রতনতনু ঘাটী
ছুটির দিনগুলোতে কান্তার কোনও কাজই করত না। একজন মানুষের সংসারে আবার কাজ কী? এ কথাই মনে করত কান্তার। তাই দরকার হলে অন লাইনে শাকসবজি অর্ডার করে দিত। তারপর বাড়িতে ডেলিভারি এলে, তখন জিনিসগুলো মিলিয়ে তুলে রাখলেই হত। কিন্তু এক-এক সময় জিনিসগুলো তুলে রাখতে গিয়ে কান্তার দেখত, বেশ কিছু জিনিসের স্টক খালি। কবে যে সেসব স্টক খালি হয়েছে, কে তার খোঁজ রাখে? মনে-মনে ভাবত কান্তার, ইস, মোবাইলে অর্ডারটা টেক্সট করার সময় ঠিকমতো দেখে নিলেই হত। মনে-মনে ভাবে কান্তার, ধুর! ওসব আমার দ্বারা এ জীবনে হল না!
ওসব ওর দ্বারা যে হবে না, এটা বুঝতে অনেকটা সময় কেটে গেল কান্তারের। তিন বছর! এ কী কম সময় নাকি? অনেকে বলে, বিয়ের পর দু’জন মানুষের দু’জনকে বুঝতে নাকি অনেকটা সময় দরকার হয়। আবার কেউ বলে, ধুর, ধুর! ওসব বাজে কথা! ঘণ্টাখানেক সময়ই ঢের!
সুলগ্না কেন যে চলে গিয়েছিল? তেমন কোনও কথা কাটাকাটিও হয়নি। একজন পাহাড় ভালোবাসতো, একজন সমুদ্র। তফাৎ আর তেমন বড় কিছুই নয়। তিন বছর পার করে একদিন ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজিয়ে উদয় হল সুলগ্না। বলল, ‘জানো তো, আলাদা থাকাই গেল না! তোমাকে ছেড়ে থাকা অতখানি মুশকিল হবে ভাবিনি।’
একা থাকার সময় কান্তার ভেবে দেখেছে, সুলগ্না এমন কিছু জটিল মেয়েই নয়। সোজাসাপটা মেয়ে। কোনও বায়না নেই। কান্তার ভাবে, এমন বায়নাহীন মেয়ে পৃথিবীতে ছিল নাকি? সুলগ্নাকে না দেখলে এ কথা বিশ্বাস করত না কান্তার। সুলগ্না খেতে, আড্ডা দিতে আর ঘুমিয়ে অথবা জেগে স্বপ্ন দেখতে খুব ভালবাসে। হঠাৎ কান্তারের রোমান্টিক কবি বায়রনের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল—‘আই হ্যাড আ ড্রিম হুইচ ওয়াজ নট আ ড্রিম।’ কলেজে পড়ার সময় বায়রন ছিল কান্তারের প্রিয় কবি। কথায়-কথায় ও বায়রনের কবিতা আবৃত্তি করত।
তবে বলা যায়, সুলগ্নার সঙ্গে স্বপ্নে ভাসতে-ভাসতে এতগুলো বছর কেটে গেল তো! খুব যে মন্দ কেটেছে বলা যাবে না। হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে সুলগ্না অরাজি ছিল আগাগোড়াই। দু’জনের মাঝখানে নতুন কারও কথা ভাবতেই পারত না। ওসব প্রসঙ্গ উঠলে সুলগ্না বলত, ‘রাখো তোমার ভবিষ্যৎ। আগে তো বর্তমানটাকে সামলেসুমলে নিয়ে চলি তো, তারপর দেখা যাবে।’
সুলগ্না নতুনের কথা উঠলে আরও যে কথা বলত, ‘চলো কান্ত, বেরিয়ে পড়ি!’
‘কোথায়? বড্ড আলসেমি লাগছে। এবারটা ছেড়ে দাও।’ কান্তার বলত।
কান্তারকে ‘কান্ত’ বলে ডাকে সুলগ্না। এখন কান্তারও ছাড়ল না। বলল, ‘না, তোমাকে আজ থেকে ‘লগ্না’ বলেই ডাকব!’
এই ছেড়ে থাকার সময়টুকুতে সুলগ্না মুটিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। ফিরে এসে হাসতে-হাসতে নিজের চেহারার দিকে আঙুল তুলে বলল সুলগ্না, ‘এত ফেস্টফুড খেয়েছি না! তুমি ছিলে না, নিষেধ করার লোকই ছিল না। সকালে ফাস্টফুড, বিকেলে ফাস্টফুড, রাতেও ফাস্টফুড। রান্নাই করতাম না!’
ও মা! শনিবার ছুটির দুপুর। খেয়েদেয়ে গোটা বিছানায় ছড়িয়ে ছিল সুলগ্না। যখন সুলগ্না এরকম নিজেকে দক্ষিণের বাতাস হয়ে ছড়িয়ে রাখে বিছানায়, তখন তাকে ওঠায় কার সাধ্যি? রাস্তা তৈরির জেসিবি মেশিনও হয়তো হার মানবে! হাজার ঠেলাঠেলিতে ওঠানো যায় না! সুলগ্না বলল, ‘আমার ওজন মাত্র আশি কিলোগ্রাম!’
ওজনের কথা উঠতে সুলগ্না তাকাল কান্তারের দিকে। বলল, ‘কান্তার, আর ক’টা দিন সবুর করো! ফাস্টফুডটা আশ মিটিয়ে আর কয়েকটা মাস খেয়ে নিই, তারপর! তখন ওজন নামিয়ে আনব এক্কেবারে ফিফটি সেভেন কেজিতে, দেখে নিও। তখন আমাকে খানিকটা শ্রীময়ী দেখতে লাগবে, কী বলো?’
এখন টানতে-টানতে সুলগ্নাকে বিছানার প্রান্তে আনতেই চিৎকার করে উঠল সুলগ্না, ‘অ্যাই কান্ত, আমি পড়ে যাব যে! ছাড়ো, ছাড়ো! দুষ্টু কোথাকার!’ বলে কান্তারের চিবুকে আদর করে বলল, ‘এবার কই আমাকে টেনে তোলো দেখি! আমি নিজেকে বিছানায় এবার ছেড়ে দিলাম। ওজন বেড়েছে কিন্তু আমার! উঁহু, তুমি পারবে না কান্ত!’
তারপর কোনওরকমে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল সুলগ্না। এবার হুশমুস করে টানতে-টানতে সুলগ্নাকে বিছানা থেকে নামিয়ে টানতে-টানতে ব্যালকনিতে নিয়ে গেল কান্তার।
ওদের মুখোমুখি উলটো দিকের ফ্ল্যাটে যারা থাকে, তারা নিউলি ম্যারেড কাপল! কোথাও বেড়াতে গেছে মনে হয়। ক’ দিন ধরে ঘরে আলো জ্বলেনি। নতুন বিয়ে করেছে তো, তাই ফ্ল্যাটে থাকলে, ব্যালকনিতে তোয়ালে শুকোতে দেওয়া ছাড়া ওদের দু’জনকে ভগবানও দেখতে পান না সারাদিনে। রুমে আলো তো জ্বালেই না। সুলগ্না হাসি ছড়িয়ে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘উলটো দিকের ফ্ল্যাটে ওরা নেই বলে খুব সাহস দেখানো হচ্ছে? এক্ষুনি যদি নতুন বউটা ব্যালকনির দরজা ঠেলে বেরিয়ে পড়ে? তখন?’
‘পড়ুক! আমার বউকে আমি আমার ব্যালকনিতে যদি জড়িয়েই ধরি, তাতে কার কী? এটা কি কোনও বেআইনি কাজ হবে নাকি?’
সুলগ্না হাসল নিশ্চুপ। বলল, ‘বউটা দেখতে কিন্তু ভারী মিষ্টি! লক্ষ্মীমন্ত মুখ। মা বলত, আমার ছেলেকে এরকম লক্ষ্মীমন্ত মুখের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব! তারপর দাদা তো বিয়েই করবে না ঘোষণা করল, ধনুর্ভঙ্গ পণ করে চলে গেল সোজা পিথোরাগড়ের মুন্সিয়ারিতে। ওখানে শহর থেকে দু’কিলোমিটার দূরে নন্দাদেবীর মন্দির। সেখানে কেমন করে যেন আশ্রয় জুটিয়ে থেকেই গেল দাদা। হিমালয় দেখার ভিউ পয়েন্টে জটাজূট ধারণ করে গেরুয়া বসন পরে দাদা তখন রীতিমতো একজন সন্ন্যাসী মানুষ। ওরই পাশে হিমালয় দর্শনের ভিউ পয়েন্টে বসে ধ্যান করত সারাদিন।’ একটু থেমে সুলগ্না বলল, ‘তবে ওই ফ্ল্যাটের বউটি ভারী মিষ্টি দেখতে!’
‘তাতে আমার কী? আমার বউও কম মিষ্টি নয়! একটুখানি চাইলে সেও দু’হাত উপচে দিতে জানে!’ বলে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমির হাসি হাসল কান্তার।
সুলগ্না চোখ ঘুরিয়ে তাকাল দূর আকাশের সাদা মেঘের ভেলার দিকে। বলল, ‘এমন সাহস কতদিন বজায় রাখতে পারো দেখি! ওরা তো সারাজীবন আর ঘুরে বেড়াবে না? একদিন না একদিন ওই ফ্ল্যাটে ফিরবেই ফিরবে।’
কান্তার আজকের কথাটা ভেবে কিছুটা মিইয়ে গেল। যে মেয়েটা দূরে বেড়ানোর জন্যে কত না আবদার করে, আজ কী যে হল! কান্তার বলল, ‘লগ্না, আমরা এবার সত্যি-সত্যি চলো লাদাখ বেড়াতে যাই!’
‘আর জায়গা খুঁজে পেলে না? তার চেয়ে আন্টার্কটিকা বলতে পারতে? অথবা টিটিকামা হ্রদ? জানো তো, আমরা টিটিকামা যাই চলো! ওখানে গেলে ক’দিন পেট ভরে ব্যাঙের রোস্ট খাওয়া যাবে। একদিকে বলিভিয়া, ওখানে পুরনো মায়া সভ্যতার যেটুকু এখনও টিকে আছে, তাও দেখে আসব। আবার ইচ্ছে হলে পেরুতেও থেকে যেতে পারি ক’টা দিন!’
কান্তার হাসতে-হাসতে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি কিন্তু ব্যাঙের রোস্ট খেতে চাই না! একদিন খেলে বেশ কয়েকদিন ধরে গায়ে গন্ধ লেগে থাকে।’
‘তা থাক না! তুমি যখন ত্রিপুরার শুঁটকি মাছের প্রিপারেশন খাও, তখন তো চারপাশে তাকিয়েও দ্য্যাখো না, পাশের টেবিলে যাঁরা খেতে বসেছেন, তাঁরা নাকে কেউ-কেউ রুমাল চাপা দিয়েছেন কিনা।’ সুলগ্নার যুক্তি অকাট্য।
সুলগ্না বলল, ‘সেই কবিতাটা পড়োনি? আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চিনারা/কত কী যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা!’
‘এবারটা লাদাখ ঘুরে আসি, প্লিজ! তার পরের বছর আন্টার্কটিকা! একদম পাক্কা!’ কান্তার ডান হাতের তর্জনী তুলে ‘ভিকট্রি’ দেখাল।
‘হঠাৎ লাদাখের ভূত তোমার উপর এমন করে ভর করল কেন শুনি?’ সুলগ্না জানতে চাইল।
‘তোমার মনে নেই, সেই যে আমাদের মিডিয়া হাউসে ঘনঘন আসত যে ছেলেটা, কাঁধে ক্যামেরা, গায়ে হাজার টুকিটাকি ছোটখাটো জিনিস রাখার মতো অগুনতি পকেটওলা জিনসের কাপড়ের নীল শার্ট পরত, মাথায় অকারণ টুপি পরে থাকত, কালো রঙের। সেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসেছিল। ঢুকেই বলল, ‘কান্তদা, চা বলো মাইরি! গলা শুকিয়ে একদম মরুভূমি।’
কান্তারের কথার মাঝখানে লগ্না বলল, ‘ও হো। বরুণ! বরুণ সেনাপতি! কেমন আছেন তিনি? তিনি তো অনেকদিন উধাও। তাঁকে আবার এখন পেলে কোথায়? তুমিও জোটাতে পারো!’
‘জোটাইনি। বরুণই নিজে এসে উদয় হল। বলল, ‘আরে কান্তদা, কতদিন টানা বরফের দেশে কাটিয়ে এলাম জানো? তোমাকে এখন আর দেখাতে পারব না বরফের দেশে থাকার প্রমাণ-চিহ্ন। ঠাণ্ডায় আমার হাতের আঙুলের মাথা ফেটে রক্ত ঝরত। ফ্রস্ট বাইট! আমার কান আর নাকের যা অবস্থা হয়েছিল, তুমি তখন আমাকে দেখলে চিনতেই পারতে না কান্তদা।’
আমি বললাম, ‘হঠাৎ বরফের প্রতি টান জন্মাল কেন তোর? সমতলের ফোটো তুলে শেষ করতে পারলি না। তায় খামোখা বরফের দেশ!’
‘তোমরা তো এসব বলবেই দাদা। তোমরা নিউজ ডেস্কে বসে যারা আমাদের প্রাণপাত করে লেখা কেটে ফর্দাফাঁই করো প্রতিদিন, তোমাদের কী? চলো একবার স্পটে, দেখে আসবে কত ধানে কত চাল!’
আমি বললাম, ‘বরুণ, ব্যাপারটা খুলে বল না, শুনি! তোর তো চিরদিনই ভেঞ্চারের নেশা!’
একটু থামল কান্তার। তারপর বলল, ‘বরুণ কী বলল শুনবে লগ্না?’ জিজ্ঞাসু মুখে এ কথা বলে থামল কান্তার। সুলগ্নার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর কান্তার বলল, ‘বরুণ চায়ে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে একটু কেশে নিয়ে কথা বলল। আমি বুঝে গেলাম, বরুণের চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া দেখলে বোঝা যায়, ও সবে বরফের দেশ থেকে ফিরেছে!’
‘জানো তো কান্তদা, তোমার সেই যে ভাই, সেই যে জীবনে কিছুই করতে না পারা ছেলেটা, সে এখন টানা মাস ছয়েক লাদাখে থাকে। বাকি ছ’ মাস কলকাতায়!’ কথাটা বলে থামল বরুণ। তারপর বলল, ‘জানো তো, ওখানকার মানুষজন খুব ভাল গো। ওখানে গেলে আমার জন্যে বাড়ি বানিয়ে দেবে বলেছে। সব রকম সাহায্য করবে। বলতে পারো কান্তদা, বাড়ি বানাতে গিয়ে আমাকে তেমন করে খাটতেও হবে না। সব ওরাই করে দেবে বলেছে! কেন বলো দেখি?’ বলে চোখ নাচাল বরুণ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
বেশ প্রাউডের ভঙ্গি করে বরুণ বলল, ‘স্রেফ আমার মতো একজন নতুন বন্ধু পাবে বলে!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা, তোর বাড়িটা কি হয়ে গেছে? নাকি ফিরে গিয়ে শুরু করবি?’
‘আমার লাদাখি বন্ধুটা বলল সেদিন ফোন করে, সে নাকি বাড়ির কাজে অলরেডি হাত দিয়েছে।’
‘তা তুই যে নীচে নেমে এলি, লাদাখে তোর বাড়ির কী হবে? কে দেখভাল করবে?’
বরুণ বলল, ‘আমার বাড়ি? পড়ে থাকলে কিচ্ছু হবে না। বরফের দেশের মানুষ ঘরে দরজা দেওয়ার নিয়মে বিশ্বাস করে না। সবই হাট হয়ে খোলা পড়ে থাকে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বরুণ, তোর বাড়িটা অতদিন অরক্ষিত হয়ে পড়ে থাকবে যে?’
হা-হা করে হাসল বরুণ। আমি বললাম, ‘বরুণ তোর ওই দিগন্ত কাঁপানো হাসি রাখ! সামনের শনিবার চলে আয় আমার ফ্ল্যাটে, নিউটাউনে। সারাদিন হইহট্টগোল হবে, খাওয়াদাওয়া চলবে, আর তুমুল আড্ডা হবে। তুই তো কতদিন সুলগ্নাকে দেখিসওনি। চলে আয়।’
দিন দুয়েক পরে বরুণ সকাল-সকাল সত্যি চলে এল কান্তারের ফ্ল্যাটে। সুলগ্না বা কান্তার, কেউই ভাবতে পারেনি। কান্তার ভেবেছিল, ওটা ওর কথার কথা! কলকাতায় কেউ অমন আসব বলে চলে আসে না তো! ডোরবেল বাজতে উঠে গিয়ে কান্তার দরজা খুলে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘দ্যাখো লগ্না, বরফের দেশের অতিথি ভোরবেলা এসে হাজির! কী কাণ্ড!’
বরুণ হেসে মজার গলায় বলল, ‘তোরা ভাবিসইনি যে আমি সত্যিই আসব, তাই না রে? বরফের দেশের মানুষরা ওরকমই। আসব বলে কথা দিলে তারা চলে আসে! যাব বললে ঠিকই চলে যায় তারা।’
সুলগ্না চা বসিয়েছে কিচেনে। বরুণ একটা ছোট ব্যাগ রান্নাঘরে ঢুকে সিঙ্কের উপর নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, অনেক দিন ইলিশ মাছ খাওয়া হয়নি, বিশ্বাস করুন! সে মাসখানেক তো হবেই। তাই বাজার থেকে একটা বড়সড় ইলিশ উঠিয়ে নিয়ে চলে এলাম। দুপুরে আচ্ছাসে সরষে-ইলিশ হয়ে যাক, কেমন!’ তারপর কান্তারের সোফার কাছে এগিয়ে এসে বরুণ বলল, ‘ম্যাডামকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম না তো কান্তদা?’
সুলগ্না হাসতে-হাসতে চায়ের কাপ এনে সেন্টার টেবিলে রেখে বলল, ‘আমার কিচ্ছু ঝমেলা নয় ভাই! আমাদের মিনতির-মা সরষে-ইলিশটা যা রাঁধে, ও আপনি খেয়ে ভুলতে পারবেন না! তা ছাড়া, বাড়িতে ইলিশ এসেছে জানলে মিনতির মাকে আটকায় কার সাধ্যি? ও কাউকেই হাত লাগাতে দেবে না।’
তিনজনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একে-অন্যের মুখের দিকে তাকাল এবার। কান্তার বলল, ‘বল ভাই বরুণ, তোর লাদাখ-অভিযানের চ্যাপ্টারটা খুলে বল! জমিয়ে গল্পটা শুনি।’
বরুণ চায়ে আর-একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘এটা মোটেও গল্প না। একশো ভাগ সত্যি। আমাকে বছর তিনেক আগে একটা কোয়াটারলি ইংলিশ পিরিয়ডিক্যাল অ্যাসাইন করল লাদাখের একটা সাবজেক্ট নিয়ে নিউজ ফোটো স্টোরি করতে।’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘চিনের নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে-আসা ভারতে ঢুকে-পড়া চিনা সৈনিকের রিয়েল স্টোরি নাকি রে?’
বরুণ বলল, ‘না না, কান্তদা। ওসব স্টোরি পেলে আমি অনেক বেশি এনথু পেয়ে যাই তুমি তো জানো! ওসব কিছু নয়। সামান্য ব্যাপার! চারদিকে কোভিড কামড় বসিয়েছিল গোটা পৃথিবী জুড়ে। আক্রমণ সবে যখন থিতিয়ে এসেছে কী আসেনি, বিদেশ থেকে ফ্লাইটের যাতায়াত আমাদের দেশে পুরোপুরি রেস্ট্রিক্টেডও হয়নি তখনও। যা হয় আর কী। ইন্ডিয়ায় সব কিছু যেমন দেরিতে ইমপ্লিমেন্ট হয়। একটু আলগা-আলগা, হচ্ছে-হবে ভাব সবেতেই চলে! তা আমি রাজি হয়ে গেলাম। দিল্লি থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে লেহ চলে গেলাম। তারপর সড়কপথে লাদাখ পৌঁছে গেলাম। বেশ একটা থ্রিল হচ্ছিল!’
কান্তার ঠোঁট উলটে বলল, ‘তুই তো সব কিছুতেই থ্রিল খুঁজে পাস। একটা বিড়াল যদি মুখ গুঁজে পাঁচিলে শুয়ে ঘুমোয়, তুই তাতেও বিরাট থ্রিল খুঁজে পাস, বল ঠিক কিনা?’
সুলগ্না বলল, ‘ব্যাচেলর থাকার এই এক সুবিধে বরুণদা। আপনার কান্তদা নেহাত ভুল করে মাথায় টোপরটা পরে ফেলেছিলেন! না হলে ওঁকে কুমেরু পাঠালে উনিও আপনার মতোই হাসতে হাসতে কুমেরু পাড়ি দিতেন।’
বরুণ বলল, ‘ব্যাচেলর থাকার আরও অনেক অ্যাডভান্টেজ আছে ম্যাডাম! সে যে না আজীবন ব্যাচেলর থেকেছে, সে ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমার বিশপ লেফ্রয় রোডের চার তলার উপরে একটা বাড়ির বারান্দা-ঘেরা আস্তানা ছিল, মনে আছে কান্তদা? সাত বছরে এক চিলতে বারান্দা-বাড়ির মালিকের সঙ্গে আমার বার দুয়েক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল। ভদ্রলোক ভাড়াটাড়া কখনও চাননি। একবার একটা সাদা খামে করে কিছু টাকা দিতে গিয়েছিলাম। বিনে পয়সায় থাকতাম, এটা মোটেও ভাল দেখায় না। প্রথম এক মাস থাকার পর ভদ্রলোককে যেদিন ভাড়া অফার করতে গেলাম, উনি কী বললেন জানো তো কান্তদা? বললেন, আরে মশাই, আপনি তো এখনও সংসারটাই করে উঠতে পারেননি? আপনি ব্যাচেলর মানুষ! আমাদের এক বন্ধু থাকেন দেশপ্রাণ শাসমল রোডে। তিনি বলতেন, ব্যাচেলরের কাছ কখনও বাড়ি ভাড়া নিতে নেই। তার থেকে বাড়িভাড়া নিলে তোমার স্থায়ী বসতবাড়িতে হুলো বিড়ালের উপদ্রব বাড়ে। তুমি কি সেটা চাও? আমি বললাম, না, চাই না। সেই থেকে ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে এক পয়সাও ভাড়া নেননি।’ একটু থামল বরুণ। তারপর বলল, ‘তুমি তো জানো কান্তদা? তুমি বার দুয়েক সেই আস্তানায় গেছও, মনে করে দ্যাখো!’
‘ঠিক মনে পড়ছে না রে! তুই খুলে বল!’
বরুণ বলল, ‘ওই যে গো, টলোমলো, কাঠের একটা কালো রঙের সিঁড়ি। সেই সিঁড়িটাকে নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি? ওটা দিয়ে আমার আস্তানায় পৌঁছলে বাঁ দিকে অনেকটা নীচে দেখতে পাওয়া যায় যন্ত্রণার শহর তিলোত্তমা মহানগরী। থিকথিক করছে গাড়ি, মানুষজন, টানা রিকশা, ভিড়, ভিখিরি, দোকান-পশরা। বাঁ দিকে উঁচু-উঁচু বাড়ির মাথার ফাঁক দিয়ে তাকালে চাঁদ দেখতে পাওয়া যায়, তার ফাঁক দিয়ে একফালি মোহময়ী আকাশ।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে।’ বলল কান্তার, ‘তুই বলতিস, ওই একফালি আকাশ-চাঁদের দিকে তাকিয়ে তুই নাকি নানারকম ফোটো-শ্যুটের স্বপ্ন দেখতিস? ফোটোগ্রাফিতে গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতিস? আর তারপর সকাল হলে বাঁকুড়ার সরু মোরামের রাস্তায় গোরুর গাড়ির ফোটো তোলার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়তিস ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে? তাই তো?’
হা-হা করে হাসল বরুণ, ‘তুমি এখনও তেমনই সুন্দর করে কথা বলতে পারাটা হারিয়ে ফেলোনি।’
সুলগ্না কান্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছোট কাজকে অমন করে ছোট করে দেখতে নেই স্যার! ওই সব ছোটখাটো ফোটো তুলতে-তুলতে তো বরুণদা আজ এত বড় ফোটোগ্রাফার হয়েছেন!’ বরুণের দিকে তাকিয়ে সম্মতি পাওয়ার আশায় সুলগ্না বলল, ‘ঠিক কিনা বলুন?’
‘ম্যাডাম, আমি আর জীবনে এগোতে পারলাম কই? ভাল ফোটোগ্রাফির একটি উদাহরণও তৈরি করতে পারলাম না জীবনে। তাই মনে কষ্টও কম নেই ম্যাডাম। তাই আমি ওই তুমুল করোনার মধ্যেও বেরিয়ে পড়েছিলাম। জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য…’ বলে থামল বরুণ।
সুলগ্না চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘ও মা! সত্যি! আপনার সাহসও আছে বটে! যখন কোভিডে ইতালিতে মৃতদেহ সৎকার করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না, চিনে থইথই করছে শবদেহের সারি। তখন আপনি ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন? কী অ্যাসাইনমেন্ট পেলেন, সেটা তো বলুন?’
‘সে আর বলবেন না ম্যাডাম। সেই ম্যাগাজিনের আবদার হল, লাদাখে একটা চমৎকার উৎসব হয়। তার নাম ‘সাগা দাওয়া পরব’। সেই পরবের ফোটো তুলে আনার অ্যাসাইনমেন্ট। ম্যাগাজিনটা একটা বড় কভারস্টোরি-ফোটোফিচার ছাপবে ওই পরব নিয়ে। মহাযান সম্প্রদায়ের মানুষরা ওই পরবে উপস্থিত থাকেন। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, দিন সাতেকের মধ্যে আমাকে হানলে নদীর তীরে পৌঁছতে হবে। তখনই শুরু হবে সাগা পরবের দিন।’
কান্তার জানতে চাইল, ‘সেটা কোথায়?’
বরুণ ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ওটা তিব্বত আর লাদাখের প্রাচীন বাণিজ্যপথের ধারে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু একটা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আছে ওখানে। বড়-বড় মহাকাশ গবেষণা চলে ওখান থেকে। অনেক সন্নেসি মানুষ ওখানে আসেন, খুব দামি বাইনোকুলারে চোখ রেখে সারারাত খোলা আকাশের নীচে ওখানে নিথর হয়ে বসে থাকেন। অপলকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখেন। ওখানে গিয়ে শুনলাম, এক সময় তিব্বতের দ্রুকপা বৌদ্ধদের বসবাস ছিল এখানে। আরও একটা কথা ওখানে গিয়ে শুনলাম, খোলা আকাশের নীচে অন্ধকারে এমন লক্ষ-কোটি তারকার সমারোহ পৃথিবীর আর কোথাও থেকে নাকি দেখতে পাওয়া যায় না।’
সুলগ্না কী যেন বলতে যাচ্ছিল। অমন সময় বরুণ সেনাপতি বলল, ‘আগে প্রত্যেক জনপদের লোকেরা আলাদা আলাদা করে তাদের এলাকায় এই পরব পালন করত। দু’বছর কোভিডের জন্যে কোথাও এই পরব হয়নি। তাই এ বছর ছ’টি জনপদের মানুষ একসঙ্গে সাগা পরব পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মেয়েরা পরে এসেছে চড়া রঙের সুলমা।’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘সুলমা জিনিসটা কী?’
বরুণ হেসে বলল, ‘আরে ওটা হল এক ধরনের লম্বা গাউন। তারা মাথায় পরে এসেছে নেলেন টুপি। এই উৎসবের আবার একটা মেনে চলার মতো দিনক্ষণ আছে। তিব্বতি চান্দ্রপঞ্জি মতে বছরের চতুর্থ মাসের পনেরো তারিখে শুরু হয় উৎসব। মানুষ রঙবেরঙের পোশাক পরে এখানে আসে। সঙ্গে ডঙ্কা আর ভেরীর তালে তাল মিলিয়ে নাচতে-নাচতে জড়ো হয় সকলে। তিব্বতী বৌদ্ধরা সাগা দাওয়ার দিন গোম্পা মঠে আর মন্দিরে যান পবিত্র মন নিয়ে। মন্ত্র উচ্চারণ করতে-করতে মঠ প্রদক্ষিণ করেন। আর দরিদ্র মানুষদের মধ্যে দানধ্যান করেন দু’হাত উজাড় করে। ওঁরা মনে করেন, ওঁদের বিশ্বাসও, এই পরবে গরিব মানুষদের দু’হাত উপুড় করে দানধ্যান করতে হয়। তা হলে তা জীবনে দু’গুণ হয়ে ফিরে আসে। বৈভবে ভরে ওঠে মানুষের আটপৌরে জীবন।’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘তুই পরবের ফোটো তুলে ফিরে এলি কলকাতায়? কতদিন ওখানে থাকতে হয়েছিল তোকে?’
বরুণ কান্তারকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে সুলগ্নার দিকে তাকাল। তারপর বিনয়ের ভঙ্গিতে আবদার করল, ‘ম্যাডাম, আর এককাপ চা হয়ে যাক, প্লিজ!’
তখনই দরজায় ডোরবেল বেজে উঠল। সুলগ্না দরজা খুলতে এগিয়ে গেল। মুখে বলল, ‘কে আবার! মনে হয় মিনতির-মা এসেছে!’ দরজা খুলে মিনতির-মাকে দেখে বরুণের চায়ের আবদারটা সঙ্গে-সঙ্গে মিনতির মায়ের উপর চালান করে দিল সুলগ্না। ফিরে এসে মৌজ করে সোফায় বসল সুলগ্না।
‘ওখানকার মানুষজন কেমন রে?’ কান্তার জানতে চাইল।
বরুণ গলা গমগমিয়ে বলল, ‘অ-সা-ধা-র-ণ! ভাই স্রেফ অ-সা-ধা-র-ণ বললে খুবই কম বলা হয়।’
‘কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব-টন্ধুত্ব হল নাকি?’
মিনতির-মা চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। তখন সুলগ্না বলল, ‘মিনতির-মা, সিঙ্কে তাকিয়ে দ্যাখো, একটা মস্ত ইলিশ মাছ। তোমার দাদার এই বিদেশি বন্ধু কিনে এনেছেন।’
আরাম করে চায়ে চুমুক দিয়ে বরুণ বলল, ‘সে হয়নি আবার? মিলন! মিলনের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করে পারা গেল না!’
‘তারপর ফোটোগ্রাফারবাবু, ফোটো তুলে ফিরে এলেন কলকাতায়?’ প্রশ্ন করল সুলগ্না।
‘ফিরে তো এলাম। কিন্তু…!’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কী রে? কিছু কি ফেলে চলে এলি ওখানে?’
‘আর বোলো না কান্তদা। আমার বাউন্ডুলে মনটা ওখানে আটকে থেকে গেল বরফের টানে। ওখান থেকে ফেরার মন নেই।’
সুলগ্না বলল, ‘মানে?’
বরুণ হেসে বলল, ‘মানে খুব সোজা! আমি বরফের প্রেমে মজে গেলাম। দিনরাত এক করে জ্যোৎস্না রাতে বরফের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম পাগলের মতো! বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, জীবনে কখনও কোনও মেয়ের প্রেমে পড়িনি, মানে পড়তে পারিনি আর কী! হঠাৎ মনে হল, এই লাদাখ-সুন্দরী আমাকে ছেড়ে দিতে চায় না। জড়িয়ে ধরতে চায়, জড়িয়ে রাখতে চায়।’
তারপর কান্তারের দিকে তাকিয়ে বরুণ বলল, ‘কান্তদা, তুমি তো জানো, আমি কোনও মেয়ের প্রণয়-প্রত্যাশী ছিলাম না কখনও? মানে সুযোগ জোটেনি আর কী? ঠিক বলেছি কিনা?’
কান্তার ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না ভাই, কথাটা পুরোপুরি সত্যি হল না মনে হচ্ছে। সেই যে মেয়েটা অ্যাকাডেমিতে তোর ফোটোগ্রাফির দশ দিনের এগজিবিশন দেখতে দশটা দিনই এসেছিল? দশ দিনই কমেন্ট লেখার খাতায় কত কী যে লিখেছিল! কী যেন নাম মেয়েটির? বল না রে বরুণ! প্রথম দিকে তুই খেয়াল করিসনি। পরে, মানে ফোর্থ ডে-তে আমি গেলাম তোর এগজিবিশন দেখতে। তারপর কমেন্ট বুকটা ওল্টাতে গিয়ে চমকে গেলাম। একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে তোকে জিজ্ঞেস করলাম, বরুণ, এই মেয়েটা তো তোর দারুণ ফ্যান হয়ে গেছে রে! দেখছি, প্রতিদিনই আসছে তোর এগজিবিশন দেখতে! নিজের কপালে টোকা মেরে কান্তার বলল, ‘আরে মানালী বসু! এখন মনে পড়ছে, সে তোর একটা ল্যান্ডস্ক্যাপ প্রিন্টও কিনেছিল। তুই তো কখনও ভাবিসইনি, কলকাতায় আজকাল ফোটোগ্রাফও বিক্রি হয় পেন্টিংয়ের মতো। অন্তত তোর ফোটোগ্রাফ? পরে মানালীর সঙ্গে তুই যোগাযোগ করিসনি? সেও তো একটা চমৎকার প্রেম!’
‘দুর, তুমি কী যে বলো কান্তদা। এগজিবিশনের শেষ দিন সে সিলেক্ট করা ফোটোগ্রাফটা কিনে নিয়ে গিয়েছিল দশ হাজার টাকা দিয়ে ঠিকই। ঠিকানা আর ফোন নম্বর একটা টুকরো কাগজে লিখে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, এটা কাছে রাখুন! আপনি এত সুন্দর ফোটো তুলতে পারেন। ভাগ্যে থাকলে একবার আপনার সঙ্গে অনেক দূর পাহাড়ের চূড়ায় ফোটো তোলা দেখতে যাব। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে অমন পেন্টিং আঁকেন কেমন করে, দেখার ইচ্ছে খুব! সেদিন আমাকে নেবেন সঙ্গে?’
‘নিশ্চয়ই তুই কোনও উত্তর দিসনি?’ কান্তার ফুট কাটল।
‘না। দুর, আমার মাথায় তখন অন্য কাহিনি ঘুরছিল।’ বরুণ বলল, ‘আমাকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার চোখে দিকে তাকিয়ে মানালী বলল, আমাকে কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন করে নিন না! অসুবিধে কী? ওরকমই দূরে-দূরে থাকব? কক্ষনো আপনার কাছে যাব না! দূরের বান্ধবী হয়ে থাকব চিরদিন। ‘বনলতা সেনে’র মতো ঘুরে বেড়াব মিথ হয়ে লোকের মুখে-মুখে, কল্পনায়। নানা মিথ হয়ে ছড়িয়ে থাকব আপনার জীবনে? কেউ বলবে ‘বনলতা সেন নামটি জীবনানন্দের ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে প্রথম লেখা হয়েছিল। কেউ বলবে ‘বনলতা সেন কবির খুড়তুতো বোন শোভনা,’ কেউ বলবে, ‘বনলতা সেনকে কবি দেখেছিলেন ট্রেনে দার্জিলিং যেতে-যেতে। নাটোর স্টেশনে ট্রেনে-ওঠা ভুবন সেনের সঙ্গে, তাঁরই বিধবা বোন বনলতা সেন।’ কেউ বলবে ‘বনলতা’ নামে এক রাজবন্দিনী রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন। তখনকার খবরের কাগজে নামটি দেখেছিলেন কবি। তিনিই হলেন কবির বনলতা সেন!’ কী মজা বলুন তো? ওরকম নানা মিথে আমি ছড়িয়ে থাকব আপনার জীবনে। একবার শুধু সামনে দাঁড়িয়ে আপনার ফোটো তোলা দেখতে চাই? আর কিচ্ছুটি না!’
সুলগ্না মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘জানেন তো, এই আপনাদের মতো মানুষদের আমার একদম ভাল লাগে না! মেয়েরা আর কেমন করে নিজেকে নিবেদন করতে পারে বলুন তো? আর কত ভাবে?’
‘নিবেদন-টন কখনও বুঝতে পারিনি ম্যাডাম। তখন অত ভেবে দেখার সময়ও হাতে নেই। উনিশে অগস্ট ওয়ার্ল্ড ফোটোগ্রাফি ডে ছিল সামনে। ফ্রেঞ্চ আকাদেমি অফ সায়েন্সেস আঠারোশো উনচল্লিশ সাল থেকে উনিশ অগস্ট দিনটিতে তারা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফোটোগ্রাফির কম্পিটিশন অর্গানাইজ করে। আমি ওদের কাছে আমার তিনটে ফোটোগ্রাফ কী ভেবে পাঠিয়ে রেখেছিলাম। অনেকদিন তার রিপ্লাই আসেনি। মন থেকে সেই ফোটোগ্রাফের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এরকম আমার জীবনে অনেকবার হয়েছে। এখন বলতে সঙ্কোচ যে হচ্ছে না তা নয়। একবার একটি মেয়ে নন্দনের সামনে আমাকে একা পেয়ে বলল, আপনি বরুণ সেনাপতি? ফোটোগ্রাফি করেন?
আমি হাঁ করে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁ! কেন?
মেয়েটি বলল, আপনি কাল অ্যাকাডেমির সামনে দাঁড়াবেন দুটো পঁয়তাল্লিশে? খুব দরকার আছে?
আমি তেমনই অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কী দরকার? কী হয়েছে? আজই বলুন না!
মেয়েটি চোখের অদ্ভুত ইশারায় বলল, না, কাল! প্লিজ! প্লিজ! পরের দিন দুটোর অনেক আগে থেকেই আমি ভো-কাট্টা হয়ে গিয়েছিলাম।’
সুলগ্না অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে?’
হাসতে-হাসতে বরুণ বলল, ‘বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের পর পর দুটো শোয়ের টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। ব্যস!’
হি হি করে হাসতে-হাসতে সুলগ্না বলল, ‘আপনি পারেনও বটে!’
বরুণ বলল, ‘ওই যে মানালী বসু, শখের বনলতা সেন, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনই আমার ফোটোগ্রাফ জমা দিয়েছিলাম। তার রিপ্লাই এসেছে। আমি তখন টগবগ করে ফুটছি।’
সুলগ্না জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর? জিততে পারলেন?’
বরুণ মজা লুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে?’
সুলগ্না হেসে বলল, ‘কাকে আবার? ফোটোগ্রাফির পুরস্কার?’
বরুণ বলল, ‘দুর! ওসব আমার কপালে জোটে না। আমার আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের এগজিবিশনের শেষ দিন মানালী বসু একটু থম মেরে থেকে কোমরে হাত রেখে বলেছিল, আচ্ছা, না হয় ওসব থাক! ওই বনলতা সেনটেন! ফের যখন আপনার ফোটোগ্রাফির এগজিবিশন হবে, এই ভূমণ্ডলের যে-কোনও প্রান্তে, খবর পেলেই আমি ছুটে যাব! দয়া করে শুধু জানাবেন একটু কষ্ট করে!’
কান্তার বলল, ‘তোর তো পরে দু’-তিনটে এগজিবিশন হয়েওছিল রে? আমার অবশ্য যাওয়া হয়নি। মানালী বসু খবর পেলে নিশ্চয়ই ছুটে আসত। তুই খবরের কাগজের ‘কোথায় কী’ বিভাগেও তোর এগজিবিশনের খবরটা দিসনি কেন? কী ছেলে রে তুই!’
মুচকি হেসে বরুণ বলল, ‘না কান্তদা! দেওয়া হয়নি। তুমি তো জানো, আমি জীবনের গোড়া থেকে একদম ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’! আমার সঙ্গে কেউ নেই যে আমার এগজিবিশনের কার্ডটা পৌঁছে দেবে নিউজ পেপার অফিসে বা মিডিয়া হাউসে।’
তিনজনেই খানিক চুপ করে গেল। মিনতির-মা টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ডাক দিল। সুলগ্না বলল, ‘খালি পেটে আর কাঁহাতক কত প্রেম-বিরহের গল্প শোনাবেন আমাদের? চলুন, চলুন!’
লুচি আর সাদা আলুর তরকারি চেটেপুটে খেতে-খেতে বরুণ বলল, ‘আঃ! কতদিন এসব বাড়ির খাবার খাইনি। সেই কোন ছেলেবেলায় মা করত!’
সুলগ্না বলল, ‘ঠিক আছে, এবার কথা দিন, আমি ঢাকাইয়া রান্নায় পোক্ত এক সুন্দরীকে জোগাড় করছি আপনার জন্যে। তখন কিন্তু না বলে সিয়াচেন পালিয়ে যাবেন না, অথবা লাদাখে।’
বরুণ বলল, ‘শুনুন না ম্যাডাম, তা হলে আর-একজন যে বেজায় রাগ করে মুখ হাঁড়ি করে বসে থাকবে?’
‘সে কে আবার? আপনি তো খুব লটঘটে মানুষ মশাই! তলে-তলে…!’
‘সেবারই তো সাগা পরবের ফোটো তুলে ফিরতে-ফিরতে ঠিক করে ফেললাম মানুষ যদি পালাতেই চায়, মানুষের সঙ্গ থেকে, শহর থেকে, তবে সেরা জায়গা হল লাদাখ। মনে-মনে ঠিক করে ফেললাম, আমাকে পালিয়ে আসতে হবে এই লাদাখেই। কী করব, লাদাখে থাকব কোথায়? কিচ্ছু জানি না। কলকাতা ফিরে ওই ম্যাগাজিনের দপ্তরে ফোটোগুলো ডাউনলোড করে দিলাম। তারপর চিফ এডিটর দেবতোষদাকে বললাম, দাদা, আমি চললাম। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখেটেখে নিন। এর পর আর কলকাতায় আমাকে পাবেন না।’
‘কেন? ফের কোথায় চললেন?’
‘আমি দেবতোষদাকে বললাম, ফের লাদাখই যাচ্ছি। দেবতোষদা বললেন, ও, হেড লাইন হয়েছে আজকের কাগজে—লাদাখের আকাশে চায়না আর্মিকপ্টার উড়ছে। কভার করতে যাচ্ছেন বুঝি? কোন কাগজ থেকে? আমি বললাম, না। ওসব নয় দাদা! লাদাখে একটা বাড়ি বানাতে যাচ্ছি। বাড়ি? ওখানে?
সাগা দাওয়া পরব কভার করতে গিয়ে মিলন দোরজেকে পেয়ে গেলাম ওখানে। দু’দিনেই সে আমার ভারী বন্ধু হয়ে গেল। মিলন লাদাখে ভারত সরকারের হয়ে রাস্তা তৈরির কাজ করে। কতদিন পর সাগা দাওয়া পরবে ছুটি নিয়ে ওর লাদাখের বাড়িতে এসেছিল। একটা বরফের খাঁজে ছোট্ট একটা বাড়ি মিলন দোরজের। জায়গাটার নাম লিকির। বাড়িতে থাকে ওর বউ নেত্রমণি আর তিন বছরের একটা মেয়ে শ্রুতি। মিলন ছ’দিন পরপর বাড়ি আসে, আবার কখড়ো মাস কাবার করে ঘরে ফেরে। তখন হাতে একটু বেশি টাকা আনতে পারে মিলন দোরজে। না হলে সপ্তাহের পারিশ্রমিক দিয়ে দেয় টহলদার লোকটা। সে টাকায় বাড়ির জন্যে চাল-ডাল কিনে আনে। এবার পরবে বাড়ি আসছে বলে বউয়ের জন্যে আর শ্রুতির জন্যে লে-বাজার থেকে নতুন জামাকাপড় আনিয়েছিল কাউকে দিয়ে। ওরা পরবের দিনে আনন্দ করবে না? মিলনের বরফের খাঁজের বাড়ি থেকে দূরে তাকালে দিনের আলোয় ঝকমক করতে দেখা যায় লিকির মনাস্ট্রিকে।’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘তা না হয় হল। কিন্তু মিলন…?’
বরুণ বলল, ‘মিলনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে মিনিট পনেরোও লাগেনি, জানো তো কান্তদা? আমি একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করছিলাম, লিকির মনাস্ট্রিতে যেতে গেলে হাঁটা পথে কতক্ষণ লাগবে?
তখন পাশ দিয়ে এক যুবক তরতর করে নেমে যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢাল ভেঙে। আমার হিন্দিতে বাংলা কথার টান শুনে পিছন ফিরে তাকাল লোকটা। হিন্দিতে বলল, আপ মেরে সাথ আও! ইহ মেরা ঘর হ্যায়। এ কথা বলে মিলন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, মেরা নাম মিলন দোরজে। ম্যায় বঙ্গালি জানতা হুঁ! তারপর একটা ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে হুট করে মিলন বাংলাতেই জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?
আমি অবাক হয়ে গেলাম মিলনের গলায় বাংলা শুনে। আমি বললাম, আমার নাম বরুণ সেনাপতি। কলকাতা থেকে এসেছি।
মিলন বলল, বরুণ, মেরে ঘর মে আও! আমি ইতস্তত করছি দেখে মিলন বলল, আপ ক্যা সোচতে হ্যায় ক্যা? তুমি খালি হাত বলে আসতে চাইছ না?
আমি ঘাড় নাড়লাম মিলনের মুখের দিকে তাকিয়ে। সে আমার হাত ধরে টানতে-টানতে বরফের ঢাল পেরিয়ে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। বাড়ি তো নয়, যেন একটা বরফ-ঢাকা ছোট্ট কুটির বলা ভালো। দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে হল তার ঘরের ভিতরে। বারো বাই দশ ফুটের একটা কুঠুরি বলা যায় ঘরটাকে। দরজায় কোনও পাল্লা নেই। হাট করে খোলা। মিলন তার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, বরুণ, মেরি পত্নী নেত্রমণি। তারপর মেয়েকে আদর করতে করতে বলল, ইয়ে চন্দা! মেরি লেড়কি! লাদাখ কী মেরি রাজকুমারী! আমার মেয়ের ভাল নাম শ্রুতি!
লজ্জায় মায়ের ওড়নার ভিতরে মুখ লুকোল চন্দা। ঠিক যেন চাঁদের মতোই দেখতে মেয়েটি। আমার জিনসের জামার পকেট থেকে একটা বড় চকোলেট বার বের করে চন্দার হাতে দিলাম। বললাম, আঙ্কেলের গিফট! না করতে নেই!
চন্দা কোনও রকমে চকোলেট বারটা হাতে নিয়েই লজ্জায় ফের মায়ের ওড়নার নীচে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। গত রাত থেকে মিলনের বাড়ির চারপাশে বরফের আস্তরণ পড়েছে। ঠান্ডা পড়েছে খুব। তাই নেত্রমণি নুডলস, সবজি আর মাংস মিশিয়ে থুকপা রান্না করেছিল। একটু পরে আমাকে আর মিলনকে খেতে দিল নেত্রমণি। আমি তো গরম-গরম থুকপা বেশ আয়েশ করে খেলাম। খিদেও পেয়েছিল খুব। সেই সকাল থেকে এদিক-ওদিক ঘুরে মরছি। তুমি শুনলে অবাক হবে কান্তদা, সেই থেকে আমি যে ক’দিন লাদাখে ছিলাম, বেশির ভাগ দিনই নেত্রমণি নাছোড় হয়ে আমাকে খাওয়াতে ছাড়ত না। নেত্রমণির হাতের রান্না ভারী সুন্দর।’
কান্তারকে কিছু বলতে গেল বরুণ। হাত তুলে বরুণকে থামিয়ে দিয়ে কান্তার জানতে চাইল, ‘লাদাখে বাড়িটা বানালি কখন?’
‘শোনো না, সে আর-এক রূপকথার গল্প! সাগা পরব নিয়ে সেই ম্যাগাজিনটা দারুণ কভার স্টোরি বের করল। চারদিকে মিডিয়া-মহলে আমাকে নিয়ে খানিকটা হইচই পড়ে গেল। কপাল মন্দ, না হলে অনেক বেশি হইচই হতে পারত। আমিও সেই সুযোগে যার সঙ্গেই দেখা হল, তাকেই বলতে লাগলাম, আমি লাদাখে বাড়ি করে চলে যাচ্ছি। আর সমতলে ফিরব বলে মনে হয় না!
তখন আমার ফোটোগ্রাফার বন্ধুরা চোখ ট্যারা করে দেখতে শুরু করল আমাকে।’
খানিক চুপ করে থেকে কান্তারের দিকে তাকিয়ে বরুণ বলল, ‘তুমি তো বীরুকে চিনতে কান্তদা? বীরু দত্ত গো। আশুতোষ কলেজে আমাদের দু’বছরের জুনিয়ার ছিল। সে দিনরাত ফোটোগ্রাফি নিয়ে পৃথিবী পালটে ফেলার কথা চিন্তা করত। সাউথ আফ্রিকান ফোটোজার্নালিস্ট কেভিন কার্টারের তোলা ভয়ানক দুর্ভিক্ষের ফোটো ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়াত বীরু। সেই যে ছবিটা গো কান্তদা, একটা মহামারির শীর্ণকায় শিশুটিকে খেতে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ক্ষুধার্ত শকুন!’
কান্তর কপালে ভাঁজ কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। অনেক ভেবেচিন্তে বলল, ‘ও হো, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত! হ্যাঁ, ওদের ব্যাচটা কলেজে ঢুকেই একেবারে হইচই ফেলে দিয়েছিল, মনে নেই আবার? একেবারে নবীন বরণের দিন কলেজে একটা নতুন দেওয়াল পত্রিকা বের করার পারমিশন আদায় করে নিয়েছিল প্রিন্সিপ্যালের কাছ থেকে। সব মনে আছে।’
বরুণ বলল, ‘ও একদিন কলেজে আমাকে ওর একটা ক্যামেরা দেখিয়ে বলেছিল, বরুণদা, তুমি তো ফোটোগ্রাফি করো? আমারও ফোটোগ্রাফি করতে খুব ভালো লাগে। আমি তো কিচ্ছু বুঝি না, জানি না। আমাকে তোমার দলে নেবে? তারপর কলেজের সামনে দেখা হলে প্রায়ই আমার কাছে ফোটোগ্রাফি নিয়ে জানতে চাইত নানা কথা। জিজ্ঞেস করত, কেমন করে ভালো ফোটো তোলা যায়? ওর অত উৎসাহ দেখে একদিন ওকে নিয়ে যতীনদাস পার্ক মেট্রো স্টেশনের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই কান্তদা, মেট্রো স্টেশনের ওই সিঁড়িটা তখন আমাদের আড্ডার ভাল ঠেক হয়ে উঠেছিল। রেল-পুলিশ আমাদের তাড়া করত মাঝে-মাঝে। লাঠি উঁচিয়ে উঠিয়ে দিত সিঁড়ি থেকে। আমি ওকে বলেছিলাম, বীরু, তোকে প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে রাখি ভাই, ফোটোগ্রাফি হল বড়লোকের ছেলেদের ব্যাপার। দামি ক্যামেরা কিনতে হবে। এখন তো আর আগফা ক্যামেরার ফোটো দিয়ে কমপিটিশনে দেওয়ার মতো ফোটো তুললে চলবে না। ফোটোর ডেপথ চাই। তারপর অ্যাঙ্গেল-ট্যাঙ্গেল নিয়ে নানা কিছু একদিন বোঝাব তোকে।’
বীরু নাছোড় হয়ে বেশ কিছুদিন আমার পিছনে ঘুরঘুর করছিল। তবে একটা কথা মানতেই হবে, ওদের দলটা ভারী ভাল ছিল। ওদের কেউ-কেউ কবিতা লিখত! কেউ ছবি আঁকত। ওদের একটা মেয়ে, বনানী গুহ নাকি যেন নাম ছিল মেয়েটির। তার একটা কবিতা দুম করে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়ে গেল! তখন ওরা যেন টগবগ করে ফুটছে! হঠাৎ একদিন বীরু আমার কাছে এসে বলল, বরুণদা, তুমি ঠিকই বলেছ। ফোটোগ্রাফি বড়লোকদের ব্যাপার। চেষ্টা করে দেখলাম। তাই আমি এখন কবিতা লিখতে শুরু করেছি। ঠিক করেছি, আমরা ক’জন মিলে একটা লিটিল ম্যাগ বের করব। কেমন হবে বলো তো?
আমি বললাম, ওরকম হুজুগে গা না ভাসিয়ে যে-কোনও একটা জিনিস নিয়েই মেতে থাক। কবিতা তো কবিতা, নয়তো ফোটোগ্রাফি তো ফোটোগ্রাফি। তবে ক্যামেরা যখন কাঁধে তুলে নিয়েছিস, ওটা ছাড়িস না। আমার একটা কথা তোকে বলি। আমি খুবই গরিব বাড়ির ছেলে। বাবা-মাকে কবেই সেই কোন ছেলেবেলায় হারিয়েছি। আমি গোড়ায় যখন ফিল্ম ভরা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতাম, তখন নেগেটিভ ডেভেলপ করে ফোটো প্রিন্ট নিতে হত। প্রায়ই লেনিন সরণির একটা স্টুডিওতে যেতাম। সেনকাকু, মাথার সব চুল এক্কেবারে সাদা! খুব কম খরচে আমাকে প্রিন্ট করে দিতেন। ক্যামেরা খারাপ হলে সারিয়েও দিতেন। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি একদিন আমাকে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন।
বীরু জিজ্ঞেস করল, কী কথা বরুণদা?
সেনকাকু বলেছিলেন, একবার যখন ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিস, তখন কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে রাখলে চলবে না। ক্যামেরা হল ভিক্ষার ঝুলির মতো। কখন একটা-দুটো সম্বল এসে জমা হয়, তার ঠিক কী? দেখিসনি, যারা ভিক্ষে করে তারা চট করে তাদের প্রফেশন ছাড়ে না। পরে দেখা যায়, তারা মারা যাওয়ার পর তাদের ফুটপাথের পলিথিনের ঝুপড়ি থেকে কারও-কারও সংগ্রহ মিলিয়ে লক্ষ-লক্ষ টাকা পাওয়া যায়? কাগজে রিপোর্ট বেরোয়, ছবি ছাপা হয়, দেখিসনি? কিছুটা না জেনেই বীরু মাথা নাড়তে লাগল। আমি বললাম, জানিস তো শেক্সপিয়রের একটা কথা আছে—বেগারস মাউন্টেড রান দেয়ার হর্স টু ডেথ।’
মন দিয়ে শুনছিল কান্তার। বলল, ‘সব সময় ওসব তত্ত্বকথা বাস্তবে মেলানো যায় না রে বরুণ! তারপর, বীরু কী করল বল?’
বরুণ বলল, ‘বীরু ফোটোগ্রাফিটা এখনও ছাড়েনি। কবিতা লিখে টাকা জমিয়ে একটা দামি ক্যামেরাও কিনেছিল। তখন বুঝেছিলাম, ওর ফার্স্ট প্যাশান ফোটোগ্রাফি, দেন কবিতা! ওর ক’জন বন্ধুও জুটে গিয়েছিল। কলেজ পাশ করার পর থেকে আর ওর কোনও খবর জানতাম না। হঠাৎ একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে আমার টেবিলে উঠে এসে একটা চেয়ার টেনে এনে বসে বলল, বরুণদা, আমাকে চিনতে পারছ? আমি বীরু? আমি চিনতে পেরে গেলাম। ওর মুখটায় একটা মায়া মাখানো ছিল। বললাম, ও হো, তুই তো ফোটোগ্রাফার? চিনতে পারব না কেন? তোর কাঁধের ব্যাগ দেখে বুঝেছি, এখনও ফোটোগ্রাফি নিয়েই আছিস দেখছি!
বীরু বলল, তুমি যে ছাড়তে না বলেছিলে? তাই ছাড়িনি। তোমাকেই খুঁজছিলাম। তোমার মোবাইল নম্বরটাও যত্ন করে তুলে রাখিনি।
তোদের একটা কথা বলি, ক্যামেরা একটা ইনস্ট্রুমেন্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ক্যামেরা মানুষকে শেখায় ক্যামেরা ছাড়া কীভাবে দেখতে হয়। আমার গম্ভীর কথা শুনে ওরা কিছুটা ঘাবড়ে গেল বলে মনে হল। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন কী আবার দরকার পড়ল আমাকে?
ওর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের দেখিয়ে বীরু বলল, ওরা সব আমার নতুন ফোটোগ্রাফার বন্ধু! আমরা একটা ফোটোগ্রাফির এগজিবিশন করব বরুণদা। সাতজন মিলে। তোমাকে ইনগরেট করতে হবে আমাদের এগজিবিশনটা! না করলে চলবে না কিন্তু!
কোথায় করবি? হল পেয়েছিস? কবে?
বীরু থমকে গেল। হঠাৎ ওর মুখটা কালো হয়ে উঠল, নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো। আমি বীরুকে পাশের চেয়ারে বসালাম। বললাম, আরে না না। হল পাসনি তো? অনেক টাকা ভাড়া চাইছে? তাই তো রে? তাতে কী হয়েছে?
মাথা নাড়ল ওদের তিনবন্ধু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা কোথায় এগজিবিশনটা করবি শুনি? একটা ঘর তো চাই!
বীরুই বলল, আমাদের এক বন্ধুর মেসোমশাইয়ের একটা বড় বসার ঘর আছে বিড়লা অ্যাকাডেমির কাছে। উনি আমাদের অনুমতি দিয়েছেন। বসার ঘরটা রাস্তা থেকে অবশ্য পিছন দিকে বটে। তাতে কী? আর ঘর তো পেলাম না। টাকা দিয়ে ঘর নিতে পারব না আমরা। আমাদের অত টাকা কোথায়? এই ঘরটার জন্যে অবশ্য কোনও ভাড়া লাগবে না! তোমাকে আমাদের এগজিবিশনটা ওপেন করতে হবে বরুণদা!’
বরুণ কান্তারের মুখটা ভাল করে দেখে নিচ্ছিল। বলল, ‘তুই রাজি হয়ে গেলি?’
‘রাজি না হয়ে পারি? ওই নবীন মুখগুলো দেখলে কার না মায়া হবে রে? ওদের বললাম, কোথায় যেন পড়েছিলাম, প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার পার্থক্য হল দুঃখ। তাই নিজের প্রত্যাশাটা একটু কমিয়ে ফ্যাল, দেখবি তোদের দুঃখও কমে গেছে!’
থম মেরে গেল তিনজনেই। সুলগ্না উঠে গেল ঘরের ভিতর। কান্তার চুপ করে হজম করার চেষ্টা করল তার দুঃখের বোঝা কোন কোন ক্ষেত্রে কতটা ভারী। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘বীরুর সঙ্গে তোর আর কখনও দেখা হয়?’
বরুণ হেসে ফেলল ফিক করে। বলল, ‘সে কথা বলতেই তো অত কথার অবতারণা করলাম। আমার লাদাখে বাড়ি করার কথা বীরুও শুনেছিল মনে হয় কোনও সোর্স থেকে। সেম প্রফেশনে থাকলে একজন আর একজনের উত্থান-পতনের খোঁজ রাখে বড় বেশি। তার উত্থানে ঈর্ষা করে বেশি। আবার তার পতনে পাগলের মতো খুশিও হয়। বিশেষত পতনের খবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলেজস্ট্রিট কফি হাউসের সামনে দেখা হয়ে গেল একদিন বীরুর সঙ্গে। বীরু জিজ্ঞেস করল, কে যেন বলছিল, বরুণদা, তুমি নাকি লাদাখে বাড়ি করছ? কথাটা ঠিক না পুরোটাই গুজব?
মজা করার চোখে তাকালাম বীরুর মুখের দিকে। বীরু চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, বরুণদা, আমাকেও সঙ্গে নিও যদি সত্যিই লাদাখে আস্তানা করো! তারপর দুম করে বীরু বলেই বসল, তুমি যদি লাদাখে বাড়ি বানাতে পারো, আমি ফোটোগ্রাফিটা সেদিনই ছেড়ে দিয়ে বাঁকুড়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ধানচাষ শুরু করব। কথাটা তীরের মতো লাগল এসে আমার গায়ে। বললাম, আগে ঠিক করি লাদাখে যাব কিনা! গেলে তোকে সঙ্গে নিতে তো হবেই। তারপর বীরু দলবল নিয়ে প্রেসিডেন্সির মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।’
বরুণ বলল, ‘কান্তদা, যখন চারদিকে এত কথা উড়ছে কালবৈশাখীর বাতাসের মতো। এর বেশিটাই আমার যোগ্যতা নিয়ে মানুষের অনাস্থা। লোকে বলতে লাগল, যে ভাল করে ক্যামেরায় একটা ক্লিক করতেই পারল না, সে নাকি বাড়ি বানাবে লাদাখে!’
লাদাখে থাকার সময় একদিন পূর্ণিমা রাতে নেত্রমণি বলল, বরুণদা, চলো আমরা আজ চাঁদ দেখি! চন্দা তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি বললাম, মিলনকে ডাকি। ও কোথাও গেল মনে হল বাইরে?
নেত্রমণি ফিক করে হেসে বলল, তোমার মিলন ভাইয়ের মনের গাঙে এখন আর চাঁদের ছায়া পড়ে না গো। যখন প্রথম দিকে লাদাখে এসেছিল, রাতে হেঁটে-হেঁটে চাঁদ দেখতে বেরোতাম আমি আর তোমার মিলনভাই। কিছুতেই ঘরে টেনে আনা যেত না ওকে। রাত গভীর হত। দূরে লিকির মনাস্ট্রির চূড়ার ওপাশে তারা খসে পড়তে দেখতে পেতাম। বরুণদা, তোমার মিলনভাই ছিল চাঁদপাগল! তারপর বরফ কাটতে-কাটতে, রাস্তা বানাতে-বানাতে কবে ওর মনটা যে শুকিয়ে গেল একদিন! তারপর কী যে হয়ে গেল দূর থেকে বারুদের গন্ধ বাতাসে ভেসে এলে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে বসে যেত। দশদিন-পনেরোদিন এক মাস পর পর ঘরে ফিরত রাস্তা তৈরির কাজ থেকে। চাল-ডাল-শাকসবজি আনত। চন্দার জন্যে ডল-পুতুল কিনে আনত। আর রাতে জেগে থেকে চিনের সৈন্যদের আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। ঘুমোতে পারত না। আমি বলতাম, তোমার মনে এত ভয় নিয়ে এখানে থাকবে কেন? চলো আমরা সমতলে নেমে যাই!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি, এখানে এত কষ্ট করে থেকে কী লাভ? নেত্রমণি, এবার এখানকার পাট মিটিয়ে ফ্যালো! সমতলে নেমে চলো, দেখবে অনেক সুখ!
নেত্রমণি বলল, আমি তো উত্তরবঙ্গের মেয়ে। মিলন এল ওখানে পাথর কাটতে একটা কারখানায়। তারপর সমতল থেকে কেন যে এত উঁচুতে চলে এলাম কে জানে? মিলন আগে বলত, ওর নাকি সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ওর গরিব বাবা-মা থাকত আসানসোলের কাছে পাথরখাদানের ধারের বসতিতে। পেটের ভাত জোগাড় করতে গিয়ে ওর আর সেনাবাহিনীর পোশাক পরা হয়নি শরীরে! তারপর বাবা-মা যেদিন মেঘ হয়ে গেল, সেদিন আমাকে নিয়ে চলে এল লাদাখে।
আমি জানতে চাইলাম, কিন্তু লাদাখে কেন?
মিলনকে কেউ যেন লোভ দেখিয়েছিল লেহ-লাদাখের লাদাখ স্কাউটসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। সেই আশায় এখানে আসা। তারপর শেষমেশ পাথর কেটে রাস্তা তৈরির কাজ জুটল কত চেষ্টা করে। সেই ওর যুদ্ধে যাওয়ার আশা শেষ।
আমি আর নেত্রমণি ওদের ঘরের মুখটা পেরিয়ে বাইরে বেরোলাম। আমি গলা ছেড়ে ডাক দিলাম, মিলন ভাই… বাড়ি এসো! কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। একটা হালকা প্রতিধ্বনি ভেসে এল অনেক দূর থেকে।
নেত্রমণির গলায় আবেগের বন্যা। গলা নামিয়ে বলল, আপনার মিলনভাই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, আবার জেগেও স্বপ্ন দেখে! এমন দুমুখো স্বপ্ন দেখা-লোক আমি জীবনে দেখিনি ভাই।
কী স্বপ্ন দেখে? সে স্বপ্নের কথা তোমাকে বলে কখনও?
বলে।’ নেত্রমণি উদাস গলায় বলল, কী স্বপ্ন দেখে আপনি শুনবেন বরুণদা?
আমি গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, বলো না! আমার স্বপ্ন দেখতে যত না ভালো লাগে, শুনতে ভাল লাগে বেশি! মিলন কী স্বপ্ন দেখে? ও একদিন লে-লাদাখের রাজা হবে, তোমাদের জন্যে লাদাখে একটা রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দেবে। তারপর…
না না। ওসব কিচ্ছু না। ও ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে গো। একদিন না একদিন চিনের সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন মিটে যাবে। লাদাখের শেষ প্রান্তের তুরতুক গ্রামটা দিয়ে পায়ে হেঁটে ওপারের লোকজন এপারে আসবে সওদা করতে। এপারের লোকজন ওপারে যাবে। সীমানা তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু সে ওই নাম কা ওয়াস্তে! কোনও ভেদাভেদ থাকবে না দু’দেশের মধ্যে। সকলে নিজের মতো করে বেঁচে থাকবে। রোজগার করবে। কিন্তু ওই স্বপ্ন দেখতে-দেখতে আপনার মিলনভাইয়ের মাথা গুলিয়ে যায়। তখন সে থেবড়ে বসে পড়ে পাথরের উপর। তারপর হাঁটু মুড়ে মাথাটা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে তো বসেই থাকে। তখন ডাকলেও সে তাকায় না। উঠে বসে না।
মিলনকে বোঝাতে হবে, স্বপ্ন দেখতে যত সুন্দর। কিন্তু সব স্বপ্ন কি সফল হয়? এমন সময় মিলন বাঁ দিকের তুষারের ঢাল বেয়ে নেমে এল একেবারে আমাদের সামনে। এসে ধপাস করে বসে পড়ল পাথরের উপর। বরুণের দিকে সে তাকাল স্থির চোখে।
আমি বললাম, মিলন, আজ আমরা তিনজন সারারাত চাঁদ দেখব। আর খুঁজে বের করব, তিব্বত থেকে লামা-সন্ন্যাসীরা এখানকার আকাশে কী খুঁজতে আসেন বছরের পর বছর ধরে? এই মহাকাশে কি কোনও কিছু সমস্যার সংকেত লুকিয়ে আছে?
মিলন বলল, ‘দুর, দুর, দুর! ওসব কত বছর ধরে কত মানুষ সন্ধান করেছেন। কত দোলপূর্ণিমা, কত অমাবস্যার অন্ধকার, জন্মষ্ঠমীর বর্ষণমুখর রাত্রি তাঁরা ওসব খুঁজে-খুঁজে উন্মাদ হয়েছেন। থাক না সে কথা! আমি তো চাই লাদাখে একটা সুন্দর পৃথিবীর সৃষ্টি হোক। এত আগ্নেয়াস্ত্র, এত কামান-গোলা-বারুদ কেন? এত প্রাণ বিসর্জন যায় কেন দু’দেশের সীমান্তে? তুমি হিসেব করে দেখে আমাকে বোলো তো বরুণদা, এসব যদি না হত, তা হলে কত সোনার ভারত, কত হিরে-মুক্তোর চিন বিকশিত হত পৃথিবীর আকাশে? অবাক গলার স্বর নিয়ে থামল মিলনভাই। গলার একটা ঘড়ঘড় শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ঝটাস করে নেত্রমণি উঠে গিয়ে কোলে টেনে নিল মিলনকে। ফিসফিস করে নেত্রমণি আতঙ্কিত গলায় বলতে লাগল, এই ফের শুরু হল ওর জ্ঞান হারানোর মূহুর্ত। ছটফট করতে লাগল নেত্রমণি, কী করবে ভেবে পেল না।
আমি পাথরের উপর শুইয়ে দিলাম মিলনকে। ধীরে-ধীরে ডাকতে লাগলাম, মিলনভাই! চলো, ঘরে ফিরতে হবে তো? একা চন্দা ঘরে ঘুমিয়ে আছে। ওঠো! চলো, যাই!
একটুখানি নড়ে উঠল যেন। তারপর বড়-বড় চোখে তাকাল আকাশের দিকে। খুব নিচু গলায় বলতে চেষ্টা করতে লাগল, তুমি কালপুরুষ চেনো? সপ্তর্ষি মণ্ডল? লুব্ধকের সঙ্গে তোমার কখনও কোনও গভীর রাতে কথা হয়েছে? তুমি বলো তো বরুণদা, এই কলঙ্কহীন আকাশের কোথায় সেই সংকেত লেখা আছে? যে সংকেত থেকে আমরা হানাহানির লাদাখকে মুক্তির আলো দেখাতে পারব?
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বললাম, সব কি আমরা পারি মিলন? যেমন আমি আমার সমতলের মায়া কাটিয়ে লাদাখে এসে বাস করতে পারি। আর নয়তো তোমরা… তুমি, নেত্রমণি, চন্দা… তোমরা আমার কলকাতার আকাশবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো! চলো, কলকাতায় যাবে? যা হোক কিছু একটা করে কাটিয়ে দেব আমরা। আমার তো যাওয়ার সময় হয়ে এল।
মিলন আমার হাতটা জাপটে ধরে বলল, আমি তোমাকে লাদাখ থেকে ফিরে যেতে দেব না বরুণদা। এখানে তোমাকে রাস্তা তৈরির কাজে লাগিয়ে দেব। ঘরে বসে নেত্রমণি আমাদের জন্যে থুকপা রান্না করে রাখবে। প্রতিদিন অনেকটা পাথুরে পথ পেরিয়ে দুই বন্ধু ঘরে ফিরে আসব। কখনও তুষারঝড় উঠলে দু’জনে মাথা নিচু করে বরফের ঝাপটা সহ্য করে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকব। চন্দা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে। হিম পড়বে খুব মিহি করে। চন্দার চোখের পাতার বড়ো লোমকূপে সাদা হিম জমতে শুরু করবে। আর লজ্জায় নেত্রমণি বাড়ির বাইরে তাকিয়ে আমাদের খুঁজবে না! পাছে লোকে দেখে ফেলে!
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি কলকাতা থেকে আমার ফোটোগ্রাফির পাট চুকিয়ে ফিরে আসি। তুমি আমার জন্যে পাথর দিয়ে একটা ছোটো বাড়ি বানিয়ে দিও মিলন। কত আর টাকা লাগবে? কিছু আমার জমানো টাকা, কিছুটা ধারকর্জ করা টাকা দিয়ে বাড়িটা বানাতে পারব না? এবার নেত্রমণির দিকে তাকালাম। তার অতল জলের মতো টলটলে চোখ দুটোতে চিকচিক করছে গভীর আশার আলো!
আমি নেত্রমণিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী গো নেত্রমণি, আমরা চারজন মিলে পারব না একটা বাড়ি বানাতে?
আমি এমন করে কখনও ভাবিনি বরুণদা! তোমাকে পেলাম। তুমি তো ভগবানের কাছ থেকে আমাদের উপরি পাওনা। মিলনের অলীক স্বপ্ন দেখা ভেঙে গিয়ে জীবনের আলো ওর দু’চোখে ঝিকমিক করে উঠবে, এর বেশি আর কিচ্ছু চাই না বরুণদা! তুমি পাশে-পাশে থাকবে আমাদের বড় দাদার মতো! বিপদে-আপদে তোমাকে জড়িয়ে বেঁচে থাকব আমরা!
আমি কথা দিচ্ছি নেত্রমণি, ফিরে আসব তোমাদের কাছে!
নেত্রমণি হাত ধরে টেনে তুলতে গেল মিলনকে। আমিও মিলনকে টেনে তুললাম, চলো মিলন, খুব খিদে পাচ্ছে! মোবাইলে তাকিয়ে দ্যাখো, এখন কত রাত!’
‘কলকাতায় ফিরে মনে-মনে যখন লাদাখ ডাকতে লাগল হাতছানি দিয়ে। অমন সময় লাদাখ থেকে মিলনের ফোন এল, বরুণদা, লাদাখ কব আয়েগা? মুঝে আহান আপনে ঘর কে পাস কহনা হ্যায়, ম্যায়নে তুমহারে লিয়ে দশ ফুট গুনা আট ফুট কা এক ছোটা মুটা ঘর বানায়া হ্যায়।
আমি ফোনের এ প্রান্ত থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, ক্যায়া কহ রহে হো মিলন? মেরে লিয়ে ঘর? আপনে কর দেখায়া? আপকো পয়সে কাহান সে মিলে? তারপর আমি বললাম, আমি চলে এসেছি বলে তুমি বাংলায় কথা বলতে ভুলে গেলে মিলন? বাংলায় বলো!
আমার কথার উত্তরে মিলন বলল, তোমার জন্যে ধার নিয়েছি গো আমার কনট্রাকটারের টহলদার বুড়োর কাছ থেকে। লাদাখে বরফ কেটে রাস্তা তৈরির কাজে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কিছুটা করে টাকা কনট্রাকটারের কাছে জমা রাখতে হয়। সব টাকা হাতে দেয় না। সে টাকা সংসারের দায়-অদায়ের জন্যে তোলা থাকে আমাদের নামে। নেত্রমণির অসুখের কথা লিখে দরখাস্ত করে দিলাম। নেত্রমণির অসুখের অজুহাত দেখিয়ে আমি সে টাকা তুলে তোমার জন্যে বাড়ি তৈরির কাজে লাগিয়ে দিয়েছি!
মিলন দোরজের কথা শুনে আমার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠল। ক’দিনের বন্ধুত্বের জোরে এতখানি করা যায়? আমরা সমতলের মানুষ এমন করার কথা তো কখনও শিখিইনি। মনে-মনে বললাম, কেন যে মিলনকে বলতে গিয়েছিলাম লাদাখে বাড়ি করার কথা! এখন মন ভেঙে গেল একটু হলেও। ধুত, কে যাবে অমন শীতের দেশে? চারদিকে বরফ আর বরফ। রাত্রি হলে বেরিয়ে পড়ে নীলচে ছাই রঙের সাহসী ভরালের দল, স্নো-লেপার্ড যদি এসে পড়ে? বড় তুষার ভালুক আছে বলে শুনেছি। তাদের ভয় সঙ্গে নিয়ে লাদাখ বাস কি খুব সুখকর হবে? এসবের উত্তরে আমি এখন কী বলব মিলনকে? ফোনে বললাম, মিলন, আমি টিকিট কাটার ব্যবস্থা করেই তোমাকে জানাচ্ছি! তুমি যে অতগুলো টাকা লাগিয়ে বাড়িটা করে ফেললে, তোমার সংসারের জন্যে জমানো সে টাকা ফেরতও দিতে হবে তো? টাকা জোগাড় করে তবে যাচ্ছি তোমার কাছে।
মিলন টেলিফোনে হা-হা করে উঠল। বলল, বরুণদা, সে টাকা এক্ষুনি আমাকে ফেরত দিতে হবে না। আগে তো তুমি লাদাখে চলে এসো! তারপর…!
আমি টেলিফোনে মজা করে মিলনকে বললাম, লাদাখের বরফের নীচে কি টাকার পাহাড় লুকনো হয়ে আছে যে, আমি গিয়ে আইসকার্টার দিয়ে খুঁড়ে তোমার টাকা তক্ষুনি শোধ করে দেব? তোমাকে জানাচ্ছি ভাই, ক’টা দিন পরে ঠিক জানাব।’
একটু চুপ করে থেকে বরুণ বলল, ‘মিলনের ফোনটা ছেড়ে দিলাম, বুঝলে কান্তদা। মনে-মনে ভাবলাম, দুর লাদাখ! কী হবে ওখানে গিয়ে? আমার কল্লোলিনী কলকাতা কি কম সুন্দরী নাকি? কেন যাব লাদাখে বলো তো কান্তদা? এই তো বেশ আছি!’
‘কেন যাবে না, সে কথাটাই বলো? দাঁড়াও। বউয়ের অসুখের অজুহাতে অফিস থেকে টাকা ধার নিয়েছে তোর জন্যে একটা লোক, বাড়ি বানিয়ে দিয়ে তোরই জন্যে অপেক্ষা করছে। আর তুই যাবি না? এ কী রে? সুলগ্নাকে ডাকছি! সুদূর লাদাখে তোকে ভালবেসে একটা লোক বাড়ি তৈরি করেছে, আর…তুই কিনা!’
কান্তার উঠে গিয়ে সুলগ্নার হাত ধরে টেনে আনল। পাশের সোফায় বসিয়ে বলল, ‘এই দ্যাখো লগ্না, বরুণ এখন বলছে, সে লাদাখে ফিরে যাবে না! আর ওর জন্যেই তো ওখানে মিলন বলে একটা লোক আস্ত একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে, টাকা ধার করেছে বউয়ের অসুখের অজুহাত দেখিয়ে অফিস থেকে। আর সে এখন বলছে লাদাখে যাবে না? তুমি ওকে লাদাখ যেতে বলো!’
সুলগ্না হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমি তো আর বরুণ সেনাপতি নই যে চলে যাব!’
কান্তার চোখ মটকে বরুণকে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবি না কেন? নিশ্চয়ই একটা কিছু কারণ ঘটেছে? কী ঘটেছে বল না খুলে।’
‘সেরকম কিছু নয়। আরে সেই যে মানালী বসু! মেয়েটার সঙ্গে গত পরশু দিন দেখা অ্যাকাডেমির সামনে। আমি একটা ফোটোগ্রাফির এগজিবিশন দেখতে ঢুকছি। অমন সময় পিছন থেকে কেউ ডাকল, এই যে সেনাপতিবাবু? আজকাল ফেসবুকের স্টাইল মেনে এরকম চল শুরু হয়েছে। দেবালোক বিশ্বাসদা, মনামী সেনদি—এরকম আর কী। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক!’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে দেখে অত অবাক হলি বলবি তো? মানালী বসু কে?’
বরুণ বলল, ‘আরে বাবা, সেই যে মেয়েটা, আমার ফোটোগ্রাফির এগজিবিশন দেখতে প্রতিদিন এসেছিল? তুমিই তো প্রথম তাকে কমেন্টবুক ঘেঁটে আবিষ্কার করেছিলে কান্তারদা? মনে নেই?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে। ও, সেই মেয়েটা, যে তোর একটা ফোটোও কিনেছিল? কত টাকায় যেন?’
বরুণ বলল, ‘হ্যাঁ, দশ হাজার টাকা দিয়ে। তারপর শোনোই না, মানালী বসু আমাকে বলল, চলুন, এগজিবিশন হলে যাই? আমার পাশে-পাশে হাঁটছিল মানালী। আকাশি রঙের মস্ত বড় পাড়ওলা সাদা শাড়ি পরেছে। ওর গায়ের থেকে কোনও একটা পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। গন্ধটায় ক্ষণেকের জন্যে চঞ্চল হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। মানালী জিজ্ঞেস করল, কী দেখছেন?
আমি বললাম, তোমাকে! তারপর জানো তো কান্তদা, আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, তুমি খুব সুন্দর! ব্যস, ওটুকুই! সেই বিকেলটা গোটা সময় সে আমার সঙ্গ ছাড়ল না। বাড়ি ফেরার সময় আমাকে বলল, যাবেন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
আমার বাড়িতে? ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি! নিউ গড়িয়া স্টেশন থেকে কাছে। চলুন না! মেট্রো ধরে টপাস করে পৌঁছে যাব।
তখনও নিজের অজান্তে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বসলাম।’
সুলগ্না হেসে বলল, ‘যাই চা নিয়ে আসি। এ গল্প চা না হলে জমবে না!’
খানিক ফিরে এসে সোফায় বসে সুলগ্না বলল, ‘গেলেন ওর নিউ গড়িয়ার বাড়িতে?’
‘গেলামই তো! মেয়েটাকে দেখে অত বড়লোক বলে বুঝতে পারিনি!’ বলে চোখ বড় করে তাকাল বরুণ।
কান্তার বলল, ‘কেন? যে তোর একটা ফোটো চট করে দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে ফেলতে পারে, সে ধনী না হোক, সচ্ছল।’
‘শোনোই না! তুমি বড্ড কথার মাঝখানে কথা বলো। গিয়ে দেখলাম, মানালীর একার জীবন!’
সুলগ্না টিপ্পনি কাটার ভঙ্গিতে বলল, ‘এসব মেয়েরা একা থাকতেই পছন্দ করে। তারপর?’
বরুণ বলল, ‘ওর জন্যে এই বাড়িটা বাবা করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, বাবা আর মেয়ে একসঙ্গে জীবন কাটাবেন। মেয়ের বিয়ে দেবেন। ওর মায়ের অভাব মুছিয়ে দেবেন। কিন্তু মেয়ে বিয়ের কথাতেই বেঁকে বসল, রাজি হল না। বলল, বাবা, আর ক’টাদিন পরে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন না, মানুষের আছে দুটো বাসার পাখি! একটা দূরের বাসার, আর-একটা কাছের বাসার। আমি আগে দূরের বাসার পাখিকে খুঁজে দেখি। তারা কি সত্যিই বাসা বাঁধে? না হলে, তখন তোমার কাছের বাসার পাখিকে নিয়ে বাসা বাঁধব। তুমি চিন্তা কোরো না বাবা। মা নেই, তুমি তো আছ? তারপর বাবা একদিন দুম করে পৃথিবীর পাততাড়ি গুটিয়ে ফেললেন।
তারপর জানো তো কান্তদা, মানালী আমাকে দুম করে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনি দূরের বাসার পাখি বলেই তো মনে হয়। চলুন না! চলুন না, আপনি আমার দূরের বাসার পাখি হবেন? আমার চারপাশে উড়বেন, চক্কর কাটবেন। কিচিমিচি, হ্যাঁ, তাও করবেন বইকী!
কোথায়? তখনও মানালীকে বুঝে উঠতে পারিনি!
মানালী চোখে দূর আকাশের রং ছড়িয়ে বলল, ওই যে, আপনি যে মেঘের ফোটো তুলতে ছটফট করতে থাকেন, সেই অচেনা মেঘের ফোটো তুলতে! পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে মেঘের মাথায় সূর্য আলপনা আঁকে সমস্ত দিবস-রজনী ধরে!
হ্যাঁ, তেমন একটা জায়গার খোঁজ অবশ্য পেয়েছি! কিন্তু যাব ভেবেও এখন যেতে মন টানছে না।
মানালী জিজ্ঞেস করল, মন টানতে হলে কী করতে হবে? দেখি চেষ্টা করে, পারি কিনা!
আমার ওরকম হয়, কখনও কখনও! ও তোমার দ্বারা হবে না। ওসব বড়লোকের আদুরে মেয়ের জন্যে নয়।
আকাশ আবার বড়লোকের মেয়ের গরিব লোকের মেয়ের, এরকম হয় নাকি? মানালী বলল, চলুন না, খুঁজে দেখতে দোষ কী?’
সুলগ্না চা শেষ করে বলে উঠল, ‘এবার খানিক রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাক, কী বলেন বরুণদা? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তাঁর কবিতায়—‘আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে/ তোমারি নাম সকল তারার মাঝে।’ এটা মানালী কবেই টের পেয়ে গিয়েছিল, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি!’
‘রাখ ওসব কাব্যকথা। এখন নিজেকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। ইলিশের গন্ধ চারপাশে। এখন, চল পেট পুরে ইলিশ-ভাত খেয়ে নিই।’ কান্তার বলল।
‘আমিও লজ্জায় তোকে বলতে পারছিলাম না। চল, চল!’
খেতে-খেতে সুলগ্না বলল, ‘ইশ, আজ যদি মানালীকে ডাকা যেত, কী ভাল যে হত। আমানীকে তো আমি দেখিইনি! একদিন আপনি মানালীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবেন কিন্তু! কবে আনবেন বলুন তো?’
‘এখন সেই কথাটাই বলি। ম্যাডাম, আপনাকে আর কান্তদাকে বলাই হয়নি, আমি আর মানালী আকাশ ধরতে যাচ্ছি। ডেটটা এখনও ঠিক করিনি। তবে খুব শিগগিরই!’
কান্তার বলল, ‘মানে? কবে?’
চারপাশ থেকে আমার ফোটোগ্রাফির পাওয়া টাকাগুলো কালেক্ট করে নিই আগে। তারপর। ওখানে গেলে মিলনের ধার শোধ করার মতো টাকার কিছুটা তো নিয়ে যেতেই হবে কান্তদা।’
কান্তার বলল, ‘ঠিক আছে। তুই যাওয়ার আগে আমার থেকে কিছু টাকা নিস। কেননা, ঘরের ছেলে একটা অভিযানে যাচ্ছে, তাকে একটু কিছু দেওয়া তো আমারও উচিত!’
‘তা দিও কান্তদা। কিন্তু আমি যদি সমতলে আর না ফিরি? তখন তোমার কাছে ঋণী থেকে যাব যে সারাজীবন? তখন কী হবে?’
‘কিচ্ছু হবে না। তখন একদিন আমাকে আর সুলগ্নাকে তোর বরফের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করিস। তা হলেই আমার ঋণ শোধ হয়ে যাবে। কে যেন বলেছেন, জীবনের অনেক ঋণই শোধ করা যায় না। শুধু স্বীকার করা যায় মাত্র! দাশরথী রায়ের পাঁচালি পড়িসনি। তিনি লিখেছেন সেই কোন যুগে, ‘আমি আছি গো তারিণী ঋণী তব পায়।’’
‘দুর, ওসব কথা ছাড়ো!’ বরুণ উড়িয়ে দিল কান্তারকে।
‘তোরা কবে রওনা হচ্ছিস? মানালীও যাচ্ছে?’ কান্তার জিজ্ঞেস করল।
সঙ্গে-সঙ্গে সুলগ্না বলল, ‘তার আগে আপনাদের সাতপাকের ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে হবে তো! তাই না বরুণদা?’
এই বয়সেও বিয়ের প্রসঙ্গে বরুণের মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল। বরুণ নিজে সেই আভা দেখতে পেল না। সূর্য যখন সকালবেলা মেঘের গায়ে আলো ছড়াতে-ছড়াতে আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন সে কি আর খোঁজ রাখে, তার লালিমা দেখতে কত শিল্পী অপলকে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে?
কান্তার ফুট কাটল, ‘তোর মুখটা যে লাল হয়ে উঠল রে বরুণ? বেশি বয়সে বিয়ের কথা উঠলে বুঝি এমন হয়?’
বিয়ের প্রসঙ্গে সব বয়সেই সকলেরই মুখে আবিরের রঙ ছড়িয়ে পড়ে। বরুণ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওর মুখের ছড়িয়ে-পড়া আবির রং রুমালে মুছে নিয়ে বলল, ‘কান্তদা, শোনো, শোনো, আমি একটা অদ্ভুত অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিলাম একবার। দুর তোমাদের সঙ্গে কত গল্প যে জমে আছে, কোনটা আগে বলি, কোনটাই বা পরে বলি! এখন বরং সেই গল্পটা তোমাকে বলি—একটা ওল্ডএজহোম থেকে ফোন এল আমার কাছে, আপনি ফোটোগ্রাফার মি. সেনাপতি বলছেন? আপনাকেই তো কোয়াটারলি একটা ইংলিশ পিরিয়ডিক্যাল অ্যাসাইন করেছিল লাদাখের সাগা দাওয়া পরব কভার করার জন্যে? সে ফোটো আমরা দেখেছি। তবে এবার যদিও আমাদের সাবজেক্টটা একটু অন্যরকম। কিন্তু আপনার ভাল লাগবে।
আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, আগে বিষয়টা বলুন, শুনি!
পাশ থেকে ফোনে আর-একজন বললেন, না, বিষয়টা তেমন কিছু নয়। আমাদের একটা নামী ওল্ডএজহোম আছে নিউআলিপুর পেট্রোল পাম্প ছাড়িয়ে বাঁ দিকে। তার দুই বোর্ডার, লোকটির বয়স এইট্টি সেভেন, অ্যান্ড মেয়েটির এইট্টি ওয়ান। ওঁরা ঠিক করেছেন ফের বিয়ে করবেন। নিজেরাই ঠিক করেছেন। তারপর আমাদের জানিয়েছেন আজ ক’দিন হয়। বলুন তো, কী বিভ্রাট! আগামী সতেরো তারিখ ওঁদের বিয়ে হবে। এই বর-কনের বিয়ের একটা জম্পেশ ফোটো স্টোরি ছাপতে চায় একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটা কলকাতা থেকে বেরোয়। ওঁরা পরে আপনার সঙ্গে কনট্রাক্ট করবেন, কী দিতে হবে?
জানো তো কান্তদা, বিষয়টা আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল, তক্ষুনি কথা দিয়ে ফেললাম। তারপর বিয়ের দিন, মানে সব যদিদং নিয়ম মেনে ছাদনাতলা তৈরি করল, লোকজন ডাকল মিডিয়াকে তো ডাকলই। ম্যারেজ রেজিস্টার এলেন। সে এক হইহই ব্যাপার। মজা করে ওল্ডএজহোম কর্তৃপক্ষ একটা চতুর্দোলাও জোগাড় করে আনল।’
সুলগ্না জিজ্ঞেস করল, ‘চতুদোর্লা কী?’
বরুণ হেসে বলল, ‘ম্যাডাম, পালকি! বর-বউ দোতলা থেকে এক তলায় বাগানের যেখানে ছাদনাতলা করেছে, অতখানি নিয়ে আসা হবে বর-বউকে পালকিতে করে।’
‘বাঃ! গুড আইডিয়া।’
বরুণ বাহাদুরি কুড়নোর জন্যে বলল, ‘জানো তো কান্তদা, অবশ্য এই আইডিয়াটা আমার। জানেন ম্যাডাম, সানাই বাজনদারদেরও একটা ছোট সানাই-টিম নিয়ে আসা হল! তখন একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।’
সুলগ্না চোখ বড় করে বলল, ‘কী দেখলেন?’
বরুণ খুব একচোট হেসে নিয়ে সুলগ্নার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি অনেক বিয়ে কভার করেছি। এমনকী, আমাদের টলিউডের হট ফেভারিট নায়ক-নায়িকা ক’জনের ম্যারেজ, কারও-কারও ফার্স্ট ম্যারেজের ফোটোও তুলেছি, সেকেন্ড ম্যারেজেরও ফোটো তুলিনি যে তা নয়! তাদের নামটা নানা কারণে এখন বলছি না! ঝমেলা আছে। তাঁদের অত মেকআপ নেওয়া মুখেও আবিরের রং ছড়িয়ে পড়তে কম দেখিনি। অবশ্য মেকআপ আর্টিস্টের চড়া মেকআপের ঘটায় সেসব নিস্প্রভ ছিল অনেকটাই। কিন্তু এই ওল্ডএজহোমের দুই বৃদ্ধ বর-কনের মুখমণ্ডলের লালিমা এখনও ভুলতে পারিনি ম্যাডাম! অনেস্টলি স্পিকিং! সে সব আমার ফোটোগ্রাফে ধরা আছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসলে কি অমন হয়?’
ফুট কাটল সুলগ্না, ‘এবার নিজেই একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে দেখুন না!’
‘দুর! আপনারা যে কী বলেন! আমার আবার বিয়ে!’ হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল বরুণ। চুপ করে বসে থাকল। বরুণ অমন করে যখন মহা সমস্যা ওর সামনে এসে জিরাফের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন বরুণ কী করবে ভেবে পায় না।
ওর অমন মুখ দেখে কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, কোনও সমস্যা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মনে হচ্ছে? কী সমস্যা?’
‘ওটা তো সাংসারিক সমস্যা গো! আমি তো সংসারই করিনি। তায় অমন সমস্যার মুখোমুখি হইওনি কখনও।’
‘বল না সমস্যাটা কী?’
‘আমি বরং ম্যাডামকে বলি। মেয়েরা খুব উপায় বাতলে দিতে পারে।’
বরুণের কথা শুনে কান্তার বলল, ‘সংসার করিসনি, আবার এসব সংসারের গূঢ় কথা জেনে বসে আছিস?’
হঠাৎ কী হল কে জানে, বরুণ খেয়েদেয়ে উঠে সুলগ্নাকে বলল, ‘ম্যাডাম, ইলিশটা কিন্তু জব্বর হয়েছে!’
তারপর কান্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কান্তদা, আমি এখন উঠি! মানালী নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। এখান থেকে তো নন্দন কম দূর নয়!’
সুলগ্না মজা করল, ‘এরই মধ্যে অপেক্ষা, প্রতীক্ষা শুরু হয়ে গেছে?’
বরুণ ওর ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, ‘চলি কান্তদা! শিগগির তোমাদের কাছে উপায় খুঁজতে আসব।’
সুলগ্নার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, সামনে মহা সমস্যা! একটা চমৎকার সমাধান চাই!’
‘এখনও তো শুনলামই না সমস্যাটা। বলুন!’
বেরিয়ে যেতে-যেতে বরুণ বলল, ‘আজ আর দেরি করলে হবে না। চলি, ফোন করে চলে আসব!’
হুড়মুড় করে বরুণ বেরিয়ে গেল। সুলগ্না ব্যালকনিতে গিয়ে তাকিয়ে দেখতে গেল বরুণকে। অমন সময় সুলগ্না রুমের দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব নিচু গলায় বল, ‘ওই তো ওরাও এসে গেছে! ওই তো তোমার লক্ষ্মীমতী মেয়েটা বারান্দায় চুলে চিরুনি দিচ্ছে।’
‘ভরপেট ইলিশ খাওয়ার পর অন্যের বউ নিয়ে আমার মাথাব্যথা কম।’ বলেই জড়িয়ে সুলগ্নাকে নিয়ে শোফায় ডিগবাজি!
একটা উবর এসে থামল পরের রোববার কান্তারদের ফ্ল্যাটের সামনে। বিকেল গড়িয়ে পড়ছে আকাশে। উবরটা ওদের চোখেই পড়ল না। তখনও সুলগ্না বিছানায় গড়াগড়ি খেতে-খেতে কান্তারকে বলল, ‘প্লিজ বেয়ারা, এককাপ চা!’
কান্তার বলল, ‘তোমার জন্যে বেয়ারা কেন, সুইপার, কেয়ারটেকার, সবই হতে রাজি।’ বলে চলে গেল কিচেনে।
তক্ষুনি ডোরবেল বেজে উঠল। সুলগ্না আলসেমি জড়ানো গলায় বলল, ‘প্লিজ কান্ত, দ্যাখো না, কে এখন এল এমন মধুর মুহূর্তে? কতদিন বলেছি মিনতির-মাকে, তুমি রোববার বিকেলে দেরি করে আসবে! তাও এক্ষুনি চলে এল?’ বলে গজগজ করতে করতে দরজাটা খুলেই হাঁ।
চেঁচিয়ে বলল, ‘কান্ত, তোমার বন্ধু আর একজন কেউ। তোমারই দরজা খোলা উচিত ছিল।’
ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বরুণ বলল, ‘ম্যাডাম, দিন অনুযায়ী আপনাদের দরজা খোলার ডিউটি ভাগ হয়ে যায়? প্লিজ, আপনাদের এই ডিউটি বিভাজিকার লিস্টের একটা কপি আমারও লাগবে তো! কবে কে কখন দরজা খুলবে, প্র্যাকটিস করতে হবে তো?’
বলেই মেয়েটিকে বলল, ‘মানালী, ইনি সুলগ্না ম্যাডাম! আমাদের নেক্সট প্ল্যানার আমার বন্ধু কান্তদার স্ত্রী!’
ততক্ষণে কান্তার সোফার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘হ্যাঁ, মানালী তো! কবে একবার দেখেছিলাম! মনে কি আর থাকে? বোসো তোমরা। আমি আরও দু’কাপ জল বাড়িয়ে নিই।’
সোফায় বসতে-বসতে বরুণ বলল, ‘কান্তদা, না বলেই মানালীকে নিয়ে চলে এসেছি।’
মানালী একটু গুটিয়ে আছে মনে হল সুলগ্নার। মানালীর হাত ধরে সোফায় বসিয়ে বলল, ‘আমি তুমি করেই বলছি ভাই! কবে তোমাদের আকাশ দেখার শুরু হচ্ছে?’
মানালী অবাক গলায় বলল, ‘আকাশ দেখার? কোথায়?’
কান্তার বলল, ‘সে আমি ভাই কী জানি? তোমরা উড়ছ আকাশে। আমি ধরার ধরণীতে পাক খাচ্ছি! কী রে বরুণ, সব পাকা করে ফেলেছিস মনে হচ্ছে? তার আগে…!’
বরুণ জিজ্ঞেস করল, ‘আর আগে বলে এখন কিছু হয় না। কান্তদা, চা খেতে-খেতে বলছি!’
কান্তার চা নিয়ে টেবিলে রাখল। বলল, ‘দাঁড়া ভাল করে বসি! তুই তো জানিস, আমি ভাল করে না বসে কোনও জরুরি কথা শুনতে পারি না! সিদ্ধান্ত নিতেও পারি না!’ মানালীর দিকে তাকিয়ে কান্তার বলল, ‘চা খাও!’ বরুণের দিকে চোখ মেলে কান্তার বলল, ‘বল, আমাকে কী করতে হবে?’
ততক্ষণে চায়ে চুমুক দিয়েছে সুলগ্না। একবার মানালীকে আড় চোখে দেখে নিল। বরুণ বলল, ‘কান্তদা, আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হবে চুচোট গাংগমা! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!’
‘কেন? কী হল যে, এত তাড়া?’ কান্তারের চোখে বিস্ময়।
‘শোনো, তোমাকে বলি! পরশু আমাকে ফোন করেছিল নেত্রমণি।’
কান্তার জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলল?’
বরুণ বলল, ‘কিছুই তো বলতে পারল না। সবটুকুই তো কান্না! কোনও কথাই ভাল করে বলতে পারল না। কান্নার সময় কেউ কি তার কথা ভাল করে বলতে পারে?’
‘তুই কী বুঝলি, সেটা বল!’ কান্তারের গলায় ব্যস্ততা।
‘নেত্রমণি সর্বহারা হয়ে গেছে কান্তদা। পরশু কাজ থেকে ফেরার পথে সপ্তাহের টাকা নিয়ে হাট-বাজার করে ফিরছিল মিলন। তখনও সন্ধের ঝুঁঝকো নামেনি। বরফের দেশে আকাশকে চটপট অন্ধকার নামাতে দেয় না বরফের সাদা। মাথায় ওর কী যে ঘুরছিল, বুঝতে পারেনি মিলন। পিছন থেকে একটা পাথর বোঝাই ট্রাকের চাকার নীচে চলে গেল মিলন।’
‘সে কী? কী বলছিস তুই?’ চিৎকার করে উঠল কান্তার। সুলগ্না সালোয়ারের ওড়নায় মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
‘কী আর বলব কান্তদা? কিন্তু আমি যে ভিখিরি হয়ে গেলাম মিলনের কাছে? নেত্রমণির সংসারের কাছে? আমাকে এখনই ছুটতে হবে গাংগমায়, মিলনের গ্রামে, ওর বরফ-ঢাকা বাড়িতে।’
হাত তুলে কান্তার বরুণকে বলল, ‘দাঁড়া। দাঁড়া মিলন। অত হুটোপাটি করলে হবে না। এখন নেত্রমণি কোথায়? চন্দা কোথায়? কেমন আছে?’
‘ওর বাড়িতে আছে। চন্দা তিনদিন কিচ্ছু খায়নি। নেত্রমণিকে দূরের গ্রাম থেকে দুটো ফ্যামিলির মেয়ে দুটো এসেছিল এমন খবর শুনে। তারা নেত্রমণি আর চন্দাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাদের বাড়িতে, রাজি হয়নি নেত্রমণি। এখন আমাকে যেতেই হবে কান্তদা! আর দেরি করলে হবে না।’
বরুণের কথার উত্তরে মানালী বলল, ‘তুমি কি একাই যাবে নাকি? আমি তো যাব। এখন আমাদের দুটো পথই তো একটা পথ।’
বরুণ বলল, ‘তুমি এখনই অত দূরের পথে যেও না। তুমি তোমার নিউ গড়িয়ার বাড়িতে থাকো! আমি নেত্রমণির কাছে যাই। দেখি কী করা যায়?’
চারপাশে অসহায়ের মতো তাকাল বরুণ, ‘আচ্ছা কান্তদা, তুমি পরামর্শ দাও তো! এখন আমার কী করা উচিত? মিলনের অফিসের লোন মেটাতে হবে, তারপর অফিস থেকে নেত্রমণির পাওনা বুঝে ওর হাতে তুলে দিতে হবে। তারপর…! তারপর কী?’
কান্তার বলল, ‘তারপর কী করবি? ওরা মানে নেত্রমণি আর চন্দা খাবে কী? কোথায় থাকবে? কে ওদের দেখবে?’
‘কান্তদা, পাহাড়ের মানুষ সকলে সকলের পাশে এসে দাঁড়ায়। সকলেই সকলকে দেখে, খোঁজখবর নেয়, ভালবাসে। বুক দিয়ে আগলে রাখে। কিন্তু আমার তো উচিত ওদের পাশে থাকা!
তা হলে অন্তত মিলন সামান্য নিশ্চিন্ততা খুঁজে পাবে আকাশ থেকে।’ উপরের দিকে হাত তুলে ঈশ্বরের দিকে নির্দেশ করল বরুণ, ‘সকলের সঙ্গে তিনি তো থাকেন।’
‘বরুণ, এখন আবেগের সময় নয়। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোকে। অত টাকা দিয়ে মিলন তোর জন্যে যে বাড়িটা করে রেখে গেল, তার কী হবে? চারদিকে কতটা না লোন করে গেছে! সে সব খবর কি নেত্রমণি জানে? নাকি নেত্রমণিকে বলেছে মিলন?’
চুপ করে বসেছিল সুলগ্না। এবার মুখ খুলল। মেয়েরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সব সময় সেরা পন্থা খুঁজে দেয়। সুলগ্না বলল, ‘বরুণদা, আগে তোমরা মন্দিরে গিয়ে তোমাদের জীবনের গ্রন্থিটা বেঁধে ফ্যালো! আমি আর কান্তদা থাকব। তারপর মানালীকে আমাদের জিম্মায় রেখে তুমি চলে যাও লাদাখ। ওদের পাশে দাঁড়াও!’
‘আমি কি অতটাই ছোট সুলগ্নাদি? আমি একাই থাকতে পারব আমার নিউ গড়িয়ার বাড়িতে। কিন্তু…ও এই শোকের মাঝখানে গাংগমাতে গিয়ে কী করবে একা? নেত্রদিকে ও কি সামলাতে পারবে একা-একা। মেয়েটার ওই পুঁচকে একটা মেয়ে চন্দা ছাড়া কিছুই থাকল না। ও এখন যেটুকু টাকা জোগাড় করতে পারে, সেটুকু নিয়ে রওনা দিক। আমিও যাব ওর সঙ্গে। বলো সুলগ্নাদি, আমাদের যা ফল হবে সব দু’জনে ভাগ করে নিতে পারি তো। যা বোঝা, সব দু’জনে বইতে তৈরি আছি।’
তারপর কান্তারের দিকে মুখ তুলে মানালী বলল, ‘কান্তদা, আপনি বরুণের হাতে যতটা পারেন টাকাপয়সা দিন। আমরাও ধারধোর করে যেটুকু পারি জোগাড় করি। ফিরে এসে মিটিয়ে দেব সব।’
কান্তদা রসিকতার মতো মুখ করে বলল, ‘কী করে আমাদের টাকা ফেরত দেবে, ভেবেছ কিছু?’ বরুণকেও জিজ্ঞেস করল কান্ত, ‘তুই কিছু ভেবেছিস বরুণ?’
বরুণ ঘাড় নাড়ল দু’দিকে, ‘না, কান্তদা। আমার তো সঞ্চয় বলতে কিচ্ছু নেই। ফোটোগ্রাফি করে কী পেয়েছি বলো? ভোবোছিলাম, ফোটোগ্রাফি করে আমার অনেক নাম হবে। টাকা? হ্যাঁ তা-ও হবে সে কথা কি মোটেও ভাবিনি তা তো নয়। কিন্তু…’
মানালী বলল, ‘আমি ভেবেছি কান্তদা। আমার নিউ গড়িয়ার বাড়িটা দরকার হলে বিক্রি করে দেব। মিলনদার ধার মেটাব গিয়ে।’
‘তারপর?’ জিজ্ঞেস করল সুলগ্না।
‘খড়কুটোর মতো ভাসব বরফের দেশে। বরুণ ফোটো তুলে নানা কাগজে পাঠাবে। আমাদের চলে যাবে কোনও রকমে।’
কান্তার বলল, ‘দুর পাগলি, কোনও রকম দিয়ে জীবন চলবে না।’
‘আগে তো যাই ওখানে। আর দেরি করা ঠিক হবে না কান্তদা।’ তারপর একটু থম মেরে থেকে মানালী হালকা হেসে বলল, ‘তারপর তো তোমরা দু’জন থাকলে দূর থেকে আমাদের পাশে। বলো আমাদের বিপদের দিনে ফেলে দিতে পারবে?’
বাড়িতে যেটুকু টাকা ছিল জোর করে বরুণের ব্যাগে ভরে দিল কান্তার। সুলগ্না ভিতরের ঘর থেকে নিজের সঞ্চয় থেকে যতটা পারল এনে মানালীর হাতে দিয়ে বলল, ‘কাল সকালে চলে আসবি আমাদের কাছে। হেতোড় মোড়ে মা জয়চণ্ডীর মন্দিরে গিয়ে তোদের বিয়েটা সেরে তারপর তোদের কাছচাড়া করব। তার আগে নয়। ঠিক চলে আসিস কিন্তু।’
মানালী সুলগ্নার মুখে মুখ রেখে বলল, ‘তোমার এই পাগলামি সারাজীবন মনে রাখব সুলগ্নাদি। আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে দিদি! আর মন্দির সাক্ষী নাই-বা হল। ঠাকুর বলেছেন না, তুমি যখন দেবতার পুজো করবে বলে মনে-মনে ঠিক করলে, তখনই তোমার পূজা পেয়ে গেলেন দেবতা! আর নাই-বা থাকল পূজাউপাচার, নাই-বা থাকল ফুলমালা। তার আগেই দেবতা পূজা গ্রহণ করেন। তাই তো তিনি দেবতা! তোমার বরুণদাও সেরকম। আমি যেদিন ওর এগজিবিশন দেখতে পাগলের মতো এ্যাকাডেমিতে গিয়েছি, তখনই তো নিবেদনের পালা সাঙ্গ হয়েছে দিদি। আর এসব নাই-বা হল!’
ওরা গড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল কান্তারের ফ্ল্যাট থেকে। দরজার কাছ থেকে দু’জনেই ফিরে এসে কান্ত আর সুলগ্নাকে প্রণাম করল দু’জনে। তারপর ওরা বেরিয়ে গেল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছিল সুলগ্না আর কান্তার।
দুটি ধূলিধূসরিত জীবন-পথিক দেখতে-দেখতে মিলিয়ে গেল দিগন্তের ওদিকে। এখন চারপাশে তেমন মানুষজন জেগে নেই। পাখিরা বাতাসে ভাসতে-ভাসতে শূন্যে ডানা মেলল দূর গগনের গান গাইতে-গাইতে। শুধু একজন অনেক দূর গগনের আড়াল থেকে ওই দুই পথিককে দেথে মিটিমিটি হাসলেন। তিনি জীবনদেবতা!
অত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে লাদাখের আকাশে যখন সূর্য অস্তগামী, তখন বরফে আর আকাশের নীলে কারা যেন অচেনা আলোর রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। সেদিকে মুখ তুলে মানালী জিজ্ঞেস করল, ‘আর কত দূর? এ তো অন্তহীন পথের কুয়াশা ছড়ানো পথ!’
‘এই তো এসে গেছি! দেখছ না, বরফের উপর যখন একটা না-দেখা আলো হুমড়ি খেয়ে পড়বে, বুঝবে এবার গাংগমা গ্রামের আর দেরি নেই। তখনই দেখবে মুলেস ফুলে ঢেকে আছে গোটা ভ্যালিটা। ওই তো দ্যাখো পারপেল ফুলের জাজিম পাতা হয়ে আছে। আমাদের বাঁ দিকে সেই বিখ্যাত কারগিল জেলা, যেখানে যুদ্ধে-বারুদে আর সেনা জওয়ানদের আত্মাহূতির জয়গান লেখা হয়ে আছে বাতাসের গায়ে। বাতাসে কান পাতলে সে গানের মূর্চ্ছনা শোনা যায়, যদি আকাশে মেঘ না থাকে। মিলন দোরজে এক-একদিন টানা বরফ প্রান্তর পেরিয়ে ওদিকে কোথায় যে চলে যেত! ফিরত সেই ভোর-গগনের গান বেজে ওঠার সময়।’
‘নেত্রমণিদিকে বলে যেত না?’ জিজ্ঞেস করল মানালী।
‘না। মিলন আমাকে একদিন বলেছিল, সে যাওয়ার কথা কাউকে বলে যেতে নেই। বলত, যা খুঁজতে যাচ্ছি, তার কথা এখনই বলব না!’
হঠাৎ একটা মিহি গন্ধ ভেসে এল বাতাসে। হিমের ছুচ ফুটল শীতের পোশাক ফুড়ে গায়ে। বরুণ মানালীর ভারী সোয়েটারের গলার দিকের বোতাম দুটো এঁটে দিল। বলল, ‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে!’
মানালী বরুণের মুখের দিকে তাকাল। এ বরুণকে সে এর আগে কখনও দ্যাখেনি! তার দু’চোখ ঝাঁপিয়ে নেমে আসছে মানালীর প্রতি অপার ভালোবাসার নদী! মানালী বরুণের কাছে সরে এসে বলল, ‘এই যে বরুণ সেনাপতি!’
বরুণ অস্ফুটে বলে উঠল, ‘উঁ?’
‘আর কত দূরে ওরা আছে?’
বরুণ বলল, ‘ওই যে চোখের দৃষ্টি চিরে তাকাও, ওই সাদা বরফের চাতালটার পাশে দুটো কালো বিন্দু দেখতে পাচ্ছ!’
মানালী ভয় পেয়ে বরুণকে জাপটে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘ও দুটো কী?’
বরুণ যেন মজা পেয়েছে, এমন গলায় বলল, ‘দুটো ব্যথাতুর অতৃপ্ত হৃদয়।’
উদ্বেগ ফুটে উঠল মানালীর গলায়, ‘কী ও দুটো? বলো না! রসিকতা করছ কেন?’
বরুণ বলল, ‘দ্যাখো, ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো মানালী, বিন্দু দুটো নড়ে উঠছে একটু একটু করে।’
‘তুমি আর হেঁয়ালি কোরো না বরুণদা। প্লিজ!’
ততক্ষণে ওরা আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। বরুণ ওখান থেকেই গলা তুলে ডাক দিল, ‘নেত্রমণি! চন্দা!’
অমনি বিন্দু দুটো ছুটতে লাগল ওদের দিকে। কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নেত্রমণি আর চন্দা, ওদের উপর। তক্ষুনি মেঘলা মনের মতো একফালি মেঘ সরে গেল আকাশ থেকে। বরুণ অস্ফুটে বলে উঠল ‘নেত্রমণি, এই হল মানালী!’
নেত্রমণিকে জড়িয়ে ধরে মানালী বলল, ‘আমি তোমাকে সঙ্গে করে কলকাতা নিয়ে যাব বলে এসেছি দিদি! আর তোমাদের এখানে থাকা চলবে না! আমি ওখানে একটা সংসার বিছিয়ে দেব তোমার আর চন্দার জন্যে। আমার নিউ গড়িয়ার ফ্ল্যাটে।’
‘তুমি আর বরুণদা?’
খলখল করে হাসল মানালী, ‘তোমার বরুণদা থাকবে তোমাদের প্রহরী হয়ে, আকাশ আড়াল করে, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ থেকে।’
‘আর তুমি মানালীদি?’ নেত্রমণির গলা বুজে এল।
‘দুর, আমি তোমার বোন তো! দিদি হলাম কবে?’ বলে নেত্রমণির চোখে ভেসে আসা হিমানির জলস্রোত মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি মিলনের আকাশ ঢ়ুঁড়ে স্বপ্ন খুঁজে বেড়ানোর ইচ্ছেটাকে ছড়িয়ে রেখে যাব, লাদাখের সীমান্ত সমস্যার সমাধানের আগামী নবীন সৈনিকদের মনোবলের মাঝখানে মিলন দাঁড়িয়ে থাকুক। আমরা কলকাতা থেকে কখনও–সখনও ছুটে আসব মিলনকে দেখতে। মিলনের স্বপ্ন সত্যি হল কিনা দেখতে।’
শীতে এতক্ষণ চন্দা বরুণ আঙ্কলের জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল! বলে উঠল, ‘মানালী আন্টি, তুমি কোথায় যাবে? আমাদের সঙ্গে থাকবে না? চলো না আমরা একসঙ্গে থাকি!’
চন্দাকে আদরে জড়িয়ে ধরে মানালী বলল, ‘তোমার বরুণ আঙ্কলের মতো দু’একজন মানুষ এখনও পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান, তাঁরা ক্যামেরার শার্টারে আঙুল রেখে লেন্সে চোখ মেলে রঙে-রঙে ছবি আঁকেন। আমি তেমন একজন মানুষকে খুঁজতে বেরোব!’
কিছুক্ষণ নীরব চরাচরে কোনও মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও স্পন্দন পাওয়া গেল না। কে যেন ইঙ্গিতে বললেন, ‘যাও, এক্ষুনি একটা তুষারঝড়ের ভবিষ্যৎবাণী আছে! তোমরা ফিরে যাও!’
ওরা তড়িঘড়ি করে বরফের খাঁজের ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। চন্দা, নেত্রমণি, মানালী আর বরুণ! বরুণ বলল, ‘নেত্রমণি, তোমার সেই থুকপাটা রেঁধে খাওয়াবে না মানালীকে? আমি তোমার ঘরের দরজার কাছটা আড়াল করে বসে থাকি, সত্যিই যদি তুষারঝড় আসে?’
আমাকে আর একটা দিন মিলনের আচার মেনে চলতে হবে বরুণদা। আজ থুকপা থাক! বিরহী মিলন দোরজেকে ফিরে যেতে দাও তারা বিছানো আকাশপথে। চলো, আমরা সেই প্রার্থনা করি!’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন