micro-story-pupur-prem

পুপুর প্রেম
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

 

পুপুকে প্রথমে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিল সুস্মিতা। মাধ্যমিক পাশের পর তখন সবে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে পুপু। ওদের স্কুলে সায়েন্স, আর্টস আর কমার্স বিভাগের বাংলা আর ইংরাজির ক্লাস একসঙ্গে একটা বিরাট হলঘরে হত। সুস্মিতা ছিল আর্টসের। ও-ই প্রথমদিন পুপুর সঙ্গে ডেকে আলাপ করেছিল। দু’ একটা কথার পরেই বলেছিল, “তুমি প্রেম করো?” পুপু শিউরে উঠে ঢকঢক করে দু’দিকে দ্রুত মাথা নেড়ে বলেছিল, “না।” তারপরেও তার মুক্তি মেলেনি। ক্লাসের পর তাকে ঘিরে ধরেছিল অনেকে। মজা করার জন্যই ওরা পুপুকে ছাড়তে চাইছিল না। সবাই মিলে জানতে চেয়েছিল, “কমলিকা! কখনও কোনও পুরুষ আসেনি তোমার জীবনে? এ কথা কি সত্যি? এত সুন্দর দেখতে তোমায়, কী সুন্দর তোমার চোখ! কেউ মুগ্ধও হয়নি? প্রশংসাও করেনি কখনও?” পুপু আবার দু’দিকে মাথা নেড়েছিল। তারপর পালিয়ে বেঁচেছিল কোনো রকমে।

তারপর সত্যিই ভাবতে বসেছিল সে। তখনই চোখের সামনে কোয়ান্টাদার মুখটা ভেসে উঠেছিল। কালো রোগা আর খুউব লম্বা। গালে অল্প কোঁকড়ানো নরম দাড়ি। চোখ দুটো ভাসা ভাসা। কোয়ান্টাদা তাকে ফিজিক্স পড়ায়। ও খুব ভাল পড়াশুনোয়। এখন ডাক্তারির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তবু প্রতি রবিবার করে ঠিক সময় বের করে সকালবেলা পুপুকে পড়াতে আসে। কোয়ান্টাদাকে তাদের বাড়ির সবাই ওর স্কুলের নামেই ডাকে। ওর স্কুলের নাম হল সুশোভন ত্রিপাঠী। কারণ সুশোভনদা পুপুর দাদা ঋজুর স্কুলের বন্ধু ছিল। সেই সূত্রে বহু বছর ধরেই সুশোভনদা ওদের বাড়িতে আসে। ফিজিক্স পড়াতে বসলে সুশোভনদা খুব গম্ভীর হয়ে যায়। পুপু আবারা ফিজিক্সে খুব কাঁচা। তাই সে পড়তে বসে ভয়ে একেবারে গুটিয়ে থাকে। পুপুকে একদিন সুশোভনদা বলেছিল, “তুই আমাকে সুশোভনদা না বলে, কোয়ান্টাদা বলবি। আমার ডাকনাম। আলোর কোয়ান্টাম থিয়োরি থেকে আমার বাবা আমার এই নামটা রেখেছে। আমি তোকে ফিজিক্স পড়াই, তাই তোর আমাকে ওই নামেই ডাকাটাই ভালো হবে। পড়াও মনে থাকবে!” পুপু অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই কোয়ান্টাদা বলেছিল, “কিছু বললেই তুই আমার দিকে চোখটা আরও বড় করে তাকাস কেন? আমি জানি তোর চোখ খুব বড়! লিচুর মতো বড় একেবারে!” পুপু মনে মনে সেদিন খুব অপমানিত হয়েছিল। সে তারপর থেকেই ওকে আর কোনো নামেই ডাকে না। কথাও বেশি বলে না। বোবার মতো নীরবে বই আর খাতা এগিয়ে দেয়। কোয়ান্টাদা পুপুকে পড়ানোর জন্য টাকা নেয় না। দাদা আর মাকে ও বলেছে, “আমার বাবা ফিজিক্সের টিচার, আর ওই সাবজেক্টটা আমার এক সময় প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিল, ওটা পড়াতে গিয়ে আবার চর্চা করতে আমার বেশ ভালই লাগে। মায়ের ইচ্ছায় ডাক্তারী পড়তে হয়েছে! আসলে আমার মা তো নার্স! মায়ের খুব আশা ছেলে ডাক্তার হবে!”

রবিবারের সকাল। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। পুজোর গন্ধ আকাশে বাতাসে। কোয়ান্টাদা গম্ভীরমুখে পুপুর পড়ার ঘরে এসে বসেছে। একটা কোয়ালিটি আইসক্রিমের বিরাট বাক্স ওর হাতে। “পুপু এটা নে। চটপট কেটে তাড়াতাড়ি সবাইকে সার্ভ করে দে!” আইসক্রিম! পুপু একছুটে রান্নাঘরে চলে গেল।

“কী রে! জানতে চাইলি না, কেন আমি আজকে আইসক্রিম এনেছি?”

পুপু আবার চোখ বড় করে তাকালো। আসলে মনোযোগ দিতে গেলেই ওর চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

“আমার ফাইনাল এমবি’র রেজাল্ট বেরিয়েছে। তুই আমার রেজাল্ট দেখবি? আমি সেভেন্টি থ্রি পার্সেন্ট পেয়েছি। যদিও নম্বরটা খুব একটা ভালো না, আবার খুব খারাপও নয়!”

পুপু একটু অবাক হয়েছে। ও তো কিছুই জানে না, কী কী পড়ানো হয়, কত নম্বরের পরীক্ষা হয়! তবুও কোয়ান্টাদা ওকে কেমন গুরুত্ব দিয়ে রেজাল্ট দেখাচ্ছে! পুপুর মনে মনে বেশ গর্ব হল। সে বিজ্ঞের মতো রেজাল্ট দেখতে দেখতে বলল, “ভালই তো দেখছি সব!”

কোয়ান্টাদা এবার আবার গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, “খুব মন দিয়ে পড়াশুনো কর। তোকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমার জীবনে কিন্তু খুব একটা উচ্চাশা নেই। ভাবছি ইন্টার্নশিপের পরে হেলথ সার্ভিস জয়েন করব। ততদিনে তোরও কলেজের পড়া শেষ হয়ে যাবে। খুব বেশি মাইনে হয়তো পাবো না, ওই দিয়েই তোকে কোনো রকমে সংসার চালাতে হবে। পারবি না?”

পুপুর সামনে আলোর গতিবেগে হিরোশিমা নাগাসাকির পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে গেল নিঃশব্দে। সে স্থানুর মতো বসে আছে। বসেই আছে? এটাই কি তাহলে তার জীবনে পাওয়া প্রথম প্রেম প্রস্তাব? কিন্তু তাকে ‘ভালবাসি’ কথাটা তো বলেনি কোয়ান্টাদা?

 

3 thoughts on “micro-story-pupur-prem

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *