বৈশাখী ঠাকুর
আমার এই বিশেষ ক্ষমতার কথা আমি আগে কখনও শুভময়কে বলিনি। আসলে প্রয়োজন পরেনি। আমার যখন আট বছর বয়স তখন আমার বাবা বদলি হয়ে চন্দননগর আসে। সেখানে যে বাড়িটা আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম সেটার চারিপাশে সুন্দর ছোট্ট একটা বাগান ছিল। বাড়িওয়ালারা ওপরে থাকত। আমরা থাকতাম একতলায়। প্রথম দিন এসেই আমাকে ফিওনা সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। বলেছিল ও খুব খুশি হয়েছে যে আমি এসেছি। এক মাথা সোনালি চুল। নীল চোখ। গোলাপি রঙের একটা লেসের ফ্রক পরে সে এসে গোলাপ ঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মিষ্টি হেসে নিজের পরিচয় দিয়েছিল। তখনই আমি জানতে পেরেছিলাম এক গভীর অসুখে ওর মৃত্যু ঘটেছে। এই বাগানেই ওকে কবর দেওয়া হয়। তারপর ওর মা বাবার আর এই বাড়িতে থাকতে ভাল লাগত না। তাই তারা বিক্রি করে দিয়ে ফ্রান্সে ফিরে যায়।
এই গল্প যখন আমি আমার বাবা মাকে বলেছিলাম সবাই হেসে বলেছিল চন্দননগর যে এককালে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল সেটা সদ্য জেনে আমার কল্পনার পাখনা মেলেছে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই এর হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। আমার বাবা মা দুজনেরই ভীষণ গাছের শখ। বাড়িওয়ালার থেকে অনুমতি নিয়ে তাই মা বাবা নিজেদের শখের বাগান করতে লেগে পরেছিল। মা পেছন দিকটায় যথারীতি সব্জি বাগান করবে বলে ঠিক করেছে। ওখানেই খুঁড়তে গিয়ে সাক্ষাৎ হল আমার বন্ধুর সাথে। নামটা ফিওনা দেখে তো সকলেই তখন ভীষণভাবে আশ্চর্য। এরকম আরও দু চারবার ঘটেছে তবে তারপর আমরা উত্তর কলকাতার কাছে একটা ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ী ভাবে চলে আসি। সেই থেকে ওখানেই আছি যতদিন না হায়দারবাদে চাকরি করতে যাই। সেখানেও যে লেডিস হোস্টেলে ছিলাম সেখানেও আনক্যানী কোন ফিলিং হয়নি। তারপর তো শুভময়ের সাথে সাক্ষাৎ। পরে ওর কোয়ার্টারেই লিভ ইন করতাম।
বিন্দাস ছিলাম। অভিভাবকহীন লাগাম ছাড়া এক অন্যন্য স্বাধীনতার জীবন। একটু বয়সটা বেশিই শুভময়ের আমার থেকে তবে সেটা আমাদের সম্পর্কের পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বেশ কাটছিল দিনগুলো —নির্ভাবনায়, নির্বিঘ্নে। কিন্তু আমার খুড়তুতো দিদি একবার ভাইজ্যাগ বেড়াতে এসে আচমকা একটা সারপ্রাইজ ভিসিট দিয়ে সব ভন্ডুল করে দিল। আমাদের মত মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে লিভ ইন রিলেশানশিপ এখনও বেশ ভাল মশলার রসদ যোগায়। ফলস্বরূপ বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসতে লাগল। অগত্যা কলকাতায় এসে ছাদনাতলায় বসলাম। শুভময়ের বন্ধুবান্ধব সবাই উপস্থিত ছিল। সঙ্গে আরো বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন যারা কিনা কলকাতায় থাকে। শুভময়ের বাবা মা কাঁথিতে বাস করেন। বয়স হয়েছে। আর অত যাওয়া আসা করতে পারেন না। তাই আমাকে নিয়ে ও রেজিস্ট্রির পর দেশের বাড়িতে গেল।
ওদের দেশের বাড়ি একটা গ্রামের ভেতর। কি সুন্দর পুকুর ঘাট —দোতলা মাটির ঘর— হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে –দড়মা দেওয়া বাড়ি। এই গ্রামের ইস্কুলে পড়ে আজ শুভময় সাফল্যের এই শীর্ষে। মাইক্রোসফটের মত বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। ভাবতেই গর্বে ভরে উঠল বুকটা আমার।
কিন্তু ওদের দেশের বাড়ির নিকনো উঠোনে পা দিতেই তমালী ওদের বড় বাতাবীলেবুর গাছের আড়ালে থেকে আমায় ইশারা করল। মিষ্টি হেসে বলল,
—— আমিও তোমার আগে এই ঘরে বৌ হয়ে এসেছিলাম। গেঁয়ো ভূত তো। পড়াশোনা জানি না। পয়সাকড়িও তেমন দিতে পারে নি আমার বাবা মা। বাচ্চা হওয়ার সময় বাপের বাড়ি যে গেলাম আর আমায় কেউ আনতে গেল না। হাতে পায়ে পরল আমার মা বাবা কিন্তু শুভময় আমাকে আর বৌ হিসেবে মেনে নিল না। একদিন রাতে তাই এই বাতাবি লেবুর গাছে দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লাম। তোমার ওপর আমার রাগ নেই। পারলে আমার মেয়েটাকে দেখ।
শাশুড়ির হাতের রান্না মন্দ না। জুত করে খেয়ে শুতে গেছি, তখন ফের দেখি জানলার ধারে তমালী। ওর বাপের বাড়ির ঠিকানাটা বলে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পরদিন প্রাতঃভ্রমণের নাম করে বেরিয়ে উপস্থিত হলাম তমালীর বাপেরবাড়িতে। খুব বেশী দূরে ছিল না। সাত সকালে আমাকে খুঁজে না পেয়ে শুভময় ফোন করতেই লাগল। ওকে নির্দেশ দিয়ে ডেকে পাঠালাম। ও ভেতরে কিছুতে আসতে চাইল না। আমি তিন বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে বাইরে এলাম। শুভময়কে জিজ্ঞেস করলাম,
—– চিনতে পার?
—– তোমাকে আমি সব বলতাম। কিন্তু তুমি এসব কি করে জানলে?
—– তমালী বলল তো। তোমার আর তমালীর নাম মিলিয়ে ওর নাম রেখেছি সুমালি।
আমার দিকে শুভময় কেমন অবিশ্বাসের চোখে তাকাল। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে বুঝি এত বেশী অবিশ্বাস জমে ছিল যা ওর অবিশ্বাসকে ছাপিয়ে গেল।
সুমালির হাত ধরে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভীষন ভালো লাগলো। সত্যিই কত অজানা জিনিস আছে। সুমালী ভালো থাকুক।
আন্তরিক ধন্যবাদ।
বেশ ভালো লাগলো পড়ে। অনেক শুভেচ্ছা রইলো ।
আন্তরিক ধন্যবাদ। প্রতি শুভেচ্ছা জানবেন। ভাল থাকবেন।