micro-story-tinti-onugolpo

তিনটি অণুগল্প
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর

অশনি সঙ্কেত

হাটবারে ছদুভাই ওরফে ছদুপাগলা কিছুক্ষণ পরপরই হাঁক দিয়ে ওঠছে, ‘অশনি সঙ্কেত! অশনি সঙ্কেত!’

ছদরুল ইসলাম আমাদের গাঁয়ের গর্ব। শিক্ষিত পাগল। গ্রামের কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তবে রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার আগেই তার মাথায় ছিট দেখা দেয়। কেন তা কেউ জানে না। আমরা অনুমান করি এর পেছনে প্রেম বিষয়ক কোন ঘটনা থাকলেও থাকতে পারে। পাগল হলেও ক্ষ্যাপাটে নয় মোটেও। প্রায়ই সে ঝিম মেরে নদীর ধারে বসে থাকে। এলাকার চেয়ারম্যানের ছেলে হওয়ায় খাওয়া-পরার অভাবও নেই তার। সে বেশ আছে তার লাইফ স্টাইলেই।

‘অশনি সঙ্কেত’ বলে আরেকবার হাঁক দিতেই আমি এগিয়ে যাই। বলি, ‘ছদুভাই, কীসের অশনি সঙ্কেত?’

ছদুভাই এবার কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে, ‘তোরা গাধা নাকি! বুঝোস না কিছু? আকাশ কালো হয়ে আসছে, ১০ নং মহাবিপদ সঙ্কেত!’

মেঘহীন পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকাই আমি।

— কোথায় আকাশ কালো, ছদু ভাই?

— ভাগ তুই গাধা! রূপক বুঝোছ না? অশনি সঙ্কেত! তামাম জাহানের জন্য অশনি সঙ্কেত!

 

সংস্কার

কেমব্রিজে পিএইচডি করা জাঁদরেল প্রফেসরের আহ্বানে এলাকার সংস্কার করার পলিসি প্রণয়নে সভা চলছে। কলেজের প্রিন্সিপাল, স্কুলের হেড মাস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মসজিদের ইমাম, দুইজন ছাত্র প্রতিনিধি সহ উপস্থিত আছেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। সবাই এলাকার উন্নয়নে তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। নোট রাখছেন ইউএনও সাহেব। হেডমাস্টারের বক্তব্য রাখার পালা এলে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘উপস্থিত সভাসদ, আপনারা সবাই জানেন আমাদের এলাকাটি কৃষিপ্রধান এবং জনগণের বড় একটি অংশ কৃষক পরিবারভূক্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকের এ সভায় কৃষকদের প্রতিনিধি একজনও নেই। এলাকায় কী কী সংস্কার হতে পারে তা আমাদের চেয়ে কৃষকেরাই ভালো জানে। তাই আমি সংস্কার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এ ধরণের সভায় দুই/তিনজন কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ হেডমাস্টারের বক্তব্যে সভায় গুঞ্জণ শুরু হয়ে যায়। প্রফেসর সাহেব সবাইকে থামিয়ে বলতে শুরু করেন, “হেডমাস্টার সাহেব, সংস্কারের বিষয়ে অশিক্ষিত কৃষকেরা কী বুঝবে! ঐসব মূর্খ কৃষকেরা সংস্কার বানান পর্যন্ত করতে পারবে না! হুম, তাদের ডাকলে তারা আসবে চা-বিস্কুট খাওয়ার লোভে, তারা কি আর কোনো ফিডব্যাক দিতে পারবে?” উত্তরে হেডমাস্টার সাহেব কিছু বলতে গেলেই থামিয়ে দেন তিনি, “আপনি তো দেখছি, আওয়ামী দোসরদের মতন কথা বলছেন!” হঠাৎ করে ছাত্র প্রতিনিধি দু’জন সমস্বরে বলে ওঠে, “হেডস্যারকে আমাদের উপর ছেড়ে দিন, প্রফেসর স্যার!”

 

স্বপ্নে এসেছিলেন তিনি

আমি নবী কিংবা রসুল নই। অহী নিয়ে আমার কাছে জিব্রাইলের ধর্ণা দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। প্রাচীনকালের ধ্যানমগ্ন কোন ঋষিও নই আমি যে দিব্যজ্ঞান ধরা দিবে। তবু মাঝেমধ্যে টের পাই, আমার কাছে কেউ কেউ আসে। জাগরণে নয়, ঘুমের মাঝে স্বপ্নের ঘোরে। তা বলে আমি স্বপ্নপীর নই – স্বপ্নে পাওয়া দাওয়াই এনে আপনাদেরকে সর্বরোগের মহাষৌধ এনে দেওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। থাকুক এইসব গৌরচন্দ্রিকা… আসুন গেলোরাতে দেখা স্বপ্নের ভিতরে ঢুকে পড়ি।

রাতের শেষভাগ। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন এসেছে আমার কাছে। নাহ, কাউকে দেখছি না। তবে বুঝতে পারছি যেই হোক না কেন সে ভয়ঙ্কর কোন একজন। আতংকে প্রশ্ন করি, ‘কে … কে?’ স্পষ্টতঃই শুনতে পাই তার ভরাট কন্ঠ –

– আমিই সেই। তোমরা যার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াও। কিন্তু শেষটায় পারো না, ধরা দিতেই হয় তোমাদের।

তার হেঁয়ালিভরা কথার খোলস ভাঙতে সময় লাগে না। তার মানে আজরাইল! ভয়ে ভয়ে বলি, ‘তার মানে তুমিই আজরাইল? আমার কাছে কেন?’
– হ্যা, আমিই সেই। মানুষ তো আমাকে নানা নামেই ডাকে… আজরাইল বলতে পারো, যমদূত বলতে পারো কিংবা বলতে পারো শুধু মৃত্যু। আমিই মৃত্যু। তবে তুমি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছ কেন? তোমার সময় তো এখনো হয়নি …
– তা কবে হবে আমার সময়?
– তা তো আমি জানি না। তবে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দুইশ’ বছর আগে হলে তো এতোদিনে তোমাকে নিয়েই যেতাম … চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি করে তোমরা তো তোমাদের আয়ু বাড়িয়ে ফেলেছো। কোন অ্যাক্সিডেন্ট না হলে তুমি আরো অনেকদিন বেঁচে যেতে পারো। তবে অনেকদিনও দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
– আচ্ছা মৃত্যু, বলো তো বিজ্ঞান কি কোনদিন মানুষকে অমরতা এনে দিতে পারবে?
– এ প্রশ্নের উত্তরও আমার জানা নেই। তবে আমিও চাই মানুষ শেষটায় আমাকে জয় করে অমর হোক, সারা জীবন বেঁচে থাকুক। জানো, মানুষকে মেরে ফেলতে আমার খুবই কষ্ট হয়। একেকজনকে মেরে ফেলে আমি যে কতো কাঁদি তা তোমরা ভাবতেও পারবে না …

মৃত্যুর কষ্টের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। এবার আমার পরকাল সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা এবার বলো তো মৃত্যুর পরের জীবনের কথা …’

হঠাৎ রুমার ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যায়। রুমা বলে উঠে, ‘সেই কখন থেকে বিড়বিড় করছো! তোমারে মনে হয় বোবায় ধরেছে …’



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *