সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
‘ছেলেগুলোকে দেখে বেশ ভালো লাগল।’
‘কাদের কথা বলছেন মশাই?’
‘ঐ যে পাড়ার ক্লাবের ছেলেগুলো, কী সুন্দর স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। আবার প্রয়াত বিপ্লবী বারীন বিশ্বাসের মূর্তি স্থাপন করেছে আজ দেখলাম। উনি যে এই পাড়ায় থাকতেন, জানতামই না।’
‘আপনি বোধহয় এদিকে নতুন এসেছেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, এই তো মাস দুয়েক হ’ল। কেন বলুন তো?’
‘হুম। সে বুঝতেই পারছি। না হলে এসব আর বলবেন কেন? সব জানলে … ’
‘মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু ভেঙ্গে বলবেন?’
‘বলছি। আগে এই চায়ের দোকান ছেড়ে একটু ওদিকটায় চলুন, এখানে সব কথা বলা সেফ না।’
‘সেকী! কিন্তু …’
‘আহ, কোনও কিন্তু নয়। আসুন এদিকে।’
‘আচ্ছা। … ঠিক আছে, এবার বলুন কী বলছিলেন।’
‘আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা। প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী বারীনবাবু তখন অশীতিপর, অশক্ত। প্রায় শয্যাশায়ী বলা চলে। স্ত্রী গত হয়েছেন। বাড়িতে শুধু একমাত্র মেয়ে ব্রততী। বিবাহবিচ্ছিন্না। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার করত, জামাইয়ের চরিত্রেও দোষ ছিল। অমন বাপের মেয়ে। সইবে কেন? আইনি পথে লড়েই বেরিয়ে এসেছিল স্বেচ্ছায়। বাবার সঙ্গেই থাকত।’
‘আচ্ছা।’
‘তারপর এল সেই রাত। সেটাও এক ১৪ই অগস্টের রাত। ১২টা বেজে গেছে। মানে বিলিতি মতে ১৫ই অগস্ট পড়ে গেছে। আপনার দেখা এই ছেলেপুলেরাই তখন লাল জল, ধোঁয়া সহযোগে একটু স্বাধীনতা উদাযাপন করছিল।’
‘সেকী!’
‘এতেই আশ্চর্য হলেন? তারপর শুরু হল মুহুর্মুহু বোমাবাজির দাপট। ইংরেজরা তো আর নেই। হয়ত কল্পনায় কোনও অদৃশ্য শত্রুকে তাড়ানোর জন্যই এইসব। একটু উল্লাস আর কি।’
‘তা কাল রাতেও আমি বাজি পটকার আওয়াজ কিছু পেয়েছিলাম বটে। সাধারণ বাজির চেয়ে বেশ জোরালোই সে শব্দ। আমি তো শুনেছিলাম শব্দবাজি নাকি নিষিদ্ধ!’
‘নিষেধ করলেই বা মানছে কে বলুন? বৃদ্ধ বারীনবাবুর হৃদরোগ ছিল। ব্রততী বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ করেও সেই ভয়ানক আর উৎকট আওয়াজ রুখতে পারল না। অবশেষে ক্লাবে যাওয়াই মনস্থ করল।’
‘তারপর?’
‘তারপর সে পাড়ার ছোট ছোট ভাইদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করল এই শব্দের অত্যাচার বন্ধ করতে। কিন্তু ভাইদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। একে তো বারীনবাবু তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের দাদাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন, দলে যোগদানের জন্য বলা হয়েছিল তাঁকে। এমন একটা মুখ সামনে থাকলে প্রচারে সুবিধা হয় কিনা। পিছনে যাই হোক না কেন। অবশ্য বিনিময়ে কিছু সরকারী সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু বারীনবাবু তাদের রীতিমত অপমান করেই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই তাঁর মেয়ে কিনা এসেছে আবদার করতে? তা আবদার তারা রেখেছিল বটে। নেশায় চুরচুর রক্তবর্ণ চোখে ঐ রাতের উৎসবের আবহে স্বাধীনচেতা মেয়েটির প্রতি করুণা করেছিল তারা। বিবাহবিচ্ছিন্না যখন, সুখের কাঙালিনী কি সেও নয়? সে সুখের সন্ধানেই কি সে এতরাতে ছেলেদের এই ক্লাবে আসেনি? অকাট্য যুক্তি, সন্দেহ নেই! গণধর্ষণের পর তার দেহটা কীভাবে পরদিন রেললাইনে পাওয়া গেছিল, স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনও তদন্ত হয়নি।’
‘ইশ! কী বলছেন! আর বারীনবাবু?’
‘উনি পুণ্যাত্মা মানুষ ছিলেন। তাই মেয়ের এই দুঃসংবাদ আর তাঁকে শুনে যেতে হয়নি। ঐ রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মুক্তি লাভ করেন।’
‘তাহলে, তাহলে এখন যে এসব …’
‘আর বলেন কেন। সরকার থেকে বলে দিয়েছে সমস্ত প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সসম্মানে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যে পাড়াগুলোতে এমন বিপ্লবীরা ছিলেন, তাদের উপরে বাড়তি দায়িত্ব বর্তায় স্বভাবতই। যেখানে যত ভালো করে এসব করা হবে, তাদের তত বেশি পুরস্কার আর রাজানুগ্রহ জুটবে। অগত্যা, সেই দামাল ছেলেরাই আজ বারীনবাবুর আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করবে, এতে আর আশ্চর্য কী!’
বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই স্থাণুবৎ বসে থাকেন একটি গাছের নিচে। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে – ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হামারা …’
‘কাদের কথা বলছেন মশাই?’
‘ঐ যে পাড়ার ক্লাবের ছেলেগুলো, কী সুন্দর স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। আবার প্রয়াত বিপ্লবী বারীন বিশ্বাসের মূর্তি স্থাপন করেছে আজ দেখলাম। উনি যে এই পাড়ায় থাকতেন, জানতামই না।’
‘আপনি বোধহয় এদিকে নতুন এসেছেন, তাই না?’
‘হ্যাঁ, এই তো মাস দুয়েক হ’ল। কেন বলুন তো?’
‘হুম। সে বুঝতেই পারছি। না হলে এসব আর বলবেন কেন? সব জানলে … ’
‘মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। একটু ভেঙ্গে বলবেন?’
‘বলছি। আগে এই চায়ের দোকান ছেড়ে একটু ওদিকটায় চলুন, এখানে সব কথা বলা সেফ না।’
‘সেকী! কিন্তু …’
‘আহ, কোনও কিন্তু নয়। আসুন এদিকে।’
‘আচ্ছা। … ঠিক আছে, এবার বলুন কী বলছিলেন।’
‘আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা। প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী বারীনবাবু তখন অশীতিপর, অশক্ত। প্রায় শয্যাশায়ী বলা চলে। স্ত্রী গত হয়েছেন। বাড়িতে শুধু একমাত্র মেয়ে ব্রততী। বিবাহবিচ্ছিন্না। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার করত, জামাইয়ের চরিত্রেও দোষ ছিল। অমন বাপের মেয়ে। সইবে কেন? আইনি পথে লড়েই বেরিয়ে এসেছিল স্বেচ্ছায়। বাবার সঙ্গেই থাকত।’
‘আচ্ছা।’
‘তারপর এল সেই রাত। সেটাও এক ১৪ই অগস্টের রাত। ১২টা বেজে গেছে। মানে বিলিতি মতে ১৫ই অগস্ট পড়ে গেছে। আপনার দেখা এই ছেলেপুলেরাই তখন লাল জল, ধোঁয়া সহযোগে একটু স্বাধীনতা উদাযাপন করছিল।’
‘সেকী!’
‘এতেই আশ্চর্য হলেন? তারপর শুরু হল মুহুর্মুহু বোমাবাজির দাপট। ইংরেজরা তো আর নেই। হয়ত কল্পনায় কোনও অদৃশ্য শত্রুকে তাড়ানোর জন্যই এইসব। একটু উল্লাস আর কি।’
‘তা কাল রাতেও আমি বাজি পটকার আওয়াজ কিছু পেয়েছিলাম বটে। সাধারণ বাজির চেয়ে বেশ জোরালোই সে শব্দ। আমি তো শুনেছিলাম শব্দবাজি নাকি নিষিদ্ধ!’
‘নিষেধ করলেই বা মানছে কে বলুন? বৃদ্ধ বারীনবাবুর হৃদরোগ ছিল। ব্রততী বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ করেও সেই ভয়ানক আর উৎকট আওয়াজ রুখতে পারল না। অবশেষে ক্লাবে যাওয়াই মনস্থ করল।’
‘তারপর?’
‘তারপর সে পাড়ার ছোট ছোট ভাইদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করল এই শব্দের অত্যাচার বন্ধ করতে। কিন্তু ভাইদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। একে তো বারীনবাবু তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলের দাদাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেছিলেন, দলে যোগদানের জন্য বলা হয়েছিল তাঁকে। এমন একটা মুখ সামনে থাকলে প্রচারে সুবিধা হয় কিনা। পিছনে যাই হোক না কেন। অবশ্য বিনিময়ে কিছু সরকারী সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু বারীনবাবু তাদের রীতিমত অপমান করেই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই তাঁর মেয়ে কিনা এসেছে আবদার করতে? তা আবদার তারা রেখেছিল বটে। নেশায় চুরচুর রক্তবর্ণ চোখে ঐ রাতের উৎসবের আবহে স্বাধীনচেতা মেয়েটির প্রতি করুণা করেছিল তারা। বিবাহবিচ্ছিন্না যখন, সুখের কাঙালিনী কি সেও নয়? সে সুখের সন্ধানেই কি সে এতরাতে ছেলেদের এই ক্লাবে আসেনি? অকাট্য যুক্তি, সন্দেহ নেই! গণধর্ষণের পর তার দেহটা কীভাবে পরদিন রেললাইনে পাওয়া গেছিল, স্বাভাবিক ভাবেই তার কোনও তদন্ত হয়নি।’
‘ইশ! কী বলছেন! আর বারীনবাবু?’
‘উনি পুণ্যাত্মা মানুষ ছিলেন। তাই মেয়ের এই দুঃসংবাদ আর তাঁকে শুনে যেতে হয়নি। ঐ রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মুক্তি লাভ করেন।’
‘তাহলে, তাহলে এখন যে এসব …’
‘আর বলেন কেন। সরকার থেকে বলে দিয়েছে সমস্ত প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সসম্মানে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যে পাড়াগুলোতে এমন বিপ্লবীরা ছিলেন, তাদের উপরে বাড়তি দায়িত্ব বর্তায় স্বভাবতই। যেখানে যত ভালো করে এসব করা হবে, তাদের তত বেশি পুরস্কার আর রাজানুগ্রহ জুটবে। অগত্যা, সেই দামাল ছেলেরাই আজ বারীনবাবুর আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করবে, এতে আর আশ্চর্য কী!’
বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই স্থাণুবৎ বসে থাকেন একটি গাছের নিচে। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে – ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হামারা …’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বাস্তব। নির্মম এবং নিশ্চিত।
বাস্তব। দারুণ গল্প
অসাধারণ অণুগল্প তোমার সপ্তর্ষি! দারুণ উপস্থাপন! তোমার লেখার দর্পণে ফুটে উঠেছে সমাজের সত্যিকারের চিত্র । যুগে যুগে এমন হয়েছে। অবশ্য বিপরীত চিত্রও যে সমাজে নেই, তা নয়। কিন্তু, এই অন্ধকার দিকটা তো মাঝে মধ্যেই দেখি আমরা । তোমার কশাঘাত কি নবীন প্রজন্মের উত্তরণ ঘটাতে পারবে? আশা তো রাখতেই পারি। এমন শারদ উপহারের জন্যে ধন্যবাদ এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা ।