দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়
“বৌমা, তুমি দুধটা ছুঁয়ে দিও না যেনো, সাধের পায়েস হবে তো। অসব তোমার ছুঁতে নেই।” কাকি শাশুড়ির কথায় থমকে গেল অহনা। তারপর রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। ওর শাশুড়ি নেই আজ দু বছর, কাকি শাশুড়িই এখন এবাড়ির সব সামলায়।
আজ ওর আদরে ননদ তুলতুলের নমাসের সাধ। ও সকাল থেকে কেটে বেটে দিলেও, ওকে আজ রান্না করতে দেয়নি কাকি শাশুড়ি। কিন্তু… এভাবে…
নিজের ঘরে এসে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে চোখ মোছে অহনা। দুটো কুট্টি কুট্টি হাত তখনি ওকে জড়িয়ে ধরে। কচি গলা প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে মামমাম?”
“ও কিছু না।”
“তুমি কাঁদছ কেন?”
কুর্চিকে কোলে টেনে নিয়ে জোর করে হাসে অহনা, বলে, “চোখে পেয়াজের রস গেছে সোনা।”
বিয়ের পর ও নিজেও গর্ভবতী হয়েছিল। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে চার মাসেই সে ফুল ঝরে যায়। এরপর আর পাঁচ বছর সন্তান না হওয়ায় দেড় মাসের কুর্চিকে দত্তক নিয়েছিল ওরা। আজ কুর্চির বয়স চার, ওর অপূর্ব মাতৃত্বকে ভরিয়ে দিয়েছে এই দেবশিশু। তাই মাঝে মাঝে ও ভুলে যায় ওর অপূর্ণতার দুঃখ। তুলি ওর হাতের পায়েস ভালোবাসে বলেই তো ও দুধটা জাল দিতে গেছিল, কিন্তু কাকি শাশুড়ি ওর নরম জায়গায় খোঁচা দিয়ে ফেলল। না, আর রান্নাঘরে যাবে না সে, আবার কী ছুঁয়ে ফেলবে। কুর্চিকেও আজ যেতে দেবে না, পাছে কেউ কিছু বলে। ও যত তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায় তাতেই মঙ্গল। আসলে তুলি গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই একটা ভয় অহনাকে তাড়া করে, গত মাসে তুলির একটা দুর্ঘটনাও ঘটেছিল। দশ দিন হাসপাতালে ছিল সে। এরপর বাপের বাড়ি এসেছে রেস্ট নিতে। অহনা প্রাণ দিয়ে করছে, তুলি ভালোবাসে রাঁধছে, নিজে হাতে ঘর মুছছে, যাতে জল না থাকে কোথাও।
না, ও আজ আর ওদিকে যাবে না, তুলির ভালো হোক, ওর দৃষ্টি যেন না পড়ে ওদিকে।
কিন্তু একটু পরেই ওর খোঁজ শুরু হল। ঘড়ির কাটা একটায় পৌঁছে গেছে, একটা পাঁচে সাধ ভক্ষণ, পুরোহিতমশাই বলেছিলেন। কুর্চি বারবার পিসির কাছে যেতে চাইছে। চুল বাঁধার অছিলায় ওকে আটকে দিয়েছে ওর মা।
হঠাৎ সোহন এসে বলে, “কী গো, বাবা তোমায় খুঁজেছে, কুর্চিকে ডাকছে। সময় বয়ে যাচ্ছে, এসো।”
“আমরা যাব না সোহন, আবার কে কী বলবে! কী দরকার!” দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নামে।
সোহন বলে, “বাবা তোমায় ডাকছে, এসো। কে আবার কী বলবে তোমায়?”
জোর করেই বৌএর হাত ধরে টানে সোহন।
হল ঘর জুড়ে আত্মীয়দের ভিড়। কাকি শাশুড়ি বলে, “তুলিকে পায়েস কে খাওয়াবে? রুমির ছেলে পিয়ার ছেলে কই?”
“পায়েস খাওয়াবে কুর্চি, কারণ ও সবার ছোট, আর বৌমা তুমি প্রথম আশীর্বাদ করবে, এদিকে এসো।”
মলয়বাবু বেশ জোরেই ঘোষণা করলেন।
অহনার কাকি শাশুড়ি বলল, “কিন্তু দাদা কুর্চি তো এ বংশের…”
“তুমি এবার চুপ করো ছোট বৌ, আজ তোমার দিদি থাকলে এই গরমে তোমায় রাঁধতে দিত না। তোমার মাথা গরম হয়েছে বুঝতে পারছি। কুর্চি আমার আদরের নাতনি, বাড়ির সব চেয়ে ছোট, তুলি ওর হাতেই পায়েস খাবে। আর ভুলে যেও না, বৌমা যদি গত মাসে রক্ত না দিত তুলি বা ওর সন্তান কেউ বাঁচত না। তুলির অত বড় দুর্ঘটনাটা ও একা হাতে সামলেছে। তখন কোথায় ছিলে তোমরা? ওর চেয়ে আপন তুলির আর কে আছে।”
মলয়বাবুর কথায় সব গুজগুজ থেমে যায়। সবাই চুপ, নেগেটিভ ব্লাড গ্ৰুপের রক্ত যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, অহনা নিজেই এগিয়ে এসেছিল। ওর শরীরে বরাবর রক্ত কম। তবুও তুলিকে বাঁচাতে ও পিছিয়ে যায়নি। মলয়বাবু বলেন, ”এসো বৌমা, তুলিকে আশীর্বাদ করো। কুর্চিকে ওর পাশে বসাও। তুলির সন্তান সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসছে শুধু তোমার জন্য।”
তুলি হাত ধরে বৌদিকে ওর পাশে বসিয়ে বলে, “তুমি আজ আমায় খাইয়ে দেবে। যেভাবে বিয়ের আগে সব সময় খাইয়ে দিতে।”
উলু ধ্বনি আর শাঁখের আওয়াজে ভরে ওঠে ঘর, অহনা ভেজা চোখে তাকাতেই তুলির বর তপন বলে, “বৌদি হাসতে হবে, নাহলে ছবি ভালো আসবে না।”
কুর্চি তখন হাসতে হাসতে পিসির মুখে পায়েস তুলে দিচ্ছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন