মোস্তফা মঈন

লোকটা জমিতে হালচাষ দিতে দিতে গাভীটার ওপর ভীষণ খেপে গেল। কিন্তু গাভীটার কী দোষ ছিল?
বেশ কিছুদিন ধরে নানান অবহেলায় গাভীটিকে পর্যাপ্ত খাবার দিচ্ছিল না চাষি। তার ওপর ভোরবেলায় গাভীটি না খেয়ে হালচাষ দিতে এসেছে খেতে। ভাদ্র মাস। হাঁটু সমান কাদা মাটি। লাঙল টানতে টানতে এখন ভরদুপুর। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। গোয়াল ঘরে তার তিন মাস বয়সী এঁড়ে বাছুরটাকে না খাইয়ে রেখে এসেছে সে। চাষি তার ওলান থেকে ভোরবেলায় সমস্ত দুধ দোহায়ে নিয়ে গেছে। এক ফোঁটা দুধও তার কচি বাছুরটি খেতে পায় নি! বাছুরটি হয়তো তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে গোয়াল ঘরের দরজায় মাথা ভাঙছে।
বাছুরটার জন্যে গাভীটির মন ভীষণ রকম খারাপ আজ। এদিকে লাঙল টানতে টানতে চাষির ধাতানি আর লাঠি পেটা খেয়ে তার পা আর চলছে না। ভাদ্রের কড়া রোদে সে এখন ভীষণ ক্লান্ত। গাভীটি দু’বার হাঁটু ভেঙে উবু হয়ে কাদার ওপর শুয়ে পড়েছিল। কাদায় লেপ্টে গেছে তার সমস্ত শরীর। কিন্তু চাষির বেদম মারপিট আর লাথি-গুঁতা খেয়ে সে তখন কোনরকমে ওঠে দাঁড়িয়ে ছিল। চাষ দিতে দিতে আরও অনেক সময় গেছে। এখন সে আর পারছে না। তার পা একটুও চলছে না।
কাঁধের ওপর কষে বাঁধা জোয়াল। ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। তার জোড়া সাঙ্গীটিও চাষির পিটুনি খাওয়ার ভয়ে দ্রুত হাঁটছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে কোনভাবেই হাঁটতে পারছে না।
এদিকে গাভীটির উপোসি পেট। ভোরবেলায় ঘাস-খড় কিংবা এক ফোঁটা পানিও তার পেটে পড়ে নাই। দুর্বল শরীর নিয়ে গাভীটা যখন হাঁটতে পারছিল না- হঠাৎ চাষি ভীষণ রকম খেপে গেল গাভীটির ওপর। রাগের চোটে গাভীটিকে সে আবার পেটাতে শুরু করলো। কিন্তু মুহূর্তেই চাষির হাতের লাঠির প্রচন্ড রকম একটা আঘাত গিয়ে পড়লো গাভীটির ডান চোখের ওপর! লাঠির আঘাতে চোখটা একেবারে গলে বেরিয়ে পড়লো!
চাষির সে খেয়াল নেই যে গাভীটির একটা চোখ বেরিয়ে পড়েছে! চিরতরে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে গাভীটির চোখ। গাভীটি চোখটা বেরিয়ে পড়ার যন্ত্রণায় চিৎকারও দিতে পারছে না। মারের চোটে গাভীটির সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। অথচ দুষ্টু চাষি গাভীটিকে বেদম পিটিয়েই যাচ্ছে!
হঠাৎ চাষি দেখল, গাভীটার ডান চোখটা গলে বেরিয়ে গেছে! চাষি বুঝে উঠতে পারছে না সে এখন কী করবে। দ্রত সেই চাষি গাভীটির কাঁধের জোয়াল খুলে, গাভীটিকে নিয়ে টেনে হিঁচড়ে গ্রামের এক পশু চিকিৎসকের কাছে গেল। চিকিৎসক গাভীটির ঝুলে পড়া চোখটা কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু গাভীটার অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। পশু চিকিৎসক চাষিকে খুব গালমন্দ করলেন। কিন্তু গালমন্দ করলে কী হবে, গাভীটির ভাগ্যে যা হবার তা তো হয়েই গেল!
পশু চিকিৎসকের পরামর্শে দীর্ঘদিন ধরে গাভীটিকে শহরের পশু হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হলো। ধীরে ধীরে গাভীটি সুস্থ হয়ে উঠলো। কিন্তু তার ডান চোখটা একেবারেই অন্ধ হয়ে গেল! গাভীটা এখন তার বাম চোখে দেখতে পায়। সুস্থ হয়ে সে আগের মতোই প্রতিদিন চাষির জমিতে লাঙল টেনে হালচাষ দেয়।
একদিন এভাবেই, সেই চাষি গাভীটিকে দিয়ে তার জমিতে হালচাষ দিচ্ছিল। সেই ভাদ্র মাস। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। দুপুর গড়াচ্ছে। কিন্তু চাষ দেয়ার সময় বড় বড় ডাঁশ মাছি এসে গাভীটিকে খুব জ্বালাতন শুরু করল। লাঙল টানতে টানতে গাভীটি তার লেজ দিয়ে ডাঁশগুলোকে তাড়াচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ কী হলো, মাছি তাড়ানো গাভীর লেজটা সজোরে গিয়ে লাগলো চাষির ডান চোখে। মুহূর্তে গাভীর লেজের শক্ত আঘাত লেগে চাষির ডান চোখটা একদম ফেটে বাইরে বেরিয়ে পড়লো!
লেজের কাদা ও গোবর লেগে চাষির চোখের অবস্থা তখন ভয়ানক খারাপ। চাষি তার খেতের ওপর গরু আর লাঙল-জোয়াল ফেলে চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে উঠলো। বাড়ির লোকেরা চাষির চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। দেখল পুরো চোখটা যে বেরিয়ে পড়েছে!
বাড়ির লোকেরা চাষিকে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেল। চাষির চোখ দেখে সার্জন স্তম্ভিত। চোখের ভেতর এত গোবর আর কাদামাটি ঢুকলো কী করে!?
হাসপাতালের সার্জন পুরো ঘটনা শুনলেন। সার্জন দেখলেন, চাষির চোখটা বাঁচিয়ে রাখার কোনো অবস্থা নেই। চাষি তার চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে না। চোখটা দ্রুত কেটে ফেলে দিতে হবে। তার পুরো চোখটাই নষ্ট হয়ে গেছে। চাষিকে সুস্থ করতে সার্জন খুব দ্রুত তার ডান চোখটা কেটে ফেলে দিলেন।
চাষি হাসপাতালের বেডে শুয়ে অনুশোচনা করছে। আর সে তার কর্মফল ভাবছে। কেন সে অকারণে মারপিট করে গাভীটির চোখটা নষ্ট করেছিল। এখন তো নিজের চোখটাই গেছে! ব্যথিত চাষি চোখের যন্ত্রণায় ছটফট করে।
গাভীটির চোখ অন্ধ করে দেয়ার ঘটনা পুরো গ্রামবাসীরা জেনে গেছে। দুষ্ট সেই চাষির ওপর গ্রামের সব মানুষ খেপে আছে।
দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর চাষি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু তার ডান চোখটা চিরদিনের মতোই অন্ধ হয়ে গেল!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন