিয়ে দিয়ে মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটিয়ে বললাম, “তাহলে আর ঠিক কতদিন ডাক্তারবাবু?”
ডক্টর সরকার আমার হাতে ধরা ফিজের টাকাটা আলতো করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গলাটা একটু খাঁকরিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, “ওয়েল, আপাতত আমি বলব মনের জোর রাখুন। চিকিৎসা পদ্ধতির রোজ উন্নতি হচ্ছে। নতুন নতুন ওষুধ বেরচ্ছে। অপারেশন, আই ট্রান্সপ্লান্ট…”
আমি ডক্টর সরকারের বাইশ বছরের পুরনো পেশেন্ট। বুঝতে পারছি ডক্টর সরকার মুখ ফুটে আন্দাজ দিতে পারছেন না ঠিক কবে থেকে আমি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাব। ব্যাপারটা আমাকে খানিক বুঝিয়ে বলেছিলেন দক্ষিণের এক ডাক্তারবাবু। হটাৎ একদিন আমি ঘুম থেকে উঠে দেখব আর আমি চর্মচক্ষুতে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। সেদিন থেকে আমি এক অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যাব। কেমন সেই জগত? আমি চোখ বন্ধ করে একটু একটু করে সেই জগতটা তৈরি করতে আরম্ভ করে দিয়েছি কয়েক মাস ধরে। সত্যি কথা বলতে এখন আমার সেই জগতে যাওয়ার একটা মৃদু ছটফটানিই হয়।
আমার ঠাকুমার আট বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তখনকার দিনে বাল্যবিবাহ। বিয়ে জিনিসটা কী ওইটুকু বয়সের একটা মেয়ে বুঝবে কিকরে? ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করতাম, “ভয় করেনি তোমার?“
ঠাকুমা বলত, “না। তখন চোখ বুঁজে শ্বশুরবাড়িটা কেমন হবে ভাবতাম। দেখতে পেতাম সেখানে অনেক সুখ, অনেক আনন্দ।“
“তা, মিলেছিল তোমার স্বপ্নের জগত?”
ঠাকুমা আমার মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে উদাস গলায় বলত, “সব কথা সবাইকে বলতে নেই ভাই। তবে পালকি চড়ে যা মনের স্যুটকেসে ভরে এনেছিলাম তোদের এই বাড়িতে, এই জীবনে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। এই যেমন তোকে।”
আমি জানি আট বছর বয়স থেকে আমাদের বাড়িতে ঠাকুমাকে অনেক কঠিন সাংসারিক লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু ঠাকুমা আট বছর বয়সে মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে আসা স্যুটকেসটা কখনও হারিয়ে ফেলেনি। শুধু লাল টুকটুকে বেনারসী আর এক গা গয়নাই নয়, ঠাকুমা মনের স্যুটকেস বোঝাই করে খেলনাবাটি, পুতুল, তেঁতুলের আচার, সই‘দের নাম আরও অনেক অনেক কিছু নিয়ে অন্য জগতে এসেছিল। আমি এখন ঠিক সেরকমই একটা প্রস্তুতি শুরু করেছি। আমি মনের স্যুটকেসে গোছাতে শুরু করেছি, এই জগত থেকে মন বন্দি করে কী কী দৃশ্য অন্য জগতে নিয়ে যাব।
ডক্টর সরকারের চেম্বারের থেকে বেরলাম। আকাশটা ছাই মেখে রয়েছে। এলোমেলো ভিজে হাওয়া বইছে। বাজারের মোড়ের কাছে সেই গণ্ডগোলটা এখনও চলছে। একটা চোর ধরা পড়েছিল। পলাশ গাছটার তলায় ওর গণ ধোলাই চলছে। আসার সময়েই দেখেছিলাম। এখন মার খেতে খেতে ছেলেটা বেশ ঝিমিয়ে পড়ছে। আর কিছুক্ষণ পর হয়ত মরেই যাবে। আগে এইসব দৃশ্য একেকটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। দাঙ্গায় বাড়ি জ্বলছে, লুঠপাট হচ্ছে। পার্কে ছেলেমেয়েগুলোর ঝোপের আড়ালে শরীরি ভালবাসায় মত্ত। আরও কত কিছু। কিন্তু এখন অন্য জগতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার মনের স্যুটকেসটা বড্ড ছোট। দৃশ্য বেছে বেছে নিয়ে যেতে হবে। ওই যে ছেলেটা মার খেতে খেতে মরে যাচ্ছে আর ওর ওপর এলোমেলো হাওয়ায় ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়ছে লাল টুকটুকে পলাশের পাপড়িগুলো, আমাকে ওই পাপড়িগুলোই মনের স্যুটকেসে ভরে নিতে হবে। ওই যে এক সুন্দরী ওর উষ্ণ স্তনযুগলের বিভাজিকার নিচে ধরে আছে ছোট্ট কুকুরছানাটাকে, ওই একরত্তি কুকুরছানাটাকে মনের স্যুটকেসে ভরতে হবে। ওই যে কার ছেঁড়া পকেট গলে এক টাকার একটা কয়েন শ্যাওলা ধরা একটা নুড়িতে ঠোক্কর খেয়ে চকচকে গায়ে লোভ দেখাচ্ছে, আমাকে ওই নুড়িটা মনের স্যুটকেসে ভরে নিতে হবে।
দক্ষিণ দিক থেকে ছাই মাখা আকাশে একটা ঘন কালো মেঘ পর্দা টানার মত এগিয়ে আসছে। ঝুপ ঝুপ করে পৃথিবীর আলো নিভে যাচ্ছে। আমি পুরু চশমার কাচের ভেতর দিয়ে চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, মনের স্যুটকেসে আর কী কী ভরব। জায়গা কম। সময় কম। আমি হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি, দৃশ্য, দৃশ্য, দৃশ্য।
হটাৎ ঝড় উঠল। ভীষণ ধুলোর ঝড়। দু‘হাতে মুখ ঢাকলাম। এক সময় ঝড় থামল। আস্তে আস্তে মুখের ওপর থেকে হতটা সরালাম। আঃ! কী সুন্দর জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চারদিক। কী সুন্দর সবজে নুড়ি বিছানো একটা পথের ওপর লাল পলাশের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। আমার আর চশমা লাগছে না। ফুরফুরে মনে আমি লাঠি ঠুক ঠুক করে এগোতে থাকলাম আমার নতুন জগতের পথ ধরে।
সেই পথের মাথায় একটা পালকি চলেছে, “হুম না… হুহুম না… হুম না… হুহুম না…“
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “মনের স্যুটকেস

  1. মিস্টার মুখোপাধ্যায়, আপনার লেখা এই অণুগল্প চেনাল, আপনি কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। অসাধারণ, অনবদ্য শব্দগুলো ব্যবহারে ব্যবহারে বড় ক্লিশে হয়ে গিয়েছে! এমন অণুগল্প যে, শেষ করেও মনের মধ্যে বহু সময় ধরে রয়ে গেল টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়ার ঝরা পাপড়ি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ! পড়লাম ? না কি ছবি দেখলাম!
    একটা বিনীত জিজ্ঞাসা :- “তাড়িয়ে তাড়িয়ে” হবে না কি “তারিয়ে তারিয়ে” ? জানালে খুশি হব।

  2. মিস্টার মুখোপাধ্যায়, আপনার লেখা এই অণুগল্প চেনাল, আপনি কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। অসাধারণ, অনবদ্য শব্দগুলো ব্যবহারে ব্যবহারে বড় ক্লিশে হয়ে গিয়েছে! এমন অণুগল্প যে, শেষ করেও মনের মধ্যে বহু সময় ধরে রয়ে গেল টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়ার ঝরা পাপড়ি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ! পড়লাম ? না কি ছবি দেখলাম!
    একটা বিনীত জিজ্ঞাসা :- “তাড়িয়ে তাড়িয়ে” হবে না কি “তারিয়ে তারিয়ে” ? জানালে খুশি হব।

  3. মিস্টার মুখোপাধ্যায়, এই অণুগল্প চিনিয়ে দিল, আপনি কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় । অসাধারণ, অনবদ্য…ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহারে ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে! এমন উঁচু মানের অণুগল্প খুব বেশি পড়িনি! পড়া শেষ করার পরেও চোখের সামনে উড়ে বেড়াতে লাগল টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়ার অজস্র ঝরা পাপড়ি…!
    একটা বিনীত জিজ্ঞাসা :- “তাড়িয়ে তাড়িয়ে” হবে? না কি হবে “তারিয়ে তারিয়ে”? জানাবেন প্লিজ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *