সুকল্প ও রেনিরার প্রেম
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
সুকল্প আর রেনিরার প্রেম কলেজ জুড়ে আলোড়ন ফেলেছিল। ওদের প্রেমের নামকরণ হয়েছিল ‘ইকোজিক্স প্রেম’। গ্র্যাজুয়েশনে সুকল্পর অনার্স ছিল ফিজিক্সে আর রেনিরার ইকনমিক্সে। এর আগে এমন কম্বিনেশন নিয়ে পড়তে আসা ছেলেমেয়ের প্রেম হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। তারপরেও ওরা ছিল প্রেমে অনন্য। উদাহরণ টেনে ওদের প্রেমের ভার, ভাব আলোচনা করা ঠিক নয়। ওদের প্রেম শুধুমাত্র গাঢ়, মাখোমাখো নয়। আরও কিছু। সেই ‘আরও কিছু’র জন্যই ওদের প্রেম ‘বিশেষ’।
দুজনের পিএইচডি শেষের দিকে। এরপর ওরা বিদেশে যাবে। এমন ভাবনা ওদের বহুদিনের। দুজনের সম্পর্কের কথা দুই বাড়ির লোকজন জানে। তাঁদের ইচ্ছে বিদেশে যাওয়ার আগে ওরা যেন বিয়েটা সেরে নেয়। বিয়ে নিয়ে সুকল্প ও রেনিরা কী ভাবছে?
মাসখানেক আগের কথা।
রেনিরার জরুরী তলবে সুকল্প এসেছে মিলেনিয়াম পার্কে।
“কী রে, জরুরি তলব কীসের?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রেনিরা বলে, “তোকে কিছু কথা বলার আছে। যা এখনই না বললে নয়।”
“কী কথা?”
“সোজাসুজি বলি। আমাদের দুই বাড়ির লোক চাইছে বিদেশ যাওয়ার আগে আমরা এখানে বিয়েটা করে যাই। এই বিষয়ে আমার আপত্তি আছে। তোর কী মত?”
“তুই কী চাইছিস বল?” সুকল্প বলে।
“যদি বলি তোকে বিয়ে করতে চাই না। ইনফ্যাক্ট কোনওরকম জোরাজুরির মধ্যে তোকে ধরে রাখতে চাই না।”
“আর কিছু বলবি?” সুকল্প প্রশ্ন করে।
“আমি মনে করি আমাদের প্রেম হবে অনেকটা রবি ঠাকুরের উপন্যাসের মতো।”
“চিরকালীন, শাশ্বত!”
“হয়তো তাই।”
“কী করতে চাস এখন?”
“আমি চাই আমাদের প্রেমে মিউচুয়াল সেপারেশন হোক।”
“মিউচুয়াল সেপারেশন!”
“হ্যাঁ। বিয়েতে যদি মিউচুয়াল সেপারেশন নেওয়া যায়, প্রেমে কেন নয়?”
রেনিরার পাশ থেকে উঠে সুকল্প কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কী ভাবছে সুকল্প? রেনিরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর উঠে এসে সুকল্পর কাঁধে হাল্কা হাতে চাপ দেয়।
রেনিরার হাতের ওপর হাত রেখে সুকল্প বলে, “বেশ। একমাস বাদে আমরা এখানে দেখা করব।”
একমাস পর
ওরা এসেছে গঙ্গার ধারে। এতদিন পর্যন্ত দুজনের যখন দেখা হয়েছে রেনিরা বেশি কথা বলেছে। আজ রেনিরা চুপ।
সুকল্প শুরু করে বলতে, “আমি সেই দিনই তোকে বলতে পারতাম। বলিনি। কারণ গত কয়েকমাস ধরে কিছু প্রশ্ন আমার মনেও ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই প্রশ্নগুলো আরও একবার নিজের মনে ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। রেনি, তোকেও কোনও নির্দিষ্ট সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে রাখতে চাই না। সম্পর্ক নানারকমের প্রত্যাশা তৈরি করে। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলে প্রথমে আসে সম্পর্কে তিক্ততা। তা ক্রমশ সম্পর্ককে ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়। নাহলে অ্যাডজাস্টমেন্ট শব্দের বাঁধনে আটকে পড়ে কাটাতে হয় গতানুগতিক জীবন। সেই জীবনে প্রেম কোথাও থাকে না।”
“আর কিছু বলবি?” রেনিরা জানতে চায়।
“জানিস রেনি, সেদিন তোর বলা কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল এ তো আমারই কথা! রেনি জানল কেমন করে? সেদিন তোকে আদরে-আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। শুধুমাত্র নিজের মনের কাছে আরও একটু পরিষ্কার হয়ে নেওয়ার জন্য তোর কাছে সময় নিয়েছিলাম।”
রেনিরা এগিয়ে আসে সুকল্পর দিকে। ওর চোখে চোখ রেখে বলে, “আমাদের প্রেম হবে অলংকারের বাক্সের এককোণে রাখা মুক্তোর মতো। পরবর্তী জীবনে আমাদের যখন কর্তব্য, দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে দমবন্ধ লাগবে তখন স্মৃতির বাক্সে রাখা ‘মুক্তো’ আমাদের একঘেয়েমি, ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেবে।”
পাঁচ বছর পর
রেনিরা দোহা বিমানবন্দরে একটি ক্যাফের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। ডালাস থেকে দেশে ফিরছে। এখানে ওর লে-ওভার। গতমাসে মার্টিনের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। হঠাৎ বাংলা কথা শুনে রেনিরা চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে সুকল্প একজন মহিলা আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ক্যাফের দিকে আসছে। মহিলা নিশ্চয়ই সুকল্পর স্ত্রী। বাচ্চাদুটো সুকল্পকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। হাসিমুখে সুকল্প সেসব সামলাচ্ছে। সুকল্প স্ত্রীর কাছে বাচ্চাদুটোকে রেখে কাউন্টারে রেনিরার পাশে এসে দাঁড়ায়।
স্বাভাবিক স্বরে রেনিরাকে বলে, “তোর কফির দামটা দিতে পারি?”
রেনিরা বলে, “নিশ্চয়ই।” বাচ্চাদুটোর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর টুইন বেবি?”
সুকল্প মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
রেনিরা বলে, “ভেরি নাইস।”
কফির কাপ হাতে নিয়ে রেনিরা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসে।

বাহ্ ভাল লাগল। খুব চেনা গল্প।