মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
অনিচ্ছাসত্ত্বেই এলেন অনুষ্ঠানমঞ্চে ধীরাজ। মন চাইছিল না একেবারেই। এলেন সাতপাঁচ ভেবে। ফোনে অনেকবার করে অনুরোধ জানালেন অরিন্দমদা। অগ্রজ কবি। তিনিই ‘পূণশশী’ সাহিত্যসংস্থা কর্তৃক পুরস্কৃত হচ্ছেন আজ। সঙ্গে গদ্যসাহিত্যিক ঋতম আচার্য। অঙ্কনশিল্পে আশিস রায়। ‘না’ বলতে পারলেন না ধীরাজ। কথা দিলেন আসবেন বলে। এলেনও। না-এলে কেমন দেখায়।
বস্তুত এমন অনুষ্ঠানগুলি এড়িয়েই চলেন ধীরাজ। মন থেকে পছন্দ করেন না বলেই। কারণ, এদ্দিনে বেশ জেনেবুঝে গেছেন এ-ধরনের অনুষ্ঠানগুলিতে প্রকৃতই কারা পুরস্কৃত হন। কেন হন। কী-কী গুণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এমন পুরস্কারগুলি করায়ত্ত করতে গেলে। বড়ো অশ্রদ্ধার সে কারণটারণগুলিও। তবে কৃত্রিম ঢাকঢোল পেটানো আড়ম্বরপূর্ণ এসব অনুষ্ঠানে মন টানবে কেন তার!
দেখতে-দেখতে বিশবছর পার সাহিত্যজীবনের তার। ভাবতে গেলে ভিরমি খান প্রায় ধীরাজ। অবাক হয়ে আপনমনে বলে ওঠেন, আরিব্বাস! এতকাল এ-লাইনে! দেখতে-দেখতে বিশটি বছর। সটান একযুগ পেরিয়ে দুইযুগের সীমারেখা ছোঁয়ার অপেক্ষা। সোজা কথা নয় কিছু!
শুরু সেই কোন্ কিশোরবেলায়। তখন বুঝি ক্লাস এইটের ছাত্র তিনি। পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। কবিতা রবি ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’। কবিতাটি ঠোঁটস্থ করতে-করতেই ভেবে বসলেন, আচ্ছা, এমন একটি কবিতা তো তিনি নিজেও লিখে ফেলতে পারেন। চেষ্টা করলে কেমন হয়? সেই কলম বাগিয়ে সাহিত্যসমুদ্রে ঝাঁপ কাটা। দিব্যি লিখেও ফেললেন একটি কবিতা। হুবহু ‘আফ্রিকা’-র মতোই আর-একটি কবিতা। ঠিক তত পঙ্ক্তি। তত স্তবক। পাড়ার সাংস্কৃতিক গুরু নারায়ণদা পড়ে চমকিত। বললেন, বাঃ! খাসা লিখেছিস যে! চালিয়ে যা। তোর হবে। তারপর আর থামা নেই।
এ-যাবৎ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি, নামি-অনামি পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন ধীরাজ। লিখে উপার্জনও করেন মাঝেসাজে কিঞ্চিৎ। ছড়া কবিতা গল্প উপন্যাস- সব লেখেন। সাধারণ লিটল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাংলাভাষার প্রথম সারির সব পত্রিকা তার লেখা ছাপে। অনেকানেক পত্রিকা আমন্ত্রণ জানায়। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এককুড়ি। সামনে-পেছনে অনেকেই ভূয়সী প্রশংসা করে তার লেখার। নানান আলোচনায়ও উঠে আসে তার নাম। কিন্তু এখনও অবধি কোনও পুরস্কারটুরস্কার- নৈব নৈব চ। ওসব তো তার পাওয়ার কথাও নয়। তিনি মুখচোরা। ঘরকুণো। প্রচারবিমুখ। একে-ওকে ধরে তৈলমর্দন করা, ধাতে নেই কোনোকালে। তবে পুরস্কারের সিকে ছেঁড়ে কেমন করে!
শিশুসাহিত্যিক শৈলেন ঘোষের একটি প্রবাদবাক্য কানে বাজে তার : ‘আমি আপনার পিঠ চুলকে দিচ্ছি, আপনি আমার। এটা সাংস্কৃতিক পাপ। এই চর্চা যদ্দিন না বন্ধ হয়, তদ্দিন বাংলাভাষাসাহিত্যের সামগ্রীক উন্নয়ন অসম্ভব।’ দুর্ভাগ্যের কথা, তাই চলছে এখন দুর্বার গতিতে। সুদিন কবে ফিরবে, কে জানে!
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সেদিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে বসে আছেন ধীরাজ। আচমকা ছন্দপতন। এক ভদ্রমহিলা এসে পাশে দাঁড়ালেন। তার উদ্দেশে হাতজোড় করে বললেন, নমস্কার! আপনি কবি ধীরাজ চক্রবর্তী? আমরা আপনার কবিতার ভক্ত। এটি আমার ছেলে। পাশে দাঁড়ানো বছর বারো-চোদ্দর ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন তিনি। আপনার কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করে ও সবসময়। এই দেখুন, এত্তগুলো পুরস্কার পেয়েছে কেবলমাত্র আপনার কবিতা আবৃত্তি করেই। বলে ঢাউস ব্যাগটি থেকে একগুচ্ছ মেমেন্টো-ট্রফি-বই বার করে আনলেন ভদ্রমহিলা।
ধীরাজ বিস্মিত তাকান সেদিকে। তিনি বাক্যরহিত। সামনে অনুষ্ঠিত পুরস্কারমঞ্চের কথা বিস্মৃত হলেন। মনের অজান্তে চোখদুটি ছলছল করে উঠল। যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্তি ঘটে গেল তার!
হ্যাঁ, বলুন স্যার?
কী বলব বলো তো? বলার কথা তো তোমার? অল্প রাগতস্বর পরাশরস্যারের। অথচ দিব্যি রয়েছ তুমি। একটি ফোন পর্যন্ত নেই। কথার কোনও দাম থাকবে না? সেদিন তো কথা দিলে-
শুনুন না স্যার। অত অস্থির হবেন না। কথা দিয়েছি তো কী হয়েছে? আজ আবার দিয়ে দিচ্ছি একটি ডেট। ব্যস। আগের তারিখটা ফেল করেছি। এবারেরটা চেষ্টা করব। এছাড়া আর কী বলি বলুন?
কী বলি, মানে? পরাশরস্যারের রাগ বাড়ে। আজ কতদিন হল বলো তো? দু-বছর একমাস। অথচ কথা ছিল, একমাসের মাথায় টাকাটা দিয়ে দেবে।
আহা, শব্দটার উপর অত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? কথা দেওয়া কি অপরাধ? সেটা তো আমার সদিচ্ছারই প্রমাণ। নয় তো বলতাম, হাতে পয়সা এলে দেব স্যার। তা বলেছি কী!
তাই বলে দু-বছর! এই নিয়ে তিনবছরে পা দিল! কী বলছ এসব, এটাও কি সাধারণ ব্যাপার? নর্মাল?
কেন নর্মাল নয়! ব্যাপারটাকে অ্যাবনর্মাল করে ভাবছেন, তাই সমস্যা হচ্ছে আপনার। জানেন, কতজনার তো কত-কত টাকা মারও যায়। টিভি খোলেন না! খবর দেখেন না নাকি! নীরব মোদিরা নীরবে হাজার-হাজার কোটি মেরে পগারপার হয়ে যাচ্ছে। আমি তো তা করছি না। এখনও বলছি, দেব। শুনতে ভালো লাগছে না আপনার? অসন্তুষ্ট হচ্ছেন স্যার? এও ভালো কথা!
তখন কিন্তু এমনটি বলোনি কনক! কত ভদ্রনম্রস্বরে টাকা চেয়েছিলে। মিন্স হাত পেতেছিলে। একমাসের মধ্যে আপনাকে সব রিটার্ন করে দেব স্যার, এমনটি বলেছিলে। আশ্চর্য! বেমালুম ভুললে সব!
এই দ্যাখো, ফের ভুল কথা বলছেন স্যার। ভুললাম কোথায়? এখনও তো বলছি, দিয়ে দেব। আর-একটু সময় চাই। বড্ড অসুবিধায় আছি। কিন্তু নীরব মোদিদের দলে নাম লেখাচ্ছি না, কথা দিচ্ছি।
কিন্তু কত আর ল্যাজে খেলাবে বলো? কত ঝোলাবে? এ তো হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের মতো চলছে যেন। ডেট পে ডেট, ডেট পে ডেট। আর কত?
আর অল্প। হয়ে এসেছে। গুছিয়ে এনেছি প্রায়। ফোনের ওপ্রান্তে কনক হাসে। খামোখা অস্থির হচ্ছেন স্যার। আপনার টাকা মারছি না। সময়মতো ঠিক পেয়ে যাবেন।
আবার হাসছ! তোমার দরকারের সময়ে এভাবে উপকার করলাম। তারপর টানা দুটিবছর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছ। তারপরও নির্বিকার! হাসি পাচ্ছে!
একটু আপত্তি করছি স্যার আপনার কথায়। কনকের গম্ভীরস্বর। আপনি টিচারমানুষ, রাগ করবেন না যেন। অপরকে শিক্ষাদান করেন। সম্মানের পেশায় রয়েছেন। ‘উপকার’-শব্দটা ব্যবহার করবেন না, প্লিজ! বলতে পারেন, আমার টাকা কিছু কমতি আছে। আপনার বাড়তি স্যার। তাই আমায় দিয়েছেন। এখানে ‘উপকার’-এর ব্যাপার আসছে কোথা থেকে?
ফোন কানে ধরে থতমত খান পরাশরস্যার। বলে কী এ! দু-বছর আগে এগারোহাজার টাকা ধার দিয়ে উপকার করেননি তিনি? বেশি আছে বলেই দিয়েছেন? আর কিছু নয়! অমনি তর্কে বিরতি টানতে কথা পালটালেন পরাশরস্যার। প্রায় মিনতির ঢঙে বললেন, বেশ। তোমার কথাতেই মান্যতা দিচ্ছি। সঠিক বলেছ তুমি। উইথড্র করলাম কথাটা। কিন্তু টাকাটা ধার দিয়েছি তোমায়- এটা তো সত্যি? ধার নিলে তা শোধ দিতে হয়!
হ্যাঁ, দিতে হয় তো! দেব বলছি তো তাই এখনও।
কবে?
আশা করছি এ-মাসের মধ্যে। কোনও চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেব।
ফোন কেটে দিলেন পরাশরস্যার। না, আর টেনশন করছেন না। ছেলেটা ঠিকই বলেছে। কাজটাকে উপকার ভাবছিলেন এদ্দিন। তাই টাকাটার জন্যে বাড়তি চিন্তা করছিলেন। -দুটিই বিপরীত কাজ হয়েছে তার পক্ষে। জগতের সবাই নীরব মোদি নয়- এটা ভেবেও কিঞ্চিৎ তৃপ্তিবোধ করা যেতে পারে বই-কি!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন