মৌমিতা তারণ
আজকাল সিধুদাকে দেখলে খুব রাগ হয় অপরাজিতার। একটা মানুষ কতখানি নির্মম আর নিষ্ঠুর হলে তবে এমন কাজ করতে পারে। তাদের সকলের শৈশব, কৈশোর, যৌবন সবকিছু গাঁইতির ঘায়ে দুরমুশ করে দিচ্ছে সিধুদা। বলা ভাল দুরমুশ করার ঠেকা নিয়েছে।
বিয়ের পর থেকে পনেরো বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরে আছে কলকাতার মেয়ে অপরাজিতা। কলকাতা ছাড়লেও কলকাতা সারাক্ষণ অপরাজিতার সঙ্গে থাকে। বিশেষ করে নিজের পাড়া এখনও তাড়া করে বেড়ায় অপরাজিতাকে। বছরে একবার বাপের বাড়ি আসে। কেবল মা বাবার টানে নয়, সমান টান অনুভব করে নিজের পাড়ার উপর। পাশের বাড়ির রাঙাকাকু প্রতিবার দেখামাত্রই জিজ্ঞাসা করবে, “কী রে কতদিনের ছুটি দিল রাজর্ষি এবার?”
আজ যেন রাঙাকাকুকে একটু বিষন্ন দেখাল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে শুধু বলল, “পরের বার এসে দেখবি তোর রাঙাকাকু আকাশে পৌঁছে গেছে।”
— কী আজেবাজে কথা বলছ, রাগ করে অপরাজিতা।
— আরে রাগ করিস না। সত্যি সত্যি আকাশে যাচ্ছি না। আকাশের কাছাকাছি যাচ্ছি। ছ’তলার ব্যালকনিতে বসে এবার থেকে আকাশ দেখব। সিধুর সঙ্গে ফাইনাল কথা হয়ে গেছে।
— যাহ্, শেষে তোমার বাড়িতেও গাঁইতির ঘা ফেলবে সিধুদা?
অপরাজিতার কথায় হো হো করে হেসে ওঠে রাঙাকাকু। সে হাসিতে মিশে থাকা সূক্ষ্ম বিষন্নতা টের পায় অপরাজিতা।
মন কি কেবল একা রাঙাকাকুরই খারাপ? অপরাজিতার মনও কেঁদে ওঠে। রাঙাকাকুদের বাড়ির ভেতরের সিঁড়িটা যে বড় প্রিয়। এই সিঁড়ির তলায় বাঁধা থাকত রাঙাকাকুদের কুকুর জন। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে নন্দার সঙ্গে খেলতে যেত অপরাজিতা। রাঙাকাকুর মেয়ে নন্দা অপরাজিতার বন্ধু। ছাদে ওঠার আগে জনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করত অপরাজিতা। চুপটি করে মাথা নামিয়ে আদর খেত জন। জন মারা যাওয়ার পরও রাঙাকাকুরা ওর গলায় বাঁধা শিকল সিঁড়ি থেকে খোলেনি। কতবার সেই শিকলে হাত বুলিয়েছে অপরাজিতা। আজ আরও একবার ইচ্ছে হল হাত বুলোতে।
তার প্রিয় পাড়ার চেহারা বদলে যাওয়াটা অপরাজিতাকে খুব কষ্ট দেয়। পাড়ার পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হচ্ছে। সেইসব ফ্ল্যাটে আসা মানুষেরা অপরাজিতার অচেনা। এই অচেনাদের ভিড়ে এককোনায় একটা ফ্ল্যাটে পড়ে আছে অপরাজিতার চেনা কাকা, মাসিমা, মেসো, জেঠুরা। গতবার এসে দেখেছিল সেনজেঠিদের বাড়িতে গাঁইতির ঘা পড়ছে। পাশের পাড়ায় অস্থায়ী আবাস তখন সেনজেঠিদের। একবছর পর তারা আবার ফিরবে নিজ বাসভূমিতে। তবে সেই নিজ বাসভূমি তখন ভাগ হয়ে যাবে আরও অনেকের সঙ্গে। সেনজেঠিদের বাইরের রকে গাঁইতির ঘা পড়ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপরাজিতা দেখেছিল কীভাবে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তার বালিকাবেলার এক্কা দোক্কা খেলার রক। শ্যামলমেসোদের পুরনো বাড়ির জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা চারতলা কামিনী আবাসনের দিকে তাকালে অপরাজিতার মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার লুকোচুরি খেলা। এখানে যখন মাটি খুঁড়ে ভিত বানিয়ে শ্যামলমেসোদের বাড়ি তৈরী হচ্ছিল তখন বিকেলবেলা সেই ভিতের ভেতর ওরা বন্ধুরা লুকোচুরি খেলত। শ্যামলমেসোদের একতলা বাড়ির নামও ছিল কামিনী আবাসন। শ্যামলমেসোর বাবার নাম ছিল কামিনী। বাড়ির উপর গাঁইতির কোপ চালালেও বাড়ির নামের উপর কোপ চালায়নি সিধুদা। যদিও এই নতুন চারতলা বাড়িটায় তার চেনা কামিনী আবাসনের কোনও গন্ধ পায় না অপরাজিতা। পাড়া থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে সুমনদের চিলেকোঠাও। পুজো বা রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পাড়ার ফাংশনের যাবতীয় রিহার্সাল চলতো সেই চিলেকোঠায়। পাড়ায় আসা নতুন মানুষজনের অবশ্য কোনও অসুবিধে হয় না এই চিলেকোঠাহীন জীবনে। পাড়ায় আর ফাংশন হয় না আজকাল। হবে কোথায়? বসুর মাঠও তো দুটো প্লটে ভাগ হয়ে বিশাল দুটো ইমারত উঠেছে সেখানে।
যত এসব দেখে সিধুদার উপর রাগ বাড়ে অপরাজিতার। ডানপিটে হলেও ছোট থেকে সিধুদার বুদ্ধি প্রখর। নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস। পাড়ার অন্যান্য ছেলেরা যখন পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করছে সিধুদা সেসময় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। পড়াশোনায় কোনওদিনই মন ছিল না। একটু বড় হয়েই বুঝেছিল চাকরিবাকরি তার দ্বারা হবে না। অন্যের খিদমত খাটা একদম না পসন্দ। ব্যবসা করতে হবে ব্যবসা। অনেক এপাশ ওপাশ করে শেষে কব্জা করেছিল এই প্রমোটারি ব্যবসা। প্রথমে টুকটাক মেরামতির কাজ দিয়ে শুরু। পাড়ায় সুমনদাদের বাড়ি ছিল সবথেকে পুরনো। সেই বাড়ি ভেঙে তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি বানানোর বরাত সুমনদা সিধুদাকে দেয়। এত যত্নের সঙ্গে সে কাজ সিধুদা করে যে এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পাড়ার পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে চারতলা, পাঁচতলা ইমারত গড়ে তোলার বরাত পেতে থাকে। ইমারতের নীচে চাপা পড়ে যায় কতজনের কত সহস্র স্মৃতি। টের পায় না সিধুদা। নিজের চেনা পাড়া এভাবে পালটে যেতে দেখে মনভার হয় অপরাজিতার। সব রাগ গিয়ে পড়ে সিধুদার উপর।
এবার এসে শুনল সিধুদা নিজের বাড়ির উপর গাঁইতির কোপ বসানোর আয়োজন করেছে। উল্টোদিকের বাড়িটাই সিধুদাদের। আজ সোমবার। সপ্তাহের শুরু। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপরাজিতা দেখল দুজন গাছকাটার লোক এসেছে সিধুদাদের বাড়ির সামনে। গাঁইতি নয় সিধুদার নির্দেশে তাদের হাতের কাটারির কোপ পড়ল বাড়ির গেটের ভেতর পুরনো চাঁপাগাছটার উপর। আর রাগ নয়, হতভম্ব অপরাজিতা একরাশ অভিমান নিয়ে সে দৃশ্য দেখছে এখন। এই সেই চাঁপাগাছ যার তলায় দাঁড়িয়ে এক উদাস করা গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সিধুদা তার ঠোঁটে এঁকেছিল ভালবাসার চুম্বন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব স্মৃতিমেদুর করে দিল এই গল্পটা। এইভাবেই কতো চেনা পাড়া আমাদের অচেনা হয়ে উঠছে প্রতিদিন, প্রতিমাসে! তাই গল্পটি সময়োপযোগী হবার সাথে সাথেই প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তববাদী! মৌমিতাদিকে সাধুবাদ জানাই এই গল্প রচনার জন্য!