জয়তী রায়
এক লাথ। আবার লাথ। ছিটকে পড়ে সোনার ঘট। ঠাকুরঘরে চকচক পাথরে জল থৈ থৈ। জলে ভাসে ফুল। বেলপাতা। দুববা। ক্রোধের আগুন- টকটক মুখে চেঁচায় ধনপতি —
মোর বাড়ি দেবীপূজা? কিসের দেবী হে চন্ডী? কে হে? সে না কি দুগ্গা? এই শেষ বার বলে দিলুম, মহাদেব ছাড়া কারো পূজা যদি করিস… তোর স্থান হবে জঙ্গলে।
পত্নী খুল্লনা ভয়ে থরথর। তাকায় স্বামী ধনপতি সদাগরের দিকে। কি বা রূপ! কি বা দাপট! সোনার বরণ শরীরে মসলিন বস্ত্র, অলংকার ঝলমল। হেই চওড়া বুকের পাটা, মসলিন ধুতির নীচে থেকে ইয়া গোছ রোমশ বলিষ্ঠ দুই পা। পুরুষ হবে এমন। ঐশ্বর্য আর ক্ষমতায় সকলের সেরা। খুল্লনা ভয়ে ভয়ে বলে —
এ কি করো সদাগর? দেবীর কোপে পড়লে পরিবারের সব্বনাশ।
পূজা করে তুষ্ট রাখতে হবে।
— ভয় দেখিয়ে পূজা আদায় — মাথা নত করবে লোভের সামনে, ভয়ের সামনে — ধনপতি সে বান্দা নয় কো!
খুল্লনা থরথর কেঁপে বলে — দৈব শক্তিরে ভয় পাই গো সওদাগর।
— তোরে ভাত দ্যায় কে?
— তুমি।
— গতরের সুখ দ্যায় কে? বল। কে দ্যায় গতর-সুখ?
— তুমি।
— আর ভজনা করো চণ্ডী? চ্যাঙমুড়ি কানির জননী — এই মেয়েমানুষের এত শখ দেবী হবে!
সওদাগরের সেরা সওদাগর চাঁদ বণিক পূজা না করলে ওই কালনাগিনী মনসা জাতে উঠত! আমি সেটাও করব না। বলে দিস তোর ঐ দেবীরে।
বেগে বেরিয়ে যায় ধনপতি। তাঁর অনেক কাজ। বণিক সমাজের মাথা চাঁদসদাগর, এখন আর বাণিজ্য যাত্রায় যেতে পারেন না। বাপ জয়পতি বণিকের দেওয়া নাম সার্থক করে ধনপতি হল ধনী।
কথা হল, দেশের ভিতর নদী – নালায় ঘুরে ঘুরে ক্রয় – বিক্রয় করে বৈদেহক– ছোট ব্যবসায়ী। কিন্তু পণ্যতরণী লয়ে বাণিজ্যে যায় যাঁরা, কড়ি, সোনা, রূপা অথবা বস্তু বিনিময় করে ধন আনে দেশ বিদেশ হতে। তাঁরা হলেন শ্রেষ্ঠী। এঁরা সমাজের মাথা। দেশের শাসন কার্যের ওঠা পড়া নির্ভর করে এঁদের অর্থ ভান্ডারের উপর। ধনপতি তেমন ক্ষমতাবান বটে। প্রাসাদের ন্যায় অট্টালিকায় বাস। দুটি পত্নী তাঁর। লহনা আর খুল্লনা। লহনা হাত ঘুরালে পরিপাটি রন্ধন। কি বা সোয়াদ। বঙ্গদেশের মানুষ, উদরপূর্তির সঙ্গে মনের ফুর্তি না হলে ভোজন কয় না তারে! তো, কি খায় সাধু ধনপতি!
বেসন দিয়ে চিতলমাছের কোল ভাজা, বড় বড় রুই মাছ ভাজা, আম দিয়ে কাতলা মাছ, হরিণ, পায়রা ভেড়া কচ্ছপের মাংস–রন্ধনশালায় লহনা দশ হাতে কাজ সামলায়। শাক পাতা, ঝোল তরকারি– তবে রান্নাটুকু করে। সামনে এসে ভাত বাড়ে না। পুরুষমানুষ! ভাত তরকারি চাই তেজালো ঝাঁঝাল মিষ্ট টকের মিশ্রণে, কিন্তু, ঘুরে ঘুরে যিনি পরিবেশন করবেন, তার রূপে হতে হবে যৌবন- জেল্লা, সুগোল হাত হতে হবে, কোমরের মটকা ঝটকা, আঁখির কটাক্ষ, ঘোমটার আড়ালে রস টুকটুক রাঙা ওষ্ঠ … তবে না খাবারের স্বোয়াদ বাড়বে? তাই রান্ধে শুখা শরীরের লহনা, সামনে ঘুরান দ্যায় খুল্লনা। খেতে খেতে পাছুতে চিমটি, গালে খিমচি… ধনপতি সুখের সাগরে ভাসে। এই জীবনে চণ্ডী কেন আসে? কেন খুল্লনা বলে– দেবীর কথা না শুনলে বিপদ হবে…!
বিপদ হতে ডরায় না বণিক। পূজা দখলের বাহানায় অত্যাচার করে যাঁরা, তেমন দেবতার পূজা মরে গেলেও করবে না ধনপতি।
হনহন করে বাইরে পা রাখা মাত্তর নফর খবর দ্যায় —
রাজার পাইক এলো গো মালিক। আপনাকে রাজদরবার যেতে হবে একবার।
ভিখমাঙ্গী রাজা। মনে মনে গজরায় সাধু — সিংহাসনে বসে আছে এদিকে কোষাগার বেবাক খালি। এদিক ওদিক হলেই হাত পাতে শ্রেষ্ঠীর কাছে।
কিন্তু এমন জরুরি তলব? মনটা কুটকুট করে ‐- এ তলব টাকার জন্য মনে হচ্ছে না — আজ রোদ্দুর শান দিচ্ছে, এমন ভর দুপুরে রাজার তলব — কর্কশ আওয়াজ করে কাক ডাকে, চাদ্দিক থমথম — ঝটকা মেরে চিন্তা সরায়, হাত উড়িয়ে ধনপতি আদেশ দেয় —
পাল্কি সাজা। রাজ দরবারে যাব।
শুনে অবিরত পুরাণ ভারত
উজানীর কথা/ গড় চারি ভিতা।
বিক্রমকেশরী তাঁহার নগরী /
তাঁহার আদেশে ধনপতি বৈসে সেথা।।
গঙ্গার তটে উজবেনির রাজা বিক্রমকেশরী, রাজার মত রাজা। যেমন তাঁর তেজ, তেমনি সদা হাস্যময়। সততায় য্যান যুধিষ্ঠির,পাণ্ডিত্য সমুদ্র সমান। দেখতেও ভারি সুন্দর। নরম নরম পেলব চেহারা। ধনপতি এসে দাঁড়ায়, খুশি মুখে রাজা বলেন — এসো হে বণিকশ্রেষ্ঠ। শিব শিব, মহাদেব, কুশল মঙ্গল তো?
ধনপতি উত্তর দেয় —
শিব শিব, কুশল মহারাজ।
রাজা হেসে কয় —
শোনো হে সাধু, দেশের সমৃদ্ধি বাড়ে বানিজ্যে। তাই তো তোমারে খাতির করি। গন্ধবণিক সমাজের তুমি মাথা। ধনপতি দত্ত। দেবাদিদেব মহাদেবের ভক্ত। সাগর নদীর ঢেউ ওঠে পড়ে য্যান তোমার আদেশে। জলের বুকে এমন প্রতাপ তোমার।
ধনপতি প্রমাদ গণে। রাজার কোষাগারে মাঝে মাঝে টান ধরে। তখন বণিকের কাছে ধার নেবে রাজা। এ হল দস্তুর। সে ভাষা আলাদা। কাজের ভাষার রকম অন্য, এ ভাষায় চাতুরীর গন্ধ– বিপদের গন্ধ।
মুখে বলে —
রাজার আদেশ বণিকের মাথায়। রাজা দেন মান, বণিক আনে অর্থ। আদেশ করুন মহারাজ! কোন দেশে যাব? কোন রত্ন আনব?
রাজা তাকান। বলেন —
যাবা বিদেশ।
— বিদেশ? এখনো তো যাই নাই।
— এইবার যাবা, তৈয়ারি শুরু করো।
পাড়ি দিবা সিংহল।
— সিংহল! স্বপ্নের দেশ। সেখানে যাওয়া তো সোজা কথা নয় রাজন।
— সোজা কাজ ধনপতি করবে কেন? চামর, চন্দন, শঙ্খ আর প্রবাল আনবা। লবঙ্গ আনবা। বদলের জিনিস নিয়া যাও যত্ত খুশি। তৈল, ঘৃত, মাষ, মুশুড়ি, তন্ডুল, মধু, গুবাক (সুপারি) জাহাজ ভরে নিয়া যাও। নিয়া যাও সেরা ধান। সে ধানের অন্ন পাক করে ভিনদেশী বুঝুক বঙ্গদেশের মাটি ক্যামন মিঠা। আর নাও গন্ধতেল- পরিবর্তে তরণী ভরে লইয়া আসো, ওদের পণ্য। পরস্পরের সন্দেশ দিও। হেই রাজা মোরে চিনুক। আমি চিনি উয়ারে।
ধনপতির মুখ গম্ভীর। খুল্লনার প্রেমে মজে আছে শরীর মন। যেতে ইচ্ছে করে না কোথাও। মনের মতন রমণী মেলে লাখে একটা, মিলে যদি, পুরুষের সুখ আর দেখে কে? এক শরীরে হাজার সাগর। এরপরেও কথা থাকে প্রয়োজনের। উজানী নগরীর সেরা ধনী, ধনের অভাব নাই। এই সেদিন এলো চম্পক নগরে বাণিজ্য সেরে। এখন আবার যাবে কেন? শোনে রাজা বলছে:
সওদাগরের সংসার হল নদী আর সাগর, ঘরে ক্যান থাকো মাগের অঞ্চলের নিচে? যাও সাধু, তৈয়ারী করো। উন্নত কর গৌড়ের মান। রাজার নাম।
ধনপতি বোঝে উপায় নাই। তাছাড়া জলের গন্ধে মাতন লাগে রক্তে। জলের সঙ্গে সঙ্গমের সুখের কথা ভাবলে চনমন করে শরীর, বিপত্তি যত বেশি মিলনে তত সুখ বেশি। সে মাথা নাড়ে… তাই হোক রাজা, পন্ডিত গণনা করুক। শুভদিন দেখি। রাজা উৎসাহে টগবগ করেন। সাগর পাড়ি দিলে মান বাড়বে বঙ্গ দেশের, বাণিজ্য বাড়বে। পাবনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, গৌড় মালদহ … আর নয়। এবার যাবে সাগরে। নিয়ে যাবে বাংলার সেরা মসলিন। আনবে হরেক কিসিমের বিদেশি জিনিস।
— ছোট ছোট ব্যাপারী সঙ্গে নে যাও। আর, সপ্তডিঙা। জলধিশত্রু আর ত্রিদেশযাত্রা…এমন জাহাজ সমুদ্রে ইন্দ্রের তুল্য সাথ দেবে। তোমার যেমন ইচ্ছা খরচ করো। কত কড়ি ( মুদ্রা) চাই তোমার কও? আমি রাজা বিক্রমকেশরী – সব দায় রাজার। সঙ্গে যাক, চতুর নিপুণ বলশালী নাইয়ার দল। গাবরদের দল নাও। বাজনদার। বাকি আর তোমায় কি বলি!
ধনপতি তাকিয়ে দেখে, রাজার মুখ প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল। সভায় বসে থাকা বাকি রাজপুরুষগুলার মুখ কালো। গোটা বঙ্গদেশ বণিকদের জয়জয়কার করে। মন্ত্রী অমাত্যর সহ্য হয় না। ধনপতি ভাবে, ষড়যন্ত্র চারিদিকে। একদিকে দৈবশক্তি অপরদিকে রাজশক্তি! মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তা সরিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। সোজা। স্বরে আত্মবিশ্বাস। বলে–
তবে যাই মহারাজ? শিব শিব।
— শিব শিব।
————–
মধুকর ডিঙা সবাকার আগুয়ান / পঞ্চপাত্র ধনে সাধু যে নায়ে দেওয়ান।।
__________
বাণিজ্যের দাপ -রাপ বাংলায় দেখার মত। সওদা করে কত কি! তরতর বইছে নদী। সরসর করে চলছে বিশাল বিশাল পণ্যতরণী। সে নাও কত রকমের। কত মজবুত- আর তাদের কর্ণধার যারা-সেই মাল্লারা বিশেষ অভিজ্ঞ। জলের রঙ, আকাশের রঙপরিবর্তন দেখে বলে দেবে তুফান আসবে, না, শান্ত থাকবে আকাশ? জলে ঢেউ বড় হবে না ছোট? বাংলা তখন নিয়ে যাচ্ছে মসলিন, ধান, পান সুপারি লবণ নারকেল, অশ্ব — আরো কত কি! চম্পাই নগরের চাঁদ সদাগর, কর্জনার নীলাম্বর, সাঁকোর শঙ্খ দত্ত, বর্ধমানের ধূম দত্ত, গণেশপুরের সনাতন চন্দ আর আমাদের সদাগর ধনপতি দত্ত… তাঁর স্থিতি অজয়ের তটে উজবনিতে।
রাজার আদেশ আর নিজের স্বপন, ধনপতি তৈয়ারী শুরু করে। ঘরের পাশে বইছে বন্ধু নদী ভ্রমরা। শান্ত ফুরফুরে ঘরের বৌটি যেমন। তার বুকের উপর দিয়ে আছড়ে পড়তে হবে উদ্দাম উত্তাল সাগরজলে। সোজা কথা! মনে মনে সাতবার কুর্নিশ ঠোকে, চাঁদ বণিকের পায়ে।
দেশের লোক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে — ও সাধু, এমন বিশাল ডিঙি তো কখনো দেখি নাই।
ধনপতি হাসে।
সাগরে যাবে বলে কথা! সে ডিঙ্গা কি আর যেমন তেমন? হতে হবে জাহাজের মত বৃহৎ। কি বা রূপ! কি বা ক্ষমতা! কি বা শক্তি! তব্বে? নদী আর সাগর! এক হয় কখনো? নদীর জলের পালোয়ান ডিঙ্গি সাগরজলে পড়লে মোচার খোলা হয়ে দাঁড়াবে!
তৈয়ারী হল — দাঁড় টানা পণ্যবাহী জাহাজ। কাঁঠাল, পিয়াল, তাল, শাল, গাম্ভরি, তেঁতুল, নিম –শক্ত শক্ত কাঠ। দুই প্রস্থ তক্তা মারা হল প্রথমে। তার উপর আরেক প্রস্থ কাঠের আচ্ছাদন। নিচে সারি দেওয়া মাল্লার ঘর। উপরে সোনায় মোড়া ঘর হল বণিকের। তার মধ্যে আছে বিলাসের হরেক উপকরণ।
প্রধান প্রধান নৌকার আছে চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ দাঁড়। সাগরের ঢেউ ভাঙবে অনায়াস। নৌঘাট থেকে বোঝাই হচ্ছে হরেক কিসিমের পণ্য। ধনপতি নজর উঁচু করে রাখে। তাঁর নৌকায় যাচ্ছে, মসলিন, রেশম, লবণ, লবঙ্গ, এলাচ, ধান, পান, সুপারি, নুন, নারকেল। পানের বদলে মরকত, নারকেলের বদলে মানিক্য। হাত ভরে স্বর্ণমুদ্রা। এমন না হলে আর সুখ কিসের! নৌবিতান হল জাহাজ তৈরির জায়গা, ধনপতি নিজে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেয়। সাধারণ কারিগর, মুখ্য কারিগরদের মুখে হাসি। জান প্রান এক করে কাজ করে।
সে এক দেখার মত বহর!
সবচেয়ে বড় ডিঙা মধুকর। গায়ে সোনার কাজ। ত্রিশূল আঁকা পতাকা। ডিঙা মকরমুখী। দৈর্ঘ্য প্রস্থে বিশাল। মধুকরের মাঝে আছে দুখানি ঘর। সোনার তৈরি ঘর। সোনার ঝালর, এই ঘর সাধু ধনপতি নিজে ব্যবহার করবে।
পরের ডিঙা দুর্গাবর। এটির আছে জলদেয়াল। গজদন্তের কাজ করা ডিঙিতে মা দুর্গার মুখ আঁকা।
তিন নম্বর ডিঙা, শঙ্খচূড়। দৈত্যাকৃতির ডিঙা।
চন্দ্রপাল ডিঙার রূপ দেখে মন ভরে যায়। আলো দিয়ে ঘেরা। পাল তুলে, আলো জ্বালিয়ে সে যখন যাত্রা করে, রূপ ফেটে পড়ে।
ছোটমুঠি ডিঙা, ধান, চাল নিয়ে যায়।
তারপর আছে, গুয়ারেখী ডিঙা। সিংহের মুখ। গুয়া নিয়া যায়।
শেষ ডিঙা খানির নাম নাটশালা। যতগুলি পারে জোয়ান নাবিক ওখানে ভরা আছে। রাস্তা ভর রঙ্গ করতে করতে যায়।
****
সাতখানা ডিঙা ভাসবে জলে।
কান্ডার সুদামা হল দেশের সেরা নাবিক। বয়স একটু বেশি। হলে হবে কি, জলের ভাষা বোঝে।
খুঁটিনাটি আগু পিছু যন্তর মন্তর তৈয়ার সব। এলোঝেলো কেবল ধনপতি নিজে। বড় বৌ লহনা কান্নাকাটি করে বটে, সেই সঙ্গে হিসাব দ্যায় উপহারের। গোল বাঁধে ছোটবৌ নিয়ে। তাঁর মুখে আষাঢ়ের আঁধার। চোখ ছল ছল। ধনা বলে —
এমন করিস ক্যান তুই? বণিকের বৌ। স্বামী জলে ভাসবে তবে তো সোনা দানায় ঘর ভরে যাবে।
খুল্লনা পায়ে পড়ে সাধুর —
ওগো। ছয়মাসের গর্ভ আমার। এদিকে তুমি যাও সাগরে। পরাণ ধুকপুক করে। একবার পেন্নাম ঠুকে যাও মাচণ্ডীর থানে। একবার?
ধনা বুঝিয়ে বলে —
আমি হলাম পুরুষ। এই দ্যাখ দুই হাত। এই দ্যাখ মগজ। দুনিয়া জয় করব আমি। দৈব নিয়া বাঁচে কাপুরুষ। কিছুতেই মাথা নত করব না আমি।
খুল্লনা আবার বলে — তুমি মানুষ হয়ে দেবীর সঙ্গে লড়াই করবে! বশ্যতা স্বীকার করে দেখো, তোমার কোনো বিপদ থাকবে না।
ধনপতি হেসে বলে — ওরে বৌ, যদি দেবী এত শক্তিমান তবে ভয় দেখায় কেন? আর আমি শিব ভক্ত। অন্য জায়গায় মাথা নিচু করব কেন?
দূর থেকে লুকিয়ে দেখে দেবী চণ্ডী। দাঁত কিড়মিড়, শরীর চিড়বিড় — এ -ত্ত বুকের পাটা! মানুষ হয়ে দৈবের সঙ্গে লড়াই করতে চায়? শেষ করে দিতে হবে, এমন জব্দ করতে হবে যে, বাপ বাপ করে তুষ্ট করতে বাধ্য হবে — ঘটে লাথি মেরে সাগর যাত্রায় যাচ্ছে ধনপতি, হিম্মৎ দেখে অবাক হতে হয় — হিম্মৎ টুকরো করে ভেঙ্গে না ফেলতে পারলে — দেবী হিসেবে কোনোদিন সম্মান করবে না কেউ!
দেবী মনসা আর চণ্ডী।
——————–
মন খারাপ দেবী দুজনার। চণ্ডী বলে —
চাঁদ ফুল ছুঁড়ল বাম হাতে। তবে গিয়ে শুরু হল তোর পুজো। ধনা দেহি আরো কঠিন। বণিক সমাজে ঢুকতেই দেবে না! কাদাভরা কাঁটা ঝোপ ভরা জঙ্গল। পোকা মাকড়। সাপ খোপ। গুঁড়ি গেগলি।
দুই দেবী লুকিয়ে বসে। সমাজে তাঁদের পুজো লুকিয়ে চুরিয়ে হয়। বাড়ির বৌ ঝি পূজা করে, তাও লুকিয়ে চুরিয়ে। সমাজের উঁচু তলায় তাঁদের এখনো সমাদর নাই। মনসা আপনমনে গজরায় —
সব জায়গায় পুরুষের প্রতাপ। দেবদেবীদের মধ্যেও দেখো, মহাদেবের পুজো হবে, আমাদের হবে না? কেন কেন? আমাদের কেউ পোঁছে না।
–তোর সবেতেই রাগ!
ফোঁস করে উঠে বলে মনসা — অধিকার কেউ দ্যায় না। আদায় করতে হয়। এমন ভয় পাইলে, জগতে আমাদের পুজা হবে না কোনোদিন। বাঙলার পুরুষ সমাজের মাথা হল বণিক। তারা যদি স্বীকৃতি না দেবে, তবে টাকাটা সিকেটা, ফল মূল প্রভাব প্রতিপত্তি কিছুই জুটবে না।
পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে চণ্ডী —
ধনার বিনাশ চাই। সে আমার ঘটে লাথ মারে। আবার পতাকা উড়ায় ডিঙা বায়। এই কথা জানলে কেউ মানবে আমাকে? মনসা শান্ত করে চণ্ডীর কান্না —
মা গো। শান্ত হও। মনে করো… চাঁদ বনিকের কথা! পাঁচকুলীনের এক কুলীন পুরুষসিংহ, বলেছিল, চ্যাঙমুড়ি কাণীর পুজো করবে না! ছানা সাপ তৈরি ছিল, হুকুম করলেই কটাস করে পিছন হতে কামড়ে দিত। চাঁদকে খতম করতে পারতাম অনায়াসে।
–ক্যান করলি না? ফুঁসে ওঠে চণ্ডী।
–চাঁদ মরলে লাভ কিছু ছিল না। তাঁর ঘাড় নীচু হ’ল তবে লোক বুঝল খ্যামতা কারে কয়!
উত্তেজিত মনসা দাঁড়িয়ে উঠে দুলতে থাকে জ্যান্ত নাগিনীর মত — ফোঁস ফোঁস করে বলে — ঘরে ঘরে আজ নাগপঞ্চমী পালন করে — দুধ দই মিষ্টান্ন অর্থ প্রতাপ ছড়াছড়ি। এর কারণ হল চান্দের আমারে পূজা করা।
চন্ডী মুখ বেঁকায় — হ! পূজা না ছাই! বাম হাতে ফুল ছোঁড়ে…।
— মা, রাগিও না বলছি, তবে একলা করো সব। আমি চললাম।
— ওরে না না, মনসা, তুই ছাড়া কে আছে! কুলীন দেবতার পুজোর মাঝে আমাদের জায়গা করতে হবে, এখন ঝগড়া করলে চলবে!
মনসা নরম হয়ে বলে — পুজো পেতে গেলে ধনপতি বিনা হবে না গো মা।
— বিটলে ধনা ধাতে আসবে কি করে?
— সওদাগর চলুক সিংহল, আমি ঠিক সময় ছেদ করে দেব নাও। অতল সাগরে ডুবে গেলে ধনা বাপ বাপ করে তোমার নাম করবে।
দুইদেবীর শলা অভিসন্ধি বিষ হয়ে জ্বলতে থাকে। ধক ধক করে লাল আঁখি। দাঁত বেরিয়ে পড়ে। জিভ শানাতে থাকে।
********
ধনপতি কুটিল অভিসন্ধি টের পায় না। তাঁর সাত সাতটি ডিঙা বোঝাই করে তুলছে কত না দ্রব্য। বাণিজ্যের দুইটি দিক। ক্রয়- বিক্রয়। বিক্রয়ের জন্য পেটিকা পূর্ণ করা হবে ধান্য, আখ, পান, নারিকেল, সুগন্ধি তৈল, রাশি রাশি রেশম মসলিন, গাঙ্গেয় কালো মুকুতা… আর যাবে পায়রা। কত রকমের পায়রা–থুড়িমারা, পাকশালিকা, গোলা, মকরজ। পায়রার পরিবর্তে ক্রয় হবে শুক পাখি, নারকেলের বিনিময়ে শাঁখ–নিমপাতা হলুদ দিয়ে লবঙ্গ, আদা- আম- আমলকি দিয়ে কর্পূর। সিন্দুরের দিয়া চামর আরো কত কী!
ঘরের নদী ভ্রমরা আজ কলকল করে হাসে। দুন্দুভি বীণা মৃদঙ ভেরি বাজে। লহনা-খুল্লনা সহ বাকি কূল বধূ গণ — কুলোর উপর দীপ জ্বালিয়ে সিঁদুর চন্দনের ফোঁটা দিয়ে নৌকা বরণ করে, জয় জয় কার গনেশঠাকুরের বিঘ্ন হরণ করার মানত করে, বাণিজ্য তরীর শুভ কামনা করে — ঝম ঝম মল বাজিয়ে মন খারাপ করে ঘরে ফেরে খুল্লনা। ভেঙে ফেলা চন্ডীরঘট আবার সাজিয়ে তোলে, আবার পুজো করে চোখের জলে, অবলা নারী, মনের জোর নেই, হাত জোড় করে স্বামীর হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে। জলের বিপদ থেকে রক্ষা করতে বলে আকুল হয়ে। দেবীর তাতে মন গলে না। দেবী শোনে আবার শোনে না। তাঁর মন এখন ধনপতির সাতটি নাওয়ের দিকে — ঘরের ছোটনদী ভ্রমরা পার হতে হতে তরতর করে চলতে চলতে ছুঁয়ে ফেলেছে ত্রিবেণী সঙ্গমের ঘাট।
——————————
নগরের নারী যেন বিদ্যাধরী
ভূষণে ভূষিত কায়।
যতেক পুরুষ মনোহর বেশ
পীরিত বসন্ত বায়।।
————————————-
ত্রিবেণী সঙ্গম শুদ্ধ পবিত্র স্রোত সঙ্গম। ধনপতির সপ্তডিঙ্গা নিথর। রাত গভীর। হেমন্তের হিম পড়ে জলে। সাধু করজোড়ে আরাধ্য দেবতা শিবকে ডাকে। শৈব সাধনা মহান। জলে জঙ্গলে গ্রামে শহরে শিবপূজা হবে। এবার সিংহল ঘুরে এলে আরো শক্তিশালী হবেন সাধু। আরো প্রচার করবেন মহাদেবের। স্ত্রী লিঙ্গ দেবতা ছাই দেবতা। তাঁকে পিঁড়ি পেতে বসতে দিলে রক্ষে আছে?
নদীর জল বাতাস সব আকুলি বিকুলি করে সাবধান করতে চায়, চারিদিক থেকে সাবধান বাণী ভেসে আসে — ঘুমাও সাধু ঘুমাও। কাল সকালে সপ্তগ্রাম। এখন এট্টু ঘুমাও। মানুষ ভাবে এক হতে পারে অন্য কিছু। নিয়তি কেউ দেখতে পায়না সাধু। এহন এট্টু শান্তিতে ঘুমাও।
সপ্তগ্রামে বাণিজ্যে আসে দূর দুরান্তের সদাগর। অঙ্গ, বঙ্গ, তেলঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট… নাও, ডিঙ্গি ,বরজ নিয়া আসে সব। সদাগর সদাগর কুশল বিনিময় হয়। ক্রয়-বিক্রয় হয়। রাত বাড়ে। রঙ্গিনী বন্দর-বেশ্যার দল কোমর নাচিয়ে ঢুকে পড়ে। মাল্লা থেকে মালিক –রেহাই নেই কারো। আনন্দে রাত কাটে। প্রবাহিত নদী স্রোত বেয়ে পরের দিন কেটে যায় আবেশে।
দেখে শুনে প্রধান মাঝি সুদামার রাগ হয়। এ কেমন কথা? জলের পথে লড়াই চলে বেশি। জল কখন মধুর কখন তিতা সে কথা বুঝা সোজা কথা নয়। ফুর্তি করে রাত দুপুরে যাত্রা শুরু করলে চলে? কে শোনে কার কথা! আমেজ ভাঙতেই চায় না। সুরার আমেজ। নারীর আমেজ। গড়িমসি করতে করতে মাঝরাতে দুলে উঠল সপ্তডিঙ্গা। মাঝি চোখে উপর হাত দিয়ে দেখে, সারা শরীরে তারা জড়িয়ে আকাশ ফিকফিক হাসে। যাক বাবা। জলের দিকে তাকায়। জল শীতল চাদর। যাক বাবা। জয় বাবা ভূতনাথ। জয় মহাদেব। দুলে উঠে এগুতে থাকে ডিঙা। মগরা বন্দর যাবে এবার।
******
যাব বললেই যাওয়া যায়?
জলের উপরে এক গল্প, জলতলের গপ্প আর এক। সেখানে পৌঁছে গেছেন দুই দেবী। তাঁদের কি বা প্রতাপ! কি বা ক্ষমতা! পদ্মা বলে —
আর দেরি নেই সর্বনাশের।
ফুলে ওঠে জল। পথ কোথায়? নদী আর নদী নাই। সে যেন কূল হারানো সাগর। গোঁ গোঁ শব্দ করে ছুটে আসে জল। জল নয় যেন লক্ষ ফনার সাপ। সেইসঙ্গে আকাশ ভেঙে জল। আকাশে জল, নদীতে জল — অবাক নাইয়া হাঁক পাড়ে সামাল সামাল। এমন হবার কথা না! মগরা শান্ত নদী। আর এখন? উদ্দাম জল ধাক্কা মারে ডিঙার শরীরে। ঝটকা খেতে খেতে সোজা হয় ডিঙা। আবার ঝটকা। আবার সোজা। সাধুর সপ্তডিঙ্গি তেজের সঙ্গে লড়াই করে। সেই সঙ্গে মাল্লাগণ। চোখে মুখে বেঁধে তীরের ফলার মত জলের ছাট। কড়কড় বাজ পড়ে। হেই হেই হে …ই ই ই…জলের আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যায় মাঝির গলা —
— মরি যাবা তবু লড়াই ছাড়বা না। সাধুর মান আমাদের মান। সাধুর জান আমাদের জান। মোরা মাল্লা বটে। মুষিক না। শিব শিব মহেশ মহেশ। জলের উপর ছেঁড়াকাগজের টুকরোর মত ভেসে যায় ঈশ্বর নাম। মধুকর ডিঙ্গির সামনে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে ধনপতি। এমন দুর্যোগ নতুন না জীবনে। এ অবস্থায় ভয় পেলে সে বণিক নামের যোগ্য নয়। তবু কোনটা প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর কোনটা অন্তর্ঘাত… ফারাক বোঝা যায়!
ধনপতি উচ্চস্বরে শিবের ভজন গায়। চোখ দিয়ে জল পড়ে শক্ত পুরুষের। নাও গুলান সন্তান সমান। মাল্লাদের জীবনের দায় তাঁর ছিল। এখন জবাব কি দেবেন তাদের পরিবারের কাছে?
কালো অন্ধকারে এক এক করে ডুবতে থাকে ডিঙ্গি। লড়তে লড়তে ডুবতে থাকে। পাঁচডিঙা ডুবতে থাকে। ফুটি ফুটি আলো তলিয়ে যায় কালো জলের অন্ধকারে। কিছু দূরে ঘূর্ণি পাকে পড়েছে দুর্গাবর। শিবো শিবো হে। হে এ এ এ এ এ এ শিবো—অ অ অ—! আর্তস্বরে ডেকে উঠে জলে ঝাঁপ দ্যান ধনপতি। জীবন বাঁচাতে পারলেন না যখন, নিজের বাঁচার অধিকার নাই তাঁর। পলকে ঝাঁপায় মাঝি। মগরা নদীর তোলপাড় জল থেকে উদ্ধার করে ধনপতির শরীর। দড়ি বেয়ে উঠে পড়ে দুর্গাবরের উপর। ভেসে যায় মধুকর ডিঙ্গা। ছয় ডিঙা মিলিয়ে যায় কোথায়? কে জানে?
সপ্তডিঙ্গার দুর্দশা দেখে খলখল হাসে দুই বোন। হাতে তালি। পায়ে লাচ। ওরে ধনা! দ্যাখ রে দ্যাখ। তোর শিবা বাঁচায় না রে। ওরে ধনা! শিব ছেড়ে চন্ডী ভজনা কর। আর যদি না ই ছাড়িস, দুই জনরেই পূজা কর! কিন্তুক, ঠেকা মাথা চরণে আমার। চন্ডী বলে–কি মনে হয় মনসা, এবার জব্দ হবে জিদ্দি পুরুষ?
মনসার ধুর্ত বুদ্ধি, সে বলে — চুপ করে শুনি কি কথা কয়, মাঝি আর মালিক!
প্রধান মাঝি বলে —
— কত্তা! লম্বা জীবন পার করলাম জলে জলে। এমন ঘটনা ঘটে নাই কভু। এর পিছনে দৈব আছে।
— থাকুক।
— ডর লাগে কত্তা।
— ডর কারে?
— একখান মোটে ডিঙা, তাই লয়ে সাগর পাড়ি? ডর লাগে! পিছে য্যান কার লাল লাল চক্ষু পাকায় পাকায় ধাওয়া করে।
— মা… ঝি …ই
হাঁক পাড়ে ধনপতি।
— শোনো হে, সব কিছুর মূলে ঐ দুই দেবীর চাতুরী। পূজা চাই ওদের। তব্বে ফিরা পাব,
স..অ..ব। না রে বাবা। না। ওই কায়দার মুখে লাথ।
একডিঙা লয়েই যাব সাগরে।
উঠে দাঁড়ায় ধনপতি। শরীর এখনো টলমল। মন অটল। আর কে না জানে? মন শক্ত হলে সাগর পাহাড় সব পার হতে পারে মানুষ।
দেবী চন্ডী ভয় পায়। মনসার হাত চেপে ধরেন —
— তোর আর কী অস্ত্র আছে রে? ধনা যে ঘুরে দাঁড়ায়! এ কেমন মানুষ রে, এত ক্ষয়-ক্ষতির পরেও ভয় খায় না। মনসা বিষ হাসি হাসে — ভাগ্য ভালো দুনিয়ায় এইরকম ঘুরে দাঁড়ানো মানুষগুলান সংখ্যায় কম। বেশি সংখ্যক দুবলা মনের। না হইলে আমাদের কেউ আর পাত্তা দিত না। যাক, চিন্তা নেই। সাগর আমার চাইতে বেশি কেউ জানেনা, এমন ভেল্কি দেখাব — এবার আর রক্ষা পাবে না!
চন্ডীর হতাশ লাগে — মানুষ অথচ দৈবের নাহি ভয়! বিপত্তি ঠেলে আবার এগিয়ে যায়। ভালো লাগে না কিছুই। দেবী তিতা গলায় বলেন —
মানুষ জাত সব পারে। ইচ্ছা করলেই দেবতা হতে পারে। দেখলি, ক্যামন ঝাঁপাইয়া পড়ল জলে? এরে তুই কি করবি? মনসা বিরক্ত হয়। কেবল ভ্যান ভ্যান ভ্যান ভ্যান। সে ঝাঁঝিয়ে ওঠে —
দেবী এমন কান্দে? দেবী ছিনাইয়া লয়। সাগরে একবার আসতে দাও। তারপর দেখো। জেগে উঠবে কমলে কামিনী। — কমলে কামিনী!
— তুমি রূপ বদলে রূপসী রমণী হবে। শোনো মা, রমণী অস্ত্র পুরুষের লাগি সবচেয়ে ভয়ানক অস্ত্র। দেখো, প্রয়োগ করে।
ধুর! চন্ডী ভাবেন — ধুর। ধনার জাহাজ সাগরে ঢোকে, মনসা ক্যাবল বড় বড় কথা! এখন আবার কমলে কামিনী রূপ ধরতে হবে!
রাগের চোটে মুখ ফিরিয়ে ভেংচি কাটেন তিনি।
******
কথায় বলে, সাগর না পেরোলে কেউ সদাগর হয় না। সাগর দেখে হতবাক সকলে। কূল নাই। কিনারা নাই। জল আর জল। এত জল! সব নোনা! দেখে দেখে চক্ষু সার্থক। সাধু উল্লসিত হয়ে বলে —
উজানিনগর থেকে সিংহল। ভ্রমরা থেকে সাগর। মানুষ পারে না, এমন কিচ্ছু নাই গো। এমন কিচ্ছু নাই। একলা দুর্গাবর নিয়েই যাব আমরা।
দেড়শ মাঝি মাল্লা আছে দুর্গাবরে। তারা আনন্দে কলকল করে। কিন্তু, প্রধান মাঝি সুদামা ভয় পাওয়া গলায় মাল্লাদের বলে — শোনো গো শোনো, আসে অমাবস্যার নিশি। মাঝে পড়বে কালীদহ। সে দহ সর্বনাশের। ভূত প্রেত নাগ নাগিনীর বাস। মনে করলেই বুক কাঁপে।
— তোমার বুক কাঁপে? তবে তো ভাবনার কথা।
— হ। বুক কাঁপে। তবে…
বলে, হাতের পাঞ্জা ঘুরায় সে — হাল যতক্ষণ ধরব, ততক্ষণ কারো জোরাজুরি খাটবে না।
— কলীদহ পার হইলে…
— হ। হ। ওইটা পার হইলে রত্নমালার ঘাট। ততক্ষণ খাও দাও। সাধুরে খাবার দাও।
***
কালো কুচকুচ রাত। কালো কুচকুচ জল। ডিঙা ঢোকে কলিয়াদহে। এখন তার চলন ধীর। শঙ্কিত। পার হতে হবে এই ভয়ংকর দহ। যার বর্ণ জমাট বাঁধা রক্তের মত কালো।
সামাল সামাল মাল্লার দল সামাল। কে জানে অপেক্ষা করছে সামনে কত্ত বড় আশঙ্কা! কে জানে?
মগরার দুর্ঘটনার পরে দুর্গাবর ধীরে ধীরে জল কাটতে থাকে। প্রাণ নাই তবু যেন অনুভবে বোঝে যেতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে। একে একে পার হয় নানান বন্দর। সামনে আছে কালিয়াদহ। একে অমাবস্যার নিশি তার উপরে কালিয়াদহ। কোনক্রমে পার হতে পারলে আর চিন্তা নাই। পৌঁছে যাবে লঙ্কাতীর। সিংহল।
কালিয়াদহ, নাম শুনলেই ডরায় মাঝি মাল্লাগণ। ওই স্থানে আছে জলের ঘুরণ। আছে ভয়ঙ্কর সাপের রাজ্য। কালিয় নাগ। লকলক আগুন শিখা ফনায়। জলের ঘুরণে একবার পড়ে গেলে, সোজা কালিয়র গর্ভে। মাঝি চেষ্টা করে — পাকা হাতে হাল ধরে থাকবে, সাবধানে গুটি গুটি জল কাটবে… হঠাৎ কখন ঘুর্ণি এসে টেনে নিয়ে যাবে অতল তল, টের পাবে না কেউ। জল আবার যে কে সেই। শান্ত। অভিজ্ঞ মাল্লা জানে, এই স্থান কু -স্থান। ভূত পিশাচ ঘুরে বেড়ায়। মরা মানুষের কান্না ঢেউ তুলে তুলে এগিয়ে আসে। যা দেখবার নয় তাই দেখতে হয়… যা শুনতে চায় না তাই শুনতে হয়… কখনো দেখে ডুবছে নাও… কখনো দেখে রূপসী রমণী ভাসে জলের উপর…কখনো আলো জ্বলে ওঠে জলের উপর… ভুল ভুলাইয়া রোগে ধরে… বেভুল বণিক মরণ স্বীকার করে সুখে থাকে… আর যদি বেঁচে ফেরে তবু তাঁর মাথা জুড়ে মন জুড়ে থই থই করে উতল জলের ঢেউ। সে আর পরিবার চেনেনা, বাসস্থান চেনে না… কেবল খোঁজে। কি খোঁজে কেউ বোঝে না।
সুদামা চতুর মাল্লা। আগে কখনো আসে নাই দহে। নাই আসুক। কাহিনী শুনে শুনে চুল সাদা এমনি এমনি হয় নাই। সাধু ধনপতির বাপ জয়পতির কাছে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে অনেক কিছু, মনিব হলেও ধনা বণিক তার কোলের বাছাটির মতন। তাঁকে রক্ষা করার দায় থেকে সুদামা জানে, রাতের কালে এই দহে যা কিছু দেখা যাক শোনা যাক… চক্ষু বুজে থাকতে হয়। কানে হাত চাপা দিয়ে ইষ্টনাম জপ করতে হয়। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হয়। ভুল ভুলাইয়া অপশক্তি শুধু তারেই দেখা দেয়, যারে চায়। তার সঙ্গেই রঙ্গ করে। তার মন ভুলায়। বাকি লোক কিছুই দেখবে না, শুনবে না। সুদামা তাই হুঁশিয়ার থাকে। সাধু যেন কিছুতেই বাহির না দেখে! কাণ্ডার সে, নৌকার শুধু নয় — জীবনেরও বটে।
*****
রাত্রি দ্বিপ্রহর। দুর্গাবরের উপর ঘরে অঘোর ঘুমে কাতর সাধু। নীচের তলায় মাল্লাগণ, আধো ঘুম আধো জাগরণ। হঠাৎ চমকে জেগে ওঠে ধনপতি। ডিঙিতে দুলুনি আছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস আসে। ঘুম সে কারণে ভাঙ্গে নাই। কোথা থেকে আসে ফুলের তীব্র সুবাস? এমন সুগন্ধ! আহা! বড় করে শ্বাস নেয় ধনপতি। মন হুহু করে। চোখ ফেটে জল আসে। মায়া ভরা সুগন্ধের উৎস কোথায়?
দুয়ার খুলে বাইরে আসে সাধু। চোখ দুটি এখনো য্যান বোজা বোজা। ওমা! আজ না কি অমাবস্যা? ঘোর আঁধার হবার কথা। অথচ কত্ত আলো আকাশ জুড়ে। জলের উপর চাঁদের আলো গলে গলে পড়ে। কত শত পদ্ম ফুটে আছে। চোখের সামনে ফুল আর ফুল। সুগন্ধে ভরপুর। কত শত পাখি গান গায়। জোছনা মাখা জলের উপর ভেসে বেড়ায় সোনার পদ্ম। তার উপরে বসে এক সুন্দরী রমণী। এক হাতে হাতি ধরে গেলে পরক্ষণেই উগরে দেয়! মরি মরি কি বা রূপ! হাসি হাসি মুখে তাকায়। যেন ডাকে আয় আয় কাছে আয়। এ ডাক ফেরাবে এমন পুরুষ নাই দুনিয়ায়। সাধুর দৃষ্টি সরে না। সাধুর শরীর নেশায় টলমল। সাধু কামিনী চায়। দুই হাত সামনে, সাধু ঝাঁপ দিতে চায় সাগরের জলে।
— করো কি। করো কি? যাও কই?
পিছন হতে আটকে ধরে সুদামা, আকুল কণ্ঠে বলে —
কেউ কিচ্ছু দেখে না। শুধু আপনে দেখেন। হায় হায়! বোঝেন না। এ মায়া। আস সাধু ঘরে আস।
বণিকের হাত ধরে টানে সুদামা —
ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে চলো। এগুলা নিশিবিকার। চলো সাধু ঘরে চলো।
চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে বৃদ্ধ মাঝির। তাঁর দায়িত্ব অনেক। এখন ধনপতি সঙ্গে করে ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেলে হয় সিংহলের ঘাট। মাঝি যত ডাকে সাধু তত দেখে সুন্দরী কামিনী। চোখ ফেরায় এমন ক্ষমতা নাই। বণিক ভুলে যায় শিব নাম। শত প্রলয় ঝড় হেলায় উড়ায়ে দেয় যে ধনপতি, সে এখন কামিনীর কাম ঝড়ে কাবু হয়ে পড়ে।
হায়! হায়! মাঝির চোখে ঘুম নাই। ধনপতি তাঁর মনিব। তার চাইতেও বেশি কাছের মানুষ। আপনজন। সন্তানসম। শ্বাস ফেলে ভাবে, একটাই আশার কথা, বাতাস অনুকূল। ভোর হবার মুখে পৌঁছে যেতে পারবে গন্তব্য বন্দরে।
ডিঙা চলে পাল তুলে। দুর্গাবর ডিঙা ক্লান্ত। আর টানতে পারে না। কোনোমতে ছুঁতে চায় ডাঙ্গা। কোনোমতে শরীর টানে সে। তরঙ্গে তরঙ্গে খেলা করে নানা রঙ। দিনমনি ওঠে ডোবে। কূল নাই। কিনারা নাই। নোনা জলের রাশি। দূর হতে দেখা যায় সবুজ রেখা। সত্য না মরীচিকা? ভালো করে দেখে সকলে — তাই তো! সবুজ রেখা ক্রমে চোখের নাগাল! নাইয়া চেঁচায় — ওরে, ডাঙ্গা ডাঙ্গা। পাল নামাও ধীরে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সকলে — যাক, রত্নমালার ঘাট এলো তবে? এলো তবে মাটি? এলো তবে মানুষের গলার শব্দ। জীবনের পারস্পরিক চেনা ছন্দ?
ধনপতি বাহিরে আসেন আপন ঘর হতে। উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নজর পড়ে সামনে স্থলভূমির দিকে। পিছনে পড়ে রয় ছোট ছোট তরঙ্গমালা শোভিত অকূল সাগর। ধনপতি শূন্য চোখে দ্যাখেন স্বপ্নের সিংহল! বাংলার তাবৎ বণিককুল এ যাবৎ এই স্বপ্ন লালন করেছে বুকে। সাগর পাড়ি। তবু, ধূ ধূ করে বুকের মাঝার, ভালো লাগে না, কিছুই ভালো লাগে না।
দুর্গাবরের নীচের তলায় হই হই রই রই। কে হেঁকে বলে
— উপরতলায় যা।
— কত্তা ঘুমায়।
— তবু যা। খাড়াইয়া থাক। ওনার আজ আনন্দের দিন বটে।
— বটে। বটে। বটেই তো।
আনন্দের কলরোল ছুঁতে পারে না ধনপতি। তাঁর মন জুড়ে বিষাদ। মনে পড়ে কার মুখ! কাল রাতে হিমের আঁধারে দেখা দিল কমলে কামিনী! কুসুমে কমলে আলোতে হাসিতে ঝলমল রূপ। সেই সঙ্গে চুম্বক রহস্য টান দেয় মনের গভীরে। এখন বয়স চব্বিশ হল ধনপতির। বহু নারী সঙ্গ হল। রতিক্রীড়া বহুবার। আজ কেন চিত্তে জন্ম লয় নতুন বোধের। ঐ নারী ডাকে তাকে। হাতছানি দ্যায়। সাগরের জলে জলে ভেসে আসে ডাক তাঁর। সব কাজ, সব চিন্তা, সব আকাঙ্খা, যশ অপযশ — তুচ্ছ মনে হয়। শূন্য মনে হয়। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কালিদহে।
শঙ্কিত সুদামা ধাক্কা মারে —
ওঠেন। জাগেন। হইল কি আপনের? আমরা সিংহল দ্বীপে। অনেক কাজ। জাগেন আপনি।
— সুদামা…
— কথা না কত্তা। বোঝেন না? সব মায়া। মায়া সত্য না। আমরা কেউ দেখলাম না। শুধু আপনি দেখলেন? এমন হয় না কি? ওঠেন। বিদেশ এইডা। ভাষা আলাদা। মানুষ আলাদা। আইন আলাদা। জাগেন। আপনি দ্যাশের গৌরব। আপনের শোভা দ্যায়না এমন ভাব!
ধনপতি শ্বাস ফেলেন।
— সব মায়া! তবে এখনও যে ডাক ভেসে আসে।
— কত্তা!
হাহাকার করে সুদামা — ঘরে মা লক্ষ্মী পথ চেয়ে আছে রাজামশাই কত আশা নিয়া আছে… আপনে ছাড়েন রমণী মোহ। চলেন।
বিষন্ন কণ্ঠে ধনপতি বলে — চলো। তৈরি হই। যাই সিংহল রাজ দরবার।
*****
ধনপতি আবার ছন্দে ফেরে। জোর করে মাটি চাপা দ্যায় ভালোবাসার কুঁড়ির উপর। পুরুষ সে। কর্ম তাঁর ধর্ম। হাঁক পাড়ে —
চলো হে। তৈয়ার করো হে। বাংলার সেরা সেরা সম্ভার। চলো হে।
সাজ সাজ রব ডিঙা জুড়ে। সেজে ওঠে দুর্গাবর। ঝকঝক তকতক করে সে। ডিঙ্গির গর্ভগৃহে মজুত সম্ভার। অশ্ব আছে। আছে দুগ্ধবতী গাভী। ধান, মধু, পান, নারিকেল, মণি, মুক্তা, তৈল ও ঘৃত নিয়ে প্রায় একশত পঞ্চাশ ভেট তৈয়ার হয়।
সিংহল রাজপথ দিয়ে চলে শোভা বঙ্গদেশের। বড় বড় চোখে দেখে লঙ্কাদ্বীপের নাগরিক। সে শোভাযাত্রায় রঙ্গীন পুষ্প, সুন্দর সঙ্গীত, সুমনোহর সাজ।
এরা কোথাকার লোক? অবাক প্রশ্ন ভেসে আসে।
গর্জন ওঠে মিছিল থেকে —
জয় গৌড়ের জয়। জয় রাজা বিক্রম কেশরীর জয়। জয় ধনপতি সওদাগরের জয়।।
জয়। জয়। জয়।
শত শত অবাক চোখের সামনে দিয়ে এগিয়ে চলে ধনপতি। মুখে গর্ব। বুকে বিশ্বাস। শিরে সফলতার মুকুট।
দিনের সূর্য ঝলক দিয়ে ওঠে। কোনদিকে কোনো ত্রুটি নাই। কেবল… কারা যেন ছায়ার মত পিছু হাঁটে। কারা যেন অভিশাপ দ্যায়। কারা যেন অমঙ্গল চায়! স্বপ্ন যখন হাতের মুঠোয়, কে ওই ছিনিয়ে নিতে চায় তাকে? কে ঠেলে দিতে চায় অপমানের কাঠগড়ায়? কে?
শোভা যাত্রার পিছন পিছন যেতে যেতে পদ্মা মুচকি হেসে বলে — মা চন্ডী গেলে কোথায়? রাবণ রাজার দেশে এসে হারিয়ে গেলে না কি?
পদ্মার ফিকফিক হাসি দেখে, গা জ্বলে যায় চন্ডীদেবীর। শোভাযাত্রায় এতক্ষণ কায়া লুকিয়ে ছায়া হয়ে ছিলেন। এবার স্ব মূর্তি ধরে বলেন — তোর রকম দেখে অবাক হই। সাপ খোপের দেবীর বুদ্ধি ওমনি গোল পাকানো। সমুদ্দুর জয় করে, দেশ জুড়ে জয় জয়কার শুনতে শুনতে ধনা পৌঁছে গেল রাজার বাড়ি। আর বাকি রইল কি?
পদ্মা শরীর বেঁকিয়ে তাকায়। তাঁকে সাপ খোপের দেবী বলা হচ্ছে? নিজে তবে কি? ফোঁস করে উঠে বলে — নেহাৎ আপনজন। না হলে দিতাম এক ছোবল। এই জন্য কারো ভালো করতে নেই! ক্ষমতা জানা আছে তোমার। ফু:। একটা মানুষ সিধা করতে পারো না, আবার বড় বড় কথা!
চন্ডীর মাথা এমনিতেই গরম থাকে। সাপের মত শীতল রক্ত তাঁর নয়। তিনি ত্রিশূল বার করে তেড়ে আসেন — তবে রে! তোর অহঙ্কার ঘুচিয়ে দেব আজ।
পদ্মা হলাহল জিভ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে — এই একলা হাতে চাঁদ জব্দ করেছিলাম। তুমি পারো? স্বীকার করো বলছি। না হলে চললাম আমি।
চন্ডী ঢোঁক গিলে হজম করে অপমান। তিনি একলা কিছুই পারবেন না। কূটবুদ্ধি কৌশলী ঘুঁটি ফেলতে পদ্মার মত কেউ পারবে না। কাতর স্বরে বলেন —
কমলে কামিনী রূপ দেখালাম বটে। তবে, সে কাজের ফল কিছু হল?
— টের পাবে পরে। এখন ইট্টু অপেক্ষা করো। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসছে কেউ।
— কে কে?
— চুপ করে বসবে? অপমানের শোধ কি করে নিই, দেকো একবার!
চন্ডী চুপ করে যায়। পদ্মাবতীর সঙ্গে তর্ক না করাই ভালো। যা খুশি করুক। তাঁর কাজ হলেই হল। পুজো না পেলে বন্ধ হবে ব্যবসা। কাজেই ভরসা করে চলাই ভালো।
দুজনের গোপন কুঠুরিতে কে যেন আসে। পায়ের শব্দ শোনা যায়। পদ্মা বলে — মা। ছায়া হয়ে যাও। রূপ দেখিও না। আর কথা কইবে না একটিও।
কুঠুরী দিনের বেলাতেও ঘোর অন্ধকার। একটি মাত্তর দীপ জ্বলে। শিখা কাঁপে দেওয়ালের গায়। পাথরের গোল মেঝের উপর মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ায় প্রধান মাঝি। চন্ডী একেবারে থ। বুঢ়া মাঝি! ধনার প্রাণ। ধনার মান। সে একেনে? ওরে বাবা। গড় করি রে পদ্মাবতী। গড় করি। সাধে তরে মান দেয়, বঙ্গের লোক? চণ্ডী ত্রিশূল নাচায় আমোদে। বুঢ়া মাঝি লাফ মারে তরাসে। ঘরে কেউ নাই। অথচ ত্রিশূল ছায়া নাচে? কূট চাল বোঝে না, সরল নাইয়া। সে ভাবে দৈব মায়া। সে কাতর কণ্ঠে বলে —
মা গো। আমাকে বাঁচাও মা।
খলখল হাসি বাজে অন্ধকারে। তীক্ষ্ম খোনা সুরে পদ্মা বলে–
বাড়িতে ছেলে বৌমা নাতি নাতনি নিয়ে ভর ভরন্ত সংসার তোমার। তাই না?
— হ।
— তিনটা সর্প ছানা পাঠায় দি? নাতনি ডাগর ডগোর। তারে বিপাকে ফেলুক? কি বলো গো কান্ডার?
— ক্যান মা ক্যান? আমার অপরাধ কি মা?
— অপরাধ!
গর্জে ওঠে পদ্মা। কুঠুরী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিষের হল্কা। নীল বিদ্যুৎ পুড়িয়ে দিতে থাকে সুদামার অঙ্গ, চিৎকার করে ভয়ে। পদ্মা হিসহিস করে বলে — ধনার সাথ দাও। এত বড় সাহস! যারে আমরা মারি, তুমি তার সঙ্গে থাকো?
— মা। নুন খাই তাঁর। বিশ্বাস করে আমারে…!
— স্পষ্ট কথা বলো কান্ডার! একদিকে পরিবার। তোমার সুখ শান্তি। নিরাপত্তা। অপরদিকে ধনপতি। একদিকে স্বার্থ অপরদিকে ভাবালুতা। একদিকে তুমি অপরদিকে দেশ। বেছে নাও।
— মা গো…!
— ধনা পৌঁছে গেছে রাজসভায়। তুমিও যাও। মনে রাখবা, ধনার বিপরীত উত্তর দিতে হবে তোমায়, নইলে… নজর থাকবে তোমার উপর।
সিংহল দেশের রাজদরবার।
চারিদিক ঝলমল সোনার ঝালর, চারিদিক মণি মুক্তা হীরা, চারিদিক শতশত পুষ্প। ইন্দ্রপুরী তুল্য রাজসভা। বাজনদার সহ ধনপতি রাজসমীপে উপস্থিত হয়ে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করে বললে —
হে সিংহলরাজ! মহামহিম শালবন। আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
— শ্রেষ্ঠী ধনপতি। সুস্বাগতম। গৌড়বঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক বহুদিনের। বাণিজ্যে তোমাদের কৃতিত্ব পৃথিবী বিখ্যাত।
— আশাকরি এবারেও আপনি নিরাশ হবেন না।
রাজা মধুর হেসে উত্তর দ্যান —
কাজের কথা হবে পরে। তুমি আমার ধন নেবে। আমি তোমার ধন নেব। কোনো কিছু বাকি রবে না সাধু। তার আগে শুনি কেমন ছিল তোমার সাগরযাত্রা। সব কুশল মঙ্গল ছিল তো?
ধনপতি থমকে গেল। কুশল মঙ্গল! চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত কি! সপ্তডিঙ্গা আর সহস্র নাইয়ার আর্ত চিৎকার!
ওহহহহ! আহ্হ্হ্! বুকের ভিতর মুচড়ে ওঠে সাধুর। মুখের ভাবটি সুন্দর রেখে উত্তর দেয় ধনপতি —
রাজা। সাগর যাত্রা বলে কথা। বিঘ্ন বিপদ মাথায় করে চলতে হবে, সে কথা জানতাম। কিন্তু…!
— কিন্তু?
রাজা উদগ্রীব — বলো শুনি। আমাদের এমন ভাগ্য কোথায়? বণিক মুখে শুনি অভিজ্ঞতা!
সভাসদ সকলে বলে — শুনি শুনি। বলো হে শ্রেষ্ঠী। স্থলের জীব মোরা। জলের কাহিনী শুনি এট্টু।
ধনপতির উজ্জ্বল মুখে মেঘের ছায়া। মনে মনে উচ্চারণ করে — শিব শিব। ডান চক্ষু কেঁপে উঠে। কর্কশ শব্দে ডেকে ওঠে কাক। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে প্রধান মাঝি সুদামা কোথাও নাই! নফর এগিয়ে এসে কানে কানে বলে —
প্রভু। কান্ডার এলো বলে। এট্টু কাজে গ্যাছে।
ধনপতির ভুরু বাঁকা। বিদেশে কাজ মাঝির? অবাক লাগে শুনে!
রাজা আবার বলে — বলো বলো শ্রেষ্ঠী। অপেক্ষায় আছি।
ধনপতি শুরু করে কাহিনী। সাগরের আছে যেমন নানা রঙ, নানা রূপ। এ কাহিনীর পরতে পরতে তেমনি কত ঘটনা! কত আনন্দ! কত বিষাদ। বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ভোজনের সময় হল। রাজা বলেন—
সাধু হে। চোখের সামনে য্যান দেখলাম সব। ঘটনা এখানেই শেষ?
ততক্ষণে এসে গেছে প্রধান মাঝি। মাঝির চক্ষু স্থির। রক্তশূন্য চেহারা। কেউ যেন মন্ত্র পড়ে রেখেছে। মাঝি কিছু দেখে না। কিছু শোনে না। একধারে চুপ করে বসে। যেন, বাজ পড়া তালগাছ!
রাজার প্রশ্নে যুবক ধনপতির মনে পড়ে তাঁর মুখ। সে-ই রূপবতী কন্যা। সে-ই অলৌকিক রাত।
ভোজন শেষে হাতে হাতে স্বর্ণ পেয়ালায় পরিবেশিত হয় উৎকৃষ্ট সুরা। বিশাল সভাগৃহে বসে আছেন কত শত পাত্র মহাপাত্র। রাজা বলেন —
আরো কি কথা য্যান আছে। কও দেখি এইবার।
কারা যেন বারণ করে —
না। না। না। ধনপতি। কইও না। কইও না। যে দৃশ্য শুধু তুমি দেখো, সে হল ইন্দ্রজাল। তুমি ছিলে সম্মোহিত। কইও না গো। তরণী ভরে দ্রব্য লয়ে ফিরে যাও ঘরে। অ ধনপতি, মুখ বন্ধ রাখো।
কোনো কথা কানে যায় না। আবার সম্মোহিত ধনপতি। জেগে ওঠে সুপ্ত কামনা।
স্বপ্ন চোখ। আকুল ভাব। সাধু বলে চলে —
মধ্যনিশায় দেখলাম অপরূপ কামিনী। শত সহস্র শতদল আচ্ছাদিত সিন্ধুবারি। চাঁদমুখ চান্দের তলে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোলে দোলে। তাঁর চোখদুটি আমারে দেখে। আমারেই দেখে। সুবিস্তৃত কমলে বসে আছে নারী। পরিপক্ক সুমিষ্ট ফল য্যান। ধনপতি বলে। দুপুর গড়িয়ে যায়। নাইয়ার দল শোনে। একজন বলে —
সাধু কি কয়? ডর লাগে। গদ্দান না যায়। সুদামা কান্ডার, তুমি এত ঝিমাও ক্যান?
মাঝি চমকে ওঠে।
ঝিমাই? কই না তো!
— এত্ত খাবার। তুমি তো খেলে না কিছুই।
মাঝি এদিক ওদিক চায়। তার সঙ্গে ঘটে গেছে অঘটন, সে কথা বলা যাবে না। ধনপতি এগিয়ে চলেছে সর্বনাশের দিকে, তবু সুদামা চুপ করে থাকে।
এদিকে সভা জুড়ে ওঠে হাসির হল্লা — হাহাহা। মধ্যনিশিতে কুমারী কন্যা? হাহাহা।
সভায় লোক যত হাসে, সোনার সিংহাসনে আসীন রাজার মুখ গম্ভীর হয়, তীব্র রাগ, সম্মুখে দাঁড়িয়ে বঙ্গের কুল তিলক ধনপতি… প্রলাপ বকছে না কি! রাজা বলে — থামো হে বণিক। প্রলাপ থামাও।
কথা কানে যায় না, টানা টানা চোখ দুটি কোন সুদূরের দিকে দেখে ধনপতি বলে যায় —
হে রাজা। অঙ্গনাটি একটি গজ একবার মুখে ঢুকায়, আবার উগরে পরক্ষণে।
হাহাহাহা — সভা ফেটে পড়ে হাসিতে। মুহূর্ত আগে যে ছিল মাথার মণি, সে ধনপতি এখন সম্বোধিত নানা রকম বিশেষণে। তার কোনোটিই বিশেষ সম্মানের নয়। এক পাত্র বলে —
সুন্দরী বালা তোমাকে চুম্বন করে নি?
— হো হো হো। সাধু ধনপতি। তুমি যুবক। তার উপর সুদর্শন। কাম চড়ে গেছিল মস্তকে।
— মত্ত গজ আর মত্ত সাধু
— হিহিহি।
অপমানে নাইয়ার দলের রক্ত গরম। চক্ষু পাকায়। তাদের অন্নদাতার অপমান। তারা সকলে তাকায় সুদামার দিকে। সুদামার চোখ নিচের দিকে। সন্তানসম মনিবের অপমান সে চুপ করে শোনে। হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন?
সিংহলরাজ গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করেন —
— এই সভায় উন্মাদের স্থান নেই। বঙ্গদেশের কলঙ্ক। সিংহল দ্বীপের নামে এমনতর অপবাদ দিও না। সাবধান। তোমার এই একটি কথায় বন্ধ হতে পারে বৈদেশিক বাণিজ্য। ভীত বণিক আসতে চাইবে না, রতনমালার বন্দরে।
হেঁকে ওঠে রক্ষীদল —
এমন নির্বোধ বণিক। এঁকে ধাক্কা দিয়া বিদায় করা হোক।
— এইয়ো।
চিৎকার করে ওঠে মাল্লার দল — হুকুম দাও প্রভু। জান দেব তবু মান দেব না।
রাজা বলে — ধনপতি। তুমি বিদায় হও। তোমার সমস্ত দ্রব্য ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
হাত তুলে উঠে দাঁড়ায় সওদাগর। শান্ত গলায় বলে–
আমি যদি দেখাতে পারি?
— অদ্ভুত কথা বলো না।
রাগে কাঁপতে থাকেন রাজা —
আমার সাগর। আমার ঘাট। পূর্বপুরুষের আমল থেকে সাগর ঘিরে আছি। এমন কথা কেউ শোনে নি। দেখা তো দূরের কথা। তুমি কে হে?
— আমি দেখাব। যদি না পারি, এই রইল পণ। আমার সমস্ত ধন আপনার। আমার জীবন আপনার। যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।
সভা স্তব্ধ। এতবড় কথা! সকলে তাকায় সাধুর মুখের দিকে। সে মুখে আছে আত্মবিশ্বাস। আত্মপ্রত্যয়। অহঙ্কার। সাধু মাথা উঁচু করে বলে —
কয়েদ থাকব এই দেশে। দ্বাদশ বৎসর। এই রাখলাম পণ।
সত্যবচনের দীপ্ত আলো সংশয়ীর বুকের ভিতরের অবিশ্বাসী অন্ধকার নাড়িয়ে দ্যায়। মুহূর্তে আপন করে নিতে ইচ্ছে করে ভয়নক অবাস্তব। কোমল হতে হতে সামলে নেন সিংহল নৃপতি। সামনে দাঁড়ান ঐ পরদেশী যুবক থেকে দেশের সমূহ বিপদ হতে পারে। যদি এমন কিছু ঘটে… এমন অশুভ কিছু… যদি সত্য হয়… তবে সমস্যা হবে প্রবল। রাজসভায় আছে কিছু বিরোধীপক্ষ। তারা চায় নিপাত যাক রাজা শালবান। এই সুযোগ নেবে তারা অবশ্যই।
চুপ করানো দরকার ধনপতিকে। এখুনি। চোখে চোখে কথা হয় প্রধান অমাত্যের সঙ্গে। সে এগিয়ে এসে বলে —
সেদিন ছিল অমাবস্যা। সুরাপান করেছিলেন হয়ত? বায়ু জন্মেছিল উদরে? গভীরে গিয়ে ভাবো বণিক, ভুল হচ্ছে তোমার। শেষের দিকে কঠিন শোনায় আমাত্যের গলার স্বর। কোমরের তরোয়ালে হাত। ধনপতি হাসে —
তোমরা রাজশক্তি। ক্ষমতাবান। আমি নিরস্ত্র ব্যবসায়ী। তবে হত্যা করলেও সত্য বিচ্যুত হব না। ঐ নারী হরণ করেছে আমার হৃদয়। মনে আছে ছবির মতন।
— আজ নিশীথে যাব সকলে। যদি দেখতে না পাই…!
কথা শেষ করেন না রাজা। কাঁটা খচ খচ তাঁর বুকের ভিতর। যদি দেখা যায় কমলেকামিনী? যদি অপপ্রচার ছড়িয়ে যায় দিকে দিকে? ধনপতি নামী শ্রেষ্ঠী। তাঁর কথার গুরুত্ব দেবে বইকি বণিক সমাজ।
সভা গৃহে ছায়া হয়ে নেচে বেড়ায় দুই দেবী। দেখি এবার কে বাঁচায় তোকে ধনা?
নিশি গভীরে রাজপুরী জুড়ে সাজো সাজো রব। বিদেশী বণিক জাদু দেখাবে, পাতাল থেকে উঠে আসবে সুন্দরী রমণী… এমন বস্তু দেখার সুযোগ হারাতে কেউ রাজি নয়। রানীর দল, রাজমাতা, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, আত্মীয় স্বজন মিলে উৎসবের চেহারা নিয়েছে। শত শত দীপ ফুল পল্লব সাজ পোশাক রথ হাতি… হই হই রই রই… যাত্রা শুরু হল কালিয়াদহের দিকে।
অন্ধকারে ছায়া হয়ে মিশে থেকে আয়োজন দেখে দুইজন। দুই দেবী। চন্ডী বলে
— ধনার মনের জোর দেখেছিস? ব্যাটার ভয় নাই।
— সব ছিনিয়ে নিলাম তবু কাঁদে না।
— তবু হেলে না।
— তবু মাথা নোয়াায় না।
দুইদেবী চুপ করে বসে থাকে, মনে জেগে ওঠে ভয়, এত কান্ড করে শেষে ইতিহাসে লেখা থাকবে ধনপতির নাম? ওদিকে শত শত ডিঙ্গা নামে দহে। কই? কোথাও কিছুই নাই। দহের জল ঠান্ডা। কালো। শীতল। ফুল তো দূর একখান শাপলা নজর আসে না। রাজা হাঁক পাড়ে —
কই হে, সওদাগর, কই তোমার কমলবন, কই তোমার কামিনী?
সদাগর মলিন হাসে — ও যে প্রেমের পুষ্প, এমন সমারোহে থাকবে কেন? নীরবে নিভৃতে আপন মনে থাকলে তবে দেখা যায়। হে রাজা, স্বর্গের অপরূপ সুবাস অঙ্গে ধারণ করতে গেলে মন নিয়ে যেতে হবে সেইখানে যেখানে প্রেমের কুঞ্জবন আছে।
রাজা গর্জন করে বলে — আর কামিনী কই?
— ফুল না থাকলে কামিনী কোথায় থাকবে রাজন?
— মিথ্যা বলার শাস্তি মনে আছে?
— মনে আছে রাজা। সব মনে আছে। মিথ্যা আমি কই নাই… এই চোখ দিয়ে দেখলাম তারে, সে আমারে ভালবাসল… আমি তারে অর্পণ করলাম হৃদয়। ভালোবাসার মুখে মিথ্যা মানায় না।
রাজা গম্ভীর। অমাত্য গম্ভীর। ফিরে চলো হে। হুকুম দিয়ে রাজা ফেরে ধনপতির দিকে। সকালে দরবারে হাজির হোক সকলে। নিষ্পত্তি হবে সমস্ত তর্কের। ভালোবাসার মুখে মিথ্যা মানায় না… এমন আজব কথা বলে কেন বণিক! লেনদেনের বাজারে হৃদয়ের কথা চলবে কেন?
রাতে ঘুম আসে না সওদাগরের। নির্ঘুম রাত দখল করে আছে সে। সে ই রূপবতী। ভুলতে পারে না। ভুলতে চায় না। এতদিন এলো কতশত নারী। খোলা জানালার মত। অলিগলি সব যেন চেনা। এমন রহস্য দেখে নাই কখনো। রহস্য ছিঁড়ে ফেলতে দুর্দম ইচ্ছে বুকের ভিতর। আহ্ রে পাষাণী। কমলেকামিনী। কোথা গেলি তুই!
সাধুর বিশ্বাস স্থির। সে আছে। সে লুকিয়ে আছে কমল বনে। আবার যেতে হবে। আবার ডাকতে হবে। উত্তেজিত ধনপতি ভাবে, এবার সে একলা যাবে। ঠিক খুঁজে আনবে তাঁকে। ভাবতে ভাবতে অবসন্ন হয় শরীর। রাজার অনুমতি মিলবে না। সে এখন কার্যত বন্দী। তবে শুধু রাজা চলুক সঙ্গে। আর কেউ নয়। পালঙ্কের উপর বসে থাকে ধনপতি। চক্ষু জ্বলে তপ্ত মরুভূমির মত। বুকের মধ্যে খর বাতাস। অপেক্ষার ক্ষণ দীর্ঘ বড় দীর্ঘ…!
রাত গভীর হয়, আরো গভীর হয়…
আঁধারে শরীর মিশিয়ে কে প্রবেশ করে চোরের মত? এ যে সুদামা! কাছের মানুষ, বিশ্বাসের মানুষ, সে এমন কাঁদে কেন! এমন হাহাকার করে কেন?
সাধুর পা জড়িয়ে ধরে মাঝি বলে — মারেন কাটেন যাই করেন কত্তা, শুধু বিশ্বাস করেন, নিজের ইচ্ছায় কোনো লোকসান আপনার করি নাই।
সাধু তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরে বুড়া মানুষটিরে — বিশ্বাস করি, শুধু বলো, ভয় কে দেখায় তোমারে?
চারিদিকে তাকায় সুদামা, জলের স্রোত তুচ্ছ করে যে নাইয়া আজ থরথর কেঁপে কেঁপে কয় — আমি আপনার পক্ষে কথা কইলে আমার সর্বনাশ। আর, আপনি যদি, দেবী চন্ডীর পূজা করেন, তবে আর সমস্যা নাই!
— কি ই ই ই… এত্তবড় সাহস! শোনো সুদামা, তোমার কোনো চিন্তা নাই, ওই দেবীরা আমার কিস্যু করতে পারব না। যাও, তুমি ঘুমাও।
********
পরদিন দরবার। পূর্ণ লোকজন। সব কিছু যথারীতি। শুধু, সাধু আজ বড়ই শুষ্ক। এলোমেলো বস্ত্র। উদভ্রান্ত বিমর্ষ। বাতাস আজ অন্য কথা কয়। সাধু বোঝে, গোলমাল কিছু আছে। সে তাকায় চারিদিকে। অস্ফুটে বলে —
একাকী যাই, দেখে আসি কমলে কামিনী!
— বারবার গিয়ে কোনো লাভ নাই। আগে এক সত্য কও।
— সত্য ছাড়া মিথ্যা কভু না কই!
বুক চিতিয়ে বলে ধনপতি। সে আবার বলে — রাজা, মিথ্যা কেন বলব। আমার কি বা হবে? কি বা পাব! ব্যাপারী মানুষ, আজ আছি কাল নাই। মিথ্যা ফেন্দে হবেটা কি?
রাজা হুংকার দেন। ঝলসে ওঠে তরবারি। রক্ত চোখে বলেন:
— হবে আমার দেশের লোকসান। কেউ আর আসবে না বাণিজ্যে। তোমাকে বলতেই হবে কামিনীর গল্প ছিল মিছা কথা। বলতেই হবে।
— কেমন করে কই রাজা? সে যে আমার বুকের ভিতর ঢেউ তোলে। তাঁর সুগন্ধ ঝাপটা দ্যায় নিঃশ্বাসে। তাঁর হাসি, তাঁর চোখ — কোথায় ভাসায়ে নিয়া যায়। আমি বণিক, দরিয়ায় ভেসে চলা ধর্ম — আজ আমি প্রেমের দরিয়ায় ভেসে যাই রাজন, এমন আর দেখি নাই। না না রাজা। কারাবাস স্বীকার, মিথ্যা কইতে পারি না।
সাধু চুপ করে। সভার মানুষজন দেখে সদাগর না, দাঁড়ায় আছে প্রেমিক। বিষাদের উত্তাল সাগরে ভেসে থাকা একলা ডিঙ্গি।
অসহায় রাজা ধীরে ধীরে বলেন — একবার সাক্ষ্য দিক তোমার কান্ডার। সঙ্গে ছিল সে। সে যদি কয়, ছিল রূপসী বালা…সে যদি কয় ছিল সেই কমলকামিনী। তবে, তুমি মুক্ত। আর যদি…!
ধনপতি উত্তর দ্যায় না। বুড়া মাঝি অসহায়! কার হয়ে সাক্ষ্য দেবে বেচারা — দুরন্ত স্বপ্নের না কঠিন শাস্তির? সৃষ্টির না ধ্বংসের?
ভীরু পাখির মত সভায় এসে দাঁড়ায় মাঝি। ধনপতি চমকে ওঠে। যেন মাস্তুল ভাঙ্গা জাহাজের মত হেলে পড়েছে! বুক টনটন করে। চোখে জল আসে। আহা। তাঁর আপনজন। তাঁর দেশের লোক। কেউ যেন চুষে নিল জীবন রস!
ধনপতির দিকে একবারও না তাকিয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে বলে —
চোখে ভালো দেহিনা। রাজন! ঘোর রাত। আমার সাক্ষ্য কাজে লাগব না।
রাজা বলে — সে আমরা বুঝব। তুমি দেখেছ কামিনী?
প্রশ্নবাণে এফোঁড় ওফোঁড় গরীব কান্ডার। দম নেয় আর বলে — দূর দহজল। কালোয় কালো।
বজ্র গর্জনে রাজা বলে —
কান্ডার! মিথ্যার দন্ড নিশ্চিন্ত।
মাঝি মাথা তোলে। কালিয়াদহে কিছু দেখেছিল না দেখে নাই, তার মনে পড়ে না। কিন্তুক, সাধু মিথ্যা বলে না, এটা নিশ্চিত। এইটুকু বললেই রক্ষা পাবে সওদাগর। সমুদ্রের দুর্যোগে শক্ত হাতে হাল ধরা কান্ডার আজ হাল ছেড়ে দেবে? স্বপ্ন দেখা এক সওদাগরকে ভাসিয়ে দেবে অতল জলে — সে না কাণ্ডার! মাথা তুলে দাঁড়ায় সুদামা — মৃদুস্বরে বলে — দেখি নাই। নিজ চোখে দেখি নাই, রাজন। কিন্তু, অনুভবে বুঝি সে ছিল। সে ই নারী। মনে হল বুঝি নিশিবিকার। পরে বুঝি, কিছু তো আছে। সামনে কেউ আছে। আমার কত্তা মিথ্যা কয় নাই!
— কা- ন্ডা-র! সাহস কম না তোমার। দেখেছ কি দেখনি! সোজা কথা বলো!
শেষ চেষ্টা করে বুড়া। শরীর কাঁপে। অকূল দরিয়ায় ডুবতে ডুবতে হাত বাড়ায় সামনে। আর্ত স্বরে বলে — আমি সামান্য মানুষ। কি বা আসে যায় আমি দেখি না দেখি।
— কোটাল! গর্দান নাও চতুর শৃগালের।
আর সহ্য হয় না ধনপতির। দৌড়ে আসেন। বেঁকে গেছে মাঝির পিঠ। শক্ত হাত ডানা ভাঙ্গা পাখি। পরম মমতায় হাত দিয়ে কাছে টানে তাঁকে — দেখো নাই কিছু। তুমি কিছু দেখো নাই। বলো। বলে ফেলো। বলো।
ঝরঝর ঝরে চোখের জল। সাগরের জলের মত যার স্বাদ নোনা। কান্না জড়ান স্বরে বলে —
দেখি নাই। দেখি নাই কিছু। দেখি নাই কমল কামিনী কুঞ্জর।
*********
খাড়া দাঁড়িয়ে ধনপতি। একে একে খুলে দ্যায় অঙ্গের স্বর্ণ হীরা মুক্তার গহনা। মহার্ঘ মসলিন ধুতি উত্তরীয় খুলে পরিয়ে দ্যায় মোটা কাপড়ের বস্ত্র। মরি মরি। এত রূপ। কালো বস্ত্র পরিধানে গৌড়বাসী সাধুর বর্ণ কনকগৌর। দীর্ঘ দেহ। সপাট সিংহের মত মধ্যদেশ। তীক্ষ্ম নাসা। আয়তচোখ। কুঞ্চিত নীলাভ কেশ। এবার কোটাল এসে বলে — চলো সাধু। কারাগারে।
সিংহল রাজা তাকায়। এ কেমন মানুষ! প্রাণ দেবে তবু সত্যে অবিচল! বঙ্গদেশের প্রতি মনে মনে কুর্নিশ ঠোকে রাজন।
রাজমহল ছেড়ে সাধু বন্দীশালা যায়। রাজশয্যা ছেড়ে সাধু শিলাতলে শুয়ে থাকে।
আলো ঝরা জীবন ছেড়ে ঘোর অন্ধকার ছোট্ট কুঠুরিতে অবস্থান। আধো ঘুম আধো জাগরণে সাধু বোঝে কে যেন শিয়রে এসে বসে। কে যেন ফিস ফিস করে বলে —
ধনপতি অ ধনপতি একবার চন্ডী নাম করবি? সপ্তডিঙা ফিরে পাবি। হারানো সম্মান ফিরে পাবি, একবার জয়ধ্বনি দে বাপ।
ধনপতি সপাট লাথ মারে অন্ধকারে। গর্জন করে দেবী। নানারকম অমঙ্গলের কথা বলে। লোভের কথা বলে। কোনো ফল হয় না! ক্লান্ত চন্ডী হাতজোড় করে অনুনয় করে — একবার শুধু একবার?
মানুষের সাহসের কাছে দৈব পরাজিত আজ। শত অনুনয় বিনয়ের উত্তরে চুপ করে থাকে ধনপতি! ফিরে যাওয়ার আগে শেষবারের মত বলে চন্ডী — কমলেকামিনী ফিরে আসবে তোর কাছে। তোর প্রেয়সী হবে সে।
উত্তর নেই। ক্লান্ত পরাজিত দেবী দেখেন, কারাগারের মেঝে আঁকড়ে গভীর আরাম — ঘুমে আচ্ছন্ন ধনপতি সওদাগর।
_______________________
নোট:
কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম রচিত মনসামঙ্গল কাব্যের বণিক খন্ডের থেকে ধনপতি চরিত্র আকর্ষণ করেছিল তাঁর নির্ভয় চরিত্রের জন্য। শেষদিন পর্যন্ত তিনি হার মানেন নি। আমার লেখার বক্তব্য মধ্যযুগের সমাজ অথবা মঙ্গল কাব্য নয়, শিরদাঁড়া সোজা আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা এক স্বপ্ন দেখা মানুষের গল্প
———————————-
সূত্র:
ক্ষুদিরাম দাস: কবি কঙ্কন চন্ডী।
সুকুমার সেন: বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস।
সুকুমার সেন: কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম বিরচিত চন্ডীমঙ্গল। v যশোহর / খুলনার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)
প্রাচীন বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
এক টানে পড়ে গেলাম তোমার লেখা ।
অসাধারণ ❤️💐
দারুণ হয়েছে!
জয়তী রায় মুনিয়া গভীর বিশ্লেষণাত্মক লেখা, অনেক কষ্টসাধ্যও… শ্রদ্ধা জানাই দি🙏
অসাধারণ লেখা। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম
অসাধারণ দিদি। খুব ভালো লাগলো ♥️👏
Loved it very much.Keep writing.We need writers like you Jayati Ray Munia.
অনবদ্য!… দৈবের কাছে হার না মানা অনমনীয় এক চরিত্র রূপ পেয়েছে ধনপতির মধ্যে!…ভীষণ ভালো লাগল!
খুব খুব ভালো লেগেছে…ধনপতি সদাগরের গল্প আমার কাছে নতুন….অপূর্ব লেখা❤❤
খুব খুব ভালো লাগলো…একেবারে অন্যরকম….অপূর্ব লেখা ❤❤
I like the novel Dhanapati, for its presentation in a completely different angle. Jayati roy keep it up
very nice novel.
Bangla sahityo r somvar ke somriddho korar jonne onek onek dhonnobad
Very Nice
Very Nice
চণ্ডী মঙ্গলের গল্প এত চমৎকার করে লেখা, পড়ে মন ভরে গেলো। জয়তী, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক, এই প্রার্থনা করি
খুব ভালো লাগলো❤❤👌
সকলকে আমার প্রণাম ও ভালোবাসা।
অসম্ভব ভালো একটি লেখা পড়লাম।অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই এমন একটি লেখার জন্য
দিদিয়ার তোমাকে অনেক ভালবাসা গো,তোমার লেখার গঠন নতুন করে ভাবতে শেখায়❤️❤️💛💛❤️❤️
Khub valo laglo jayati roy
এমন লেখা তোমার কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। তাই তো আমিও পাঠক হয়ে তোমার লেখার সওদাগর হই। ❤️🙏
প্রাপ্তি। ভালোবাসা
This is really amazing.
Very interesting read, the protagonist Dhanapati has been represented in a very different perspective, which is definitely quite unique.
Kudos to the author and the web magazine.
সকলকে ধন্যবাদ
অসাধারণ উপন্যাস তোমার জয়তী! ‘কি’ আর ‘কী’-র ভুল ধরা ছেড়ে আমি একটানা পড়ে গেছি। জানা গল্প । তবু, দারুণ পরিবেশনে মন জয় করে নিয়েছ তুমি আমার জয়তী।অনবদ্য! অসাধারণ! কিন্তু সপ্তডিঙা ফিরে পাওয়ার কথা বাদ রাখলে কেন বুঝলাম না! থাকছে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
সপ্তডিঙ্গা ফিরে পাওয়ার গল্পে ধনপতি নয়, ছিল তাঁর ছেলে শ্রীমন্ত। আর, সেটাও চন্ডী দেবীর সাহায্যে। ধনপতি সেটা মোটেই চায় নি। আমি এখানে এমন একজন চরিত্র এঁকেছি, যে নিজের মাথা নত করেননি। মধ্যযুগে এইরকম আধুনিক চরিত্র দুর্লভ। চাঁদ সওদাগর বাম হাতে ফুল দিয়েছিলেন, ধনপতি সেটাও করেনি। কাজেই, ওইখানে সমাপ্তি টেনেছি। প্রণাম দাদা।
দারুন একটা উপন্যাস পড়লাম mam. এটা আমার সৌভাগ্য। এই রকম সুযোগ করে দেওয়ার জন্য thanku so much.
অপূর্ব উপন্যাস। mam এ রকম উপন্যাস বার বার পড়ার জন্য অপেক্ষা করবো
Apurbo uponasg
Valo golpo.bar bar porte mon korbe
Khub valo uponash
Thanku so much. ato valo golpo upohar deoar jonno.
Darun, darun, darun golpo
Excellent story👍🏻