মেঘ অদিতি
এত খানাখন্দ। এত তীব্র ঝাঁকুনি। পথ কেন যে ফুরোয় না! জীবনের কোনো পথই আসলে কখনই সরলরেখার মত হয়না। হলে অপহৃত সময়গুলো গর্তে পড়ে এভাবে খাবি খেত না।
নিজের ছোট গাড়িটার জন্য মউয়ের রীতিমতো মায়া হয়। ময়মনসিংহ পর্যন্ত তবু কোনোরকম আসা গেছে। তারপর থেকে বিশাল বিশাল গর্ত রাস্তায়। গাড়ির চালক সাবধানী। তবু এবড়োখেবড়ো পথে সেও রীতিমতো গলদঘর্ম। সে মানে মউয়ের বর শিমুল। বিরক্তিতে ছেয়ে আছে চোখমুখ। নিজেকে অপরাধী লাগে মউয়ের। মনে হয়, কী দরকার ছিল গাড়ি নিয়ে আসার। সে ট্রেন ধরলে পারত। শিমু্ল যেচেই তখন গাড়ি নিয়ে বেরুল। এখন বিরক্তি দেখাচ্ছে। ওর স্নায়ুর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ কেবল রাস্তার ধকল বা শিমুলের বিরক্তিপ্রকাশ নয়। সকাল থেকে মাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। ক্ষণেক্ষণে মউয়ের ফোন বাজছে। বড়দা বলছে,,তাড়াতাড়ি আয়, শেষ দেখাও তো দেখতে পাবি নে। মেজদির কান্না জড়ানো গলা, মনারে মাকে বাঁচাতি পারব তো? মা না থাকলে আমি আর বেঁচে কী করবু বুনু! বুনু রে.. কতদুর তুই?
মউয়ের শ্বাস যেন গলার কাছে এসে আটকে পড়তে চায়। মুখে বিনবিনে ঘাম। অথচ এসি চলছে। হঠাৎ কী যেন হয়ে। ফোনের সুইচ অফ করে চোখ বুঁজে সিটে গা হেলান দেয়। যেন ফোন বন্ধ রাখলেই এই অস্থিরতা থেকে সে মুক্তি পাবে। কী প্রবল শক্ত ধাতের কড়া মেজাজি মা ছিল তার। কত সাহসী। মাকে নিয়ে কত গল্প যে বাবা মউকে শুনিয়েছে। একাত্তরের আগেই মা নাকি বাড়ির পিছনের জমিতে তিন তিনটে ট্রেঞ্চ বানিয়ে তার উপরে নয়ানজুলি থেকে পুঁই আর ডাঁটাশাক লাগিয়ে জায়গাটাকে কিছুটা জংলামত বানিয়ে দুঃসময়ে নিজেদের আত্মগোপনের আস্তানা বানিয়েছিল। কী করে আঁচ করেছিল মা অত আগেই! স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ সময়টায় পুরো পরিবার ছাড়াও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের এক জমাদার এবং আরও একটি পরিবার। মাকে কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করতেও দেখেনি মউ। কোনো অবস্থাতেই নিজের তিন সন্তানের কোনো রকম ভুলকে প্রশ্রয় দেয়নি। ব্যস্ত বাবাকে তার কাজের জগতে ছেড়ে দিয়ে একাহাতে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন.নানাবিধ সমস্যা সামলে মফস্বলের ডাক্তার গিন্নী হয়ে নিজের রাজ্যপাটে বিজয়িনীর মত কাটিয়ে গেছে। কিন্তু সময়, যা সবার জন্যই শেষ অবধি নির্মম হয়ে ওঠে, সে যখন মানুষের নিয়তি ঠিক করে দেয় তখন মানুষ বড় অসহায়। বাবা চলে যাবার পর মউয়ের মা কেমন যেন হয়ে গেল। কারো সাথে তেমন কথা বলত না। কোমরে চাবি গুঁজে, নিজের ঘরে বিছানায় গ্যাঁট হয়ে বসে টিভি দেখে কেবল। মেজদি প্রায় অভিযোগ করে, সারাদিন গাঁকগাঁক শব্দে মা জিবাংলা দেখে। ধর্মকর্ম মনে নেই। অত সিরিয়াল দেখার কী আছে? বড়দার অভিযোগ, দ্যাখ এখন অবধি জায়গা জমি ব্যাংকের হিসেব কিচ্ছুটি নিয়ে মুখ খোলে না। কেন রে? বাবার সম্পত্তিতে আমাদের হক নেই? মউ কেবল শুনত। উত্তর করত না। মউ বুঝত, মা নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবে। মউ বহুবার নিজের কাছে নিতে চেয়েছে। মা রাজী নয়। বাড়িঘর, সংসার সব বেদখল হবার ভয়। ওর সামনেই সেবার মেজদি আঙুল উঁচিয়ে মাকে শাসন করেছিল। টিভির রিমোট কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল। মার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছিল। বড় তাচ্ছিল্যের জীবন রে.. মউকে বলতে বলতে চোখ মুছেছিল আঁচলে।
অত ঝাঁকুনিতেও রাতজাগা চোখদুটো লেগে এসেছিল হয়ত। হঠাৎ মাকে ও দেখতে পেল পাশে। পান চিবুচ্ছে। তারপর বলল, হ্যাঁ রে, তোর গর্ভে একটু জায়গা হবে আমার? রাখবি? রাখ না.. শিমুলের ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেসেজ। আচ্ছন্নতা কেটে গেল। চমকে উঠল।
বড়দার টেক্সট। মা আর নেই..
সমান্তরালে চলা একটা মালবাহী ট্রেন তখন ধুঁকতে ধুঁকতে চলে যাচ্ছে, অনেক দূরে..
নিজের ছোট গাড়িটার জন্য মউয়ের রীতিমতো মায়া হয়। ময়মনসিংহ পর্যন্ত তবু কোনোরকম আসা গেছে। তারপর থেকে বিশাল বিশাল গর্ত রাস্তায়। গাড়ির চালক সাবধানী। তবু এবড়োখেবড়ো পথে সেও রীতিমতো গলদঘর্ম। সে মানে মউয়ের বর শিমুল। বিরক্তিতে ছেয়ে আছে চোখমুখ। নিজেকে অপরাধী লাগে মউয়ের। মনে হয়, কী দরকার ছিল গাড়ি নিয়ে আসার। সে ট্রেন ধরলে পারত। শিমু্ল যেচেই তখন গাড়ি নিয়ে বেরুল। এখন বিরক্তি দেখাচ্ছে। ওর স্নায়ুর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ কেবল রাস্তার ধকল বা শিমুলের বিরক্তিপ্রকাশ নয়। সকাল থেকে মাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। ক্ষণেক্ষণে মউয়ের ফোন বাজছে। বড়দা বলছে,,তাড়াতাড়ি আয়, শেষ দেখাও তো দেখতে পাবি নে। মেজদির কান্না জড়ানো গলা, মনারে মাকে বাঁচাতি পারব তো? মা না থাকলে আমি আর বেঁচে কী করবু বুনু! বুনু রে.. কতদুর তুই?
মউয়ের শ্বাস যেন গলার কাছে এসে আটকে পড়তে চায়। মুখে বিনবিনে ঘাম। অথচ এসি চলছে। হঠাৎ কী যেন হয়ে। ফোনের সুইচ অফ করে চোখ বুঁজে সিটে গা হেলান দেয়। যেন ফোন বন্ধ রাখলেই এই অস্থিরতা থেকে সে মুক্তি পাবে। কী প্রবল শক্ত ধাতের কড়া মেজাজি মা ছিল তার। কত সাহসী। মাকে নিয়ে কত গল্প যে বাবা মউকে শুনিয়েছে। একাত্তরের আগেই মা নাকি বাড়ির পিছনের জমিতে তিন তিনটে ট্রেঞ্চ বানিয়ে তার উপরে নয়ানজুলি থেকে পুঁই আর ডাঁটাশাক লাগিয়ে জায়গাটাকে কিছুটা জংলামত বানিয়ে দুঃসময়ে নিজেদের আত্মগোপনের আস্তানা বানিয়েছিল। কী করে আঁচ করেছিল মা অত আগেই! স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বেশিরভাগ সময়টায় পুরো পরিবার ছাড়াও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের এক জমাদার এবং আরও একটি পরিবার। মাকে কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করতেও দেখেনি মউ। কোনো অবস্থাতেই নিজের তিন সন্তানের কোনো রকম ভুলকে প্রশ্রয় দেয়নি। ব্যস্ত বাবাকে তার কাজের জগতে ছেড়ে দিয়ে একাহাতে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন.নানাবিধ সমস্যা সামলে মফস্বলের ডাক্তার গিন্নী হয়ে নিজের রাজ্যপাটে বিজয়িনীর মত কাটিয়ে গেছে। কিন্তু সময়, যা সবার জন্যই শেষ অবধি নির্মম হয়ে ওঠে, সে যখন মানুষের নিয়তি ঠিক করে দেয় তখন মানুষ বড় অসহায়। বাবা চলে যাবার পর মউয়ের মা কেমন যেন হয়ে গেল। কারো সাথে তেমন কথা বলত না। কোমরে চাবি গুঁজে, নিজের ঘরে বিছানায় গ্যাঁট হয়ে বসে টিভি দেখে কেবল। মেজদি প্রায় অভিযোগ করে, সারাদিন গাঁকগাঁক শব্দে মা জিবাংলা দেখে। ধর্মকর্ম মনে নেই। অত সিরিয়াল দেখার কী আছে? বড়দার অভিযোগ, দ্যাখ এখন অবধি জায়গা জমি ব্যাংকের হিসেব কিচ্ছুটি নিয়ে মুখ খোলে না। কেন রে? বাবার সম্পত্তিতে আমাদের হক নেই? মউ কেবল শুনত। উত্তর করত না। মউ বুঝত, মা নিজেকে নিরাপত্তাহীন ভাবে। মউ বহুবার নিজের কাছে নিতে চেয়েছে। মা রাজী নয়। বাড়িঘর, সংসার সব বেদখল হবার ভয়। ওর সামনেই সেবার মেজদি আঙুল উঁচিয়ে মাকে শাসন করেছিল। টিভির রিমোট কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল। মার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছিল। বড় তাচ্ছিল্যের জীবন রে.. মউকে বলতে বলতে চোখ মুছেছিল আঁচলে।
অত ঝাঁকুনিতেও রাতজাগা চোখদুটো লেগে এসেছিল হয়ত। হঠাৎ মাকে ও দেখতে পেল পাশে। পান চিবুচ্ছে। তারপর বলল, হ্যাঁ রে, তোর গর্ভে একটু জায়গা হবে আমার? রাখবি? রাখ না.. শিমুলের ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেসেজ। আচ্ছন্নতা কেটে গেল। চমকে উঠল।
বড়দার টেক্সট। মা আর নেই..
সমান্তরালে চলা একটা মালবাহী ট্রেন তখন ধুঁকতে ধুঁকতে চলে যাচ্ছে, অনেক দূরে..
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন