micro-story-osurdoloni

অসুরদলনী
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়


ডাক্তার মৈত্রর চেম্বারে মায়ের নাম লেখানোর পর এই প্রথমবার কৌশানীর মেজাজ খারাপ হল না। নাহলে প্রতি মাসেই অ্যাপয়েন্টমেন্টের পর তার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। মাকে ডাক্তার দেখানো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা ডাক্তারের অ্যাসিস্টেন্ট শ্রবণা সেনগুপ্তকে নিয়ে। শ্রবণা ম্যাডাম এমন হাবভাব দেখান যেন তিনিই সর্বেসর্বা। অসহ্য লাগে কৌশানীর। নাম লেখানোর সময় গলায় যেন মধু ঝরে পড়ে। তারপর চেম্বারে গেলে মনে হবে সমস্ত রোগী আর তাদের বাড়ির লোক যেন শ্রবণা ম্যাডামের কাছে ক্লাস করতে এসেছে।

‘স্যার প্লিজ, মোবাইলটা সাইলেন্ট করুন।’ ‘ম্যাম, ফোনে কথা বলতে হলে কাইন্ডলি সামনের প্যাসেজে গিয়ে বলুন।’ ‘আপনাদের যার যা টেস্ট রিপোর্ট আছে এখানে রেডি করে নিন। ভিতরে গিয়ে তাহলে সময় নষ্ট হবে না।’

গতে বাঁধা একই কয়েকটা বাক্য। এর সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার আছে। কোন রোগীকে কত নম্বরে দেবেন তা তিনিই জানেন। ফোনে নাম লেখানোর সময় কিছুতেই নম্বর বলেন না। আজ কৌশানীদের আসতে দেরিও হয়েছে। নির্ঘাত আজ একেবারে শেষেই ডাকবেন।

মোবাইলে ঘড়ি দেখে কৌশানী। রাত বেশি হলে ক্যাব পেতেও অসুবিধে হয়। যদিও মাসখানেক পর দুর্গাপুজো। পুজো-পুজোভাব এখন সর্বত্র। কৌশানী খেয়াল করেছে, শ্রবণা ম্যাডাম কোনও এক অজানা কারণে তার উপর বিরক্ত। আজ পর্যন্ত ভালভাবে একবারও কথা বলেননি। হতেই পারে মেয়েলি জেলাসি! কৌশানীর সৌন্দর্য খর্বাকৃতি, কৃষ্ণকায়া শ্রবণা ম্যাডাম সহ্য করতে পারেন না।

কৌশানী মাকে ডাক্তার মৈত্রকে দেখাচ্ছে বিগত পাঁচ বছর। গত দেড় বছর ধরে তিনি বলে আসছেন মায়ের কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন করার কথা। খরচ অনেক। নতুন মেডিক্লেম বলে কৌশানী কভারেজ পাচ্ছিল না। এতদিনে এজেন্ট জানিয়েছেন, কৌশানী ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এগোতে পারে। মেডিক্লেম পেয়ে যাবে।

মা-ও হাঁটু নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। চলাফেরা, ওঠাবসা সবেতেই কষ্ট। মৈত্র স্যার আশ্বাস দিয়েছেন, হাঁটু প্রতিস্থাপন হওয়ার পর মায়ের কষ্ট, অসুবিধে ধীরে ধীরে সব চলে যাবে। মা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারবে। বেশ ভারমুক্ত লাগে কৌশানীর। মা-ও সুস্থ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মৈত্র স্যারের কাছে আর আসতে হবে না। ফলে শ্রবণা ম্যাডামের মুখোমুখি হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।

মৈত্র স্যারের চেম্বার থেকে কৌশানীরা বেরোল যখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। দেরি না করে ক্যাব বুক করার চেষ্টা করে। পরপর তিনটে ক্যাব বাতিল করে। রাত বাড়লে কেন যে কোনও ক্যাব, ট্যাক্সি হাওড়া যেতে চায় না কৌশানীর মাথায় ঢোকে না। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিল কৌশানী। কখন তিনটে ছেলে বেসামাল অবস্থায় তাদের কাছাকাছি এসে গেছে খেয়াল করেনি। তাদের বিশ্রী ভাষা আর কটু গন্ধে মুখ তোলে কৌশানী। ইস্‌, যেমন চেহারা ছিরি, তেমন মুখের ভাষা। পা টললেও অসভ্যতা করার প্রবৃত্তি বিস্তর।

কৌশানী ভেবেছিল চিৎকার চেঁচামেচি করলে এরা ভয়ে পালাবে। কিন্তু আশেপাশে তেমন লোকজনও নেই। এবার ভয় লাগে কৌশানীর। মা ভাল করে চলতে পারে না। কী করবে সে!

কৌশানীকে চরম বিস্ময়ে পৌঁছে দিয়ে কৌশানীর মা এগিয়ে আসেন।

“তোরা আর এক পা যদি আমার মেয়ের দিকে বাড়িয়েছিস! দেখ তোদের কী করি।”

কুৎসিতভাবে ছেলেগুলো হেসে উঠে কৌশানীর দিকে আরও একটু এগিয়ে আসে। মা না থাকলে কৌশানী দৌড়ানোর চেষ্টা করত। এখন সেটাও সম্ভব নয়।

হঠাৎ কৌশানী দেখে ওদের মধ্যে একটা ছেলে ‘মরে গেলাম রে’ বলে মাথা চেপে ধরে রাস্তায় আধশোয়া হয়ে গেল। বাকি দুজন হকচকিয়ে কারণ খোঁজার আগেই দেখল একজন নিঁখুত আর নিপুন ক্যারাটের প্যাঁচে তাদের আছাড়ের পর আছাড় খাওয়াচ্ছে। কৌশানী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। শ্রবণা ম্যাডাম! মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ছেলেগুলো হাওয়া।

কৌশানী কী বলবে ভেবে পায় না। তখনও সে কাঁপছে। এতটা ভয় বোধহয় আগে কখনও পায়নি। কাঁপা গলায় কিছু বলতে যায় কৌশানী। তার আগে শ্রবণা ম্যাডাম এসে কৌশানীর হাত ধরে বলেন, “কিছু বলতে হবে না। এ তো আমার কর্তব্য। ক্যাব বুক করুন। আমি আছি।”

কৌশানীর মনে হয়, মা দুর্গা বছরে একবার সাজগোজ করে দেখা দিলেও সারাবছর মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে। কখনও শ্রবণা ম্যাডাম হয়ে, কখনও বা তার মায়ের মতো হয়ে, কখনও বা অন্যভাবে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-osurdoloni

  1. Nice writing. Khub val luglo… Maa sotiyee tho Bohu rupay sonmukay amader. Sudhu chinay nitay hobay.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *