আলমগীর খোরশেদ
অমাবশ্যার রাত ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতটাই দেখা যায় না। সাপের মত এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া গ্রামের রাস্তা। দু’পাশে কলাগাছ, তাল গাছ, ঝোঁপঝাড়ে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে আঁধারের ঘনত্ব। রাস্তার উপর বাঁশ এসে ঝুলে আছে, বাঁশঝাড়ের সঙ্গ ছেড়ে এসে বাতাসের সাথে মিতালি করে। পেঁচার ডাক, বাদুড়ের ওড়াউড়ি, মির্জালী মেম্বারের বাড়ির কবর স্থান পেরিয়ে নিমাই শীলদের বড় কড়ই গাছের নীচে এসে থামে ওরা। অশরীরী তিনজন। রশীদ, সদূ চেয়ারম্যানের কাজের মেয়ে অজিফি ও মির্জালী মেম্বার। সবাই কিছুদিন পুরনো কবরে থেকেছে। বৃষ্টির পানিতে কবর উপচে পড়ায় এখন কড়ই গাছে বসবাস। নতুন নামে চলাচলে পৃথিবীর সব দেখে ওরা, কে কি করছে, কে কোথায় যাচ্ছে। ভালো মন্দ সব বুঝে, কিন্তু করার কিছুই থাকে না, ওদের দেখে না কেও। কড়ই গাছের নীচে বড় বেতঝাড়। শিমূল, গাবগাছ, পাশেই পাগার বা জলাশয়ে সারাবছর পানি থাকে। শুকায় না কখনো। দিনের বেলাতেই আসেনা কেও ভয়ে। মির্জালী মেম্বারের ছোট ছেলে রশিদ ক্লাস ফোরে পড়তো। মির্জালী মেম্বার মারা যাবার পর তার চার ছেলেদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে শুরু হলো মনোমালিন্য। কথা ছিলো, রোজা ঈদে সবাই যখন বাড়িতে আসবে, তখন জমি জমা বন্টনের ব্যবস্থা করবে। কিছুদিন যেতেই একদিন সকাল বেলায় কান্না শোনা গেলো মির্জালী মেম্বারের বাড়িতে। বাড়ির পিছে ধানক্ষেতে মেম্বারের লাশ পাওয়া গেলো। জবাই করে হত্যা। মেম্বারের বড় ছেলেকে পৃথক করে দিয়েছিলেন পূর্ব থেকেই। বিভিন্ন ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে তাকে বাঁচিয়েছেন মেম্বার। এখন জমিজমা বন্টন করলে অন্য ভাইদের চেয়ে কম পাবে। এই সিদ্ধান্তই কাল হলো মেম্বারের। রাতে বাজার থেকে বাড়ি ফিরার পথে হঠাৎ পিছন থেকে মাথায় আঘাত। দৌড়ে বাড়ির পিছে ধান ক্ষেত পর্যন্ত, আবার আঘাত। পড়ে যান রাস্তায়। “ক্ষেত দিবো না, যা অহন কেডায় বাঁচায় তরে”। এটুকু শোনে মেম্বার এখন আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। রশীদের অনেক জ্বর। পাড়ার হোমিও ডাক্তার সতীশ তিন দাগ ঔষধ দিয়ে বল্লো, ” চেংড়া মানুষ, ভালো হয়ে যাবেন রাঙাদা। চিন্তা হরোইনন্নাযে।”
তিন দিনের মাথায় হঠাৎ সকালে কাছারী ঘরে রশীদকে খোঁজে পাওয়া যায় না। কাছারী ঘরেই থাকতো রশীদ। বালি, সুজি ছাড়া আর কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি। অনেক খোঁজে সবাই ক্লান্ত। তখন ওপাড়ার সাহেবালী দৌড়ে এসে খবর দিলো, রশীদ নিমাই শীলের পাগারে মরে পানিতে ভেসে আছে। সবাই গিয়ে দেখে রশীদ পানিতে। তোলে এনে দেখা গেলো, গলায় কালো দাগ। কেউ জানে না কেমন করে রাতে এতদূর রশীদ এলো। যে কিনা প্রশ্রাব করে ঘরের পিরায় বসে, সে কেমন করে অন্ধকারে এতদূরে। অজিফিও এদের দলে। বেচারীর জীবনে সুখ হয়নি। অভাবের সংসারে জন্ম। বেড়ে ওঠা মামার বাড়িতে। বাবা আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছেন। দুই ভাইবোন মামা বাড়িতেই বড় হয়েছে।অজিফি জানে অভাব, দারিদ্র্য, কষ্ট কি। সদূ চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে। চেয়ারম্যান বাড়ির যাবতীয় কাজ কাম করতো। সদূ চেয়ারম্যান বয়স্ক মানুষ হলেও তার দৃষ্টি থেকে রেহাই পায়নি অজিফি। রান্না ঘরে থাকায় গভীর রাতে চাপা দাড়ি মুখের কালো ছায়ামূর্তি ঢুকতো এসে রান্না ঘরে। বাধা দিতে গেলে মুখে হাত পড়ে, বুঝতে পারে সারা বাড়িতে এই দাঁড়ির মানুষ কেবল একজনই। মাস দুই পর অজিফি বুঝতে পারে তার ভিতর নতুন অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। চেয়ারম্যানকে জানায় অজিফি। পাড়ার মতুকবিরাজের লতাপাতার ঔষধ খেয়ে অতিরিক্ত রক্তপাত হয়। দুদিন না যেতেই মৃত্যুর সাথে মোলাকাত করে অজিফি।
এখন ওরা মানুষ থেকে লাশ তারপর লাশ থেকে আঁধার রাতের যাত্রী অশরীরী তিনজন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন