“কি বাবা? এই রাইত দুপুরে কই যাব বাবা? তোরা সারাদিন কত কাজকাম করিস আবার আমার জন্য এই রাইতের বেলাতেও বাইর হওয়া লাগবে? আহারে! ক্যান যে আমার এই শরীরটা খারাপ হইল!তোরা বুঝি হাসপাতালে নিয়া যাবি? আল্লাহ, আমার এই পোলাপানরা কিচ্ছু বোঝে না। আমি এমনিতেই ভাল হয়া যাব বাবা। তোরা অস্থির হইস না। আমি বুড়া মানুষ। বয়স হইছে, শরীর তো কিছু খারাপ হইবেই। তাওতো আমি ভালই থাকি। দম টেনে টেনে কথা বলেন।যখন বউরা সহ তোরা সবাই কাজকামে যাইতিস, আমি তো একলাই থাকতাম। সারাদিন দুধওয়ালা আসে, তোদের চিঠপত্র আসে, বাবু, ময়নারা ইশকুল থাকি ফেরে, কামের মানুষ শরিফা আসে, আমি ঠিকঠাক দরজা খুলি ফির বন্ধ করি। শরিফা খুব ভালো বাবা, বসি বসি আমার সাথে গফ করে। তাদের সংসারের ভালোমন্দ শোনায়। বাবা তোরা রাগ করিস না। আমার হাতে তো কিছু থাকে না, শরিফার স্বামীর জ্বরের কথা শুনি ওই চাউলের ড্রাম থাকি কিছু আতপ চাউল ওকে দিছি। তোরা রাগারাগি করিস না, আর আমি কিছু দেব না”।বহুকষ্টে চাপাকন্ঠে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে কোনরকমে মাকে গাড়ীতে তোলা গেল। গাড়ি চলছে ফাঁকা রাস্তা ধরে। শেয়ালরা নির্বিঘ্নে রাস্তা পারাপার করে। নিশুতি রাতে গাছভরতি পাখিগুলো ডাকাডাকি করে। পাখপাখালি যেন একেবারে রাজত্ব পেয়ে গেছে। সামনে দুজন বসেছে, তারা সুরক্ষিত। সুরক্ষার আপাদমস্তক সাদা পোষাক নিজেরা সংগ্রহ করেছে। পাখির ডাক তাদের অসহ্য লাগে। ‘এগুলাকে গুলি করতে পারলে ভালো হত’।গাড়ি চলছে। মা ঢুলছে। শরীরটা আর বসে থাকতে পারছে না। নিস্তেজ কন্ঠ বিড়বিড় করে “বাবা, আর কদ্দুর বাবা”? আকাশের শোকার্ত চাঁদটা তাকিয়ে থাকে নির্বিকার। রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঢুকে যায় জঙ্গলে। কিছুদূর যাবার পরে-ভাইজান, এখানেই, নাকি?আরেকটু ভেতরে চল…স্টিয়ারিং হুইলে নিষ্কম্প হাত। গাড়ি এগিয়ে যায় আরো গহনে। ঘন জঙ্গলের মাঝে অসুস্থ দলা পাকানো মানুষটাকে কসরত করে গাড়ী থেকে নামাতে দুজনে হাফিয়ে যায়। মায়ের মনে হয় তার জন্য ছেলেদের এত কষ্ট! তুমুল শ্বাসকষ্টের ভেতরই তিনি আরো কুন্ঠিত হয়ে পড়েন। জঙ্গল যতই ঘন হোক, চাঁদটা সব দেখতে পায়। চাইলেও আঁখিপল্লব বন্ধ করা যায়না, সে আর সহ্য করতে পারে না। দ্রুত ঘন মেঘের আড়া্লে লুকিয়ে পড়ে। ‘ভালো হলো, কিছুটা আন্ধার হলো’ গাড়ীটা নির্বিঘ্নে বাড়িতে ফেরে। স্টার্টের আগে অতি ম্রিয়মাণ একটা কন্ঠ শোনা যায় কি যায় না “সাবধানে যাইস বাবা”। গাড়ি, বাড়ি, নিজেদের শরীর সব জীবাণুমুক্ত করে তারা শুতে যায়। যাক বাবা, এখন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল! ছোটছেলের বড় মেয়েটার কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, বাবা কপালে হাত দিয়ে দেখে গায়ে উথাল পাতাল জ্বর।বড়ছেলে আপদমুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বস্তির ঘুম। ভোরের দিকে তার গলাটা ব্যথা করতে থাকে… জ্বরও আসছে…
করোনা কালের করুণ কাব্য !
আমি দুঃখিত এই কারণে যে, এই অণুগল্পটা আমার নজর এড়িয়ে গেল আগে ! আজ এই গল্প-পাঠ শুনলাম সুমনা ম্যাডামের কণ্ঠে। তারপর, এটা আবার পড়লাম। এত উঁচু মানের অণুগল্প যে, কোনো শব্দই প্রশংসার জন্যে যথেষ্ট নয়। নিখুঁত উপস্থাপন-গুণে চরিতগুলো মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে। চাঁদ এমন অমানবিক নৃশংস কাণ্ড ঘটতে চলেছে বলে মেঘের আড়ালে মুখ লুকোল, আপনি লিখেছেন কাজী লাবণ্য মহাশয়া…অসাধারণ ! আগাগোড়া গল্পটা মনছুঁয়ে গেল ! আন্তরিক শুভেচ্ছা আপনার জন্যে।