micro-story-taan

টান
বিক্রম অধিকারী


দীর্ঘ রোগভোগের পর বাবা বিদেয় নিয়েছেন। এখন মা-র মাথাটাও একটু বিগড়েছে। বাবার চিকিৎসায় বাজারে অনেক ঋণ হয়েছিল। পল্লব মাকে ভুলভাল বুঝিয়ে ওদের ভিটেমাটির অর্ধেকটা অনেক আগেই বিক্রি করেছে। ধার-দেনা শোধ করতেই সেই টাকার অনেকটা উবে গেছে। বেকার পল্লবের টিউশনের টাকায় এখন সংসার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। পল্লব চাকরির জন্য একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিল। প্রভাবশালীদের সঙ্গে সরিৎ সামন্তের ভালো যোগাযোগ আছে। ব্যাপারটা এখন ওপেন সিক্রেট, চাকরি মোক্ষ লাভ হলে সরিৎ সামন্ত হল পাণ্ডা। পল্লব সরিৎ সামন্তের কাছে যায়। সামন্ত বলে, ‘শুধু ভাইভা দিলে হবে? ভাও না দিলে কি চাকরি হয়?’ পল্লব ঢোক গিলে, ‘স্যার, আপনি আমার অবস্থা তো জানেন।’ একগাল হেসে সামন্ত বলে, ‘এই চাকরির রেট পনেরো লাখ চলছে। তুই মেধাবী। আমার পাড়ার ছেলে। যা, তোর জন্য দশ লাখ।’ পল্লব মাকে বিস্তারিত সব জানায়। নিরুত্তর মা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

এই চাকরিটা বাগাতেই হবে। পল্লব প্রোমোটার, কুবের ঘোষের কাছে যায়। ওদের শেষ সম্বল চিলতে উঠোন সহ বসতবাড়িটা কেনার জন্য কুবের ঘোষ আগে যেচে পনেরো লাখ দিতে চেয়েছিল। এবার পল্লবকে বাগে পেয়ে সে এগারো লাখ টাকায় জায়গাটা গ্রাস করে। নিরুপায় পল্লবের পকেটে বায়নার দশ হাজার টাকা। পল্লব স্বপক্ষে যুক্তি সাজায়, একটা প্লট বিক্রি করেও তো দিদির বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দিদি ছোট-খাটো একটা চাকরিও করে। ক্ষ্যাপা মা-র দায়িত্ব কি শুধু আমার? বেকার ছেলের ঘাড়ে বসে মা তো অনেকদিনই থাকল। দিদিও না হয় ক’বছর মাকে রাখুক। পুরো নিঃস্ব হয়ে পল্লব একটা চাকরি চায়। অনিশ্চিত টিউশনের টাকার ওপর না, নিরাপদ স্যালারির টাকায় বাঁচতে চায়। অপরাধবোধ পল্লবকে ঘুমোতে দেয় না।

ভিটের অর্ধেক বিক্রির জখমটা এখনও শুকোয়নি। প্রতি রাতেই মা ঘুমের ঘোরে হাঁটতে-হাঁটতে চলে যায় পুরনো ভিটের টানে। দেনা-অভাবের তাড়নায় অর্ধেক বাস্তুভিটে বিক্রিটা মেনে নিলেও মা-র মনে পুরনো বাড়িটি আজও অক্ষত। সাইকিয়াট্রিস্ট ড. সেনের ওষুধে মা ঘুমে কাদা হয়ে আছে। ঘরের দরজা ভেজিয়ে পল্লব বাইরে আসে। অঙ্গহানির জ্বালা নিয়ে টিমটিম করে জ্বলছে কৃষ্ণ পক্ষের আধ খাওয়া চাঁদ। বাড়ির সামনে আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়া জায়গায় ঘোষদের নির্মীয়মাণ বহুতল সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘোষদের অসম্পূর্ণ দালানের কংক্রিটের গুমোট গন্ধ ছাপিয়ে পল্লবকে আবিষ্ট করে স্মৃতিমাখা পরিচিত বাস্তুঘ্রাণ। উঠোনের চিহ্ন মুছে যাওয়া জায়গায় পল্লব নিজের সুখ-দুঃখের ইতিহাস হাতড়ে বেড়ায়। নির্দয় সিমেন্ট-বালুতে আক্রান্ত থুত্থুরে বুড়ো উঠোন অনেক আগেই দেহত্যাগ করেছে। ধুলোবালিতে বিধ্বস্ত নিঃসঙ্গ জামরুল গাছটা দাঁড়িয়ে ধুঁকছে। টগবগে জামরুলের সঙ্গে হুটোপুটি করে পল্লব বড় হয়েছে। ওর যে দিন জন্ম হয়েছিল ঠিক সেই দিন বাবা উঠোনে একটা ক্যামেলিয়া গাছ বুনেছিল। প্রত্যেকবার জন্মদিনে গাছটি ফুলে সেজে ওকে অভিনন্দন জানাত। এ সপ্তাহেই তো ওর জন্মদিন। ও মাটির স্তূপ ডিঙিয়ে কায়ামেলিয়া গাছাটা খুঁজতে থাকে।

হঠাৎ আলোআঁধারি ফুঁড়ে মা দৌড়ে এসে পল্লবের হাত টেনে ধরে, ‘এই পলু, অন্ধের মতো হাঁটছিস যে। সামনেই খোলা কুয়ো, দেখছিস না?’ পল্লবের শিউড়ে ওঠে, আর ক’পা এগোলেই এই নিশুতি রাতে ও নিজেও গভীর গর্তে পড়ে ইতিহাস হয়ে যেত। মা বিড়বিড় করেন, ‘ভিটের টান নাড়ির টানের মতোই। জানি, তুইও ভিটে মাটিকে ভুলতে পারিসনি। চোখ মেলে দেখি, তোর বিছানা ফাঁকা। ছুটে এলাম— কাল ওরা কুয়ো খুঁড়ে খোলা ছেড়ে গেছে।’ মা আর মাটির বিকল্প নেই। পল্লবের আবেগসিক্ত গলা, ‘মা…’ মা ফিরে যেতে যেতে বলে, ‘পলু, এই ভিটে মাটির কাছে এলেই আমার মাথা বিগড়ে যায়। তোর দিদি আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তুই বরং বাকি ভিটেমাটিও বিক্রি করে দে।’



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *