ছন্দা বিশ্বাস
মধ্যমগ্রাম কালীবাড়ির মন্দির চত্বরে সেদিন পা দিতেই চোখে পড়ল ভদ্রলোককে। স্মিতা ওর পাঁচ বছরের নাতনী রাইকে নিয়ে গিয়েছিল মন্দিরে। ঘুরে ঘুরে দিদুনকে দেখাচ্ছিল রাধা গোবন্দি, শিব মন্দির, কালী এবং রামকৃষ্ণদেবের মন্দির। প্রায় পাঁচ বছর বাদে স্মিতা এলো ছোট মেয়ের বাড়ি। স্বামী মারা যাবার পরে বহু বছর হল ছেলের কাছে কানাডাতে থাকেন। এই নাতনীটি হওয়ার সময়ে এসেছিলেন, তারপরে এই দেখছেন। ছোটোখাটো মফঃস্বল শহরটা নানান সাজে সেজে উঠেছে। কত ঝা চকচকে আবাসন হয়েছে। কত শপিং মল, নতুন নতুন দোকান পাট। একেবারে জমজমাট পরিবেশ।
প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকেই ডান হাতে রাধা গোবন্দজীর মন্দির। পাশেই নাট মঞ্চে ভাগবত পাঠ হচ্ছে। অনেক মানুষ শুনছেন সেই পাঠ। পাঠক শ্রী নরোত্তম ঠাকুর খুব সুন্দর এবং মধুর বচনে শোনাচ্ছেন কলিযুগে রাম আর রাবণের কথা। বৃষ্টির জলের উপমা টেনে প্রাণজল ভাষায় শ্রোতাদের বোঝাচ্ছেন। অধর্ম কীভাবে আমাদের গ্রাস করে চলেছে। মানুষের ভিতর থেকে মানবিক গুণ সমূহ ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে জায়গা নিচ্ছে অধর্ম রাবণ।
স্মিতা প্রতিদিন বিকেলে চলে আসেন এখানে।
সেদিন একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল। কথায় কথায় জানা গেল তিনিও ছেলে বৌমার সঙ্গে কানাডাতে থাকেন। ভাই এর অসুস্থতার খবর শুনে তিনি ছুটে এসেছেন। ভাই চার্ণক হাস্পাতালে ভর্তি আছে। এ কথায় সে কথায় ভদ্রলোকও শুনলেন স্মিতা তারই মতো কানাডাতে একই শহরে ছেলের কাছে থাকেন।
দেখুন এতো বছর আমরা আছি অথচ একবারের জন্যেও আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। ওখানকার বাঙ্গালী য়্যাসোসিয়েশানে প্রতি বছর ঘটা করে দুর্গা পূজা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সকলে জমায়েত হই অথচ এইভাবে কখনো কথা হয়নি।
স্মিতা বল্লেন, আমি একবার নাট্যকার মনোজ মিত্রের লেখা নাটক, ‘সন্ধ্যাতারা’ তে পার্টিসিপেট করেছিলাম।
তাই নাকি? আমি তো পুরোটাই দেখেছি। আপনার অভিনয় দেখে সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেদিন। আপনি কি সত্যি সত্যি সেদিন কেঁদেছিলেন?
না কাঁদলে আপনাদের কাঁদাতে পারতাম?
কথা বলতে বলতে দুইজনেই হেসে উঠলেন ।
রাই পাশেই বসে অন্য কয়েকজন শিশুর সঙ্গে খেলা করছিল।
দেখতে দেখতে এক মাস কীভাবে যে কেটে গেল। স্মিতা জানালেন তিনি আর কানাডাতে ফিরে যাবেন না। জীবনের বাকী কটা দিন মেয়ের কাছেই কাটিয়ে দেবেন ।
ছেলে কী বল্লে?
ছেলের তো খুব মন খারাপ।
ভদ্রলোক স্মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছু সময় তারপরে মৃদু স্বরে বল্লেন, থাকতে পারবেন?
না পারলে ফিরে যাবো।
স্মিতা কিশোরী গলায় বল্লেন।
যাবার দিন এসে পড়েছে। ভদ্রলোক আজ আবার দেখা করতে এসেছেন স্মিতার সঙ্গে। এই কয়েক দিনে দুইজনার ভিতরে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। পাঁচটা বাজলেই কেউই আর ঘরে থাকতে পারেন না। সুমিতবাবু ওনার নিঃসংগ জীবনের গল্প শোনান আর স্মিতা শোনান ওনার ফেলে আসা অতীত জীবনের কথা। কথা যেন ফুরোতেই চায় না। শেষের দিন কেউই উঠতে চাইছেন না। এদিকে ঘন ঘন ফোন করছে মেয়ে।
সুমিতবাবু বল্লেন, এরপর কাকে শোনাবেন এইসব বিগত জীবনের গল্প?
স্মিতা নীরব রইলেন। মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে। স্মিতার চোখ জলে ভরে উঠল সহসা। কন্ঠ বাষ্পে পূর্ণ।
স্মিতার সঙ্গে পায়ে পায়ে অনেকটা পথ এলেন সুমিতবাবু।
অবশেষে ফিরতে হল। সুমিতবাবু হাত উঁচু করে ‘এবারে তাহলে আসি’, বলে বিদায় নিলেন।
কানাডাতে ফিরে সেদিন পার্কের বেঞ্চে মনমরা হয়ে বসেছিলেন সুমিতবাবু। স্মিতার কথাই ভাবছিলেন। রুচিশীলা এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহিলা স্মিতাদেবী। কী সুন্দর কথা বলেন। যত ভাবছেন মনটা ক্রমশঃ ভারী হয়ে আসছে।
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।
আজকের মতো সূর্যদেব বিদায় নিচ্ছেন। তির্যক আলো এসে পড়েছে পার্কের একদিকে। ঠিক সেই মুহূর্ত্যে তার সামনে দীর্ঘ একটি ছায়া এসে পড়ল। ঘুরে তাকালেন সুমিতবাবু। স্মিতাকে দেখে অবাক হলেন। ফিরে এলে তাহলে? দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক নেত্রে। পড়ন্ত বেলার আলো এসে পড়েছে দুজনের মুখে। উজ্জ্বল প্রশান্তিময়। সুমিতবাবু হাতটা এগিয়ে দিলেন স্মিতাদেবীর দিকে। স্মিতা স্পর্শ করল সেই হাত।
অন্য এক বসন্তের ছোঁয়াচ পেলেন তাঁরা বহু বছর বাদে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন