micro-story-strabery-ronger-nighty

স্ট্রবেরি রঙের নাইটি
পার্থ দে


পার্কের গা ঘেঁষে দোকান। ছোট দোকান। চা, কফি, সিগারেট, বাটার টোস্ট, ডিমের ওমলেট, সসপ্যানে ম্যাগি এইসব পাওয়া যায়। ছেলেটার বন্ধুদের কেউ একজন দোকানের মালিক। দোকানের সামনের বেঞ্চিটা কখনও ফাঁকা থাকে না। জ্বলন্ত সিগারেটের কাউন্টার ওর বন্ধুদের আঙুল থেকে আঙুলে ঘোরে। ছেলেটা পাতি গ্র‍্যাজুয়েট, কাঠ-বেকার, পকেটেও রেস্ত নেই। ওর বাবা বলে, ওর কোনো অ্যাম্বিশন নেই, জীবনে কী হতে চায় তাও জানে না! কিন্তু মুখে একটা সরল হাসি লেগে থাকে। সত্যি বলতে, ওই হাসিটার জন্য ওকে আরও বোকাটে দেখায়। 

পার্কের উল্টোদিকে একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। রাস্তামুখী দোতলার বারান্দায় রঙিন ফুলের টব। মানিপ্ল্যান্ট উঠেছে লতিয়ে লতিয়ে। ছেলেটা জানে, যাদের ঘরে মানিপ্ল্যান্ট থাকে, তাদের প্রচুর টাকা হয়। সে শুনেছে, নিচের গ্যারেজে ওদের একটা কালো সেডান দাঁড়িয়ে থাকে। অবিশ্যি টাকাপয়সার ব্যাপারে ওর আগ্রহ কম। ও দেখে দোতলার বারান্দার তারে মাঝেমধ্যে একটা স্ট্রবেরি রঙের নাইটি ঝোলে। সেই নাইটির মালকিন থাকে বারান্দা-লাগোয়া ঘরে। বৃষ্টির দিনে সে-ঘর থেকে ভেসে আসে শুভমিতার গান— ‘দেখেছ কি তাকে ওই নীল নদীর ধারে / বৃষ্টি পায়ে পায়ে তার কী যেন কী নাম’! নাহ্‌, শুভমিতার গান যে গায়, যার শরীর জড়িয়ে থাকে স্ট্রবেরি রঙের নাইটি, ছেলেটা তার নাম জানে না। তবে নাম না-জানলেও চার-পাঁচবার দেখেছে ওই ফ্ল্যাটের বারান্দায়। একমাস হল ওরা এ-পাড়ায় নতুন ফ্ল্যাট কিনে এসেছে। ছেলেটাও তো এ-পাড়ায় থাকে না, খালপাড়ের কলোনিতে থাকে। 

গত তিন-চারদিন নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। দুদিন আগে বৃষ্টির মধ্যে স্ট্রবেরি নাইটি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রেলিংয়ের বাইরে বাড়ানো তার হাতে বৃষ্টির ফোঁটা। ধুয়ে যাচ্ছে ফরসা আঙুল। 

ছেলেটার মনে সেদিন জীবনে প্রথমবার একটা অ্যাম্বিশন এল। তার বৃষ্টি হতে ইচ্ছে করল। 

কিন্তু বৃষ্টি হওয়া আর হল না। বৃষ্টির দিন যে ফুরিয়ে এসেছে। ততদিনে বৃষ্টি সরে গিয়ে মেঘরঙের শরৎ হাজির। নরম রোদ পিছলে পড়েছে দোতলার বারান্দায়। সেই রোদ পিঠের ওপর নিয়ে স্ট্রবেরি রঙের নাইটি সেদিন কোলের ওপর একটা বই খুলে বসেছে। 

ছেলেটা সেদিন দ্বিধায় পড়ে গেল। বুঝে উঠতে পারছিল না সে কী হবে— রোদ হবে, না বই! বই হলে মেয়েটার কোলের ওপর পড়ে থাকবে অনেকক্ষণ। কিন্তু রোদ হওয়াই বা কম কথা কি! শেষমেশ ঠিক করল সে অমলকান্তির মতো রোদ্দুরই হবে! 

রোদ্দুর হওয়ার জন্য যা যা করার সব করল সে। ভোরে উঠে সূর্যদেবের স্তব করল, পথ-কুকুরদের ভাত খাওয়াল, বুড়োবুড়িদের বাড়ির বিদ্যুতের বিল জমা দিল, গরীব বাচ্চাদের সান্ধ্য স্কুলে রোজ পড়ানো শুরু করল। সত্যি বলতে, একটু একটু করে সে ঠিকঠাক রোদ্দুর হয়ে উঠছিল। কিন্তু অন্য একটা মুশকিল হল। 

ততদিনে মেয়েটার রোদ্দুরের দিকে আর মন নেই। সে তুষার পছন্দ করতে শুরু করেছে। সে বিয়ে করে যে দেশে তুষার পড়ে সে-দেশে পাকাপাকিভাবে চলে গেল। স্ট্রবেরি রঙের নাইটিটাও অন্য দেশের অন্য কোনো শহরের বারান্দার তারে ঝুলতে লাগল।  

ছেলেটা তখন অনেক ভেবেচিন্তে পাখি হতে চাইল। পাখি হলে অন্য দেশে অন্য শহরে পাড়ি দিয়ে স্ট্রবেরি রঙের নাইটির কাছে যাওয়া যাবে! সে একটু ওড়ার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু তার ডানায় তো আর অত জোর নেই। বিশ্ব-নাগরিক হতে গেলে যে বিদ্যের জোর লাগে!  

অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে সে ঠিক করল, এবার বরং বই হওয়া যাক। 

শেষ পর্যন্ত ছেলেটা একটা বই-ই হল। যার যেমন কপাল! স্ট্রবেরি রঙের মলাটের কবিতার বই, যার ভিতর লেগে আছে রোদ-বৃষ্টি আর পৃষ্ঠাগুলো পাখির মতো ডানা ঝটপটায়।  

2 thoughts on “micro-story-strabery-ronger-nighty

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *