এবং শ্রী অমল কুমার
অজিতেশ নাগ

“মানে?”
যে কথাটা কানে গেলে একজন মানুষ তার যে সব আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে, তার মধ্যে কোনটা বাছলে মনের ভাবটা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারবে, ভেবে কুলিয়ে উঠতে না পেরে, মেঘা হতবুদ্ধির মত সৌপ্তিকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেছিল। সৌপ্তিকের কিন্তু কোনও ভাব পরিবর্তন দেখা যায়নি।
মেঘার পুরো নাম রূপমেঘা। বাড়ির ডাকনাম ছিল মেঘা, সবাই সেই নামেই তাকে ডাকত, তাই হয়ত সৌপ্তিক তাকে বিয়ের পর থেকে ডাকে রূপু বলে। লোরেটো থেকে বেরিয়ে শেষমেশ মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা মার্কেন্টাইল আপিসে চাকরি করে মেঘা। দরকারে নয়, নেহাত বাড়তি হাতখরচ সামাল দিতে। বিয়ের পর অবশ্য তারও দরকার ছিল না। কারণ সৌপ্তিক মুখার্জী যা কামায় তাতে করে সে তিনটে বৌ রাখতে পারে। মজা করে কথাটা একদিন সৌপ্তিকই বলেছিল। কিন্তু সারাটা দিন ঘরে বসে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয় বলেই মেঘার এই চাকরিটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে সে সৌপ্তিককে কথা দিয়েছে, একবার কনসিভ করলেই, চাকরিটা সে ছেড়ে দেবে, সারাজীবনের জন্য। তার পরে মন দিয়ে ঘর-সংসার, সন্তান মানুষ করে তোলা, এইসব নিয়েই থাকবে।
সেদিন রাতে তখন তাদের নিত্যকার আদর-পর্ব সবে শেষ হয়েছে। নাইট-বাল্বের আলোয় শায়িত সৌপ্তিকের ঘামে ভেজা চকচকে মুখটা দেখতে দেখতে মেঘা ভাবছিল, একজন পুরুষ একজন নারীকে কতটা গভীরভাবে ভালবাসতে পারে, সৌপ্তিকের সঙ্গে তার বিয়ে না হলে অজানাই থেকে যেত। আরও হয়ত সাতপাঁচ কিছু ভাবছিল আর একটা রমণ-ক্লান্তি ধীরে ধীরে ঘিরে ধরে মেঘাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সুষুপ্তির দিকে। তবে সেভাবে সিরিয়াসলি চিন্তা করবার বিশেষ কিছু ছিল না। কারণ পরের দিন শুক্রবার। মেঘার উইকলি হলিডে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সৌপ্তিক নতুন চাকরিতে জয়েন করে দেখে সেখানেও প্রতি শুক্রবার ছুটি। ফলে সোনায় সোহাগা। এখন শুক্রবার মানেই দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, মেঘা কফি বানাবে, সৌপ্তিক ব্রেকফাস্ট। তারপর স্নান সেরে রেডি হয়েই দুটিতে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। মেঘার বিয়ে হয়েছে আজ ঠিক এক বছর চার মাস চৌদ্দ দিন। সৌপ্তিকের নতুন চাকরিতে জয়েন করবার পরে, হাতে গোনা দু’চারটে শুক্রবার বাদ দিলে, কোনদিনই এই রুটিনের হেরফের ঘটেনি। বাইরে মানে বহু দূরে কোথাও না। লং ড্রাইভে বেরিয়ে হয়ত ডায়মন্ডহারবার, রায়চক, দেউলটি বা একটু দূরে মহিষাদল। তেমন কিছু খুঁজে না পেলে পৈলানের স্বামীনারায়ন মন্দিরে গিয়ে বসে থাকা। লাঞ্চও সারা হয় বাইরে। মেঘা আর সৌপ্তিক দু’জনেই ড্রাইভিং জানে। তাই ভারি আনন্দে কেটে যায় প্রতিটি শুক্রবার।
সৌপ্তিক বেশ মজার মানুষ। যে কোনও সিরিয়াস ব্যাপার সৌপ্তিক তাৎক্ষণিক মজার মোড়কে মুড়ে দিতে পারে। তাই ও যখন বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে বলল, নেক্সট উইকে ও স্ট্রাসবার্গ উড়ে যাচ্ছে আর ফিরতে ফিরতে এক মাস পেরিয়ে যাবে, মেঘা ভেবেছিল ও মজা করছে। কারণ এমনটাই সৌপ্তিক করে থাকে। হয়ত কোনওদিন মেঘার স্প্যাগেটি খেতে খুব ইচ্ছে করছে, সৌপ্তিককে বলতেই ও ঠিক বলবে, “দাঁড়াও, ফ্লোরেন্স থেকে আনিয়ে দিচ্ছি।”
মেঘা অবাক হয়ে হয়ত প্রশ্ন করেছিল, “ফ্লোরেন্স? পার্ক স্ট্রিটে কোনও নতুন রেস্টুর্যান্ট হয়েছে নাকি?”
ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে সৌপ্তিক বলবে, “ওহ নো, ফ্লোরেন্স। ইটালির তাসকানি রিজিয়নের সিটি। নাম শোনোনি?”
বোঝো কাণ্ড! সেই রকমেরই কিছু একটা হবে ভেবে মেঘা, সৌপ্তিকের বলিষ্ঠ বাহুর উপরে মাথা রেখে, মুচকি হেসে বলেছিল, “আচ্ছা? স্ট্রাসবার্গ? সেটা কোথায়, সোনা?”
“নর্থ-ইস্টার্ন ফ্রান্স।”
“তাই বুঝি? তাও আবার দু’মাসের জন্য? এক্সেলেন্ট স্টোরি।”
সৌপ্তিক বলেছিল, “আয়াম সিরিয়াস মেঘা। তোমাকে তো বলেছিলাম, আমার এই নতুন অফিসটা একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি। আর আমি যে পোস্টে জয়েন করেছি, সেখানে ফরেন ট্যুর করতে হতে পারে। বলিনি?”
তা অবশ্য বলেছিল। মেঘা উত্তর দিয়েছিল, “সিরিয়াসলি? তবে তো ফ্যান্টাবুলাস। তুমি কাজ করবে আর আমি ফ্রান্সের পথে পথে ঘুরে শপিং করব। তুমি জাস্ট তোমার কার্ডটা আমাকে দিয়ে রেখো। হিহিহি।”
তারপরেই সে বলেছিল, “কিন্তু তোমার শ্রীমান ভাইটিকে রাখবে কোথায়? তাকে…”
সৌপ্তিক মেঘাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে তার দিকে ফিরে কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, “না, একটা প্রবলেম আছে, রূপু। ওরা এখনই স্পাউসকে অ্যালাউ করছে না।” তারপরেই এক গাল হেসে বলেছিল, “তোমার বরবাবাজী উন্নতি করেছে বটে এবং সেটা জাস্ট বৌয়ের ভাগ্যের জোরেই এটাও ঠিক, কিন্তু এতটাও করেনি, যে…”
“তুমি সত্যি সত্যি যাচ্ছ? মজা করছ না তো?”
“না, রূপু। আজই ইমেইলটা পেয়েছি। আরে, চিন্তা করছ কেন? আমি একা যাচ্ছি নাকি? আমার সঙ্গে যাচ্ছে মিস মারিয়া। উফফ। আয়াম সো এক্সাইটেড।”
মেঘা সটান উঠে বসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে আবার শুইয়ে দিয়েছিল সৌপ্তিক, “আরে, জোকিং ইয়ার। আমরা চারজন যাচ্ছি, চারজনই কাঠ পুরুষমানুষ। হাহাহা।”
ততক্ষণে অভিমানে মেঘার ঠোঁট ফুলে উঠেছে, “আমি সে কথা বলছি না। তুমি মারিয়া ফারিয়া যার সঙ্গে ইচ্ছে যাও, বাট, আমি এই এক মাস একা একা থাকব নাকি?”
“আহাহাহা, তা কেন, শ্রীমান অমল কুমার তো রইলই।”
আর সেই শুনেই মেঘার মুখ দিয়ে ঐ একটা শব্দই বেরিয়েছিল, “মানে?”
অমল কুমার সৌপ্তিকের নিজের ভাই নয়। ওর নিজের কোনও ভাই নেই। এক দিদি আছে, থাকে ব্যাঙ্গালোরে। ওর বাবা-মা দিদির কাছেই থাকেন। মেঘার নিজের বাবা অনেক বছর আগে মারা গেছেন। মা-ও চলে গেলেন দু’বছর আগে। মেঘা তাদের একমাত্র মেয়ে। নিজের বলতে এক পিসি, যিনি ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। প্রধানত পিসে আর পিসিমার উদ্যোগেই সম্বন্ধ করে এই বিয়েটা হয়েছিল।
সৌপ্তিকের আদি বাড়ি মেদিনীপুরের এক অজ গ্রামে। নামটা মেঘা শুনেছিল একবারই, পরে ভুলে গেছে। সেখানে সৌপ্তিকের দূর সম্পর্কের এক মাসির বাড়ি আছে। সেই মাসির ছেলে অমল কুমার। প্রথম যেদিন ওকে মেঘা দেখে, তখনই সম্পর্কটা জিজ্ঞেস করায়, সৌপ্তিক বলেছিল, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, “শিয়ালদা থেকে হাওড়া তুমি কী ভাবে যাবে, রূপু?”
এ আবার কী প্রশ্ন? সৌপ্তিক বলেছিল, “খূব সোজা। হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে স্ট্রেইট দিল্লি চলে যাও, তারপর সেখান থেকে আরেকটা রাজধানী ধরে শিয়ালদা। খরচা একটু বেশি হল বটে, তবে মাঝে কমফর্টেবল অ্যাটমসফিয়ার, ফ্রিতে খাওয়াদাওয়া, এগুলোও কম কী?”
“তুমি কী বোঝাতে চাইছ?” মেঘা কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিল।
“শ্রীমান অমল কুমারের সঙ্গে আমার শিয়ালদা-হাওড়ার সম্পর্ক, ভায়া দিল্লি। এবার বুঝলে?”
“কিন্তু তাহলে ওকে উঠিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে এলে কেন?”
মাস চারেক আগে একটা ইনল্যান্ড লেটার আসে মেঘাদের কালিঘাটের সদানন্দ রোডের এই বাড়িতে। ডাকবাক্সে চিঠিটা পেয়ে তো মেঘা অবাক। আজকালকার দিনে কেউ ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড লিখতে পারে তার ধারণায় ছিল না। সেই চিঠি পড়েই সৌপ্তিক দৌড়ল আর ফিরল সৌপ্তিকেরই প্রায় সম-বয়সী একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। সৌপ্তিক আলাপ করিয়ে দিল। ভারি অবাক হয়েছিল মেঘা। ছেলেটি দেখতে শুনতে মন্দ না হলেও মানসিক স্থিতি যে সেই ইনল্যান্ড লেটার আর ঘুঁটে দিয়ে উনুন ধরাবার যুগে পড়ে আছে বুঝতে পেরেছিল। মাথাভর্তি তেল চপচপে চুল আর নামটা অমন শুনে যা বোঝার সে বুঝে নিয়েছিল। আরও জেনেছিল, মাসি মারা গেছেন আর তার এই একটি মাত্র পুত্রের চারকুলে কেউ নেই। এই মাসির কথা যে মেঘা আগে শোনেনি, তা নয়। শুনেছিল, অনেকদিন আগে সৌপ্তিকের বাবার ব্যবসার অবস্থা যখন প্রায় পড়োপড়ো, তখন এই মাসি নাকি তার যথাসর্বস্ব দিয়ে সৌপ্তিকের বাবার ব্যবসা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ঋণ কিছু কম নয়।
“তাই বলে সরাসরি এখানে নিয়ে এলে? কদ্দিন থাকবে?” মেঘা প্রশ্ন করেছিল।
“যদ্দিন না ওর একটা হিল্লে করতে পারছি।” বলে সৌপ্তিক স্নানঘরে চলে গিয়েছিল।
সৌপ্তিকের উত্তরে মেঘা পুরো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। বুঝেছিল, শ্রীমান অমল কুমার এই বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। কারণ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যে ছেলের অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন ক্লাস সেভেন, তার এই মেট্রোপলিটান শহরে হিল্লে হতে হতে মেঘা-সৌপ্তিকের নাতনির বিয়ে হয়ে যাবে।
সেই থেকে অমল কুমার থেকে গেল। সৌপ্তিকদের এই বাড়িটা আদতে পৈত্রিক ভিটে। চালু ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও মেঘার শ্বশুরমশাইয়ের অবস্থা এমন কিছু ভাল ছিল না। সৌপ্তিক সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় আজ এতটা অবধি উঠে এসেছে। উঁচু উঁচু ছাদওয়ালা দুটো বেডরুম, যদিও তাদের আকৃতি আজকের দিনের তুলনায় বিশাল বড় বড়, তার সঙ্গে মানানসই একটা বড়সড় কিচেন আর দুটো ঘরের লাগোয়া দুটো টয়লেট আর একটা প্রশস্ত বারান্দা। ব্যস। মেঘাদের বাসস্থানের পরিধির এখানেই সমাপ্তি। বাড়ির পেছনে বেশ খানিকটা খালি জায়গা আছে। মেঘার শ্বশুরমশাই সেখানে একসময় একটা শখের বাগান বানিয়েছিলেন। মেঘার বিয়ের পর পরই, প্রধানত ঘরের সঙ্কুলানের কারণেই হোক বা ছেলে-বৌমাকে হাত-পা খেলিয়ে থাকতে দেওয়ার কারণেই হোক, মেঘার শ্বশুর-শাশুড়ি মেয়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। সেই ইস্তক বাগানটা অযত্নেই পড়ে ছিল, সেদিকে যাওয়ার বা তাকাবার ফুরসত কারও ছিল না। একদিন কী একটা কাজে বাড়ির পেছনে গিয়ে মেঘা অবাক। দেখে জায়গাটায় আবার আগের শ্রী ফিরে এসেছে। বেশ কিছু ফুলের চারা হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে আর গোলাপ, গাঁদা আর দোপাটি গাছের মত কিছু ফুলগাছে ফুলও ধরেছে দেদার। এ সব কে করল? ভাবছে, এমন সময় দেখে, অমল কুমার এক হাতে মাটির তাল আর আরেক হাতে মাটি-মাখা খুরপি নিয়ে তার সামনে হাজির। মেঘা বুঝল।
অবশ্য অমল কুমারের আরও অনেক অবদান ধীরে ধীরে প্রমাণিত হয়েছে। সে রাঁধতে জানে, কাপড়-জামা কাচতে জানে। মানে ঘরকন্নার মোটামুটি যা কাজকম্ম, সে করে নিতে পারে। একদিন ডিনারে বসে সৌপ্তিক অবাক, “কাঁচকলা? তুমি রাঁধলে? তোমার তো কাঁচকলা দু-চক্ষের বিষ।”
সত্যিই। কাঁচকলা যে কেউ রান্না করে খায় এবং খেলে এত উপাদেয় লাগে সেটা অমল কুমারের হাতের রান্না খেয়ে মেঘা বুঝেছিল। একদিন ঠাট্টা করে বলেছিল, “মিস্টার অমল কুমার মেয়ে হতে হতে ছেলে হয়ে গেছে।”
সৌপ্তিক হাসেনি। বলেছিল, “মেসো মারা গেলেন যক্ষায়। একমাত্র আর্নিং মেম্বার ছিল। তাও বছর পনেরো হয়ে গেল। তার পরে মাসি পড়ল বিছানায়। সে প্রায় আজ পাঁচ-পাঁচটা বছর হয়ে গেল। একেবারে বেড-রিডন। সো? অমল সব কাজকম্ম না শিখে নিলে সংসারটা ভেসে যেত না?”
একটা কথা আচমকা মাথায় আসায় মেঘা বলেছিল, “তাহলে তোমার মেসো মারা যাওয়ার পরে ওদের সংসার চলত কী করে? মানে টাকাপয়সা…”
সৌপ্তিক দৃশ্যত বিব্রত হল, মুহূর্তের জন্য, তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বলল, “সে এক ভারি অ্যাডাল্ট গল্প, আগে তোমার আঠেরো হোক, তার পরে বলব।”
বোঝো কাণ্ড! কিন্তু স্ট্রাসবার্গ যাওয়ার ব্যাপারটা তো আর মজা নয়। একটা প্রায়-অচেনা ছেলের সঙ্গে একই ছাদের নিচে একা মেঘা পুরো তিরিশটা দিন কাটাবে? সৌপ্তিকের মাথার ঠিক আছে তো?
পরদিন অফিস থেকে সৌপ্তিক ফিরে এলে মেঘা বলেছিল, “তুমি বুঝতে পারছ না, অমল কুমার তোমার মায়ের পেটের ভাই নয়, মানে আমি কী বলতে চাইছি…”
সৌপ্তিক দরাজ হেসে মেঘাকে জড়িয়ে ধরেছিল, “তুমি আমাকে কী ভাব? আমি অনেক চিন্তা করেই বলছি, আমার অ্যাবসেন্সে অমলের মত একজন সিকিওরড বডিগার্ড পেতাম না। একবার ভেবেছিলাম জানো, ব্যাঙ্গালোরের টিকিট কেটে দিই তোমাকে, বাট তাহলে অমলকে এই বাড়িতে একা থাকতে হয়। সেটা ঠিক হবে কি, রূপু? আর বিসাইডস, তুমি আরামে থাকবে। অমল ঘরের সব কাজ করতে পারে, ইনক্লুডিং কুকিং, ইউ নো। তোমাকে রানির হালে রাখবে। আর হোয়াটস-অ্যাপ, ফেসবুকের যুগের মেয়ে তুমি। চাইলেই আমার শ্রীবদনখানি দেখতে পার। জাস্ট টাইম ক্যালকুলেশনটা করে নিও, ব্যস। ওকে? ম্যায় ইউ গয়া অওর ইউ আয়া।”
মেঘা কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
সৌপ্তিক উড়ে গেল। ওকে ভোর-রাতে সি-অফ করে দিয়ে মেঘা বাড়ি ফিরে এল। আজ ফ্রাই-ডে নয়, তাই অফিস যেতে হবে। কিন্তু যতবারই সে ভাবছে, এই বাড়িতে সে আর অমল কুমার একা, তখনই তার মনটা খচখচ করে উঠছে। বিশেষ করে কাল রাতের আদর-পালার পরে সৌপ্তিক ঘুমিয়ে পড়লেও মেঘা সোজা তাকিয়েছিল কড়িকাঠের দিকে। আচ্ছা, সৌপ্তিক যে সে দিন বলল, অমলের বাবা মারা যাওয়ার পরে অমলদের সংসার চলার পেছনে একটা অ্যাডাল্ট গল্প আছে সেটা কী? তবে কি সৌপ্তিকের মাসি কোনও অবৈধ কাজ করত? নাকি অমল নিজেই? সৌপ্তিক জানে, তাকে বলছে না। সেই ছেলের সঙ্গে… এক বাড়িতে… ভাবতে ভাবতে মেঘার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। সে উঠে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। কতক্ষণ, কে জানে।
যে বাড়িতে মেঘা হাসতে হাসতে প্রবেশ করেছে এতদিন, সেই বাড়িতেই আজ, কেন কে জানে, চোরের মত পা টিপে টিপে প্রবেশ করল মেঘা। একটাই চিন্তা। অমল কুমার কোথায়? বারান্দায় উঠে একটু দাঁড়াল। একটু আগেও মেট্রো স্টেশনে থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজেকে বুঝিয়েছে, বিপদের থেকে কোনদিনও পালাতে নেই। অতএব? সে কেন নিজেরই বাড়িতে এইভাবে চুপিসারে ঢুকবে? একবার মনস্থির করে নিয়ে সে পর্দা সরিয়ে নিজেদের বেডরুমে প্রবেশ করল এবং ভারি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
মেঘা নিজে কোনদিনও গোছানো নয়। কলেজ, অফিস বা পার্টি থেকে ফিরে শাড়ি-শায়া-অন্তর্বাস-শালোয়ার এদিক ওদিক ছুড়ে দেওয়া তার চিরকালীন অভ্যেস। বাপের বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিল না। মা বলত, এখানে মহারানি হয়ে ফুটানি মারছিস, শ্বশুরবাড়িতে গেলে বুঝবি। সে একটা চিন্তা ছিল বটে, কিন্তু এখানে এসে ইস্তক, সৌপ্তিক মারাত্মক-লেভেলের গোছানো ছেলে দেখে, মেঘা ভারি নিশ্চিন্ত হয়েছিল। জামাকাপড় সব গুছিয়ে পাট পাট করে তুলে রাখতে হবে ভাবলেই মেঘার গায়ে জ্বর আসে অথচ সৌপ্তিক কী সুন্দর হাসিমুখে সেই সব করে নেয়। নিজেরও আর স্ত্রীরও।
কিন্তু আজ ভোরে সেই সব করবার মত যথেষ্ট সময় সৌপ্তিকের হাতে ছিল না। তাই বাড়ি ফিরে এবং পরবর্তী চার সপ্তাহ তাকেই এসব করতে হবে ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল মেঘা। কিন্তু ঘরে ঢুকে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুধু তার আর সৌপ্তিকের বাসি জামাকাপড়ই নয়, লণ্ডভণ্ড হয়ে থাকা বিছানা, ড্রেসিং-টেবিলের উপরে ছত্রাকার হয়ে থাকা তার সাজগোজের জিনিসপত্র সব কে যেন নিপুণ হাতে গুছিয়ে রেখেছে। মেঝের উপরে একটা খালি চিপসের প্যাকেট পড়েছিল, ছিল তার টয়লেট-স্লিপারও। সেগুলো নেই। মেঝেতে শুধু ঝাঁটপাটই পড়েনি, জল দিয়ে মোছাও হয়েছে বুঝতে পারল মেঘা। বেড-সাইড টেবিলের উপরে সৌপ্তিকের সিগারেটের অ্যাশ-ট্রেটা ছিল, সেখানে এখন এক বোতল জল আর একটা কাঁচের গ্লাস উল্টো করে রাখা। বিছানার চাদর শুধু টানটানই নয়, একটা নতুন বেড-কভার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। জানালার পর্দা সরানো, বাইরে থেকে রোদ এসে বিছানা ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
পুরো দৃশ্যটা যে কোনও কারও মনকে নিমেষে ভাল করে দিতে পারে, কিন্তু আচমকা মেঘার মাথাটা গরম হয়ে গেল। অমল কুমার ছেলেটার এত সাহস যে, পারমিশান না নিয়ে তাদের বেডরুমে ঢুকেছিল? এত গোছাতে তাকে কে বলেছে? বিশেষ করে মেঘার যখন মনে পড়ল, বাসি বিছানার উপরে তার ব্রা আর প্যান্টিও ছিল, তখন লজ্জায়, রাগে সে চেঁচিয়ে উঠল, “অমল, অমল কুমার।”
এই বাড়িতে আসার পর থেকেই অমল কুমার সৌপ্তিককে ‘সুপু’ আর মেঘাকে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকত। মেঘা জানত সৌপ্তিকের ডাকনাম ‘সুপু’, কিন্তু নামটা বেজায় বাজে বলে সে কোনদিনও তাকে সেই নামে ডাকেনি, কেউ ডাকুক সে চায় না। অমলের মুখে সেই ডাক শুনে সে সৌপ্তিককে বলেছিল, “উফফ। নট এগেইন। অ্যাই, তুমি ওকে সুপু, নিপু এইসব নামে ডাকতে বারণ করে দেবে তো।”
সৌপ্তিকের ভ্রু কপালে, “সে কী! ওই নামে তো আমাকে ছোটবেলা থেকেই সবাই চেনে, মাসিও, ও-ও ডেকে এসেছে।”
“সে হোক। আমার সামনে চলবে না। তোমাকে… তোমাকে… সৌপ্তিক নামে ডাকবে।”
“পাগল? ভাই কোনদিনও ভাইকে অফিশিয়াল নামে ডাকে? আর নামে কী যায় আসে, রূপু? সেই যে কোন কবি বলে গিয়েছিলেন, গোলাপকে …”
“ইয়ার্কি থামাও। আচ্ছা, বেশ। তাহলে শুধু ‘ভাই’ বলেই ডাকুক। কেমন? আর আমাকে? ম্যাডাম আবার কী ডাক? ও কি আমার অফিসের সাব-অর্ডিনেট বা পিওন নাকি? আর নিজের নামেরই বা কী বাহার। অমল কুমার। প্রি-হিস্টোরিক নেম।”
সেই প্রথম সৌপ্তিককে ভীষণ গম্ভীর হতে দেখেছিল মেঘা। সে থমকে গিয়েছিল। সৌপ্তিক একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরে ধীরে বলেছিল, “ওকে। আমি ওকে বলে দেব। আমাকে ‘সৌপ্তিক’ আর তোমাকে ‘রূপমেঘা’ নামেই ডাকতে।”
“কিন্তু…”
“নো ফারদার আর্গুমেন্ট প্লিজ।” সৌপ্তিক সিগারেটটা নিয়েই টয়লেটে ঢুকে গিয়েছিল।
সেই থেকেই অমলের কাছে সে রূপমেঘা। প্রথম প্রথম কানে বাজলেও, পরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।
“আসব?”
দুই ঘরের দরজার মাঝখানে ঝুলছে ভারি পর্দা। তার ওদিকে অমল কুমারের গলা। ততক্ষণে রাগ চড়ে বসেছে মেঘার ব্রহ্মতালুতে। সে শুধু ‘হুঁ’ বলাতে তৎক্ষণাৎ পর্দা সরিয়ে অমল কুমারের প্রবেশ। মুখে অম্লান হাসি, হাতে চায়ের পেয়ালা, “চা হাজির, রূপমেঘা।”
দারুণ উত্তেজনায় কী একটা বলতে গিয়েও গলা আটকে গেল মেঘার। কই, অমল কুমারের মুখে তো এই ঘরে অনধিকার প্রবেশের বা তার ভাই-বৌয়ের অন্তর্বাস ছুঁয়ে দেখার সামান্যতমও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না? তার জায়গায় কেমন একটা শিশুসুলভ নরম হাসি। দেখলেই মনে হয়, এর মনে কোনও পাপ থাকতে পারে না। অবশ্য ছেলেটা উঁচুদরের অভিনেতা বা মিটমিটে শয়তান হলেও এটা সম্ভব। মেঘা শুধু আঙুল দিয়ে ঘরের দিকে দেখাতেই আবার এক গাল হেসে অমল কুমার বলল, “ও আমি সব গুছিয়ে দিয়েছি। ও সব নিয়ে তোমাকে কোনও চিন্তা করতে হবে না। তা ছাড়া এখন কি আর তোমার হাতে সময় আছে যে ঘর গোছাবে? নাকে মুখে গুঁজেই তো আবার ছুটতে হবে আপিসে।”
মেঘা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অমল বলল, “আরে চিন্তা নেই। জামাকাপড় সব ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়েছি।”
“তু-তুমি ওয়াশিং মেশিন চালাতে পার?”
অমল কুমার লজ্জিত মুখ করে বলল, “সৌপ্তিক শিখিয়ে দিয়েছে।”
মেঘা যেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, “এখন আমি চা খাব? ক’টা বাজে দেখেছ?”
অমল কুমার ফের হাসে, “অত ভোরে উঠেছ, অতটা পথ গেলে, এলে, তাই ভাবলাম এক কাপ চা খেলে ক্লান্তিটা কেটে যাবে। বিস্কুট আর দিলাম না। একটু পরেই ভাত খেও না হয়।”
কথা মিথ্যে নয়। কোনদিনই অত ভোরে ওঠবার অভ্যেস তার নেই। না বাপের বাড়িতে, না এই বাড়িতে। শুধু হনিমুনে উটিতে যাওয়ার দিন এত ভোরে উঠতে হয়েছিল। আর আজ। ফিরতে ফিরতে টের পেয়েছিল মাথাটা ধরে গেছে। চা-টা হাতে পেয়ে আনন্দে মনটা নেচে উঠল যেন। এক চুমুক দিয়েই সে টের পেল, রান্নাবান্নার মত চা-টাও অমল কুমার করে দুর্দান্ত। দ্বিতীয় চুমুকটা দিতেই অমল কুমারের গলা কানে এল, “চা খেয়ে তুমি চানে চলে যাও দেখি। আমার ওদিকে ভাত রেডি। সৌপ্তিক তো আমাকে কালই রাতে জানাল, ও চলে যাচ্ছে বাইরে। আগে তো জানতাম না। তাই বেশি কিছু করতে পারিনি। ভাত, মুসুরির ডাল, পটলভাজা আর মাছের ঝোল। কম হল?”
কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না মেঘা। অমল কুমার বলল, “রাতে চিকেন করব ভাবছি। ঘরে সব্জি বাড়ন্ত। তুমি বেরিয়ে গেলেই একবার বাজারে বেরোব।”
মেঘা অবাক হয়ে তাকাল, “তুমি টাকা পাবে কোথায়?”
“সে থোক টাটা সৌপ্তিক দিয়ে গেছে আমাকে। আমি বলি কী, টাকাগুলো তুমি রেখে দাও, রূপমেঘা। আমি কোথায় হারিয়ে-মারিয়ে ফেলব। এত টাকা। দরকারে চেয়ে নেব বরং?”
চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে মেঘা বলল, “নাহ। তোমার ভাই তোমাকে দিয়েছে, তুমিই রাখো। যদি ফুরিয়ে যায় চেয়ে নিও।”
অমল কুমার চলে যেতে গিয়ে ফিরে তাকাল, “আমি সব হিসেব লিখে রাখছি কিন্তু, তুমি চাইলে…”
মেঘা কড়া গলায় বলে উঠল, “আমি হিসেব চেয়েছি? আর হ্যাঁ, এই বেড-কভার তুমি পেলে কোথায়? তুমি আলমারি খুলেছিলে?”
নিমেষে অমল কুমারের মুখ ম্লান হয়ে এল, “এ মা! না না। বিছানার নিচেই তো ছিল।”
মনে পড়ল মেঘার। মাস চারেক আগে এই কভারটাই ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে সৌপ্তিক ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিছানার নিচে। বলেছিল, ফ্রিতে ইস্ত্রি হয়ে যাবে। নিজেকে ধিক্কার দিল সে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই অমল কুমার এমন একটা কথা বলল, মেঘার কথা আটকে গেল।
“রূপমেঘা, যদি আপিসের দেরি হয়ে যায়, তাই একটা কথা বলছি। তুমি যতক্ষণ কলঘরে থাকবে, ততক্ষণে মানে যদি তোমার আলমারিটা খুলতে দাও, তাহলে তোমার শাড়ি-টাড়ি আমি বের করে বিছানার উপরে গুছিয়ে রাখতে পারি।”
স্নানকে চান, টয়লেটকে কলঘর, কিচেনকে পাকঘর বলতে নেই, বলতে বলতে মেঘা হাঁপিয়ে গিয়েছিল, অমল কুমার শোধরায়নি। কিন্তু এই প্রস্তাব তাকে একেবারে হতচকিত করে দিল। এর মানে কী? অমল কুমার তার শাড়ি, শায়া, ব্রা, প্যান্টি গুছিয়ে রাখবে বিছানার উপরে! ছেলেটা মহা শয়তান না বোকা পায়জামা? নাহ, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মেঘা অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শোনো অমল কুমার। যদ্দিন সৌপ্তিক ফিরে না আসে, তোমার এই রুমে আসার দরকার নেই। ফিরে আসার পরেও নেই। বুঝতে পেরেছ? আমি তো একটা মেয়ে। নিজের কাজ নিজেই করে নিতে পারি। আমার জামা-কাপড় আমি নিজেই কেচে নিতে পারব।”
অমল কুমারের মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণার চিত্র ফুটে উঠল। সে ‘আচ্ছা’ বলে খালি কাপ-প্লেট উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। মেঘা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে টয়লেটে ঢুকে গেল।
অন্য দিন সৌপ্তিক মেঘাকে তার অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফেরার সময় অবশ্য মেঘা মেট্রোরেল ধরে ফিরে আসে। তো মেঘা দেখেছে যাওয়ার সময় অমল কুমার বাইরের বারান্দায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। এমনও নয় যে মেঘা আর সৌপ্তিক তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়, তবুও দাঁড়ায়। এতদিন মাঝের ঘরের ছিটকিনি আটকাবার প্রয়োজন পড়েনি। আজ সেই ছিটকিনি আটকে আর নিজেদের ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একবার যেন আনমনে বাড়িটাকেই দেখছে এমন ভান করে মেঘা আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, বারান্দায় অমল কুমার দাঁড়িয়ে নেই। সে ঠোঁট বেঁকিয়ে একবার ভাবল গাড়িটা নিয়েই আপিসে যাবে, কিন্তু মন বদলাল। সৌপ্তিক অবশ্য অনুরোধ করে গেছে, এই ক’দিন সে যেন গাড়ি নিয়েই অফিসে যায়, কিন্তু মেঘা রাজি হয়নি। তার মতে, সস্তায় এবং দ্রুত যখন মেট্রোতেই যাওয়া যায়, তখন এক গাদা টাকার পেট্রোল পুড়িয়ে লাভ কী?
সদানন্দ রোড থেকে রাসবিহারীর মোড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মেঘার হাসি পেল। বাবুর গোসা হয়েছে। হোক। কিন্তু সে কিছুতেই অমল কুমারকে নিজের জামাকাপড়ে হাত লাগাতে দেবে না। একমাত্র সৌপ্তিককে ছাড়া আর কাউকে এই অনুমতি দিতে পারবে না। সে অমল কুমার না হয়ে অমলা কুমারী হলেও না হয় ভেবে দেখা যেত। কিন্তু তার স্বামীর একজন দূর সম্পর্কের ভাই তার অন্তর্বাস ঘাঁটছে, ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।
অফিস থেকে বেরিয়ে অন্যদিন সে তাড়াতাড়ি মেট্রোর গেটের দিকে হাঁটা লাগায়। প্রথম প্রথম তার ইচ্ছে হত, সৌপ্তিক ফিরে আসার আগেই সে স্নান-টান সেরে সেজেগুজে বসে থাকবে। সৌপ্তিক ঘরে ঢুকলেই চকাস করে একটা চুমু খেয়ে বলবে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আজ তোমার ভাই ফিশ-ফ্রাই বানিয়েছে। দু’জনে খেতে খেতে গপ্প করব। নয়ত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ট্যাবে ওয়েব সিরিজ দেখব। পরে এই উত্তেজনাটা চলে গেলেও অভ্যেসটা থেকে গিয়েছিল।
কিন্তু আজ থেকে আগামী তিরিশটা দিন বাড়ির সামনে সৌপ্তিকের গাড়ি থামার শব্দ শোনা যাবে না, ভাবতেই মনটা উদাস হয়ে গেল মেঘার। কী যেন থেকেও নেই। সৌপ্তিক এখন আকাশে। ও যা হিসেব দিয়ে গেছে, মোটামুটি আঠেরো-উনিশ ঘণ্টা লাগবে ইস্তাম্বুল হয়ে স্ট্রাসবার্গ পৌঁছতে। অফিসে বসে বসে মেঘা হিসেব করে দেখেছে, ওখানকার এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে বেরোতে মোটামুটি রাত দুটো পেরিয়ে যাবে। সে আরও দেখেছে, কোলকাতার চাইতে সাড়ে চার ঘণ্টা পিছিয়ে আছে স্ট্রাসবার্গ। তার মানে আমাদের রাত দুটো হলে ওদের রাত দশটা। পরক্ষণেই বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকিয়েছে সে। কী লাভ এইসব হিসেব-নিকেশ করে? মোদ্দা গপ্পটা তো হচ্ছে এই যে, আজ বাড়ি ফিরে সে সৌপ্তিককে দেখতে পাবে না সে। পাবে না আরও ঊনত্রিশ দিন। কোনও মানে হয়?
“কী ব্যাপার? শুনলাম আমার কম্পিটিটর নাকি উড়ে গেছে? বৈদেহীর মুখে জাস্ট খবরটা পেলাম। তাই ভাবি, মুখার্জী ম্যাডাম আপসেট কেন?”
চমকে পেছনে তাকিয়ে মেঘা দেখে, শুভায়ু। দেখেই মুখটা তেতো হয়ে গেল। প্রথম প্রথম এই ইয়ার্কিগুলো মন্দ লাগত না। সে ভাবত, তার কলিগ এই ছেলেটা নিজেকে ‘সৌপ্তিকের প্রতিযোগী’ বলে ঘোষণা করে জাস্ট মজা করছে। সে-ও হেসে জবাব দিত। অফিস-কাছারিতে ছোটখাটো ফ্লার্ট চলে। কিন্তু এখন যা দাঁড়িয়েছে, ব্যাপারটা অতটাও মজার নেই। ছেলেটা যে কাজ করতে করতে প্রায় সারাক্ষণ তাকেই নোটিশ করে যায়, ছুটির পর তার পেছন পেছন আসে, এটা শুধু সে নয়, মেহুলি, অভীপ্সা, সৌরিন্দ্র, দেবাঞ্জনাদের চোখেও পড়েছে। মেঘা আলগোছে বলল, “কী করে বুঝলে, আমি আপসেট?”
“দেখলাম তো। কাজ করতে করতে একবার মাথা ঝাঁকালে। তার পর চোখ বুজে বসেছিলে।”
“নিজের কাজটা কখন করা হয় তোমার?”
শুভায়ু সেই কথার উত্তর না দিয়ে বলল, “যাক, এতদিনে আমার টার্ন এলো।”
এই কথার অর্থ না-বোঝার মত কিছু নয়। মেঘার দারুণ বিরক্তি লাগল। সব প্রফেশনেই কিছু এইরকম মাল থাকে, যারা সারাদিন ছুঁকছুঁক করে বেড়ায়। নিজেরা বিবাহিত হোক বা না হোক, মেয়ে দেখলেই তাদের দেহের বিভিন্ন অংশে চোখ রাখবে, তাও আড়চোখে। তবুও মেঘা আন-ম্যারেড হলে একটা কথা ছিল। শুভায়ু এমনিতে দেখতে শুনতে মন্দ নয়। বড়লোক বাড়ির ছেলে। মার্সিডিজ না ঐরকম কী একটা দামি গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসে। বিয়ে করেনি এখনও অবধি। কিন্তু অফিসে তো প্রচুর আন-ম্যারেড মেয়ে আছে, তারা দেখতেও কেউ কেউ রীতিমত সুন্দরী, তাদের কাছে যা না রে বাবা, তার পেছনে কেন? কবে যেন, মিসেস চোপড়া, ইয়ার্কির ছলেই বলেছিল, ‘ম্যারেড মহিলাদের রিস্ক কম।’ শুনে গা-টা রিরি করে উঠেছিল। মেঘা যে প্রতিবাদ করেনি, এমনটাও নয়। একদিন তো রীতিমত চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “শুভায়ু, স্টপ দিস, আদারওয়াইজ আই ইউল বি কমপেল্ড টু টেক ড্রাস্টিক স্টেপ। আমার মামা লালবাজারে আছে।”
যদিও মেঘার কোনও মামা নেই, তবুও হুমকিটা কাজে এসেছিল। কিন্তু ক’দিন চুপচাপ থাকার পরে আবার যে-কে-সেই। মাঝে মধ্যেই শুভায়ু রাতে ফোন করে। কথা কিছু নেই। খালি ‘কী করছ?’, ‘ডিনার হল কিনা’ এই সব আল-ফাল কথা। ব্যাপারটা নোটিশ করে সৌপ্তিক বলেছিল, “পেটি কেস। আমাকে হ্যান্ডেল করবার পারমিশন দাও। তারপর দেখো।”
কিন্তু নিজের অফিসের মধ্যেই নিজেই একটা বিতর্কে সে জড়িয়ে পড়ুক, মেঘা নিজেই চায়নি। কিন্তু দিনে দিনে ব্যাপারটা এত সিরিয়াস দিকে টার্ন নিচ্ছে যে, মনে হচ্ছে সৌপ্তিককে হ্যান্ডওভার করেই দেবে। সৌপ্তিকের অনেক কানেকশন আছে। একবার মেঘা ভেবেওছিল ব্রাঞ্চ ম্যানেজার নিয়োগীজীর কাছে কমপ্লেইন লজ করবে কি না। শুনে সৌরসেনী ফিক করে হেসে বলেছিল, “লাভ নেই। শুভায়ু কে জানিস? মিস্টার নিয়োগীর বুজম ফ্রেন্ডের ছেলে।”
বোঝো! সৌরসেনী চোখ টিপে ফিসফিস করে বলেছিল, “র্যাদার, তুই একটু ঢিলে দে, ক’দিন ঘুরে ফিরে শপিং-মপিং করে-ফরে, ফুটিয়ে দে।”
ছিঃ! এইরকম কেউ করে?
মেঘা বলল, “শুভায়ু, আমাকে একটু ঐ দোকানে যেতে হবে। আশা করি নিশ্চয়ই তুমি ঢুকতে চাইবে না?”
দোকানটা একটা মহিলাদের অন্তর্বাসের দোকান। দোকানি মহিলা মেঘাকে ভালভাবেই চেনেন। আধা-ঘণ্টা গল্পগুজব করে দুটো ব্রা কিনে বাইরে এসে সে দেখল, শুভায়ু নেই।
আজ সারাদিন অমল কুমারকে মনেই পড়েনি, গেটের সামনে না এসে পড়া অবধি। বারান্দায় উঠে দেখল, সারা বাড়ি নিঃস্তব্ধ। এমনিতেই পাড়াটা বেশ নির্জন। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেল মেঘা। একমাত্র বারান্দার টিউবটা বাদ দিলে সারা বাড়ি অন্ধকার। সে না হয় ঘরে নেই, তাই তার ঘরের দরজা বন্ধ, কিন্তু অমল কুমারেরও দরজা বন্ধ কেন? কোথাও বেরুল নাকি? ভাল করে খেয়াল করতেই নজরে এল, অমল কুমারের দরজা একদম বন্ধ নয়, সামান্য ফাঁক আছে। আর তার মধ্যে দিয়ে, খুব ধীরে হলেও, ভেসে আসছে একটা বাঁশির আওয়াজ। বাঁশি কে বাজায়? বুঝতে পারে না মেঘা। একবার ভাবে, পাশের বাড়ি থেকে আসছে, আরেকবার ‘যাক গে’ বলে নিজের ঘরের দরজার তালা খুলতেই বাঁশির শব্দটা থেমে গেল। ও মাই গড। শ্রীমান অমল কুমারের আবার বাঁশিও আছে, সেটা আবার সে বাজাতেও পারে।
“কে?”
অমল কুমারের প্রশ্ন ভেসে এল। মেঘা প্রথমে ভাবল জবাব দেবে না। শেষে ‘অ্যাটলিস্ট ভূত নয়’ বলে মেঘা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
দুটো ঘরের মাঝের দরজাটা ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করা যায়। ছিটিকিনিটা মেঘাদের বেডরুমের দিকে। সেটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে সে টয়লেটে ঢুকে গেল।
বেরিয়ে এসে মনে হল এক কাপ চা হলে মন্দ হত না। সামান্য খিদেও পেয়েছে। এই সময়টা, একমাত্র শুক্রবারগুলো বাদ দিলে, অমল কুমারের হাতে বানানো কিছু-না-কিছু জলখাবার খাওয়াটা তাদের একপ্রকার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আজও অমল কুমারকে ডাকতে গিয়েই থমকে গেল। দরকার নেই। সে নিজেই বানিয়ে নেবে। নয়ত ‘আপনজন’ থেকে নিয়ে আসবে। সেই উদ্দেশ্যে বারান্দার দিকের দরজাটা খুলতেই চমকে গেল। ডান হাতে চায়ের কাপ আর বাঁ হাতে একটা প্লেট নিয়ে কখন নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে আছে অমল কুমার। প্লেটে ওগুলো আবার কী? লুচি আর কী একটা ভাজা! আহ। লুচি মেঘার ফেভারিট। সে উচ্ছসিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “অমন ভূতের মত কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? ডাকতে জানো না? আমি যদি দরজা না খুলতাম, তাহলে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে নাকি?”
কোনও জবাব নেই। মেঘা সরে দাঁড়াতেই অমল কুমার ভেতরে এসে হাতের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মেঘা বলল, “দাঁড়াও।”
অমল কুমার মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইল। মেঘার একবার মনে হল, সকালবেলা কথাগুলো অমন কড়া করে না বললেও হত। গ্রামের ছেলে। হয়ত সরল মনেই জানতে চেয়েছিল। পরক্ষণেই কী কারণে তার হাসি পেয়ে গেল। হাসি চেপে খানিকটা লুচি আর ভাজা মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে মেঘা বলল, “আমি কি মেয়ে দেখতে এসেছি নাকি, অমল? অমন করে নববধূ-স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
কোনও উত্তর নেই।
“তোমাকে বসাতে হলে কি আমাকে হাতজোড় করতে হবে?” মেঘা কড়া গলায় বলল।
এবার জানালার পাশে রাখা একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসল অমল কুমার। মেঘা সরাসরি জানতে চাইল, “বাঁশি কে বাজাচ্ছিল?”
“আমি।” ছোট্ট জবাব। দৃষ্টি আর মেঝের দিকে নেই, দেওয়ালের উপরে নিবদ্ধ।
“আগে কানে আসেনি তো?”
“আগেও বাজাতাম। ছোটবেলা থেকেই বাজাই। আগে সৌপ্তিকের গাড়ির আওয়াজ পেলেই থেমে যেতাম। আজ বুঝতে পারিনি।”
“থামার কী আছে? কোলকাতায় বাঁশি বাজানো ব্যানড নাকি? নাকি সৌপ্তিক মানা করেছিল?”
“তোমাদের জন্য চা-জলখাবার বানাতে হত।”
অকাট্য যুক্তি। মেঘা বেশ খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করে নিয়ে বলল, “আচ্ছা, অমল, তোমার জীবনে মা ছাড়া আর কোনও নারী আসেনি?”
পরিবেশটা হাল্কা করতেই এই প্রশ্ন, কিন্তু অমল কুমার ভয়ঙ্কর রকমের ভাবিত হয়ে বলল, “মা বাদে? হ্যাঁ, জ্যোৎস্না ঠাকুমা, রতুপিসি, বাবুর মা, নব’র শাশুড়ি, ও হ্যাঁ, আমাদের পাশের বাড়ির পদ্মদিদি আর… আর… হ্যাঁ, গোলাপি।”
নারীদের পরিচয় শুনতে শুনতে দমে যাচ্ছিল মেঘা, এবার উস্কে উঠল, “গোলাপি কে?”
এতক্ষণে যেন অমলের মুখের ভাব খানিক প্রসন্ন হল, “গোলাপি? ও তো পদ্মদিদির ছোট মেয়ে গো। এই এত্তটুকু। ভারি তরতরে মুখ। শোয়ার সময়টুকু ছাড়া আমার কাছেই থাকত। একবার কী হল…”
“থাক অমল। তোমার কাছে নারীর অর্থ যদি… বাদ দাও। লুচিগুলো ভাল ফুলকো হয়েছে। আর এই কুদলি-ভাজাটাও। আরেকদিন কোরো তো।”
অমল কুমারের মুখ কান-ছোঁয়া হাসিতে ভরে গেল, “দেখ কাণ্ড! ওটা কুদলি নয়, রূপমেঘা, আলুর খোসা ভাজা।”
মেঘার হাত থেমে গেল, “খোসা!!”
লজ্জিত গলায় অমল কুমার বলল, “আমরা গাঁ-ঘরের মানুষজন, তার উপরে গরীব। রোজ রোজ আলু-ভাজা খাওয়ার মত পয়সা কোথায়? তাই লাউয়ের খোসা, আলুর খোসা কিছুই ফেলা যেত না। মা বানাতে শিখিয়েছিল। বেশি ঝামেলা নেই। সঙ্গে শুধু এক চামচ হলুদ গুঁড়ো, এক চামচ লবণ, চার-পাঁচটা কাঁচালঙ্কা, একটু তেল, একটু চিনি আর কালোজিরা। ব্যস। হয়ে গেল।”
সব্জির খোসাও যে খাদ্যপদবাচ্য হতে পারে, এই প্রথম জানল মেঘা।
আগেকার দিনে তৈরি করা বলেই সম্ভবত সৌপ্তিকদের এই বাড়িতে ঘরের সংখ্যা কম হলেও সেগুলো সাধারণ মাপের চাইতে অনেকটাই বড়, প্রায় দ্বিগুণ। ঘরের ছাদ কড়িবরগাওয়ালা আর দেওয়াল যা মোটা, তাতে করে প্রখর গ্রীষ্মের দিনগুলোতেও তেমন গরম অনুভূত হয় না। রান্নাঘরটাও তেমনই। মেঘাদের মামাবাড়ি উত্তরবঙ্গে। ছোটবেলায় মামাবাড়িতে গিয়ে রান্নাঘর দেখে থ’ হয়ে যেত সে। এখনকার দিনে মোটামুটি দুই কামরার একটা ফ্ল্যাট তাতে ঢুকে যেতে পারে। রান্নাঘরে ছিল দুটো বিশাল মাটির উনুন আর একটা আস্ত খাট, অবশ্যই বিছানাবিহীন। মেঘার দাদু পিঁড়িতে পা মুড়ে বসতে পারতেন না বলে সেই খাটে পা ঝুলিয়ে বসে খেতেন। তার পরেও যা জায়গা বেঁচে থাকত, তাতে একসঙ্গে আট নয়জন হেসেখেলে পিঁড়ি পেতে বসে খেতে পারত।
সদানন্দ রোডের এই বাড়ির রান্নাঘরটাও অনেকটা সেই পদের। ততটা বড় না হলেও কিছু কম নয়। কোনওদিন বেডরুমের অভাব দেখা দিলে স্বচ্ছন্দে এটাকেই বেডরুম বানিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
“তুমি চিকেন নেবে না?”
মেঘা খেতে খেতে খেয়াল করছিল, ডাল, পটল ভাজা আর সিম-বেগুনের তরকারি দিয়েই পাতের ভাত শেষ করে ফেলছিল অমল কুমার। কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে জিভ কাটল মেঘা। ইসস। ভুল হয়ে গেছে।
“তুমি যে চিকেন খাও না, ভুলেই গেছিলাম। একটা ডিমসিদ্ধ করে নিলে না কেন?”
অমল কুমার খাওয়ার সময় একদম মাথা ঝুঁকিয়ে এক মনে খেয়ে যায়, আজও খাচ্ছিল, মুখ তুলে মেঘার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে বলল, “এখানে তো তবু ডিম, মাছ, মাংস খাচ্ছি, গ্রামে থাকার সময়…”
“ও কথা থাক। খেয়ে নাও। আর শোনো, কাল খুব ভোরে আমাকে ডেকে দেবে তো। একটা কাজ আজ পেন্ডিং রয়ে গেছে। কাল নিয়োগীজী আসার আগেই…”
এই অবধি বলেই মেঘার সম্ভবত খেয়াল হল, এত কথা অমল কুমারকে বলে কোনও লাভ নেই। আসলে খেতে বসে সৌপ্তিকের সঙ্গে অফিসের টুকটাক গল্প করা তার অভ্যেস।
“কী করে ডাকব?”
“মানে?”
“মানে… বাইরে থেকে ডাক দেব, নাকি দরজায় টোকা দেব?”
মেঘার মনে পড়ল, কোনওদিন অফিসে আর্জেন্ট কাজ থাকলে সৌপ্তিকই তাকে ডেকে দিত। তারপরে অবশ্য মিনিট পাঁচেক হাল্কা আদর-টাদর করে তবে ছাড়ত।
“দুটোই, দুটোই। আমি সাড়া না দেওয়া অবধি।”
“তোমার মোবাইল আছে না?”
মেঘা চমৎকৃত হল। মোবাইলে যে অ্যালার্ম ক্লক বলে একটা বস্তু আছে, সেটা ভুলে গেল কী করে? তার মনে নেই, অথচ যার মোবাইল নেই, সে মনে করে বসে আছে। মেঘা বলল, “সে থাকুক, তোমাকে ডাকতে বলেছি, তুমি ডাকবে।”
“কটায়?”
“ঠিক ছ’টায়। তুমি আবার ঘুমিয়ে থাকবে না তো?”
অমল কুমার হাসল, “আমার ঘুম ভাঙে চারটে, সাড়ে চারটেয়। খুব দেরি হলে পাঁচটা। কোনও চিন্তা নেই। সকালে জলখাবারে কী খাবে?”
মেঘা ভেবেছিল, খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বে, নইলে সকালে ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু সৌপ্তিকের হোয়াটস-অ্যাপের অপেক্ষা করছিল সে। সেই মেসেজ যখন ঢুকল, তখন রাত ঠিক একটার সামান্য পরে। ছোট্ট মেসেজ, ‘প্লেন ল্যান্ড করেছে। কাল কথা হবে। গুড নাইট ডার্লিং।’
মোবাইল রেখে সবে চোখ বুজেছে মিনিট পাঁচেকও হয়নি, বারান্দামুখী দরজায় টকটক শব্দ। চোখ খুলে গেল মেঘার। কে শব্দ করে? তবে কি সকাল হয়ে গেল? মোবাইল দেখল সে। রাত একটা বেজে দশ। বাইরে থমথম করছে রাত। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? নাহ, আবার শব্দ হল দরজায়। মেঘা বুঝল বারান্দার দরজা নয়, শব্দটা আসছে ভেতরের ঘরের দরজার ওপাশ থেকে। অমল কুমার? আচমকা একটা অজানা ভয়ে মেঘা কেঁপে উঠল। কাঁপা গলাতেই প্রশ্ন করল, “ক্কে?”
আওয়াজ ভেসে এল, “রূপমেঘা।”
অমল কুমার! এত রাতে দরজায় শব্দ করছে! শয়তান!! কড়া হতে গিয়ে গলাটা বিকৃত হয়ে গেল মেঘার, “কী চাই?”
“দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছ। ছিটকিনিটা আটকে দিও।”
বিদ্যুৎগতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে পর্দা সরিয়ে মেঘা দেখল, সত্যিই, ছিটকিনি নামানো। সশব্দে ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে বিছানায় ফিরে এসে একপ্রকার হাঁপাতে লাগল সে। জলের গ্লাস তুলে খানিকটা জল খেল। মিনিট পাঁচেক পরে নিজেকে একটু শান্ত মনে হতেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। টের পেল, আসলে দারুণ ভয় পেয়েছিল সে। অমল কুমার আসলে কে? অথবা কী? নিতান্তই গোবেচারা ভাল মানুষ একজন? নাকি মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখা আসলে আস্ত একটা শয়তান? ভাই তো শুধু সম্পর্কেই, আসলে তো সৌপ্তিকের সঙ্গে অমল কুমারের কোনও রক্তের সম্পর্কই নেই। অতএব? মাঝের দরজা খোলা, পাশের ঘরে একজন পূর্ণযুবতী একা। অমল কুমারের জায়গায় শুভায়ু হলে কী করত? একটু আগের ঘটনাটা কী ছিল? অমল কুমারের এত ভাল ব্যবহারের পেছনে মতলবটা আসলে কী? একটু একটু করে মেঘার বিশ্বাস অর্জন করে তারপর একদিন…। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল মেঘা।
সৌপ্তিক চলে গেছে আজ দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। এই চোদ্দ দিনে, যতক্ষণ মেঘা বাড়িতে থাকত, অমল কুমারকে অনেকবার আড়চোখে খেয়াল করে গেছে। কিন্তু সেই রাতের তিলমাত্র প্রতিক্রিয়াও তার হাবেভাবে বা কথাবার্তায় চোখে পড়েনি। রোজকার মতই অমল কুমার বাজারে গেছে, রান্না করেছে, মেঘার মুখের সামনে চা-জলখাবার, ব্রেকফাস্ট, ডিনার ধরেছে, মেঘার অনুপস্থিতিতে ঘর গুছিয়েছে, বারণ করা সত্ত্বেও তার জামাকাপড় ধুয়ে পাটপাট করে ইস্ত্রি করে বিছানার উপরে সাজিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে বাগানের পরিচর্যা করতেও ভোলেনি। মেঘা অবশ্য অফিস যাওয়ার আগে, মনে করে নিজের অন্তর্বাসগুলো, আলমারিতে তুলে রেখে যায়। ইচ্ছে আছে, শুক্রবার সেগুলো নিজের হাতে ওয়াশিং মেশিনে কেচে নেবে। এরই মধ্যে বার দশেক সৌপ্তিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, বার সাতেক ভিডিও কল করেছিল। সৌপ্তিক তাকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নত্রে-দাম ক্যাথিড্রাল দেখিয়েছে, ভউবেন ব্যারেজ দেখিয়েছে, সেন্ট টমাস চার্চ দেখিয়েছে, তকতকে পাথুরে রাস্তাঘাট দেখিয়েছে, আরও কত কী। সঙ্গে অবশ্য এটাও শুনিয়েছে, ফরাসি মেয়েগুলো নাকি দারুণ সেক্সি, ফলে আদৌ সে দেশে ফিরতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সবটাই মজা, এটা মেঘা জানে। তাই সে-ও শুনিয়েছে, ইতিমধ্যেই সে নাকি দু-চারটে প্রোপোজাল পেয়েছে, তাদের একজন আবার লন্ডন-নিবাসী। সঠিক তারিখে সৌপ্তিক না ফিরে এলে, সে-ও পা বাড়াবে লন্ডনের পথে। স্বভাবজ ভঙ্গিতেই, বাতাস কাঁপিয়ে দারুণ হেসেছে সৌপ্তিক।
সবই ঠিক আছে। কিন্তু সর্বদাই একটা খচখচানি কেন যে মগজের ভেতরে ক্রমাগত সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে, নিজেই বুঝতে পারে না মেঘা। অমল কুমার কি আগের মতই আছে? নাকি একটু হলেও বদলেছে? আজকাল সে একটু বেশিই ফিটফাট থাকে না? আগেকার মত পায়জামা অতটা উঠিয়ে পরে না তো? সে বরাবরই ফুলহাতা জামা পরে, ইদানিং হাতা গুটিয়ে রাখাটা অভ্যেস করেছে না? আগে কি রোজ ও শেভ করত? আসলে অমল কুমারের দিকে তেমন মনোযোগ দেওয়ার সময়, প্রয়োজন বা ইচ্ছে কোনটাই আগে ছিল না। ফলে মেঘা বিভ্রান্ত হয়। এই তো সেদিন অফিস থেকে ফিরেই দেখল, বেড-সাইড টেবিলে একটা নতুন বস্তু সংযোজন হয়েছে। সেটা হচ্ছে একটা ফুলদানি। জিনিসটা দেখেই চিনতে পারে সে। বিয়েতে পেয়েছিল, কিন্তু শো-পিস হিসেবে মনঃপুত হয়নি বলে, আলমারির পেছনে জিনিসটা এতদিন ধুলো আর ঝুল জমা করছিল। সেই বস্তুটা এখন ধুয়েপুঁছে টেবিলের উপরে বিদ্যমান আর শুধু তাই নয়, দিব্যি এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা তাতে শোভা পাচ্ছে। রজনীগন্ধা! তার জন্য বাজার থেকে কিনে এনেছে নাকি অমল কুমার? অমল কুমারের সাফাই একদম নির্ভেজাল। বাড়ির পেছনের বাগানের ফুল, অনেকদিন সেদিকে যায়নি বলে মেঘার নজরে আসেনি।
কিন্তু আজকাল ভাত রাঁধলে যে রকম গন্ধ বেরোয়, বোঝাই যায় দামি চাল রাঁধছে অমল কুমার। বাসমতী কি? সৌপ্তিক থাকার সময়েও কি একই চালের ভাত হত? কিছুতেই মনে করতে পারে না মেঘা। সৌপ্তিক ঝাল একদম খেতে পারে না। তাই আলাদা করে পাতে লঙ্কা ডলে নিতে হত মেঘাকে। গত সপ্তাহের শুক্রবারের দুপুরে মোচার ঘণ্টতে যে পরিমাপ ঝালের আস্বাদ সে পেয়েছিল, মেঘার টেস্টবাডগুলো যেন অ্যাদ্দিনে আরাম পেয়েছিল, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও খেয়াল করেছিল, অমল কুমার সামান্য হিস হিস শব্দ করছে। মনে পড়েছিল, সে শুনেছিল বটে, গ্রামের ছেলে হলেও সৌপ্তিকের মতই অমল কুমারও ঝাল খেতে পারে না। সেইদিন থেকে সামান্য ঝাঁঝালো খাবারদাবারই রান্না করে আসছে অমল কুমার। তবে কি এই বদান্যতা শুধু মেঘার জন্যই? কবে যেন অমল কুমার চা দিতে তার ঘরে আসায় একটা মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল মেঘা। অমল কুমার পারফিউম ইউজ করেছে? কিন্তু এই স্মেলের পারফিউম তো সৌপ্তিকের নয়। তবে কি সে নিজে কিনে এনেছে? কেন? এটাই তো শেষ নয়। গত পরশুর আগেরদিন অফিসের বেরোনোর আগে অমল কুমার বলল, রোজ রোজ অফিসের ক্যান্টিনের খাবার না খেয়ে যেন লাঞ্চবক্সে করে বাড়ির খাবার নিয়ে যায় সে। প্রস্তাবটা মন্দ নয়, কারণ ক্যান্টিনের মধুদা তেল আর ঝালের ভারসাম্যটা এতদিনেও বুঝল না। কিন্তু চমকটা তো অন্য জায়গায়। সৌপ্তিকও তো অফিসেই লাঞ্চ সেরে নেয়। তাকে তো কোনদিনও এমন অফার করেনি অমল কুমার। শুধু মেঘার জন্য? কেন? কী উদ্দেশ্যে? ভাবতে ভাবতে অফিসের কাজে একটা মারাত্মক ভুল করে বসতে যাচ্ছিল মেঘা, কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়েছিল।
সেদিন ছিল রবিবার। অফিসে যেতেই ঘোষণা কানে এসেছিল খবরটা। জিএম আসছেন চেন্নাই থেকে। আসছে বৃহস্পতিবার। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সাজো সাজো রব পড়ে গিয়েছিল অফিসে। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সব্বাই। কাজ থেকে পোশাক, ডেকোরেশন থেকে ম্যানারিজম, কোথাও এক ফোঁটাও খুঁত সহ্য করতে পারেন না জিএম মশাই। তাই ব্যস্ত ছিল শুভায়ুও। সারাক্ষণ ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের পিছু পিছু ঘুরতে দেখা যাচ্ছিল তাকে। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে, শুভায়ুর যা পারফরমেন্স, সম্ভবত আসছে বছর সে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হতে চলেছে। শুনে মেঘা খুশি হয়েছিল। কারণ এই তিনদিন তাকে অলটাইম ফলো করবার চান্স পাবে না ছেলেটা। নিশ্চয়ই পদোন্নতি ঘটলে আরও পাবে না।
কিন্তু হায় রাম। আজ বুধবার। বেরোতে দেরি না হলেও, বেরিয়েই মেট্রো না ধরে একটা অ্যাপ-ক্যাব বুক করেছিল মেঘা। উদ্দেশ্য ভবানিপুরের একটা শপিং মলে ঢুকে কিছু ড্রেস-মেটেরিয়াল কেনে। ম্যাট-ফিনিশের লিপস্টিকটাও ফুরিয়ে এসেছে, সঙ্গে দু’চারটে জাঙ্ক-জুয়েলারি না কিনলেই নয়। হয়ত চার-পাঁচদিন পরে হলেও চলত, কিন্তু কালকের বিশেষ দিনটার কথা মাথায় থাকায় আর স্টকে কোনও আনকোরা নতুন ড্রেস আছে কি না মনে করতে না পারায়, এই সিদ্ধান্ত।
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, আচমকা কানের পেছন থেকে কে বলে উঠল, “গুড ইভনিং, ম্যাডাম।”
আবার শুভায়ু! ছিনে-জোঁকের উপমাটা সে শুধু শুনেই এসেছে, চোখে কোনদিনও দেখেনি। এখন মনে হল সাক্ষাত একটি ছিনে-জোঁক তার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলাচ্ছে। সে বলল, “বাড়ি ফিরছ? তো গাড়ি কোথায়?”
“আরে না, আমার ফিরতে ফিরতে এখনও ঘণ্টা দেড়েক। বাট ইউ নো, স্মোকিং-হ্যাবিট ইজ ভেরি ব্যাড। হাউএভার একটা ধরাচ্ছি, কেমন? তুমি তো নিশ্চয়ই হ্যাবিচুয়েটেড? আফটার অল মাই কমম্পিটিটর ইজ অলসো আ স্মোকার। হাহাহা।”
মেঘা কোনও জবাব দিল না। একমনে মোবাইল দেখতে লাগল। ক্যাবটা আসতে এত দেরি করছে কেন? ততক্ষণে শুভায়ু একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে শুরু করেছে, “একদিন বাড়িতে ডাকো।”
“পারপাস?” শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় মেঘা।
“বাহ। চিয়ার্স করতে হবে না? মানে মদিরা না হোক, এক কাপ চা-ই খাইও না হয়।”
“এত আনন্দের কারণ?” মেঘার চোয়ালের হাড় শক্ত হয়।
“আমার প্রোমোশনের কথা চলছে। ভাবছি, প্রোমোশনটা পেয়ে গেলে তোমাকে আমার অ্যাসিস্টেন্ট করে নেবো। প্রাইভেট চেম্বার। হাউ ইজ ইট?”
স্তম্ভিত হয়ে গেল মেঘা। তলে তলে এতটা ভেবে ফেলেছে ছেলেটা? নাহ, এইবার কিছু একটা করতেই হবে। আর কিছু না পারুক, চাকরিটা তো ছেড়ে দিতে পারবে।
নিজস্ব কেনাকাটা শেষ করে দাম মিটিয়ে বেরোবার আগে জেন্টস সেকশনের দিকে নজর গেল মেঘার। সৌপ্তিকের জন্য একটা শার্ট কিনবে? নাহ, থাক। সৌপ্তিক যা হাত-খোলা মানুষ। নিশ্চয়ই আসার সময় এক্সট্রা ব্যাগেজ ভর্তি করে তার আর মেঘার জন্য রাজ্যের জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে। আচমকাই অমল কুমারের মুখটা ভেসে উঠল। ওর জন্য একটা শার্ট নেওয়া যেতে পারে কি? নাকি আলমারিতে সৌপ্তিকের এখনও না-ব্যবহার করা যে খান-পাঁচেক শার্ট রয়ে গেছে, তার থেকে একটা দিয়ে দেবে? সেই ভাল।
মুখ ঘোরাতে গিয়েও মেঘা থমকে গেল। সে হাতে করে শপিংমলের ছাপ্পা-মারা অন্তত চার-পাঁচটা প্যাকেট নিয়ে বাড়িতে ফিরবে। অমল কুমারের চোখের সামনে দিয়েই ঢুকবে। সেটা ঠিক হবে কি? অমল কুমার সরল প্রকৃতির হতে পারে, তবে বোকা হাঁদা নয়। মেঘা খানিক কী ভাবল। অমল কুমারের একটা ভাল জামা নেই, তাই না? সে গ্রাম থেকে যা নিয়ে এসেছিল, তা তো এমনিতেই পাতে দেওয়ার মত ছিল না। সৌপ্তিক সব দেখে শুনে তিন সেট নতুন গেঞ্জি-পায়জামা-জাঙ্গিয়া আর গোটা দুই ফুলহাতা জামা, শেভিং-সেট ইত্যাদি কিনে এনে দিয়েছিল। মেঘা ঠোঁট কামড়াল। সৌপ্তিকের শার্ট অমল কুমারকে দিয়ে দেওয়ার কথা একটু আগেও তার মাথায় এসেছিল, এখন নিজেই ক্যান্সেল করল। সব ক’টা শার্টই সে নিজে পছন্দ করে কিনেছিল সৌপ্তিকের জন্য, সেগুলো হাতে ধরে অমল কুমারকে সে কিছুতেই দিতে পারবে না।
নেবে শার্ট? কি নেবে না? যে দুটো শার্ট অমল কুমারকে সৌপ্তিক দিয়েছিল, সেগুলো ধুতে ধুতে সুতো বেরিয়ে গেছে। আহা, মেঘা হয়ত অমলকুমারের অন্তর্বাস কিনতে পারবে না, তবে শার্ট তো কিনতেই পারে। খানিক ভেবেচিন্তে দুটো শার্ট নিয়েই নিল সে। একটা হোয়াইট-গ্রে চেকড, আরেকটা ডিপ ব্লু কালারের। অমল কুমারের গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। মানাবে ভাল। কিন্তু পাতলুন? এতদিন অমল কুমারের পাতলুন কেনার দরকার পড়েনি, কারণ তার বাড়ির বাইরে যাওয়া মানে তো শুধু কাছের দোকান আর বাজার। একটা পাতলুন নেবে? হয়ত লোকসমাজে যাওয়ার তার দরকার পড়বে না, তবুও। সাত পাঁচ ভেবে সে একটা নিয়ে নিল। মাপ তো সৌপ্তিকের মাপেরই। কিনে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠল মেঘা। অমল কুমার নিশ্চয়ই চমকে যাবে।
সবই তো হল। এক জোড়া চপ্পল নেওয়া যেতে পারে কি? খানিক ভেবে মত বদলাল সে। নাহ, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে সেটা।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ন’টা পার হয়ে গেল। বাড়ির সামনে অ্যাপ-ক্যাবটা দাঁড়াতেই অমল কুমার যেন দৌড়ে এল, “কোথায় গিয়েছিলে?”
মেঘা ভারি অবাক হয়। অমল কুমারের চোখমুখে স্পষ্টত উৎকণ্ঠা। সে বলল, “কেন? কী হয়েছে? কোনও প্রবলেম?”
ততক্ষণে নিজে সামলে নিয়েছে অমল কুমার। ভাল করে মেঘাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল, “না, এত দেরী তো হয় না।”
অমল কুমারের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল মেঘা। এমন নয় যে সব দিনই মেঘা সৌপ্তিকের আগে বাড়িতে ফিরেছে। হয়ত কোনও কোনও দিন অফিসের কাজে বা বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়ার কারণে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে মেঘার। এসে দেখেছে, সৌপ্তিক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দিব্যি ঠ্যাঙয়ের উপরে ঠ্যাঙ তুলে মোবাইল দেখছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আচমকা মনে পড়ল মেঘার, তাই তো। যে ক’দিন সৌপ্তিকের পরে সে বাড়ি ফিরত, একটা আবছায়া মূর্তিকে যেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত বটে। মেঘা জানত সে অমল কুমার, কিন্তু কোনও কাজে বারান্দায় এসেছিল ভেবে আর গা করেনি। কিন্তু এখন? তার বাড়ি ফিরতে ঘণ্টা কয়েক দেরি হয়েছে বলে অমল কুমার টেনশন করছিল? এর মানে?
সে একটা প্যাকেট অমল কুমারের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “অত চিন্তার কিছু নেই। আমি বাচ্চা মেয়ে নই। হারিয়ে যাব না। এটা ধরো। কিছু ড্রেস-মেটেরিয়াল আছে। এগুলো পরবে। যেগুলো অলরেডি আছে, সেগুলো ধুয়ে ব্যাগে পুরে ফেলো, আর পোরো না।”
কিছুক্ষণ বাদে, ফ্রেশ হয়ে, মাঝের ঘরের পর্দা সামান্য সরিয়ে উঁকি মেরে মেঘা দেখতে পেল, ঘরের মাঝখানে অমল কুমার নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা সেই প্যান্ট আর শার্ট দুটো। অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে। দেখেই যাচ্ছে। মেঘা সরে এল। অমল কুমার তাহলে কি সত্যিই একজন ভাল মনের ছেলে? তার জন্য টেনশনে ঘর-বার করছিল? কিন্তু মানুষ যাকে একমাত্র খুব কাছের জন মনে করে, তার সম্পর্কেই তো এত চিন্তা-ভাবনা করে। আর চোখ, ওর চোখ দুটো? ছেলেদের চাইতে মেয়েদের চোখ হাজার গুণ ক্ষমতাশালী, অন্যের চোখের ভাষা পড়ে নেওয়ার জন্য। অমল কুমারের চোখ দুটো কী শান্ত, কী সমাহিত, কী নিস্পাপ। তবে কি… তবে কি…। মেঘা কোথায় যেন পড়েছিল, যারা ভীষণ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে, তাদের চোখও এমন শান্ত হয়। দূর বাবা! মেঘা নিজের উপরে বিরক্তিতেই যেন চেঁচিয়ে উঠল, “আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে। খেতে দেওয়া হবে কি?”
কী কারণে গত মাসে মেঘার পিরিয়ড হয়নি। সৌপ্তিককে জানানোই যেত, কিন্তু বললেই গুড নিউজ ভেবে সে লাফাতে শুরু করে দেবে। আগে থেকেই সেই কারণে একটা ইউরিন-টেস্ট কিট কিনে বাড়িতে রেখে দিয়েছিল সৌপ্তিক। সে অন্তত কনসিভ করেনি, সেটা বোঝার পরেই সৌপ্তিক না জানিয়ে ডক্টর ম্যাডামের সঙ্গে কনসাল্ট করেছিল মেঘা। ডক্টর ম্যাডাম জানিয়েছিলেন, পরের মাসটা দেখতে। এটা এমন কিছু আনন্যাচারাল ব্যাপার নয়। অনেক সময় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণেও হতে পারে। পরের মাসেও ইর-রেগুলার হলে তখন দেখা যাবে।
রাত থাকতেই টের পেয়েছিল মেঘা, সম্ভবত আগামিকাল অঘটন ঘটতে চলেছে। ঠিক তাই। শেষ রাত থেকে শুরু হল ব্লিডিং আর তার সঙ্গে অসহ্য ব্যথা। কোনওমতে বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারি থেকে প্যাড বের করে চেঞ্জ করে নিয়েছিল সে। উফ। এত ব্যথা তো তার হয় না। কোমর থেকে সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যেন ব্যথাটা। সারা শরীরটা যেন অবশ হয়ে আসতে চাইছে। এই সময়টা সৌপ্তিককে খুব মিস করছে মেঘা। সে থাকলে হট-ওয়াটার ব্যাগটা চেপে ধরত তলপেটে।
বাকি রাতটা দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না মেঘা। সকাল হতেই বুঝল, আজ কিছুতেই অফিস যাওয়া সম্ভব নয়। সে কোনওমতে টয়লেট থেকে ফিরে বিছানায় ফের শুয়ে পড়তে যাচ্ছে, ভেতরের দরজায় টোকার শব্দ, “রূপমেঘা, চা।”
মেঘা ঠোঁট কামড়াল। উফফ! এই এক যন্ত্রণা হয়েছে। নীরবে বিছানায় পড়ে থাকবে, তারও উপায় নেই। কিন্তু এক কাপ গরম চায়ের কথা মনে পড়তেই সে কোনওমতে ছিটকিনি নামিয়ে ফিরে এল বিছানায়।
“কী হয়েছে?”
ধূমায়মান চায়ের কাপ রেখেই ঘুরে দাঁড়াল অমল কুমার, “শুয়ে পড়লে যে? স্নানে যাবে না? ওদিকে আমার শুধু মাছের ঝোলটা বাকি।”
এই সময় কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না। কোনওমতে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে মেঘা বলল, “আজ অফিসে যাব না। আর যাই বা না যাই, তোমার এত মাথাব্যথা কেন?”
কিছুক্ষণ মেঘাকে দেখে নিয়ে অমল কুমার বলল, “তুমি তো কামাই করো না, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। আজ তো শুক্রবারও নয়। কোথাও লেগেছে নাকি? পড়ে গিয়েছিলে?”
“নাহ। তুমি যাও তো।”
“সে যাচ্ছি, কিন্তু তোমার মুখ-চোখ দেখে আমার ভাল লাগছে না। পেটে ব্যথা হচ্ছে?”
মেঘা কোনও জবাব দিল না। নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিল। অমল কুমার বলল, “নিশ্চয়ই পেটে গণ্ডগোল হয়েছে। ইসস। আগে জানলে থানকুনি পাতা দিয়ে ঝোলটা করতে পারতাম।”
মেঘা কী একটা উত্তর দিতে গিয়েও পারল না। ‘মা গো’ বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অমল কুমার বলল, “কদ্দিন বলেছি, বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে যাও। অফিসে কী না কী তেল দিয়ে রান্না করে।”
যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল মেঘার, “তোমায় কে বলল, অফিসে খাবার খেয়ে আমার শরীর খারাপ হয়েছে?”
“তা নয়ত কী? বাড়ির খাবারে গোলমাল হলে আমারও হত। লোকে বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। এটা যে কত বড় মিছে কথা, সে আমাকে বলেছিল পদ্মদিদি। দাঁড়াও। ঝোলটা নামিয়ে আমি একটু ঘুরে আসছি।”
“কোথায় যাবে?”
“ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি। নইলে এভাবেই শুয়ে শুয়ে কাতরাবে নাকি?”
“উফ। প্লিজ। কাউকে ডাকতে হবে না।”
বলেই মেঘা পাশবালিশটা দুই পায়ের মাঝখানে চেপে ধরে কাত হল। বুঝতে পারল, নিঃশব্দে তাকে কিছুক্ষণ দেখে অমল কুমার বেরিয়ে গেল। মেঘা প্রমাদ গুনল। একে তো আর বলে যায় না, তার কী প্রবলেম হচ্ছে। আবার ডাক্তার-ফাক্তার ডেকে নিয়ে এলেই হয়েছে আর কী। একটা ইবুপ্রোফেন টাইপের ট্যাবলেট পেলে কাজ হত। একটা কাগজে লিখে অমল কুমারকে ফার্মেসিতে পাঠাবে? ও নিশ্চয়ই অতশত বুঝবে না।
“ধরো।”
সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল মেঘা, চটকা ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখে সামনে অমল কুমার। বিরক্ত হতে গিয়েও থমকে গেল সে। অমল কুমারের হাতে হট-ওয়াটার ব্যাগ! ও জানল কী করে!! অমল কুমার বলল, “এটা নাও। উপকার পাবে। আর দুটো ওষুধ নিয়ে এসেছি দোকান থেকে। দেখো, যদি… আর তুমি কি দুধ খাও রূপমেঘা? আমি যেমন খুব ভালবাসি।”
স্মিত হাসল অমল কুমার। মেঘা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে অমল কুমার ফের হাসল, “আমার পদ্মদিদির যখন খুব ব্যথা উঠত, তখন মাকে দেখেছি ডেকচি করে গরম জল নিয়ে যেতে। অনেক পরে আমি করে দিতাম। পদ্মদিদিরা তো খুব গরীব। একা গোলাপিকে নিয়ে যে কী ভাবে দিদির দিন কাটাত। কোনদিনও খেয়ে, কোনদিনও না খেয়ে…। তারপর একদিন মা বিছানায় পড়ল। তখন আমাকেই রান্না-বান্না সব কিছু করতে হত। পদ্মদিদিরা না খেয়ে আছে, জানতে পারলেই, আমি খাবার দিয়ে আসতাম ওদের। এই ব্যথা তো সব বৌ-ঝিদেরই হয়, তবে আমার পদ্মদিদির ছিল যেন একেবারে মাত্রাছাড়া। কাটা পাঁঠার মত ছটফট করত। যাক গে যাক, অনেক বাজে কথা বলে ফেললাম। কী যেন… ও হ্যাঁ, দুধ নিয়ে আসছি।”
হট-ওয়াটার ব্যাগটা তলপেটে চেপে ধরে আরামে যেন চোখ বুজে আসছিল মেঘার, সে মিনমিন করে বলল, “আমি দুধ খাই না, গন্ধ লাগে।”
“লাগুক। কিন্তু দুধ দিয়েই এই ওষুধটা খেতে হবে। আমি কোনও আপত্তি শুনব না, এই বলে রাখলাম।”
হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেল অমল কুমার। মেঘা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানালার দিকে। তারপর চোখ বন্ধ করল। দু ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে নামল কোল বেয়ে।
কথায় বলে বিপদ কখনও একা আসে না। আজ প্রায় সারাদিন অমল কুমার ঘুরে ঘুরে এসেছে তার কাছে। বারে বারে হট-ওয়াটার ব্যাগ ভর্তি করে গরম জল নিয়ে এসেছে। লাঞ্চ, ডিনার ঘরেই সার্ভ করেছে। হাত ধোয়ার জন্য বাটিতে করে জল নিয়ে এসেছে। রাতে ডিনারের পর একবার কপালে হাত ছোঁয়াতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিয়েছে সে, খেয়াল করে মনে মনে হেসেছে মেঘা। বলেছে, “নাহ। জ্বর আসেনি। হাউএভার থ্যাঙ্কিউ।”
অমল কুমারের মুখ নিমেষে গম্ভীর হয়েছে। সেটা খেয়াল করে মেঘা বলেছে, “আরে ওটা এমনিই বললাম। অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে তুমি যা করলে, সত্যিই ভাবতে পারিনি। আচ্ছা, এবার তুমি যাও। আমি শোবো।”
“সে ঠিক আছে। আগে কলঘর থেকে ঘুরে এস। একা একা পারবে? নাকি…”
মেঘা হেসেছে, “আরে, এত কিছু জেনে বসে আছ, আর এটা জানো না, এইসব মেয়েদের অভ্যেসের ব্যাপার। প্রত্যেক মাসের ব্যাপার। তা ছাড়া আমি ল্যাংড়া হয়ে পড়িনি।”
যেন কতকটা নিজেকে প্রমাণ করবার জন্যই সে টয়লেটের দিকে পা বাড়াল এবং তখনই বিপদটা ঘটল। আচমকা মাথাটা যেন বোঁ করে ঘুরে গেল মেঘার। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে খাটের বাজুটা ধরে ফেলতে চাইল, কিন্তু ততক্ষণে পায়ের নিচ থেকে পাপোষ গিয়েছে পিছলে। মেঘা উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যে তার মাথাটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে আছড়ে পড়তে যাচ্ছে, সেটাও বুঝে গিয়েছিল, অমল কুমার ধরে ফেলল শক্ত হাতে। নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা।
“বোঝ কাণ্ড! তখনই বললাম, পারবে না। তুমি এত জেদি কেন, রূপমেঘা?”
অমল কুমার আরও কী কী সব বলে যাচ্ছিল, মেঘার কানে ঢুকছিল না। তার গোটা গা-টা যেন থরথর করে কাঁপছিল। মোক্ষম সময়ে অমল কুমার ধরে না ফেললে, তার চোখ দুটো, নয়ত নিদেনপক্ষে দাঁতের পাটি খুলে হাতে চলে আসত, বুঝতে পেরেই হয়ত।
মিনিট খানেক পরে ধাতস্থ হয়ে চোখ খুলতেই সামনে অমল কুমারের উদ্বিগ্ন মুখ। সে বলল, “শিক্ষে হয়েছে? উফ। সৌপ্তিক চলে এলে যেন আমি বাঁচি।”
ওর কথার ধরনে মেঘার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু ওদিকে এখনই টয়লেটে না গেলে নয়। সে বলল, “এবার আমি পারব।”
“খুব হয়েছে। আমার হাত ধরো।”
এই কথা অমল কুমার অন্য সময় বললে মেঘার মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হত জানা নেই, কিন্তু এই মুহূর্তে একটা পুরুষালি হাতের বড্ড প্রয়োজন অনুভব করছিল মেঘা। সে দু’বার ভেবে নিয়ে হাত বাড়াল।
টয়লেট থেকে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তেই একটা চাদর টেনে তাকে ঢেকে দিয়ে অমল কুমার বলল, “রূপমেঘা।”
“উঁ?”
“তুমি চাইলে সৌপ্তিকের কাছে থেকে অনুমতি নিতে পার, কিন্তু আমি আমার ভাইকে চিনি। সে এখানে থাকলে সেটাই করত।”
“কী বলতে চাইছ?”
“আজ মাঝের দরজাটা আটকিও না। আমার ঘুম পাতলা। রাতে উঠলে আমাকে একবার ডাক দিলেই আমি জেগে যাব।”
“কিন্তু…”
“মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। আমার পদ্মদিদি বলত।”
গম্ভীর গলায় কথাটা বলেই অমল কুমার নিজের ঘরে চলে গেল। ব্যথাটা কি আবার চেপে আসছে? বুঝতে না পেরে বালিশে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল মেঘা। একটা ঘুম, নিশ্ছিদ্র একটা লম্বা ঘুম তার চাই। ঠিক সেই সময়ে মনে পড়ল, আজ সারাদিন সৌপ্তিক তাকে একবারও ফোন করেনি। কেন?
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল মেঘার। আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে তাকাল মাঝের ঘরের দরজার দিকে। দরজা খোলা কিন্তু পর্দা টানা। ওদিকের ঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে অমল কুমার ঘুমোয়নি? কিন্তু কেন? মেঘা কী একটা ভাবনা চাপতে গিয়েই বুঝল চোখ দুটো জ্বালা করে উঠছে। সে মনে মনে বলল, অমল কুমার, তুমি এত সব কেন করছ? এর তো কোনও নির্দিষ্ট পরিসমাপ্তি নেই, কোনও ফলাফলও নেই। তবে? তুমি কি আমাকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলছ? ভুল, ভুল, খুব ভুল করছ তুমি অমল কুমার, দারুণ একটা ভুল করতে চলেছ। প্লিজ, কাল থেকে এইসব কোরো না। প্লিজ তুমি দুর্বল হয়ে পোড়ো না। তাতে আমার কিছু হবে না, কিন্তু তোমার নিজের জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে।
ইচ্ছে থাকলেও পরের দিনও অফিসে যেতে পারল না মেঘা। আজ ব্যথাটা থাকলেও সেটা সহনশীলতার মধ্যে। দুপুরে লাঞ্চের পরে অমল কুমারকে ডেকে নিল মেঘা। মনটা বিশেষ ভাল নেই তার। সৌপ্তিকের কোনও ফোন তো আসেইনি, আবার মেঘা ফোন করে দেখেছে, ফোন নট-রিচেবল। মেঘার আপসোস হল। এমন জানলে সৌপ্তিকের সঙ্গে যারা গেছে, তাদের ফোন নাম্বারগুলো নিয়ে রাখতে পারত। একবার সৌপ্তিকের অফিসে ফোন করে দেখবে? ওদের অফিসের ল্যান্ডলাইন নাম্বারটা তো আছেই। খানিক ভেবে সেটা ক্যান্সেল করল। সৌপ্তিকের নতুন চাকরি। ফোন করে খবর নিলে কী হতে কী হয়ে যাবে।
দুপুরটা ভারি দীর্ঘ মনে হচ্ছে। শেষ শুক্রবারগুলো সে নিজের অন্তর্বাসগুলো কাচাধোয়া, ঘর গুছোনো, হাল্কা শপিং করে কাটিয়েছে। এখন শরীরের যা অবস্থা, গা নাড়িয়ে কিছু করতেও ইচ্ছে করছে না। আর এক হয়েছে অমল কুমার। তাকে কুটোটি নাড়তে দিচ্ছে না। মেঘা অনুভব করতে পারছে গত কালের পর থেকে অমল কুমারের প্রতি তারও মনে একটা সফট কর্নার তৈরি হয়েছে। এটা সত্যি, অমল কুমার না থাকলে কাল যে কী হত।
“এখনই চা খাবে? এই তো ভাত খেয়ে উঠলে।” অমল কুমার এসে দাঁড়িয়েছে।
মেঘা অল্প হাসল, “নাহ, কাল থেকে এত ঘুমিয়েছি যে, আর ঘুমোতে পারছি না, বাবা।”
“বই পড়বে? আমার কাছে রামকৃষ্ণ কথামৃত আছে।”
মেঘা চমৎকৃত হল। অমল কুমার রামকৃষ্ণ পড়ে? সে বলল, “কিচ্ছু লাগবে না। তুমি বোসো তো।”
অমল কুমার আজ আর সঙ্কোচ করল না, সহজভাবেই বিছানার কাছে একটা চেয়ার টেনে নিল। মেঘা বলল, “তুমি বাঁশি বাজাতে শিখেছ কার কাছে?”
অমনি একগাল হেসে ফেলল অমল কুমার, হয়ত খানিকটা লজ্জাও পেল। মেঘা খেয়াল করেছে, হাসলে অমল কুমারকে ভারি নিস্পাপ লাগে। এই মানুষটাকে নিয়ে সে না জানি কী দুশ্চিন্তাই করেছে। বিশেষ করে সৌপ্তিক যখন তাকে অমল কুমারের সঙ্গে রেখে চলে গেল, কী ভয়টাই না সে পেয়েছিল। সৌপ্তিকের নির্বুদ্ধিতার নিন্দাও করেছিল। এখন মনে মনে সৌপ্তিকের সিদ্ধান্তকে ধন্যবাদ জানাল সে। প্রশ্নটা করেই সে কিছুক্ষণ অমল কুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েরা সম্ভবত যুগে যুগে এমন পুরুষের সঙ্গই চেয়ে এসেছে। মেঘা নিজে জানে সে যথেষ্ট সুন্দরী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারি। শুধু শুভায়ু কেন, অফিসে, রাস্তায়, দোকানে, শপিংমলে অনেকেই তার ঊর্ধ্বাঙ্গ থেকে নিম্নাঙ্গে, পশ্চাৎদেশে চোখ বুলিয়েছে অক্লেশে। শুধুমাত্র মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, চোখে চোখ রেখে, এমন অপরিচিত পুরুষ, অমল কুমার বাদে, আর কাউকে দেখেছে বলে মেঘা মনে করতে পারে না।
অমল কুমার বলে, “ধ্যাত, তুমি যে কী বলো না, রূপমেঘা, তার কোনও ঠিক নেই। আরে, আমরা কী অত বড়লোক, যে বাড়িতে গুরু রেখে শিখব?”
“তবে?” মেঘা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।
“তবে কিছু না। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম ঝাউলিয়া। আউল-বাউলদের গ্রাম। ঐ গ্রামে অচিন্ত্য-বাউলের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকে থেকে আমার বাঁশি শেখা। যদি গুরু বল, তবে উনিই আমার গুরু।” বলেই হাতটা একবার নিজের মাথায় ছোঁয়াল অমল কুমার।
“পড়াশোনাটা ছেড়ে দিলে কেন?”
আবার হেসে ফেলল অমল কুমার, “ঐ শোনো মেয়ের কথা। বললাম যে আমাদের পয়সা ছিল না। যা হাতে আসত চাল, ডাল, তেল কিনতেই ফতুর। ক্লাস সেভেন অবধি টেনে হাল ছেড়ে দিলাম। হাহাহা।”
এই বাড়িতে আসা ইস্তক এই প্রথম অমল কুমার প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে উঠল। মেঘা সামান্য চমকেই গিয়েছিল। পায়রা-ওড়ানো হাসির কথা সে বইয়ে পড়েছিল, আজ প্রথম প্রত্যক্ষ্য করল। তার সঙ্গে খেয়াল করল, অমল কুমারের দাঁতগুলো কী দারুণ ঝকঝকে। মেঘাও না হেসে পারল না। হাসি থামলে অমল কুমার আরও কিছু বলে যাচ্ছিল, মেঘার কানে যাচ্ছিল না। কারণ সেই মুহূর্তেই সৌপ্তিকের কথাগুলো মেঘার মনে ভেসে উঠেছিল। অমল কুমারের বাপ মরে যাওয়ার পরে তাদের সংসার কীভাবে চলত এই ব্যাপারটা সৌপ্তিক তার কাছে চেপে গিয়েছে। এখন অমল কুমারকে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কি? ভাবতে ভাবতেই মেঘা খেয়াল করল কথা থামিয়ে অমল কুমার তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মেঘা বলল, “তোমার পদ্মাদিদি তো ভারি ভাল ভাল কথা বলে। খুব ভাল মানুষ বুঝি?”
“পদ্মা না গো, ও তো আমার পদ্মদিদি। পদ্মের মত মুখখানি।”
“জানো আমারও এক দিদি ছিলেন। যদিও তিনি প্রায় আমার মায়ের বয়সী, তবুও আমি দিদি বলে ডাকতাম। মা কতদিন বলেছে, দিদি বলছিস কেন, মাসি বল, কিন্তু…”
“এই দেখো কাণ্ড! পদ্মদিদি আমার তেমন নয় গো। আমার চাইতে ছ’মাস কী এক বছরের ছোটই হবে।”
কী কারণে মেঘার বুকটা একবার কেঁপে উঠল একবার, হয়ত কোনও আকস্মিকতায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, “সে আবার কী! তবে যে দিদি বলে ডাকো?”
“আমার বাবা বলত। পদ্মদিদিকে কোলে পিঠে করেছে অনেক। আদর করে নাচাতে নাচাতে বলত, ‘ও আমার পদ্মদিদি, ও আমার পদ্মদিদি’। সেই শুনে শুনে আমিও বলতাম। তার পরে দিদির যখন বিয়ে হয়ে গেল আর তারপরে ফিরেও এল, তখন আর শোধরাতে পারিনি। সেই পদ্মদিদিই রয়ে গেল।”
“ফিরে এল? মানে বাপের বাড়িতে? হাজবেন্ড মারা গেছে বুঝি?”
জবাব দিতে গিয়ে অমল কুমারের মুখটা ম্লান হয়ে এল, “নাহহ। সবই ভাগ্য। আমার পদ্মদিদির বিয়ে হল পনেরো বছর বয়সে। দশ বছর পেরিয়ে গেল, কোনও সন্তানাদি হল না। সেই সময় কত যে গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে আমার পদ্মদিদিকে। মায়ের মুখে সব শুনতাম। তারপর একদিন সুখবর। কিন্তু সেই সন্তানকে নিয়েই যত গোলমাল। সে তোমাকে আমি বলতে পারব না, রূপমেঘা।”
মেঘা ভারি উৎসুক হয়ে উঠল, “আরে, আমাকে বলতে সমস্যা কী। আমি থোড়াই পাড়ায় বলতে বেরোব।”
খানিক চুপ করে থেকে অমল কুমার বলল, “শ্বশুরবাড়ির দোষ আমি দিই না, রূপমেঘা। নিজের স্বামী যদি…”
“কী বলছ ঘোড়াড্ডিম, বুঝতে পারছি না।”
“আমাদের জীবনটা কেমন জান, রূপমেঘা? দাঁড়িপাল্লার মত। একদিকে কিছু ভাল হলে আরেকদিকে কিছু মন্দ হবেই। পদ্মদিদির পেটে সন্তান এল তো পদ্মদিদিকে তাড়িয়ে দিল শ্বশুরবাড়ি থেকে। ওরা বলল, ঐ সন্তান নাকি আমার পদ্মদিদির স্বামীর নয়। তাই কখনও হয়? বল দেখি তুমি? পদ্মদিদি কত কাঁদল, কত পায়ে ধরল। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি আমার পদ্মদিদিকে। সেই থেকে বাপের বাড়িতেই। সেখানেই গোলাপির জন্ম হল।”
একটা রসালো গল্পের খোঁজ পেয়ে যেন মেঘা নড়েচড়ে বসল, “দেখো, তুমি না হয় তোমার পদ্মদিদিকে খুব ভালবাস, কিন্তু ভেবে দেখ, কেউ না জানুক, নিজের স্বামী তো জানবে সেই সন্তান তার নাকি তার নয়? ওদিকে তুমি বলছ, ওদের দশ বছর হল কোনও সন্তান হয়নি। তাই…”
আচমকা অমল কুমার উঠে দাঁড়াল, চোখ-মুখ গম্ভীর, “রূপমেঘা, এই জগতে কেউ না জানুক, আমি জানি, আমার পদ্মদিদি কোনও অন্যায় করতেই পারে না। আমার পদ্মদিদি পদ্মের মতই নিস্পাপ। এই দ্যাখো, সকালেই ভেবে রেখেছিলাম, যে দুধটুকু বেঁচে গেছে, তোমার জন্য ছানা করে রাখব, ভুলেই গেছি। দাঁড়াও আমি আনছি।”
“আরে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। ছানা আমার দু’চক্ষের বিষ। তোমার প্যান্ট শার্ট পছন্দ হয়েছে?”
অমল কুমার গম্ভীরভাবেই জবাব দিল, “অত দামি জামাকাপড় কিনতে গেলে কেন তুমি? আমরা গ্রামের ছেলে। মোটা কাপড়ের ফতুয়া, পায়জামা পরেই আমাদের দিন কাটে।”
অমল কুমার ভেতরে চলে গেল। আচমকা মেঘার বুকের ভেতরটা কেমন যেন জ্বালা করে উঠল। পদ্মদিদির উপরে এই লোকটার এত বিশ্বাস? ভালবাসার প্রথম ধাপটাই তো বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই, সারা জগত যাকে দুশ্চরিত্রা ঠাউড়ে নিয়েছে, তাকে অন্ধভাবে নিস্পাপ ভেবে চলেছে অমল কুমার? ও কি ওর পদ্মদিদিকে ভালবাসে? আর সেটা সত্যি হলে তার কালকের রাতের ভাবনাটা ভুল ছিল। অমল কুমারকে সৌপ্তিক আশ্রয় দিয়েছে আর অমল কুমার তারই প্রতিদান হিসেবে মেঘার সেবাশুশ্রূষা করে চলেছে। নিশ্চয়ই তাই। নিমেষে অমল কুমারকে দারুণ অসহ্য মনে হল মেঘার। সৌপ্তিক চলে এলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে এই অকৃতজ্ঞকে, একপ্রকার স্থির করেই ফেলল মেঘা। কিন্তু কোন এক অজ গ্রামের এক অশিক্ষিতা বিধবা মহিলার জন্য নিজের মন কেন বিক্ষিপ্ত হচ্ছে, ভেবে কুল করতে পারে না সে। মাথা ঠাণ্ডা হলে একবার মনে হল, সৌপ্তিকের সঙ্গে কথা বলাটা খুব দরকারি। কী হল মানুষটার? মেঘা ফোন উঠিয়ে আরেকবার নাম্বার ঘোরাল। ফোন নট-রিচেবল। ‘দুত্তেরি, নিকুচি করেছে’ বলে সে মোবাইলটাকে বিছানার উপরে ছুড়ে ফেলে শুয়ে পড়ল। কী কুক্ষণে যে অমল কুমারকে ডেকে গল্প করতে গিয়েছিল।
সারা রাত কী এক অসহ্য মানসিক বেদনায় যে কেটে গেল মেঘার, ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেই অবাক হয়ে গেল। কে অমল কুমার? কে পদ্মদিদি? তার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? সে কেন অযথা মানসিক চাপ নিচ্ছে? টয়লেটে গিয়ে স্নান সারতে সারতে মনটা অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল। তার জায়গায় অন্য চিন্তা মাথা চাড়া দিল। সৌপ্তিকের কী হল? যদি তার মোবাইল খারাপ হয়ে গিয়েও থাকে, তাহলেও সেটা কোনও সমস্যাই নয়। অন্য কলিগদের নাম্বার নিশ্চয়ই সচল আছে? তাও যদি না থাকে, তবে পাবলিক বুথ বলে তো একটা ব্যাপার পৃথিবীর সব দেশেই আছে, নাকি? তবে? আচ্ছা, সৌপ্তিকের কোনও দুর্ঘটনা ঘটল না তো? মেঘা ঠিক করল, আর একদিন দেখে সে সৌপ্তিকের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
আজ অফিসের উদ্দেশে বাইরে বেরোতেই, সামনে অমল কুমার। হাতে একটা লাঞ্চ-বক্স। দেখেই চিনতে পারল মেঘা। লাস্ট বার্থডেতে এক কলিগ গিফট করেছিল।
“এটা কী?” বুঝতে পেরেও হাল্কা মেজাজে প্রশ্ন করল মেঘা।
অমল কুমার আবার আগের মতই। কান অবধি হেসে জবাব দিল, “আর বাইরের খাবার খেতে হবে না। আজ থেকে রুটিন চেঞ্জ। খাবার পছন্দ না হলে বোলো, তখন ভেবে দেখা যাবে।”
মেঘার ঠোঁটের আগায় এসে গিয়েছিল, আমি কোথায় খাই না খাই, তাতে তোমার কেন ফাটছে বাপু? তুমি একটা বিয়ে করো, তারপরে নিজের বৌকে এই সব পিরিত দেখিও। কিন্তু কী একটা কারণে সে থেমে গেল।
আজ মারাত্মক খুশি মনে বাড়ি ফিরল মেঘা। যদি তেমন কোনও অঘটন না ঘটে, তবে আসছে মাসে তার প্রোমোশন ঘটতে চলেছে। যদিও কনফার্মেশন ইমেলটা এখনও আসেনি, তবে এসে যাবে। আজ নিয়োগীজী নিজের চেম্বারে ডেকে তাকে সেই কথা শুনিয়েছে। এখন শুধু হেড অফিস থেকে ইমেলটা আসা বাকি। মেঘার খুশির কারণ আরেকটা কারণেও আর সেটা হল তার ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে রাসেল স্ট্রিটের ব্রাঞ্চে। একবার সেটা হয়ে গেলে আর শুভায়ুর মুখ দেখতে হবে না।
আজ অফিস থেকে বেরিয়ে আর মেট্রোয় চড়তে ইচ্ছে করল না। একটা অ্যাপ-ক্যাব নিয়ে মেঘা সোজা চলে এল বাড়ি। ইসস। সৌপ্তিক থাকলে একটা সেলিব্রেশন করা যেত। খবরটা পেলে সৌপ্তিক নির্ঘাত আজ এক বোতল দামি স্কচ নিয়ে বাড়ি ঢুকত। সৌপ্তিক রেগুলার ড্রিঙ্কার নয়। ন’মাসে ছ’মাসে কোনও সেলিব্রেশন করতে হলে তবেই। সেই সময়ে মেঘাও ঠোঁট ছোঁয়ায়। কিন্তু অমল কুমারের সঙ্গে তো সেই সব চলবে না। যা গেঁয়ো লোক, হয়ত, ‘ইস তুমি মেয়ে হয়ে মদ খাও’ বলে ন্যাকা ন্যাকা কমেন্ট ঝেড়ে মুডটা নষ্ট করে দেবে।
আজ একপ্রকার নাচতে নাচতে বাড়িতে ঢুকেই চমকে গেল মেঘা। তার বাড়িতে মহিলার কণ্ঠস্বর? তার কোনও রিলেটিভ চলে এল নাকি? কে আসতে পারে? আর তাই যদি হয়, তবে তার সঙ্গে অমল কুমার কেন হেসে হেসে গল্প করবে? হাসিঠাট্টার মাত্রা এতটাই যে গ্যারেজের সামনে আসতেই কানে বাজল। সে বারান্দায় উঠে এল। কী একটা কথা অমল কুমার বলছে আর সেই মহিলা-কন্ঠস্বর একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা কী?
অমল কুমারের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার ভাবল হুট করে ঘরে ঢুকে গিয়ে দেখবে ব্যাপারটা কী, আরেকবার ভাবল একবার নক করে ঢোকাটা ভদ্রতা। পরক্ষণেই মনে হল, এটা তো তার বাড়ি, নিজের ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি লাগবে কেন? সে অমল কুমারের ঘরের পর্দা সরাল।
একটি বছর তিরিশের মহিলা আর একটি পাঁচ-ছ বছরের বাচ্চা মেয়ে। তাদের মুখোমুখি বসে আছে অমল কুমার। তারা গল্পে এতটাই মশগুল যে, মেঘা ঘরে ঢুকেছে, এটা কারও খেয়ালই হল না। তার উপরে প্রথম চোখ পড়ল বাচ্চা মেয়েটির। সে সিঁটিয়ে গেল অমল কুমারের কাছে আর তক্ষুনি সবাই ঘুরে তাকাল তার দিকে। ওমনি অমল কুমার হেসে বলল, “ওমা, তুমি এসে গেছ, রূপমেঘা। দেখো দেখি কাণ্ড। এসো এসো।”
যেন নিজের বাড়িতে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে এমন তার বলার ভঙ্গিমা। নিমেষে গা জ্বলে গেল মেঘার। সে গম্ভীর হয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। একবার মহিলাটিকে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, “এরা কারা?”
“আরে, এর কথাই তো বলছিলাম তোমায়। এ হল আমার পদ্মদিদি। আর এই পিচ্চিটা হল গোলাপি।”
মেঘা ভ্রু কুঁচকে মহিলার মুখের দিকে তাকাল। কাল অমল কুমার একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যিই, সদ্যফোঁটা পদ্মের মত মুখখানি মহিলার। গায়ের রঙ যাকে বলে দুধে-আলতা। যদিও পরনের শাড়িটি অত্যন্ত মলিন। ব্লাউজটার রঙ একসময় হয়ত উজ্জ্বল সবুজ ছিল, এখন ফিকে হয়ে এসেছে। সারা শরীরে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু তা সত্ত্বেও যৌবন ভরপুর মাত্রায়, সেটা যে কেউ এক ঝলক দেখেই বলে দিতে পারবে। এরা কখন এসেছে? এর সঙ্গে অমল কুমার এতক্ষণ কী রসালাপ করছিল?
মুহূর্তে মেঘার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। মহিলাটি তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে মেঘাকে প্রণাম করতে এগিয়ে এল। মেঘা চট করে সরে গেল, “ওমা! এ কী! আমি প্রণাম নিই না। আর অমল কুমার, তুমি আমার সঙ্গে পাশের ঘরে এসো।”
অমল কুমার মেঘার ঘরে ঢুকতেই মেঘা চাপা সুরে গর্জন করে উঠল, “আমার অ্যাবসেন্সে এসব কী হচ্ছে?”
অমল কুমার ভারি অবাক হয়ে বলল, “কী আবার হবে? ও হো, গল্প করার কথা বলছ? সে কি আমাদের কম গল্প গো? এতদিনের জমানো কত কথা, গাঁ-ঘরের কত খবর…”
তাকে থামিয়ে দিয়ে মেঘা বলল, “কখন এসেছে এরা? এরা যে আসবে, তুমি আমাকে জানাওনি তো।”
“আরে আমিই কি জানতাম ছাই? সে ভারি আশ্চর্যের কথা। আজ দুপুরবেলা। আমি একটু দোকানে গিয়েছিলাম। তেজপাতা, হলুদ এই সব টুকিটাকি আনতে। ফিরে এসে দেখি, বারান্দায় আমার পদ্মদিদি। সঙ্গে গোলাপি। আমি তো…”
“এরা এখানকার ঠিকানা জানল কী করে?”
“ঠিক ধরেছ, প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। পরে পদ্মদিদি বলতে আমার মনে পড়ল। সৌপ্তিক যখন আমাকে নিয়ে চলে এল, তখন পদ্মদিদির হাতে কিছু টাকা আর আমাদের এই বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়ে এসেছিল। ও মা। আমি তো ভাবিইনি, ওরা এত বড় শহরে… ঠিক খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে। ভাব দেখি কাণ্ড।”
‘আমাদের এই বাড়ির ঠিকানা’ কথাটা গরম শলাকার মত মেঘার মগজে বিঁধল। মানে? তার আর সৌপ্তিকের এই বাড়িটা কি নিজের বাড়ি বলে মনে করে নিয়েছে নাকি অমল কুমার? এত দূর? আগে নিজে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, এখন কোথাকার কে পদ্মদিদি আর তার বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। মানে সংসার কমপ্লিট?
প্রচণ্ড রাগে গরগর করতে করতে মেঘা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “এই সব রাসলীলা এই বাড়িতে চলবে না। এই সব করতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে করবে, এই আমি বলে দিলাম।”
“কী বলছ!” বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেল অমল কুমার, “যা বলছ আস্তে বল। পাশের ঘরে আমার…”
ব্যঙ্গ করতে গিয়ে গলা বিকৃত হয়ে গেল মেঘার, “তোমার পদ্মদিদি তো? উপরে উপরে তো দিব্যি ভালমানুষ সেজে বসে ছিলে অ্যাদ্দিন আর তলে তলে এইসব? তা মেয়েটি তো দিব্যি সুন্দরী। ওকেই…”
“চুপ করো। দয়া করে চুপ করো।” অমল কুমারের গলায় কান্না জমে এল।
মেঘার স্বর যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল, “এটা আমার বাড়ি আর আমাকেই চুপ করিয়ে দিতে চাও? বাস্টার্ড! বেরিয়ে যাও। এখনই বেরিয়ে যাও তোমার পদ্ম, গোলাপ, জুঁইফুল নিয়ে। যত্তসব আতলামি, আমারই কপালে জোটে।”
তিরিশ সেকেন্ডের মত নীরব হয়ে থাকবার পরে অমল কুমার নিজের ঘরে চলে গেল। ভেতর থেকে সশব্দে ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল মেঘা। মাথার ভেতরটায় যেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি থেকে ক্রমাগত লাভা-বিস্ফোরণ ঘটছে। তার সঙ্গে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে খানিক বসে রইল সে। আর বসে থাকতে পারছে না সে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপরেই কী এক অজানা কারণে প্রবল কান্নায় ভিজে যেতে লাগল তার বালিশ। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে, খেয়াল নেই।
ঘুম যখন ভাঙল, মোবাইলের দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে উঠল মেঘার। সোয়া ন’টা! সর্বনাশ! অমল কুমার ডাকেনি কেন? ভাবতেই পেটের ভেতরটা খিদেয় চুঁইচুঁই করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে কালকের কথা মনে পড়ে গেল। কাল সেই যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর হুঁশ ছিল না। মাঝরাতে একবার মনে হল ধুম জ্বর এসেছে, আরেকবার মনে হল, কে যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কপালে, মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সৌপ্তিক নাকি? সে যেন সৌপ্তিকের নাম বিড়বিড় করে ডেকেওছিল বার কয়েক। তারপরে আর কিছু মনে নেই।
মেঘা এক লাফে পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল। ঘরে সেই মহিলা আর বাচ্চাটা তো নেইই, অমল কুমারও নেই। বিছানার চাদর টানটান। ঘরের সব কিছু তকতকে করে গোছানো। অমল কুমার চলে গেল নাকি? আচমকাই মনটা ভারি খারাপ হয়ে মেঘার। কাল কি সে একটু বেশিই রি-অ্যাক্ট করে ফেলেছে? আরেকবার মনে হল আপদ গিয়েছে, বাঁচা গেছে। কিন্তু কখন গেল ওরা? কাল রাতেই? নাকি আজ সকালে? তার মানে কাল সারা রাত তার অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ওরা একঘরে রাত কাটিয়েছে? ব্যাটা ক্যারেক্টার-লেস লম্পট কোথাকার!
অমল কুমার চুলোয় যাক। কিন্তু হাতে এখন যা সময় রয়েছে, তাতে স্নান করে খাবার-দাবার বানিয়ে খেয়ে অফিসে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না। মেঘা কিচেনে ঢুকল। এই একমাস পর এই প্রথম কিচেনে পা রাখল সে। দেখল, ডাইনিং টেবিলের উপরে ভাত, ডাল, ফুলকপির তরকারী আর চিকেন রান্না করে ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। ব্যাপার কী! যদি কাল রাতে অমল কুমার চলে গিয়েই থাকে, তাহলে এত সব রান্না করল কে?
চুলোয় যাক। মেঘা ঠিক করল আর অমল কুমারকে নিয়ে সে কোনও চিন্তা করবে না। আর অবশ্যই আজ সৌপ্তিকের অফিসে যাবে সে। নিজের অফিসেও একটা ফোন করে দেওয়া দরকার। এক কাপ চা বানিয়ে মোবাইলটা তুলে নিতেই সেটা বেজে উঠল। একটা আন-নোন নাম্বার। ট্রু-কলারে দেখাচ্ছে এস. গুহ রায়। তবে কি সৌপ্তিক? অন্য কারও নাম্বার থেকে ফোন করছে? কিন্তু এটা তো ডিস্ট্যান্স কল-নাম্বার নয়।
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে এল একটা পরিচিত স্বর, “হাই, জানেমন। আমার কম্পিটিটার ফিরে এসেছে? তাই বুঝি আজ অ্যাবসেন্ট?”
উফ। শুভায়ুর টাইটেল যে গুহ রায় ভুলেই গিয়েছিল মেঘা। আগের নাম্বারটা ব্লক করেছিল বলে নতুন নাম্বার থেকে ফোন করছে। সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, “না।”
ঠিক তক্ষুনি বারান্দার চটির শব্দ পেল মেঘা। সে প্রশ্ন করল, “কে?”
বারান্দা থেকে আওয়াজ এল, “আমি।”
অমল কুমার! তাহলে চলে যায়নি? মেঘা উত্তপ্ত গলায় বলল, “তো কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল শুনি? এদিকে এসো।”
ঘরে ঢুকল অমল কুমার। হাতে একটা ব্যাগ। বলল, “মাছ ফুরিয়ে গিয়েছিল।”
এক রাতে অমল কুমারের এ কী চেহারা হয়েছে? চোখ বসে গেছে। রাতে ঘুমোয়নি নাকি? সে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অমল কুমার বলল, “চিন্তা কোরো না। ওদের কাল রাতেই বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তুমি ঘুমোচ্ছিলে। তাই জানাতে পারিনি। একটা চিঠি লিখছিলাম। আর…”
“তুমি আবার কাকে কী লিখছিলে?”
“কেন? আমার কী কেউ থাকতে নেই?”
মেঘা বলতে যাচ্ছিল, ‘আছে তো, তোমার পদ্মসোনা’ তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তা আজ সকালে আমাকে ডাকতে কী হয়েছিল? নাকি তুমিও নাক ডাকাচ্ছিলে?”
“কাল রাতে তো কিছুই খাওনি। আজ ভোর ভোর তাই ডাকতে এসেছিলাম। মোট চারবার এসেছি। প্রচুর ডাকাডাকি করেছি, কিন্তু তোমার ঘুম ভাঙেনি।”
এই বলে পাশের ঘরে চলে গেল অমল কুমার। ফোনের ওপার থেকে শুভায়ু বলল, “কার সঙ্গে কথা বলছ?”
মেঘা জবাব দিল, “সব্জিওয়ালা।”
“সো? আজ অফিসে আসছ তো?”
“না। শরীর ঠিক নেই।”
“তাহলে আমিই যাই। তোমাকে দেখেও আসি, আবার একটা সুযোগও পেয়ে যাবো, কী বলো?”
নিমেষে কী যেন হয়ে গেল মেঘার মাথার ভেতরে, বলে দিল, “চলে এসো।”
এই উত্তরটা যেন শুভায়ু আশা করেনি, বলল, “আর ইউ সিরিয়াস?”
“একদম। ঠিকানা তো অফিস রেকর্ডবুকে পেয়েই যাবে।”
ফোনটা কেটে মেঘা এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল। একবার মনে হল, কাজটা সে আদৌ ঠিক করল কি? পরক্ষণেই মনে হল, বেশ হয়েছে। শুভায়ু আজ আসুক, তারপরে দেখা যাবে অমল কুমারের রি-অ্যাকশন। কাল ওদের মতই আজ তারা জোরে জোরে গল্প করবে, হাসি-ঠাট্টা করবে। জ্বলুক অমল কুমার, যত পারে জ্বলুক। দিনের বেলা শুভায়ু কী আর এমন অসভ্যতা করবে? আর বাড়িতে আরও একজন পুরুষমানুষ আছে দেখলে অতটাও এগোবে না। এর পর থেকে তো সে নতুন অফিসে চলেই যাচ্ছে। ফলে শুভায়ুর চ্যাপ্টার আজই শেষ। মনে মনে খুব হেসে নিল মেঘা।
কিন্তু সৌপ্তিকের অফিস? মেঘা ঠিক করল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শুভায়ুকে কাটিয়ে দিয়ে সে সৌপ্তিকের অফিসে চলে যাবে।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে আজ মেঘা নিজেকে মোটামুটি সাজিয়ে নিল। একটা পছন্দের শাড়ি বের করে পড়ল। তারপর একবার অছিলায় কিচেনে যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, অমল কুমার তাকে অবাক হয়ে দেখছে। মেঘা ভারি তৃপ্ত হল। দেখুক। জ্বলুক। মরুক আজ শ্রী অমল কুমার।
শুভায়ু এল দুপুর আড়াইটে নাগাদ। তাকে অভ্যর্থনা করে ঘরে নিয়ে এল মেঘা। দরকার ছিল না, কিন্তু ইচ্ছে করেই অমল কুমারকে ডেকে দু’কাপ চা বানাতে বলল। শুভায়ু ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই মেঘা বলল, “হোমমেইড।”
শুভায়ু বলল, “দূর, চা কী খাব? তোমার প্রোমোশন হচ্ছে। আমারই ব্যাড-লাক।”
“কেন? তোমারও তো প্রোমোশন হচ্ছে। খবর পেয়েছি মশাই, খবর পেয়েছি।”
শুভায়ু ঠোঁট ওল্টালো, “দূর। তোমাকে নিয়ে কত কী ভেবে রেখেছিলাম। সব জলে। তাই সেলিব্রেশনটা এখনই করেনি। কবে ধাঁ হয়ে যাবে। গ্লাস হবে? আর আইস-কিউব?”
বলেই শুভায়ু নিজের ব্যাগ থেকে একটা ওয়াইনের বোতল বের করে ফেলল। প্রমাদ গুনল মেঘা। কিন্তু হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেছে। সে অমল কুমারকে ডেকে দুটো গ্লাস, এক বোতল জল আর ডিপ-ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে দিতে বলল। মেঘা টের পেল, অমল কুমারের ভ্রু উঠে গেছে। মজা পেল সে। অমল কুমার হয়ত নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। জ্বলছে, নির্ঘাত ব্যাটা ভেতরে ভেতরে জ্বলছে।
শুভায়ু দুটো গ্লাস আন্দাজ মত ভর্তি করে দিতেই মেঘার মোবাইলটা বেজে উঠল। আবার একটা আন-নোন নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপার থেকে ইংরেজিতে একটা পুরুষকন্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল, “আমি কি মিসেস মুখার্জীর সঙ্গে কথা বলছি?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি?”
নিজেকে যে কোম্পানির ডাইরেক্টর বলে পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক, মেঘা চমকে উঠল। এ তো সৌপ্তিকের অফিস। একটা অজানা আশঙ্কায় সে মোবাইলটা কানে জোরে চেপে ধরল, “সৌপ্তিকের কিছু হয়েছে?”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ নীরব থেকে যা বললেন, মোবাইলটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল মেঘার। সে-ও ধপ করে বিছানার উপরে বসে পড়ল। না, সৌপ্তিকের কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। সে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে এবং যেখানে গিয়েছিল সেখানেই আছে। তার সঙ্গীসাথিরা ফিরে এসেছে গত পরশু। তাহলে? ভদ্রলোক জানালেন, সৌপ্তিক মুখার্জী আপাতত ফিরবে না। ফিরতে পারবে না। সে ওখানকার একজন মহিলার শ্লীলতাহানি করতে গিয়ে আপাতত পুলিশ হেফাজতে আছে। মেঘার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। সে স্বপ্ন দেখছে না তো? সৌপ্তিক? তার সৌপ্তিক? কোনও ভুল হচ্ছে না তো? ভদ্রলোক খানিক ইতস্তত করে জানালেন, শুধু শ্লীলতাহানিই নয়, আরও বেশি কিছু করে ফেলেছে সে। তাই মিস্টার মুখার্জীর আপাতত ফরাসী কয়েদখানায় গমন এবং পরবর্তীকালে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাদন্ডে দণ্ডিত হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সৌপ্তিক নাকি আরও অনেক কাণ্ড করেছে, এই একমাসে। কলিগরা বারে বারে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হয়নি। এই ঘটনায় তার সঙ্গীসাথিদেরও কম পুলিশি-হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। যাক গে। মিস্টার সৌপ্তিক মুখার্জীকে আপাতত কোম্পানি বরখাস্ত করছে। মিসেস মুখার্জীকে অনুরোধ করা হচ্ছে, যেন তিনি পরের সপ্তাহে অফিসে এসে তাদের প্রাক্তন কর্মীর সব পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে যান।
ফোন কেটে গেল। মেঘার প্রচণ্ড জোরে কান্না পেল, কিন্তু তার দু’চোখ পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। শুভায়ু বলল, “হুয়া কেয়া?”
মেঘা কোনও জবাব দিল না। শুভায়ু চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে গ্লাস-হাতে আরও কাছে ঘনিয়ে এল, “কোনও স্যাড নিউজ নাকি? আরে ইয়ার। জীবনে দুঃখ বলে কিছু হয় না। দুঃখকে দুঃখ মনে করলেই সেটা দুঃখ। আদার ওয়াইজ ওটা জাস্ট একটা ওয়ার্ড। এই নাও, এক চুমুক মেরে দাও, সব ভুলে যাবে।”
শুভায়ু হাতের গ্লাসটা মেঘার ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল। তারপর এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে আঙুল দিয়ে মেঘার ঠোঁট স্পর্শ করল। মেঘার যেন সম্বিত ফিরে এল। সে এক ঝটকায় শুভায়ুকে সরিয়ে দিতেই, শুভায়ু হিসহিস করে উঠল, “হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? একা বাড়িতে ডেকে এনে এখন ভার্জিনিটি দেখাচ্ছ নাকি?”
মেঘার চোখ ততক্ষণে লাল হয়ে এসেছে। যেন রক্ত জমাট বেঁধেছে দু’চোখে। সে শুভায়ুর দিকে তাকিয়ে চাপা গর্জন করে উঠল, “গেট আউট, জাস্ট গেট আউট।”
শুভায়ু সরে যাওয়ার বদলে মেঘার আরও কাছে সরে এল, “আরে ইয়ার। ডোন্ট ওরি। আই অলওয়েজ ক্যারি প্রোটেকশন।”
শুভায়ু এরপরেই মেঘাকে জড়িয়ে ধরে বিছানার উপরে শুইয়ে দিতে চাইল। মেঘা চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই শুভায়ু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। অমল কুমারের এক মোক্ষম লাথি তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। মেঘা টের পেল তার জ্ঞান ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে আসছে। সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে যাওয়ার আগে সে ঝাপসা চোখে দেখতে পেল, অমল কুমারের হাতে একটা লাঠি আর সে সেটা তুলে ধরেছে শুভায়ুর দিকে। আর কিছু মনে নেই।
মেঘার জ্ঞান যখন ফিরে এল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সে বিছানায় উঠে বসল। টের পেল মাথাটা ভীষণ ধরে আছে। সে চারদিকে তাকিয়ে একবার দেখল। কেউ কোত্থাও নেই। ঘর ঠিক আগের মতই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জানালা দিয়ে পড়ন্ত রোদের আলো এসে বিছানার উপরে চকরা-বকরা নকশা কেটেছে। সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমল কুমারের মুখটা মনে ভেসে উঠল। অজান্তেই মেঘার দু’চোখ দিয়ে এক ফোঁটা করে জল নেমে এল। আজ অমল কুমার না থাকলে যে কী হত কে জানে।
কিন্তু সৌপ্তিক? তার সৌপ্তিক? তার একান্ত আর সবচাইতে ভালবাসার মানুষ সৌপ্তিক? নাহ। সৌপ্তিকের ব্যাপারটা পরে বোঝা যাবে, কিন্তু এখন এক কাপ চা না হলে… সে ডাক দিল, “অমল কুমার।”
কোনও উত্তর নেই। সে আবার ডাক দিয়েও উত্তর না পেয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর পাশের ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অমল কুমার নেই, শুধু তাই নয়, তার ব্যবহৃত কোনও জিনিসপত্রই নেই। শুধু তার বিছানার পাশের টেবিলে রাখা আছে, মেঘার দেওয়া শার্ট আর পাতলুনের প্যাকেটটা। আর কিচ্ছুটি নেই। তার মানে, অমল কুমার এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে? কিন্তু কেন? মেঘা দৌড়ে বারান্দায় এল। বারান্দার কর্নারে একটা তারে অমল কুমারের ভেজা পায়জামা শুকোতে দেওয়া থাকে। নেই। টয়লেটের সামনে থাকে এক জোড়া হাওয়াই চপ্পল। কিছুই নেই। মেঘা আঁতিপাঁতি করে ঘরের কোনা কোনা, খাটের নিচে উঁকি মেরে দেখল। নাহ। সব ফাঁকা। শুধু তার দেওয়া উপহারগুলো বাদ দিয়ে নিজের সব কিছু নিয়ে চলে গেছে অমল কুমার। কিন্তু কেন?
মেঘা টলতে টলতে টেবিলের কাছে আসতেই চোখে পড়ল জিনিসটা। শার্ট আর পাতলুনের প্যাকেটের নিচে চাপা দেওয়া একটা কাগজ। মেঘা খুলে ফেলল। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মোট তিন পাতার একটা চিঠি। উপরে গতকালের তারিখে। তার পরেই সম্বোধন, ‘ম্যাডাম’। আর একদম নিচে লেখা ‘অমল কুমার’। এই চিঠিটাই কি সে লিখছিল সেদিন রাতে বসে বসে? আর মেঘা ভেবেছিল সেই চিঠি পদ্মদিদির উদ্দেশ্যে?
মেঘা স্লথ পায়ে চিঠিটা নিয়ে নিজের বিছানায় এসে বসল, তারপরে পড়তে শুরু করল,
“এখন অনেক রাত। একটু আগে পদ্মদিদি আর গোলাপিকে রাতের বাসে উঠিয়ে দিয়ে এলাম। জানি না ঠিক মত বাসায় পৌঁছতে পারবে কিনা। ভগবান ওদের সহায় হোন। ভেবেছিলাম, আমি নিজে গিয়েই তাদের পৌঁছিয়ে দিয়ে আসব, কিন্তু এতদিন তোমাদের অন্ন ধ্বংস করেছি, তাই একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। তুমি অকাতরে ঘুমোচ্ছ, সব দরজা হাট করে খোলা। এই অবস্থায় তো তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। গেলে সুপুর কাছে মুখ দেখাব কী করে। তাই ফিরে এলাম।
পদ্মদিদিকে ওভাবে না বললেই পারতে। কাঁদতে কাঁদতে পদ্মদিদির চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। ওরা কিছু খেয়ে আসেনি। আমি রাতের ভাত বসিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের বলেছিলাম, অন্তত খেয়ে যেতে। পদ্মদিদি শুনল না। খিদে পেটে নিয়েই আমার গোলাপিটা চলে গেল। হা ঈশ্বর। তোমাকে একটা কথা লিখি। আমার কাছে দিদি মানে দিদিই, বোন মানে শুধুই বোন। সারাজীবন যে পদ্মদিদি আমাকে ভাইফোঁটা দিয়ে এসেছে, তার সম্পর্কে কিছু না জেনেই অমন জঘন্য মন্তব্য করতে পারলে, ম্যাডাম? তোমাকে আমি যে খুব বিশ্বাস করেছিলাম। পদ্মদিদি বলে, ভুল বোঝাবুঝি থাকাটাও একটা মস্ত বড় ভুল। তাই এই চিঠি লেখা।
চিঠিটা এখানেই শেষ করতে পারতাম, কিন্তু তোমাকে কিছু কথা না জানালে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। সুপু আমার ভাই। নাহ, বিনা-রক্তের নয়, দূর সম্পর্কেরও নয়। সুপু আমার নিজের জন্মদাতা বাবারই আরেক ছেলে। সুপু হয়ত তোমাকে বলেছিল, আমার নিজের বাবা যক্ষায় মারা গেছে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। যক্ষায় মারা যাওয়ার কথাটা বলতে আমাকে শিখিয়ে আনা হয়েছিল। আমার আর সুপুর মা আলাদা আলাদা হলেও বাবা একই। আমি সুশোভন মুখার্জীর অবৈধ সন্তান। সুশোভন মুখার্জীকে চেনো নিশ্চয়ই? তোমার শ্বশুরমশাই। আমি যখন মায়ের পেটে তখন আমার মা কুমারী ছিলেন। পরে আমার এখনকার বাবা, যাকে আমি আমার সত্যিকারের বাবা বলেই মানি, সব জেনে শুনেই, আমার গর্ভবতী মাকে বিয়ে করেন। তার আগেই অবশ্য সুপুর বাবা পাততাড়ি গুটিয়ে কোলকাতায় পালিয়ে যান আর সেখানে আরেকটা বিয়ে করে বসেন। তাই সুপুর জন্ম কোলকাতায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, প্রতি শনিবার সুশোভনবাবু আমাদের বাড়ি আসতেন, নিশ্চয়ই কোলকাতার বাড়িতে না জানিয়ে। আমাকে আদর করতেন, মা’র হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতেন তারপর ভোরে উঠে চলে যেতেন। আমার এখানকার বাবা লিলুয়ার কারখানায় কাজ করত। একদিন অসময়ে ফিরে এসে সুশোভনবাবু আর আমার মা’কে দেখে ফেলে। ম্যাডাম, আমার বাবার যক্ষা হয়নি, উনি আত্মহত্যা করেছিলেন। সুশোভনবাবুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি আর আমাদের গ্রামে পা না রাখলেও নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। যদিও শুনেছিলাম ভদ্রলোক আরও অনেক সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। জানো, আমার মা কিন্তু সত্যি সত্যিই সুশোভনবাবুকে ভালবেসে ছিল। তাই তো ব্যবসা খারাপ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়েই উনি ওঁর যথাসর্বস্বম লোক মারফত, তুলে দিয়েছিলেন সুশোভনবাবুর হাতে। সেগুলো থাকলে আমার মা আর আমি আরেকটু ভাল জীবন কাটাতে পারতাম। তাই না?
জানি না, তুমি বিশ্বাস করবে কি না, তবে সুপু একদম তার বাবার ধাত পেয়েছে। ওকে আমি চিনি। অনেক আগে আমার মাকে দেখতে আসার নাম করে ও আমাদের গ্রামের একটি মেয়ের সঙ্গে… থাক। আমি সে যাত্রায় তাকে কোনওমতে বাঁচিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, আমি যখন শুনলাম ও বিয়ে করেছে, খুব চিন্তায় ছিলাম। ও যে চরিত্রের ছেলে, তাতে ওর স্ত্রী কতটা শান্তিতে থাকবে সন্দেহ ছিল। তাই ও আমাকে আনেনি, আমিই জোর করে ওর সঙ্গে গ্রাম থেকে এখানে চলে এসেছিলাম।
এখানে শেষ নয়। ভোর হয়ে আসছে। আরও কটি কথা লিখে যাই। ভেবেছিলাম বিয়ের পর সুপু শুধরে যাবে। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। তুমি যখন অফিসে, তখন মাঝেমধ্যেই সুপু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসত। আর একা আসত না। এসেই দরজা বন্ধ করে দিত। ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা পরে বেরিয়ে যেত। থাক, ঐ নোংরা ব্যাপারে আর লিখব না। তোমাকে বলিনি, কারণ তুমি বিশ্বাস করতে না। তুমি সুপুকে খুব ভালবাস, তাই না? তোমাকে দেখলেই আমার মায়ের মুখটা মনে পড়ত।
বাকিটা আজ সকালে লিখছি। তুমি ও ঘরে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছ। বদমাশ লোকটাকে মারতে মারতে বের করে দিয়েছি। আশা করি ও তোমাকে আর বিরক্ত করবে না। নিশ্চয়ই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তুমি জেগে যাবে। জল ছিটিয়ে তোমাকে জাগাতেই পারতাম, কিন্তু থাক। আসলে তুমি জেগে গেলে আমি আর যেতে পারব না। কারণটা তুমি আজ বুঝবে না। বা হয়ত বুঝবে। একজন বিবাহিতা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি বললে হয়ত ঘাড়ধাক্কা খাব। তার চেয়ে এই ভাল। যাওয়ার আগে সত্যিটাই জানিয়ে গেলাম। কারণ সত্যের পথ থেকে আমি এখনও সরে আসিনি, আসতে শিখিনি।
আপাতত গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। পদ্মদিদির কাছেই। দুটি ভাইবোন মিলেমিশে থাকব। আর গোলাপি তো আছেই। এতদিন ওকে না দেখে কী ভাবে যে ছিলাম।
যদি কোনদিনও জীবনের কোথাও কোনও ফাঁক খুঁজে পাও, তখনই আমাকে খুঁজো। খোঁজার একান্ত দরকার হলে তবেই। সেক্ষেত্রে আমাকে খুঁজে নেওয়ার দায়ও তোমারই থাকবে। তাই ঠিকানা দিচ্ছি না। আর না খুঁজতে চাইলে এই চিঠিটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিও। সেটাই বরং ভাল হবে।
ভাল থেক, রূপমেঘা।”
কতক্ষণ যে থম মেরে বসেছিল মেঘা কে জানে। হাত থেকে চিঠিটা কখন খসে পড়ে গেছে খেয়াল করেনি। তারপর ধীরে ধীরে উঠে সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে পেছনের বাগানে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। পাখপাখালিরা ডাকতে ডাকতে নিজের নিজের বাসায় ফিরে আসছে। আচমকা দমকা বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল মেঘার। আকাশের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল, বহু দূর থেকে একটা কালো মেঘের টুকরো খুব ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। দু’চোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখতে থাকে মেঘা, দেখতেই থাকে।