micro-story-parthokyo

পার্থক্য
অনুভা নাথ

 

ন্যাশানাল হাইওয়ে ১৬-র ওপর দিয়ে হু হু করে গাড়ি চলছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বিএমডব্লু গাড়ির পুরু কাচের বাইরের দৃশ্য যেন গরমে ঝলসে যাচ্ছে! আগুন কালো পিচঢালা রাস্তাটা যেন একটা কালো পাইথন, গিলে ফেলতে চায় নিরীহ গাড়িগুলোকে।

গাড়ির মধ্যে চিলড ঠান্ডা। রুহানা কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে মগ্ন। রুহানার পাশে তার মা মহুয়া বসে। তিনি জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে। মহুয়া মেয়েকে বললেন “গাড়িতে উঠে থেকে গানই শুনে যাচ্ছিস। এদিকে আমি বসে বসে বোর হচ্ছি। একটু কথা তো বলতে পারিস, রে”। রুহানার মুখ দেখে মনে হল, সে গানের ভল্যুয়ুম একই রেখেছে তাই মায়ের কথা শুনতে পায়নি। জিজ্ঞাসু চোখে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে। মহুয়া চুপ করে গেলেন। এই যুগের প্রজন্মটাই এমন, সৃষ্টিছাড়া। ইনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, মাসির বাড়ি পৌঁছাতে এখনও দু’ঘন্টা লাগবে। মহুয়া রুহানাকে ইশারায় কানের হেডফোন খুলতে বললেন।

“মম, তুমি আর জায়গা পেলে না? এইরকম নন স্ট্যান্ডার্ড ধাবায় আমরা খাব?” গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে হাইওয়ের পাশে একটা হোটেলে। রুহানা গাড়িতে বসে বিরক্তিমাখা গলায় মহুয়াকে কথাগুলো বলল। মহুয়া গাড়ির দরজা খুলে নামতে নামতে উত্তর দিলেন “রাস্তায় তো আর তোমার জন্য কেউ সুইগি জোম্যাটো থেকে খাবার আনাতে পারবে না। যা পেয়েছ তাই খাও।”

হোটেলটির নাম অন্নপূর্ণা ভাতের হোটেল। বাইরের ঘরে গুটি কয়েক বেঞ্চ পাতা। ভেতরে খুপরিতে রয়েছে রান্নার ব্যবস্থা। তারই একপাশে একটা ছেঁড়া চটের ওপর বসে বছর আঠারোর মলি পড়ছে। তার মা অন্নপূর্ণা পাশে দাঁড়িয়ে খাবার গোছাচ্ছে। অন্নপূর্ণা মলিকে দেখছে, মলি সারাদিন এই হোটেলে কাজ করে, ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনো। মায়ের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। মলির অপুষ্ট, রোগা শরীরটার দিকে তাকিয়ে অন্নপূর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বাইরে গাড়ির হর্ণের শব্দে তার ঘোর কাটল। মহুয়া আর রুবানা হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে। রুবানা কান থেকে হেডফোন খুলে মহুয়াকে বলল “কাম অন মা, এখানে ভাত খেতে পারব না। আজ আমার ফাস্ট আছে!” মহুয়া মেয়ের অতি রোগা কোমরের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল “আর কত সাইজ জিরো হবি, মা? চেহারায় লালিত্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে” অন্নপূর্ণা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। কথাটা শুনে ওর মনে হল, মলিরও তো শরীরটা এমনই…। ততক্ষণে মলি পড়া ছেড়ে বাইরের ঘরে চলে এসেছে।

“তবুও একসঙ্গে যাচ্ছি বলে তোর মুখটা দেখছি। বাড়িতে থাকলে তো নিজের ঘরেই থাকিস। কী যে করিস বুঝি না বাবা” মহুয়ার টুকরো কথা অন্নপূর্ণার কানে গেল। তার চকিতে মনে পড়ল, মলি সারাদিন কাজের মধ্যে থাকে, ভাল করে ওর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই!

রুবানা ভাত খাচ্ছে না, শুধু ডাল আর পনির খেল। তার জিন্সের দিকে তাকিয়ে মহুয়া বলল “মা, তুই এই প্যান্টটা কেন পরিস? ফাটা… পায়ের কতটা অংশ দেখা যাচ্ছে!” সঙ্গে সঙ্গে অন্নপূর্ণা মলির দিকে তাকাল, মেয়েটার কুর্তিটা বিভিন্ন জায়গায় রিফু করা। তবুও অবাধ্য সেলাই খুলে কিছু কিছু জায়গায় শরীর হয়েছে অনাবৃত।

খাওয়া শেষ করে মহুয়া আর রুবানা দাম মিটিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মহুয়া তাকালেন মেয়ের দিকে। রোগা, ছেঁড়া জামা পরা মলি বাসন মাজছে। একজনের অভাব আর অন্যজনের স্বভাব আপাতদৃষ্টিতে আলাদা করা না গেলেও প্রয়োজনের পার্থক্যটা বড্ড চোখে লাগল অন্নপূর্ণার। তার অসহায়, নীরব চোখে জমল জল।

2 thoughts on “micro-story-parthokyo

  1. সত্যি পুরো অন্যরকম আদলে লেখা গল্পটা। একজনের বিলাসিতা আর আরেকজনের অসহায়তা পাশাপাশি এমনভাবে ফুটে উঠেছে যে পড়া শেষে দুজনের জন্যই মন খারাপ হয় – দুজন কেন বলি – দুই মা আর দুই মেয়ে, সবার জন্যই মন খারাপ হয়। কারও নেই, কারও থেকেও নেই!

  2. ভীষণ ভালো লাগলো এই অণুগল্পটি। আমাদের বাস্তব সমাজের একটুকরো ছবি লেখিকা ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণতার সাথে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই লেখাটি পড়ে বেশ ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *