রাজশ্রী বসু অধিকারী
টিউ জানলার দিকে খেয়াল রাখছিল। উত্তাল যায় কি না রাস্তা দিয়ে। কাল যায়নি, পরশুও না। অথচ তার আগে পুরো ছেষট্টি দিন সকাল দুপুর বিকেল এবং রাত চারবেলা এই জানলার পাশ দিয়ে গিয়েছে। বলা ভাল পরিক্রমা করেছে। প্রথম সাতদিন টিউ ছাদে দাঁড়িয়ে দেখত হেঁটে বা সাইকেল নিয়ে যাওয়া উত্তালকে। তারপর নেমে এসে এই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। না হলে যে ওই ডাকাতটাই দাঁড়িয়ে থাকত সারাক্ষন। অত সুন্দর চোখ আর নরম দাড়ির ছেলেকে কি ওরকম কষ্ট দেওয়া যায় নাকি? কক্ষনো তা পারবেনা টিউ। পারেওনি। তার ফলে এখন নিজে কষ্ট পাচ্ছে। ঠিক ছেষট্টি দিন পর থেকে শুরূ হয়েছে এই অসহ্য কষ্ট। তবে ভেবে দেখলে, আগের আগের বার গুলোতে পঞ্চাশদিন পার হয়নি কেউ। উত্তালই ষোলদিন বেশী ব্যাটিং করল। এখন প্রশ্ন একটাই ,খেলা কি শেষ নাকি শুরু?
এই যে উত্তাল আর আসছেনা, ফোন করছে না, করলে ধরছে না, এই যে হঠাত নেমে আসা দমবন্ধকরা নীরবতা, এটাকেই কি ব্রেক আপ বলে? ওদের কি ব্রেক আপ হয়ে যাচ্ছে? জানলার গ্রীলের বাইরে রাস্তাটার শেষমাথায় ঝুঁকে পড়া গাছগুলোর সোহাগী চলনের দিকে তাকিয়ে থেকে টিউ ভাবে। ভাবে আর গলার ভেতর চেপে ধরা অস্বস্তি, বুকে নাছোড় মাদল, চোখের পাতায় অনেকখানি মরূভুমির হাওয়া, এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রে সেজে ধেয়ে আসা মনখারাপের মোকাবিলা করতে তৈরী হয়। হাতের মোবাইল অযত্নের ধূলো মেখেছে। প্রিয় পুরাতনী গানের সিডিগুলো সব অগোছালো। একঢাল খোলা চুলে কতদিন যেন মাখা হয়নি সুগন্ধী সেই ক্রীমটা। ওই গন্ধটা খুব প্রিয় ছিল না উত্তালের? চুলে মুখ ডুবিয়ে কতদিন না সে ভুলে গিয়েছে পৃথিবী? আর তাহলে কি হবে সেই গন্ধ? আর তো কাউকে দিতে পারবে না টিউ।
সন্ধ্যে হয়েছে কখন যেন। জানলায় শুধু চাপ চাপ অন্ধকার। শুধু মাঝে মাঝে খড়খড় শব্দ, এই বুঝি কেউ সাইকেল চালিয়ে গেল শুকনো পাতার বিছানায়। এখন আকাশী নীল শাড়ীর আঁচল ঘরের মেঝেয় ছড়ানো। কেমন মনে হয়েছিল এই রংটার টানে টানে একবার উত্তাল সেই ঢেউ এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর কাছে। এখন রাত আটটা প্রায়। কেউ তো আসেনি। আসবেওনা বোধহয়। টিউ অপেক্ষা করে করে স্ট্যাচু। ওর শরীর নড়ে না। শুধু মন দৌড়ে বেড়ায় সারা ঘরে।
উত্তাল কবে যেন এসেছিল আমার জীবনে? ছেষট্টি দিন আগে? এতগুলো দিনে কিছুই তৈরী হয়নি? কোন সম্পর্ক? একচুমুক সত্যি ভালবাসা? যদি এটা সত্যি হয় তাহলে ওই আগের আগের সব মানুষগুলো? ওরা কে ছিল? ওরা কেন? ওগুলো সব মিথ্যে?
ওগুলো সব মিথ্যে। কারন ওদের চলে যাওয়ার দিনে কোন বৃষ্টি পড়েনি। কোন গান আমার ভেতর টুকরো টুকরো বেজে যায়নি সারাক্ষন, সারাক্ষন। কিন্তু এখন? এই চারদিন ধরে এসব কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? কেন হচ্ছে? কেন সব সুর এলোমেলো? সব সকাল অন্ধকার? সব ফুলগুলো কাগজের? উফফ … এটা কি? এটাই কি সত্যি ভালবাসা? তাহলে এই যে এত কষ্ট, এটাও বা কি? এটাকেই ব্রেক আপ বলে বুঝি?
আকাশী শাড়ীটায় মুখ ঢেকে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ে টিউ। আর ঠিক তক্ষুনি, মেনডোরের বেলটা বেজে ওঠে। জানলা দিয়ে নয়, এতদিনের ভাবনা আজকে সিদ্ধান্তে বদলে দিতে সোজাসুজি দরজা দিয়েই ঢুকে পড়তে চাইছে উত্তাল। কে যেন দরজা খুলে দিয়েছে ওকে। অন্ধকার ঘরে ভেসে আসা ঢেউএর আওয়াজে আকাশী শাড়ীর তলায় উপত্যকা কেঁপে ওঠে। মরা ডালে ফুটে ওঠে রং বেরং এর ফুল। দেওয়ালের গায়ে হাজার তারা হাসছে। টিউ বন্ধ থাকা নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে নিজেকে বলে, হ্যাঁ, এটাই সত্যি ভালবাসা।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন