মহুয়া সমাদ্দার
অজিতবাবু আজ কয়েকদিন ধরেই ভীষণ উত্তেজিত। কয়েকদিন মানে যেদিন থেকে মেয়ে দোয়েলের মুখে শুনেছেন যে অয়ন এই মাসের চব্বিশ তারিখে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পাচ্ছে, সেদিন থেকে। গত রাতে তো তিনি টেনশানে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারেননি। যদিও আজ কদিন যাবৎ তাঁর খুব ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও অয়নের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। তিনি অবশ্য এই কদিনে অয়নকে ফোন করেছেন বহুবার। কিন্তু অয়ন একটিবারের জন্যেও রিসিভ করেনি ফোন। অজিতবাবু বুঝতে পারছেন এই সময় সে কতটা ব্যাস্ত। আর হবে নাই বা কেন! এত বড় একটা সম্মান পাবে! সেখানে গিয়ে কত গুণী জনদের সামনে দাঁড়িয়ে স্পিচ দিতে হবে। সে কি চাট্টিখানি কথা! যদিও তাঁর মনের কোনায় মেঘও জমেছে কিছুটা। সে মেঘ অবশ্য অভিমানের মেঘ। আজ গিয়ে অয়নকে একা পেলেই একটু বকুনি দিতে হবে। ও ওর অ্যাচিভমেন্টের কথা ফেসবুকে পোস্ট করতে পারছে, অথচ তাকে একটিবারের জন্যে ফোন করে বলতে পারল না!
দোলন যদিও বারেবারে বলছে — “বাবা, অয়নদা আর তোমায় পাত্তা দেয় না গো! তোমার কাছ থেকে যতটা নেবার ও নিয়ে নিয়েছে। আর তোমাকে ওর প্রয়োজন নেই।”
সে দোলন যা বলে বলুক। ওর যতসব ছেলেমানুষি কথা! আরে বাবা অয়নকে পুরো হাতে ধরে লেখা শিখিয়েছেন অজিতবাবু। না। অয়নের মধ্যে কোনও প্রতিভা ছিল না, এমনটা মোটেও নয়। কিন্তু ওর এই সাহিত্যিক কেরিয়ারের পেছনে অজিতবাবুর অবদানও কিছু কম নয়। কত কত রাত কেমোথেরাপি নেওয়ার পরেও শুধুমাত্র অয়নের সঙ্গে ওর গল্পের প্লট নিয়ে আলোচনা করে অসুস্থতা বাড়িয়েছেন নিজের। সেসব কথা কি অয়ন ভুলতে পারে কখনও! তিনি নিশ্চিত কাল অয়ন তাকে ফোন করে কোথায় অনুষ্ঠান হবে বা কখন কিভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে – সেসব কিছু জানিয়ে দেবে। তিনি অবশ্য কাল কখন কি করবেন সেটা আগে থাকতেই সব ঠিক করে রেখেছেন। সিল্কের পাঞ্জাবি পায়জামা দোলনকে দিয়ে গতকালই ইস্তিরি করিয়ে রেখেছেন।
*************
অজিতবাবু আজ সকাল সকালই স্নান খাওয়া সেরে ইস্তিরি করা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে বসে আছেন। অয়নের ফোন এলে আর এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করতে রাজি নন তিনি। অয়ন নিশচয়ই তাঁকেও স্টেজে উঠিয়েই ছাড়বে। যা জেদি ছেলে! তাই একটা ভাল স্পিচ নিজের জন্যেও রেডি করে রেখেছেন তিনি। সবকিছুই তাঁর গোছানো আছে। এখন শুধু ফোনটা এলেই তিনি দুগগা দুগগা করে বেরিয়ে পড়বেন।
দোলন সকাল থেকেই বাবার কান্ড কারখানা দেখছে। অয়নদা ওর ফেসবুক ফ্রেন্ড বলে নানা ধরণের আপডেটও সে পাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে সে কিছুই বলতে পারছে না। একেই ক্যান্সার পেশেন্ট তার বাবা। এইসব লেখালিখি সংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় যদি সে ভাল থাকে তো তাই থাকুক। তাই আর….
কিন্তু একটু আগেই ফেসবুকে আপডেট দেখেছে দোলন। অয়নদার অনুষ্ঠান এখন প্রায় শেষের পথে। অর্থাৎ বাবার কাছে অয়নদার ফোন আর আসবে না। অয়নদা তার পুরষ্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে বাবাকে আমন্ত্রণ জানাবে না। কিন্তু খবরটা যে বাবাকে সে কিভাবে দেবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না দোলন। পুরষ্কার পাওয়ার কথা অয়নদা বাবাকে নিজের মুখে জানায়নি বলে মানুষটা এমনিতেই কত কষ্টই না পেয়েছেন! আজ আরও একবার….!
যা হোক কিছু একটা বলে বাবাকে ভোলাতে হবে। – বুঝতে পারছে দোলন। মনে মনে নানা রকমের কথা সাজাতে সাজাতে অজিতবাবুর ঘরের দিকে এগোলো সে। কিন্তু দরজার সামনে গিয়েই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল দোলন। বাবা হাসতে হাসতে কার সঙ্গে যেন গল্পের একটা প্লট নিয়ে আলোচনা করছেন। এটা তো অয়নদা নয়! ওর অনুষ্ঠান তো এখনও চলছে। ফেসবুকে সেটার লাইভ হচ্ছে। মিনিট দুই তিন আগেও দেখেছে সে। তাহলে? এ আবার কে! নতুন কেউ! উফ! বাবাটা পারেও বটে! সত্যিকারের ভালো মানুষ বোধহয় এদেরকেই বলে!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন