novel-fera-sei-path-e

ফেরা সেই পথে
সুপ্রিয় চৌধুরী



গভীর রাত। হাড় ফুটো করে দেওয়া কনকনে ঠান্ডা আর চাপ চাপ জমাট বাঁধা কুয়াশায় জবুথবু মেরে পড়ে রয়েছে মাইল মাইল বিস্তীর্ণ চিতোয়ানের জঙ্গল। শিবালিক পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে যতদূর অবধি চোখ যায় বিশাল এই অরণ্যকে দেখতে লাগছিল অপার, অন্তহীন ধূসর একটা কম্বল যেন। মাঝেমধ্যে ফুটোফাটার মত এদিকওদিক মাথা ফুঁড়ে ওঠা দু’চারটে আকাশছোঁয়া গাছের মগডাল। ‘ট্রিঁইইই’ – নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে উড়ে গেল কোন রাতচরা পাখি।

পাহাড় চূড়াটার গজদশেক নীচেই চওড়া পাথরটার ওপর টানটান আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছিলেন নানাসাহেব ধুন্ধুপন্থ রাও। সুগঠিত গৌরবর্ণ শরীর। উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ নিরাভরণ। নিম্নাঙ্গে মারাঠা রীতিতে মালসাট মেরে পড়া শ্বেতশুভ্র ধুতি। মোটা উপবীতখানা চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধে একপাক মেরে নেমে গেছে কোমর অবধি। স্থির চোখে মাথার ওপর ঘোলাটে আকাশটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন নানাসাহেব। তাঁর পাশে বসা দুর্জয়। বিশাল চেহারার ডোরাকাটা বাঘ। পরম স্নেহে দুর্জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন নানাসাহেব। জবাবে আদরমাখা মৃদু গরগর একটা আওয়াজ বের হচ্ছিল দুর্জয়ের গলা দিয়ে। বিশাল জালার মত মাথাটা বারবার ঘষছিল নানাসাহেবের হাতে। সেদিকে তাকিয়ে ভারী হতাশ, বিষন্ন একটা হাসি খেলে গেল নানার চোখে। উদাস চোখে দুর্জয়ের দিকে তাকালেন নানা। “নাঃ! দিনকাল এতটুকুও বদলালো না রে, দুর্জয়! সেই কবেকার কথা! ব্যবসা করতে এদেশে এলো আংরেজ বানিয়া। তবে বেসাতির আড়ালে ফিরঙ্গিদের মতলব তো ছিলো অন্য। তামাম হিন্দুস্তানের দখল নেওয়া। একটু একটু করে ওদের খুনি পাঞ্জা দুটো সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছিল ওরা। এক এক করে সব স্বাধীন রাজ্যগুলো সেখানকার রাজাদের হঠিয়ে দখল নিতে শুরু করলো ওরা। মহীশুর কা শের টিপু সুলতান, সাচ্চা শের কা মাফিক লড়কর শহীদ হুয়া। উসকা পুরা কা পুরা খানদান কো কয়েদ করকে লে গিয়া কলকত্তা। নওয়াব ওয়াজেদ আলি শাহ, উসকা জান সে পেয়ারি লখনও নগরী ছিন লিয়া উনসে। তারপর নওয়াব কে ভি কলকত্তা পাঠিয়ে দিল ওই হারামি ফিরঙ্গিরা! আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন আমার পিতাজী পেশোয়া বাজীরাও। বিথুরের রাজত্ব থেকে পিতাজীকেও হঠিয়েছিল ওহ শালা আংরেজ। তাকে যে পেনশন দিতো, স্বর্গবাসী হওয়ার পর সেটাও বন্ধ করে দিলো ওরা। হাম রাজা কা গোদ লিয়া হুয়া বেটা। পেনশনের হকদার, বারবার দরবার করলাম ওদের কাছে, শুনলোই না ওরা! পুরানা কানুন বদলে নয়া কানুন বানালো। বাপের পেনশনে গোদ লিয়া হুয়া বেটার কোন হকই নেই। ওই একই কাহানি ঝান্সিতেও। নিজেদের একলওতা বেটা জনম নেওয়ার কিছুদিন পরেই মারা গেলে রিস্তেদার কা বেটা দামোদরকে দত্তক নেন ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও। রাজার মৃত্যুর পর তাকেও রাজ্যের অধিকার দিলো না ফিরঙ্গিরা! বেওয়া রাণী মণিকর্ণিকা বাঈ বারবার দরবার করলেন বড়লাটের কাছে। লেকিন তাতেও দরিন্দা আংরেজের পাত্থর দিল গললো না!” বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো নানার! চোখ তুলে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তারা বিহীন ঘোলাটে রাতের আকাশটার দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে ফের মাথায় হাত রাখলেন দুর্জয়ের। “ইসি কে কারণ বহোত চোট পহুঁছা থা হাম সবকে দিল মে। লেকিন খুন কা ঘুঁট পিকে চুপ রহা হাম সবলোগ। আসলে মওকার ইন্তেজার করছিলাম আমরা সবাই। কোথায় একটুকরো আগুন উসকে ওঠে। আর সে আগ বহোত জলদি হি জ্বলে উঠলো একদিন!” দুর্জয়ের মাথার ওপর উত্তেজনায় থরথর কাঁপছিল নানাসাহেবের বলিষ্ঠ হাতখানা! “বঙ্গাল কা ব্যারাকপুর লাটবাগানের সিপাহি ছাউনিতে আখির তক এক জাঁবাজ বাহাদুর সিপাহি, শের কা বাচ্চা মঙ্গল পাঁড়ে আংরেজ কে খিলাফ বন্দুক তুলে নিলো। পহেলা ক্রান্তি কা আগ!” দম চেপে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে শান্ত করলেন নানাসাহেব। ফের শুরু করলেন, “লেকিন ওহ আগ হাম সবলোগোঁকা মাফিক সিপাহিয়োঁ কা দিল মে ভি জ্বল রহা থা বহোত দিন সে। একজন আম আংরেজ সিপাহি মাস মাহিনা মে যা তনখোয়া পেত, একজন দেশী সিপাহি পেত তার আধা। লেকিন সব কুছ বরদাস্ত কা বাহার চলা গিয়া একদিন। প্রিচেট এনফিল্ড রাইফেল। এক নয়া বন্দুক লায়া থা আংরেজোঁ নে সিপাহিয়োঁ কে লিয়ে। ওই রাইফেলের টোটায় গাই আর শুয়ারের চর্বি একসাথে লাগানো থাকে। হিন্দুর কাছে গোমাংস নিষেধ আর মুসলমানের কাছে শুয়ার হারাম। প্রিচেট এনফিল্ড রাইফেলের ওই টোটা দাঁতে ছিঁড়ে ব্যারেলে ভরতে হতো। এভাবে দুই জাতকেই ধর্মভ্রষ্ট করতে চেয়েছিল শালা ফিরঙ্গিরা। আর ওটাই সিপাহিদের বুকে এতদিন ধরে জমে থাকা বারুদের স্তূপে আগুন লাগিয়ে দিলো। অওর ওহ আগ কা পহেলা চিঙ্গারি থা মঙ্গল পাঁড়ে। এক সকালে কুচকাওয়াজ শুরুর আগে বন্দুক তুলে সিধা ললকার জানালো ফিরঙ্গিদের। কোই দেশি সিপাহি পাঁড়ে কা রাস্তা নহি রোখা। এক আংরেজ অফসর আয়া বন্দুক ছিননে অওর পাঁড়ে কা গোলি সে মওত হো গিয়া উসকা।” বলতে বলতে গলাটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছিলো নানার। “পরে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাগী হয়ে চলে আসা সব সিপাহিদের মুখ থেকে শুনেছিলাম, কুচকাওয়াজের খোলা ময়দানে বন্দুক উঁচিয়ে টানা চিৎকার করে যাচ্ছিল মঙ্গল, “ধরম নাশ করনেওয়ালে ইয়ে দরিন্দা আংরেজ কোম্পানি কে খিলাফ এক জুট হো কর হাতিয়ার উঠাও মেরে বাহাদুর সাথীয়োঁ! অন্ত করো ইয়ে শালে জুল্ম কে হুকুমত কো!” নিদারুণ বিষন্নতার অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলো নানাসাহেবের কন্ঠস্বর। “লেকিন আখির তক ওরা কব্জা করে নিলো মঙ্গলকে! লাটবাগানের ময়দানেই ওকে ফাঁসিতে চড়িয়ে দিলো দরিন্দারা। ব্যাস!” এক নিমেষে বিষন্নতা কেটে গিয়ে চোখদুটো চকচক করে উঠলো নানার! “ওহি এক চিঙ্গারি ভয়ঙ্কর আগ বনকে ফ্যাহেল গয়া মিরাট, কানপুর, বারেইলি, পাটনা, গোয়ালিয়র, লখনও…পুরা মুল্ক মেঁ! ঝান্সি কি রাণী, তাঁতীয়া তোপি, লাখো বাগী সিপাহি…আমরা সবাই সামিল হয়ে গেলাম সেই মহা ক্রান্তিতে। আমাদের তলোয়ারের সামনে ডর কে মারে জান লিয়ে ভাগতে শুরু করলো সব কোম্পানির ফওজিরা!” বিষন্নতাটা আবার ফিরে আসছিল নানাসাহেবের গলায়। “লেকিন আখির তক জঙ্গটা হেরে গেলাম আমরা। তাঁতিয়া, বাঈসাহেবা…লাখোঁ বাহাদুর সিপাহি এত শাহাদাত …এতবড় একটা গদর…তবু লড়াইটা হারতে হলো আমাদের! হাজার হাজার বাগী সিপাহিকে জিন্দা ফাঁসিতে লটকে দেওয়া হলো জি টি রোড আর দেশের সমস্ত বড় বড় সড়কগুলোর পাশে গাছের ডালে। বেলিজ কামানের নলে বেঁধে তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হলো কতজনকে। পাগলা বেতালের মত চারদিক আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল আংরেজ ফওজ। ঝান্সির রাণী, তাঁতিয়া টোপি…সবাই গেছে! এবার আমাকে চাই ওদের । বেঁচেকুচে থাকা হাতেগোনা কয়েকজন ওয়াফাদার সেনাকে নিয়ে পালাতে শুরু করলাম আমি। কত নদী, পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে শেষে এই নেপালে। জং বাহাদুর রানার আশ্রয়ে। তবে রানাও খুব ভালোভাবে জানতো, আমাকে আশ্রয় দিলে ওরও বিপদ হবে। আংরেজ তার পুরা তাকত নিয়ে এসে হাজির হবে নেপালে। তাই আমাকে সে লুকিয়ে রাখলো এই চিতোয়ানের জঙ্গলে পুরানা এক খুফিয়া (গোপন) কেল্লায়। আংরেজদের এলান করে দিলো – নানাসাহেব নেপালে নেই।

একনাগাড়ে এতক্ষণ কথা বলে ফের রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইলেন নানা। ফের যখন শুরু করলেন তখনও দমচাপা বিষন্নতাটা চেপে বসে রয়েছে গলায়। “তবে ওই যে বলে কিসমত! আংরেজের নজর এড়াতে পারলেও আরেক দুশমনের খুনি পাঞ্জা এড়াতে পারলাম না আমি। জংলি ম্যালেরিয়া। হাঁ ওই বিমারিই আখির তক জান নিলো আমার।” দুর্জয়ের দিকে তাকালেন নানা। “আর এসবের কিছুদিনের মধ্যেই তো শিকারিদের হাতে ফৌত হয়ে তুইও চলে এলি আমার কাছে। আর তারপর তো করিব করিব এই পৌনে দো-শও সাল ধরে আমরা দুজন সেই ভেসে ভেসেই বেড়াচ্ছি চিতোয়ানের পাহাড়ে, জঙ্গলে। তবে আর না!” পাথরের ওপর সোজা হয়ে বসলেন নানাসাহেব! “ওই মহা গদরের পরেই সেয়ানা আংরেজ বুঝে ফেলেছিল, হিন্দু মুসলমান এক হয়ে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে লড়লে ওদের বিপদ আছে। তাই ওরা এক নয়া তারকিব নিলো। ডিভাইড এ্যান্ড রুল প্ল্যান। দো কওম কো আপস মে লড়া দো অওর আরামসে রাজ করো। আর সেই প্ল্যান মাফিক হুকুমত চালিয়ে গেল তিনশও সাল।” দুর্জয়ের পিঠে উত্তেজনায় একটা চাপড় মারলেন নানা। “বহোত তানাবানির পর একদিন মুল্ক আজাদ হলো। লেকিন মজহব কে নাম পে দো টুকরে মে বাঁটকর। তবু ভেবেছিলাম, যাক! আংরেজ লুটেরার হাত থেকে তো ছুটকারা মিললো! লেকিন ফল তো আরো খারাপ হলো! এপার ওপার দুপারেই এখন ওই কারবারের কারবারিদের ফলাও ধান্দা। ধরম কা নাম পে, মজহব কা নাম পে বাঁটতে চলো, বাঁটতেই রহো ইনসান কো অওর আরামসে রাজ করো। একদম ওহি ব্রিটিশ সরকার কা মাফিক। আর এদিকে পুরা মুল্ক জুড়ে পুঁজিপতি বানিয়ার রাজ। দেশের সম্পদের সিংহভাগই গোটা দু’তিনেক শ্রেষ্ঠী পরিবারের হাতে। তাতেও আশ মিটছে না ওদের। জল জঙ্গল জমি…সবকিছুর ওপর দখল চাই ওদের…আর ওইসব বানিয়াদের সাথে হাত মিলিয়েছে নেতারা। সারা দেশ জুড়ে রাজত্ব ওদের…ওদের পকেট ভরে দাও ঠিকঠাক। তারপর ছোটাও লুটতরাজের পানসি…না! এ হতে পারে না! কিছুতেই না!” বলতে বলতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন নানাসাহেব ধুন্ধুপন্থ রাও! “শরীর পঞ্চভূতে লীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মন? মনের মধ্যে ইচ্ছেগুলো তো মরে যায়নি। ওই সেই স্বপ্নটা? ফের একটা গদরের, যা কিছু অন্যায়, তাকে চুরমার করে দেওয়া একটা উথালপাথাল ক্রান্তির স্বপ্ন! আংরেজ রাজা আর বানিয়ারা গেছে। তাদের জায়গায় দেশি নেতা মন্ত্রী, দেশি বানিয়া। রাজা আর পুঁজি মিলেমিশে একাকার…এর খিলাফ ফের হাতিয়ার ওঠাতে হবে, এক নয়া গদর, এক নয়ি জঙ্গ কা এলান করনা হোগা। আমাদের আগে পরে মুল্কে যত ক্রান্তি হয়েছিল সেই সমস্ত ক্রান্তিকারিকে ডাক পাঠাতে হবে এই ক্রান্তিতে সামিল হওয়ার জন্য।” ঝটিতি দুর্জয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন নানাসাহেব! “জোর সে দাহাড় (গর্জন) উঠা জঙ্গল কা রাজা! ওরা সবাই যেন শুনতে পায়!” শোনামাত্র গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে গুমগুমে গলায় ‘ঘ্র্যাআম!’ – জঙ্গল কাঁপিয়ে গর্জে উঠল দুর্জয়। আর পরমুহূর্তেই ঘোলাটে আকাশটার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত আলোর ঝলসানিতে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে ছুটে চলে গেল বিদ্যুত রেখা! আর এর গায়ে লেগে ‘কড়কড়াৎ!’ শব্দে ভয়ংকর বজ্রপাত! সে শব্দ মেলাতে না মেলাতেই উথালপাথাল ঝড় আর তীব্র বৃষ্টি! দীর্ঘসময় ধরে চলা সেই বিপুল প্রলয়ঙ্কর তান্ডবলীলা একসময় থামার পর দেখা গেল পাথরটার ওপর কেউ নেই!

রাঁচি সেন্ট্রাল জেলের বাইশ নম্বর সেল। ইয়া পুরু, নরম গদীর বিছানায় মখমলি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে মৃদু গলায় দিল্লিতে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছিল ইন্দ্রদেও। ইন্দ্রদেও সিং। ধানবাদের বাহুবলী নেতা। পরিধানে দুধসাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ধুতি। বয়েস বছর সত্তর মত হবে। দীর্ঘকায়, রীতিমতো মুগুর ভাঁজা পাহেলোয়ানি চেহারা ইদানীং একটু ভারীর দিকে। ডান-পাখানা এই মুহূর্তে তুলে দেওয়া এক ফালতুর কোলে। ফালতু মানে জেলের কোড ভাষায় যারা ছিঁচকে চুরিটুরির মত ছোটখাটো কোন অপরাধ করে জেলখানায় এসেছে আর কি। ইন্দ্রদেওয়ের পা-টা তেল মাখিয়ে ভালো করে মালিশ করে দিচ্ছিলো ফালতু ছেলেটা। কথা বলতে বলতেই আরামে চোখ দুটো প্রায় বুজে আসছিলো ইন্দ্রদেওয়ের। ইন্দ্রদেও। অপরাধ একইসাথে রাজনীতির দুনিয়ায় এই বাহুবলীর উত্থানের ইতিহাসটা বেশ দীর্ঘ। যৌবনের শুরুতেই স্থানীয় একটা গ্যাঙের নেতা। দলের ছেলেপুলেদের নিয়ে চাল, গমের বস্তা আর সিল্ক কাপড়ের গাঁঠরি নামাতো ওয়াগন থেকে, সেখান থেকে কয়লা খাদানের ধান্দায়, গোটাপাঁচেক বৈধ, অবৈধ খনির মালিক। কয়লার বাজারে পড়তি শুরু হলে রেলের স্ক্র্যাপ টেন্ডারের কারবারে। খড়গপুর, আদ্রা, ধানবাদ থেকে সেই ইউ পি-র গোরখপুর। একচেটিয়া দাপট যুগের পর যুগ ধরে। এসবের পাশাপাশি দুবারের নির্দলীয় বিধায়ক নিজের বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। পরবর্তীতে ওই কেন্দ্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে গেলে নিজের পুত্রবধূকে সেই আসনে প্রার্থী করে নিজে চলে আসে লোকসভা কেন্দ্রে। সেখানেও টানা সাংসদ দুবারের। নিজে কোনদিন কোন পার্টিতে নাম লেখায়নি। উল্টে প্রায় প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলই কখনো না কখনো ইন্দ্রদেওয়ের কাছে এসে সাহায্য চেয়েছে। বিশেষত নির্বাচনের পর সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রমাণ ও সরকার গঠনের প্রশ্নে। আর সে নিজেও এই রাজনীতির ময়দানে কোন পক্ষে যোগদান তার জন্য সর্বাধিক লাভজনক হবে সেটা ভালো করে বুঝে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এই মুহূর্তে ইন্দ্রদেওয়ের সামনে টেবিলের ওপর রাখা বারো ইঞ্চির একটা রঙিন এল ই ডি টিভি। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনার দিন আজ। তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে সেদিকে নজর রেখেই ফোনে কথাবার্তা চালাচ্ছিল ইন্দ্রদেও। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে তার পুত্রবধূ তিন রাউন্ড গননা শেষ হওয়ার পর বারো হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে আছে। ভারী তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠলো বাহুবলী নেতার মুখে। সেটা প্রকাশ পেল কথাতেও, “একদম নিশ্চিন্ত রহিয়ে মন্ত্রীজি, আপ কা পার্টি কে লিয়ে রাজ্য মে মন্ত্রীসভা গঠন একদম নিশ্চিত হ্যায়! …হাঁ, হাঁ, মেরা পাঁচ বিধায়ক আপ হি কা পার্টি কা পকশ্ মে রহেগা…গ্রান্টি, হান্ড্রেড পার্সেন্ট! লেকিন মেরা বেটা কা বহু কো ক্যাবিনেট মিনিস্ট্রি মে তাগড়া কোই পোস্ট চাহিয়ে…পাক্কা হো যায়গা তো? ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়…মেরা তরফ সে পুরা কা পুরা সহায়তা মিলেগা আপকো…” আরো মিনিটপাঁচেক মতো কথাবার্তা চালিয়ে ফোনটা কেটে একটা লম্বা হাই তুললো ইন্দ্রদেও। ওকে ঘিরে বসে থাকা দলের গোটাপাঁচেক ছেলে তাদের একজনের হাতে রিমোটটা ধরিয়ে দিয়ে পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকালো। একটা একশো টাকার নোট মালিশ করনেওয়ালা ‘ফালতু’ ছোকরাটার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এলিয়ে পড়লো তাকিয়ায়।

বাইশ নম্বর সেলের একদম উল্টোদিকেই কনডেমড সেলটার মেঝেতে শুয়ে ইন্দ্রদেও আর তার সব চ্যালাচামুন্ডাগুলোর কান্ডকারখানা দেখে বিস্ময়ে আর কৌতুকে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিলেন বিরসা মুন্ডা। শালো, কি সময়ঠোই না এল্যো বট্যে। এই গিধ (শকুন) আর লকড়বাগ্ঘাগুলান (হায়েনা) দেশটার বুকে রাজত্ব করবে বলে তিনি, খুন্টির উলহাতু গাঁয়ে মুন্ডারি পরিবারে সুগানা মুন্ডার বেট্যা, ওই শয়তান ফিরঙ্গিদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিলেন! গাঁয়ে গাঁয়ে জিলায় জিলায় ঘুরে দুনিয়ার পুরা মুন্ডারি জাতকে একজোটটি কইরেছিল্যেন! আদিবাসীদের জোতজমিন লুটে লেওয়া ফিরিঙ্গিদের পাহাড়, জমিন, জঙ্গল…সবখান থ্যিকে খেদায়ে ভাগাতে সেই মহা বিদ্রোহ উলগুলানের ডাক দিয়েছিল্যেন! আর এই কারণেই তাকে বন্দী কইরে এই জেলখানায় লিয়্যে এইস্যেছিল ওই বিরটিশের বাচ্চারা। ফাঁসির সাজা শুনাইছিল গোরা চামড়া ম্যাজিস্টর। তবে সে সুযোগ পায়নি ওরা। পুরা মুন্ডারি সমাজ তাঁকে ডাকতো বিরসা ভগবান নামে। ভগবানকে ফাঁসিতে চড়ানোর সাধঠো অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল্য শালোদের। তার আগেই এক রাতে এ গরাদখানা ছেইড়ে বেরোয়ে গেছিল্যেন ভগবান। গোরা চামড়ার ডাগদার রিপোর্ট লিখ্যেছিল – কজ অফ ডেথ – কলেরা। ভেদবমি। ডাগদারের পাশে বসে পুরো রিপোর্টটা দেখেছিলেন মিশনারি স্কুলে পাঁচ ক্লাস অবধি পড়া বিরসা। তবে সে তো শুধুই শরীরের রিপোর্টঠো বট্যে। বাকিটা তো সেই একশ বছরের বেশি সময় ধরে পড়েই আছে ইখানে। মজার কথা, জেলার, জেল সিপাহি, ওয়ার্ডার, কয়েদীদের কেউ সেটা দেখতে পায় না!…এইসব ভাবনাচিন্তার মাঝখানেই দূর, বহুদূর থেকে থেকে শোনা গেল গর্জনটা! হাল্কা হলেও স্পষ্ট! ওকে চেনেন ভগবান। দুর্জয়। নানাসাহেবের বাঘ। নানাসাহেব ধুন্দুপন্থ রাও। খুন্টির উলহাতু গাঁয়ে ভগবানের জন্মেরও প্রায় দু-যুগ আগে আরেক মহা বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন ঝান্সির রাণী লক্ষীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি আর হাজার হাজার বাগী সিপাহিদের সাথে একজোট হয়ে। ফের দুর্জয়ের মাধ্যমে ডাক পাঠাচ্ছেন নানাসাহেব! “জেলখানার ঠান্ডা মেঝেতে পড়ে পড়ে অনেক ঘুমিয়েছো হে সুগানা মুন্ডার বেটা। অনেক আরাম হয়েছে। এবার ওঠো হে! আবার এক মহা উলগুলানের সময় উপস্থিত! সেই সময়টাই ডাক পাঠাচ্ছে তোমাকে!” শুনতে শুনতে লক আপের স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বিরসা ভগবান! এবার যেতে হবে। রাঁচি, খুন্টি, চাইবাসা, সাঙ্কারা, তামার, বেসাই, লাতেহার, চান্দোয়া, ছিপদোহর, ভালুমার, সিংভূম, মানভূম আর ছোট নাগপুরের পাহাড়, নদী, জঙ্গল ঘেরা আরো অনেক ছোট বড়ো সব গাঁয়ে। ধামসা মাদলে ডাক পাঠাতে হবে আরেক মহা উলগুলানের! নয়া রাজা, পুঁজিপতি বানিয়া আর ধর্মের যত কারবারিদের খিলাফ নয়া উলগুলান। কনডেমড সেলের গরাদ গলে বেরিয়ে এসে করিডর ধরে হেঁটে চলে গেলেন ভগবান। জেলার, সেপাই, রাইটার, ওয়ার্ডার, মেট, বাইশটা সেলের কয়েদীরা…কেউ দেখতে পেলো না তাঁকে!

জি টি রোড। এলাহাবাদ আর কানপুরের মাঝামাঝি সুবিশাল হাইওয়ের ধারে জমজমাট বচন সিংয়ের ধাবা। সন্ধের মুখে খদ্দেরের জবরদস্ত ভীড়। শহর থেকে ইটিং আউট করতে আসা সুবেশ তরুণ তরুণীদের ভিড়। ওয়েস্টার্ন আর হিন্দি ফিউশনের উদ্দাম সুর গাড়িতে গাড়িতে। ধাবার আরেকদিকে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো সব বারো চাকা, ষোল চাকার পাঞ্জাব হেভি বডি ট্রাকগুলো। সামনে খোলা জমিতে পাতা সার সার খাটে ড্রাইভারদের গুলতানি। কসৌরি মেথির ফোড়ন, চিকেন তন্দুরি আর খাঁটি ভঁয়সা দুধে ফোটানো পোয়াপাত্তি চায়ের মিশ্র সুগন্ধী ভাপ ভেসে আসছে ধাবার ভেতর থেকে। ধাবা মালিকের হাঁকডাক, চায়ের গেলাস আর খাবারের প্লেট হাতে বেয়ারা ছেলেছোকরাদের দৌড়োদৌড়ি…সব মিলিয়ে যখন চারপাশ বেজায় জমজমাট, ঠিক তখনই ধাবার মিটারদশেক দূরে কোন সেই আদ্যিকালের পাকুড় গাছটার ডালে খুব ধীরে ধীরে খুলে গেল সেই কবে থেকে ফাঁসিতে ঝুলে থাকা সিপাহি তবরেজ খানের চোখদুটো। ডাকটা তখনও ভেসে আসছে কানে। ফাঁপা জালার মধ্যে থেকে উঠে আসা একটা গুমগুমে আওয়াজের মত ডাকটা কি বলতে চাইছে সেটা ভালোমতোই জানে তবরেজ। ফির এক জানকবুল গদর! গলার দড়িটা এক ঝটকায় খুলে ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দুপাশে তাকালো তবরেজ। দুদিকে দুটো ডালে রামপ্রবেশ আর আল্লাবক্সের চোখদুটোও খুলছে আস্তে আস্তে। সামনেও সবকটা গাছে গলার ফাঁস খুলে ঝটপট মাটিতে লাফিয়ে নামছে বাকি সব সিপাহিরাও।

ঘুরে পিছনে তাকালো তবরেজ। রাস্তার গায়েই যদ্দুর চোখ যায় গন্না (আখ), গেঁহু অওর সর্ষোঁ কা খেতিজমিন। মাঠের ওপর দাঁড়ানো বিশাল বেলিজ কামানটা। ওটারই মুখে বেঁধে তোপের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ওদের ব্যাটেলিয়ান হাবিলদার বিন্ধেশ্বর সিংকে। ক্ষেতের ওপর এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাড়, মাংস, চামড়া, মজ্জা…সবকিছুই নিখুঁতভাবে একে অপরের সাথে জোড়া লাগতে শুরু করেছে আবার। দেখতে দেখতে ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা মুঠোয় ধরে ফসল কাটা খোলা ময়দানে উঠে দাঁড়ালো বিন্ধেশ্বর সিং। “ওহ শের কা দাহাড় শুন রহে হো সাথীলোগ? ওহ নানাসাহিব কা শের হ্যায়! সাহিব পুকার রহেঁ হ্যায় হাম সবকো। ফির একবার ক্রান্তি কা বুলাওয়া আ গিয়া! শও শও সাল বিত গয়েঁ। বহোত হো গিয়া আরাম কা নিদ। ফির জঙ্গ ছেড়না হ্যায় নয়া দুশমনোঁ কি খিলাফ!” বলেই গর্জে উঠলো ব্যাটেলিয়ান হাবিলদার – “কুইক মার্চ! লেফট রাইট লেফট…!” কমান্ডের তালে তাল মিলিয়ে সমবেত কুচকাওয়াজে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের কুয়াশায় মিলিয়ে গেল হাজার হাজার বাগি সিপাহির ব্যাটেলিয়েন! ঠিক পাশেই ধাবায় জমজমাট ভিড়টার কানেই গেল না সেই কমান্ড আর সমবেত কুচকাওয়াজের শব্দ।

গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়াদের ভাঙাচোরা দুর্গটার মাথার ওপর তাঁর দুধসাদা ঘোড়ায় চেপে উড়ে বেড়াচ্ছিলেন ঝান্সি কি রাণী মণিকর্ণিকা লছমী বাঈ। রাতের ঝকঝকে আকাশে অযুত কোটি তারা আর মাঝেমাঝে ভেসে যাওয়া ফুরফুরে পেঁজা মেঘের ভেলা। তার গায়ে গা লাগিয়ে ভাসছে রাণীর ঘোড়া আর পিছনে ফেলে আসা অসংখ্য স্মৃতি! আকাশের ওই তারাগুলোর মতোই…সেই কবেকার কথা! তাঁর স্বামী রাজা গঙ্গাধর রাও, রাণীর অকালমৃত শিশুসন্তানের শূন্যস্থান পূরণ করতে দত্তক নিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের সন্তান দামোদরকে। কিন্তু রাজার মৃত্যুর পর সেই শিশুকে ঝান্সির উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি দিলো না আংরেজ সরকার। অনেক দরবার, চিঠিচাপাটি করলেন রাণী। কোন ফল হলো না। আংরেজ সরকার নাছোড়। দত্তক শিশুপুত্রকে কিছুতেই ঝাঁসির রাজা বলে মেনে নেবে না তারা। এদিকে নাছোড় রাণীও। “মেরি ঝান্সি নহি দুঙ্গি!” স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বৃটিশ দূতকে। ফল যা হওয়ার তাই হলো। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলো আংরেজ সরকার। রাণীও প্রস্তুত ছিলেন এই পরিণতির জন্য। সীমিত সামর্থ্য নিয়েও মরণপণ লড়ে গেলেন রাইফেল আর কামানে সজ্জিত ব্যাটেলিয়ন কে ব্যাটেলিয়ন মহা শক্তিধর বৃটিশ ফওজের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েক সপ্তাহ লড়াই চলার পর বোঝা গেল এভাবে আর আংরেজদের আটকে রাখা যাবে না। ঝাঁসির দুর্গকে চারদিক থেকে ক্রমাগত ঘিরে ফেলছিলো ওরা। প্রতিদিন নয়া নয়া ব্যাটেলিয়ন এসে যোগ দিচ্ছিল, সঙ্গে প্রচুর হাতী, ঘোড়া, উট, গোলা বন্দুক আর কামান নিয়ে। নিজের অতি বিশ্বস্ত একদল মারাঠা আর রোহিলা পাঠান সমৃদ্ধ দুর্ধর্ষ সেনাদল নিয়ে বৃটিশ ফওজের ঘেরাও ভেঙে বেরিয়ে গেলেন তিনি, সারাঙ্গির পিঠে সওয়ার হয়ে। পিঠে বাঁধা শিশুপুত্র দামোদর। আর দুই পাশে আরো তিনটে ঘোড়ায় তিন বিশ্বস্ত সহচরী কালীবাঈ, সুন্দরবাঈ আর মন্দারবাঈ। ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গোয়ালিয়র পৌঁছে গেলেন রাণী। পথে যত বিদ্রোহী সন্ন্যাসী, ফকির, দলছুট বাগী সিপাহি, ছোটখাটো সব গাঁয়ের জমিদার লোকলস্কর, প্রজা, রায়ত নিয়ে জুটে গেল তাঁর সাথে। বৃটিশের দালাল সিন্ধিয়া রাজারা ঝড়ের মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল রাণীর সেই ফওজের সামনে। প্রাণ নিয়ে পালানো সিন্ধিয়াদের কেল্লার দখল নিলেন তিনি। পিছু পিছু ধেয়ে এলো আংরেজ ফওজ। ফির সে এক ঘামাসান জঙ্গ চললো হফতা ভর। এক সময় সমস্ত গোলাবারুদ গেল ফুরিয়ে। দলে দলে শহিদ হলো রাণীর সেনারা। অতঃপর একদিন কেল্লার এক খুফিয়া (গোপন) পথে কালীবাঈ আর খুব ওয়াফাাদার দু’চারজন সেনার সাথে দামোদরকে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে দিয়ে সুন্দরবাঈ, মন্দারবাঈ আর তখনও জীবিত, হাতে গোনা কিছু ফকির, সন্ন্যাসী, বাগি মারাঠা আর পাঠান সেনাকে সঙ্গে নিয়ে কোম্পানির ফওজের বিরুদ্ধে শেষ লড়াইয়ে নামলেন তিনি। এক আখরি জঙ্গ! চারদিক থেকে আন্ধাধুন প্রিচেট এনফিল্ড রাইফেলের টানা গোলিবারি, মুহুর্মুহু উড়ে এসে পড়া বেলিজ কামানের গোলা… একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল সুন্দরবাঈ, মন্দারবাঈ আর রাণীর সব ওয়াফাদার সিপাহিরা। এসবের মধ্যেও তলোয়ারের কোপে একের পর এক আংরেজ ফওজকে কচুকাটা করতে করতে সামনে এগোচ্ছিলেন রাণী। ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট এসে বিঁধে যাচ্ছিল তাঁর আর তাঁর ঘোড়ার শরীরে। শেষ বুলেটটা সোজা কপালের মাঝখানে! রেকাব থেকে টলে পড়ে যাওয়ার আগে অবাক হয়ে দেখেছিলেন তাঁকে নিয়ে এক লাফে আকাশে উড়ান দিলো তাঁর সাদা পক্ষীরাজ ঘোড়া! আর সেই থেকে আজ অবধি আকাশেই উড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ভারী মিঠে একটা হাসি হেসে তাঁর বাহনের গলায় হাত বুলিয়ে দিলেন রাণীসাহেবা। ঝান্সি থেকে গোয়ালিয়র, দীর্ঘ, তীব্র পথশ্রমে মারাত্মক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তার প্রিয় ঘোটকী সারাঙ্গি। উপায়ন্তর না দেখে সিন্ধিয়াদের আস্তাবল থেকে বেছে নিতে হয়েছিল নতুন এই বাহনকে। দুশমনের আস্তাবলের ঘোড়া। লেকিন বেইমানি নহি কিয়া। আখির তক লড়ে গিয়েছিল বাঈসাহেবাকে পিঠে নিয়ে …ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালেন রাণী। সাদা ঘোড়ার গায়ে লেগে লেগে ছুটছে রাণীর জান সে পেয়ারা ঘোড়ি সারাঙ্গি। সাদা ঘোড়া তাঁকে নিয়ে আশমানে উড়ান দেওয়ার পর একমাসও কাটেনি শরীর ছেড়ে মহাশূন্যে উড়ান দিয়েছিল সেও। এই মুহূর্তে গায়ে লেগে লেগে ছুটছে দুজনে। পাশাপাশি ভারী সুন্দর লাগে দুজনকে। এবার জোড়ি বাঁধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে দুজনকে…এইসব চিন্তাভাবনার মাঝখানেই দূর থেকে হাঁক “রাণীসাহেবা!” মুহূর্তে সচকিত হয়ে সামনে তাকালেন তিনি। মেঘের ভেলায় পাল তুলে উড়ে আসছে তাঁতীয়া টোপি। দুপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে সুন্দরবাঈ, মন্দারবাঈ, কালীবাঈ, দামোদর, মারাঠা আর রোহিলা পাঠান সেনারা। সাদা ঘোড়ার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো মেঘের ভেলা। তাঁতীয়ার চোখে বিস্ময়! “আপনি কিছু শোনেননি?” “নহি তো?” বিস্ময় রাণীর চোখেও! “কান পাতুন আকাশে রাণী সাহেবা! ওহ পুকার জরুর শুনাই দেগা আপ কো!” গাম্ভীর্যের সাথে কিছুটা ক্ষুন্ন ভাবও যেন মিশে আছে তাঁতীয়ার গলায়। আকাশে কান পাতলেন রাণী মণিকর্ণিকা। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে গুমগুমে বজ্রগম্ভীর গর্জনটা। নানাসাহিক কা শের হ্যায় ওহ। ওর মাধ্যমে ডাক পাঠাচ্ছেন পেশোয়া ধুন্দুপন্থ রাও! ভিতরে ভিতরে একটু লজ্জিতই হলেন রাণী। নানারকম সব ভাবনায় ডুবে থাকায় শুনতেই পাননি ডাকটা। কোমরের খাপ থেকে এক টানে তলোয়ারটা বের করে উঁচিয়ে ধরলেন শূন্যে। তারপর হেসে উঠলেন সামনে ভীড়টার দিকে তাকিয়ে। “আব অওর শোচনে কা কুছ নহি হ্যায়! চলো মেরে জিগরা শের অওর শেরনিওঁ! ওয়াক্ত কা বুলাওয়া আ গিয়া!”

বগি কাঁসার থালার মত গোলপানা চকচকে একটা চাঁদের আলোয় উদ্দাম, বেসামাল ভেসে যাচ্ছিল ভগনাডিহির মাঠ। মাঠের মাঝখানে প্রাচীন সেই পাঁচকাঠিয়া বটগাছ। কে জানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবে থেকে। মাঠটাকে ঘিরে, শাল, পিয়াল, পলাশ, সেগুন, কেন্দু আর মহুয়ার বন। কিন্তু মাঠের মধ্যে এই বটবৃক্ষ, এই আদিম মহাদ্রুম ব্যতীত আর কোন মহীরুহের অস্তিত্ব নেই। যুগের পর যুগ ধরে একাই সে দন্ডায়মান এই আদিম প্রান্তরে! প্রকৃতি যেন খানিকটা নিজের খেয়ালেই স্বতন্ত্র করে রেখেছে তার এই বিপুল সৃষ্টিকে। সাধারণত্বের মানদণ্ডে মাপতে চায়নি কখনোই। কারণ সে জানে, সেই কবে কোনকালে ঘুমন্ত পাহাড়ের চূড়ো ফাটিয়ে শূন্যে লাফ দিয়ে ওঠা আগ্নেয়গিরির মতো একটা সময়কে তার পাতায় পাতায়, ডালে ডালে, শাখাপ্রশাখা আর মাটি অবধি নামিয়ে দেওয়া ঝুরিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে এই মহাদ্রুম! গাঁয়ে গাঁয়ে গাঁওবুড়ারা আজও এই বটগাছের কথা বলে। জোয়ান সব ছেলে ছোকরাগুলো হাতের ওই যন্তরটায় চোখ সেঁটে রাখলে বলে – “উয়ার মধ্যে কিছু নাই রে বাপ মোর! উঠো রেইখ্যে ই কিস্যা ঠো শুন কেনে। হুলের কিস্যা শুন। ওই বুড়হা বটের কিস্যা শুন!” স্মার্টফোনের পর্দায় সিনেমা, গান বন্ধ করে কান থেকে গুলগুলি দুটো খুলে বাপজ্যাঠাদের কাছে এসে বসে ছেলেপুলেগুলো। “কিস্যা শুরু করো হে বুড়হা বাবা।” বলে ওঠে মুরুব্বি মাতব্বররা। চুট্টায় শেষ টানটা মেরে মাটিতে ঘষে সেটাকে নিভিয়ে দিয়ে জোয়ান ছেলেছোকরাদের দিকে ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে তাকালো গাঁওবুড়া। “সি সব কুন কালের কিস্যা ঠো বট্যে। ধলভূম, মানভূম, হাজারিবাগ…আরো সব জাগা থিক্যে আমার বাপদাদাদের ইখানে এইন্যে বসত পত্তনি দিয়েছিল কোম্পানির গোরা চামড়া সাহেবগুলান। জাগাঠোর নাম হল্য সান্থাল পরগণা। চারোধারে পাহাড় জঙ্গল আর রুখাশুখা টাঁড় বাঞ্জার জমিন। সি পাত্থর, মাটি কোপায়ে আবাদ করলাম। হাড্ডি টুটা মেহনত খেইট্যে ফসল উবলালো মেয়েমরদ সবঠো মিইল্যে…পুরা দু-দুটা আড়িয়াল বয়েলের সমান মেহনত খাটল একেকজন। পরোয়া লাই। ইসব তো লিজের ঘর, লিজের জমির বেপার বট্যে। ইয়ার লেইগ্যে এতটুকু না খাটলে চলে? লেকিন আমাদের বাপদাদারা ছিলো বক্কাসক্কা সিধাসাধা মুনিষ। সাহেবগুলার দাঁওপেঁচ ফিকির উয়ারা বুঝ্যে লাই বট্যে। যেই দেখল পাত্থরে সোনা ঠো ফলতে লেইগ্যেছে, তুরন্ত পাঠায়ে দিলো উয়াদের পাঁও চাটা সব দিকু (ভদ্রলোক) জমিনদারগুলাকে। লোকলস্কর, নায়েব, গোমস্তা, লাঠিয়াল লিয়্যে এলো উয়ারা। জমিনদার বললো – “সরকারি জমিনঠো চাষ করছিস তুয়ারা। ইয়ার লেইগ্যে খাজনা আর ফসলের ভাগ দিতে হব্যে। না হলে জমিন কেইড়ে লিয়া হব্যে বট্যে। গাঁও কে গাঁও ঘিরে ফেইল্যে শুরু হইয়্যে গেল শালো হুঁড়ার (নেকড়ে) দিকু জমিনদারদের জুলুম। ঘর জ্বালানো, ফসল কেইট্যে নেওয়া, মেইয়ে-মেঝেন, ঝি-বহুরিদের তুইল্যে লিয়ে যাওয়া…কিচ্ছুটি বাদ গেল না। উয়াদের মাথার উপর কোম্পানির সাহেবগুলার হাত। কত্তসব সিপাই সান্ত্রী, ফওজ, হাঁথী, ঘোড়া, কামান, বন্দুক উয়াদের। বারুদের মত গুস্যা জমছিল সবঠোর মনে। এই বারুদের ঢেরায় পত্থম আগঠো লাগাল্য সাহেবগঞ্জ, ভগনাডিহি গাঁওয়ের দুই ভাই। সিদো মুর্মু আর কানহো মুর্মু। ইয়াদের সাথে জুইট্যে গেল ওই গাঁয়েই চুন্নি মাঝির দুই বেটা চাঁদ আর ভৈরব। জমিনদারের নায়েব, গুন্ডা, লাঠিয়ালদের শিয়ার (শেয়াল) খেদা ঠো খেদায়ে ভাগালো ওরা সবঠি মিল্যে। গাঁয়ের পর গাঁ বিলকুল আজাদ হইয়্যে গেল জমিনদারের জুলুম থিক্যে। পন্দের (পাছার) কাপড় তুইল্যে পলাইন গেল সব জমিনদারেরা। এই আজাদি ঠো চইলেছিল্য মোটের উপর দুই বরষ!” বলতে বলতে পাথরের মত ভারী হয়ে এলো গাঁওবুড়ার অজস্র বলিরেখায় ভর্তি ঘোর কালো মুখখানা! ছানি পড়া ঘোলাটে চোখে রাতের আকাশের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো সে। তারপর আবার যখন বলা শুরু করলো তখন গলার আওয়াজও ওই পাথর জমাট মুখখানার মতোই ভারী হয়ে গেছে। “নিজেদের হাভেলি থেকে জান লিয়্যে পলাইন দিকু জমিনদারগুলান সবঠো মিইল্যে যেইয়ে উঠল সদরে। উয়াদের সাহেব বাপদের পায়ে পইড়্যে কান্দতে শুরু করলো বেজায় রকম। ‘মাই বাপ, বাঁচা মোদের সবটিকে!’ ইবার হাঁথী ঘোড়া, পুলিশ ফওজ, কামান বন্দুক লিয়্যে লড়তে এলো কোম্পানির গোরা চামড়া সাহেবগুলান। ততদিনে তো ভগনাডিহির সীমা ঠো পার হইয়ে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, হাজারিবাগ, কটক, সিংভূম, ধলভূম, মানভূম, ছোটা নাগপুর … গাঁয়ের পর গাঁয়ে আদিবাসী, মাঝি মাড়োয়া ঘরের হাজার হাজার জোয়ান মরদ জুইট্যে যেইঞ্ছে সিদো, কানহো, চাঁদ আর ভৈরবের দলে। দিনের পর দিন সি এক ভয়ংকর কঠ্যিন লড়াই বট্যে। কিন্তুক শেষাশেষি কোম্পানির ফওজের হাতী, ঘোড়া কামান, বন্দুকের সামনে লড়াই ঠো হেরে গেল সিদো, কানহো, চাঁদ, ভৈরবরা! এক বেইমান ধরাইন দিল্য সিদোকে। কোম্পানি ফওজ গুলি কইরে মারলো উয়াকে। মুখামুখি লড়াইয়ে গুলি খেয়্যে মারাংবুরুর শরণ লিল্য চাঁদ আর ভৈরব। কানহো ধরা ঠো খেল্য কটা দিন বাদে। ভগনাডিহির মাঠে উয়াকে ওই পাঁচকাঠিয়া বটগাছের ডালে ফাঁসিতে লটকালো শালোর বেটা সাহেবরা। কিন্তুক ফাঁস গলায় পড়ানোর আগে তেন্দুয়া বাঘের মত দাহাড় দিয়ে উঠেছিল কানহো। ‘মুই আর মোদের এই হুলকে খতম করতে পারবি লাই তুহারা! তুহাদের জুলুমের খিলাফ হাতিয়ার উঠায়ে বারবার ফিরে আসবো মোরা!… বারবার…’ বলতে বলতে হাউহাউ কান্নায় ভেঙে পড়লো গাঁওবুড়া!

গাঁওবুড়ার ঠিক পিছনেই বসা সিদো, চাঁদ আর ভৈরব। চিকচিকে চোখে চাঁদ আর ভৈরবের দিকে তাকালো সিদো। “দেখলি! মোদের কথা, মোদের সেই হুলের কথাটো আজও ভুলে নাই উয়ারা।” “সি তো লিয্যস কথা বট্যে।” বললো ভৈরব। “ইবার চল দেখি কেনে ভগনাডিহির মাঠে। কানহো বেচারি ঠায় বইসে রইয়েছে ওই ঠেঙে সেই কবে থিক্যে!’’ ‘’হক কথা বট্যে।” পাশ থেকে বলে উঠলো চাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে শনশন হাওয়া উঠলো একটা। সেই হাওয়ায় উড়ে চলে গেল তিনজন!

ভগনাডিহির খোলা মাঠে পূর্ণিমা চাঁদের ভেসে যাওয়া আলোয় পাথরকাঠিয়া বটগাছটা বেয়ে নেমে আসা মোটা মোটা ঝুড়ির দোলনায় দোল খাচ্ছিল কানহো। গলায় সেই ফাঁসির দড়ি খুলে ফেলেছে কবেই। জায়গাটায় দড়ির নীলচে দাগটা রয়ে গেছে শুধু।

এই মুহূর্তে নীচে দাঁড়িয়ে শুঁড় দিয়ে বট পাতা পেড়ে খাচ্ছে বিশাল হাতীটা। ওটা দলছুট দাঁতাল। এই এলাকার ত্রাস। তবে ও ছাড়াও একজোটে আসে হাতীর পাল। আসে ঝাড়খণ্ড আর ওড়িশার জঙ্গল পালানো বাঘ। ভীতু ভীতু পায়ে আসে চিতল হরিণ। বটফল কুড়িয়ে খায়। একটু শব্দ পেলেই তীরবেগে ছুটে উধাও শাল, মহুয়ার জঙ্গলে! এছাড়াও হাজারো কিসিমের পাখির বাসা এই গাছে। এই মুহূর্তে তারা সবাই চুপচাপ! পেট ভরে ডালপাতা খেয়ে নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে আকাশের দিকে শুঁড় তুলে হাঁকাড় দিলো দাঁতালটা। সসাগরা ধরিত্রী যেন কেঁপে উঠলো সেই বৃংহতিতে। আর তার গায়ে গায়ে লেগেই প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় ভেসে এলো গর্জনটা। কানহোর এক মূহুর্তও সময় লাগলো না, কে, কেন আর কোন উদ্দেশ্যে এ ডাক পাঠাচ্ছে। কিন্তু সিদো ভাইয়া, চাঁদ, ভৈরব ওরা সব কুথায়! আর ঠিক তখনই চোখে পড়লো, ঝড়ের ডানায় ভর দিয়ে উড়ে আসছে ওরা তিনজন। পিছনে সেই হুলের সময়ের হাজার সাথী! এর মানে একটাই। ডাকটা শুনে ফেলেছে ওরা সবাই! “হুল! জোহার হুল!” – গলা ফাটিয়ে আওয়াজ তুলে ঝড়ের ডানায় চেপে বসলো কানহো!

ভরা জোছনার আলোয় চকচক করছিলো খোড়ো চূর্ণির জল। প্রায় মাইলখানেক এগোনোর পর একটা সরু সোঁতা চূর্ণির গা থেকে আলাদা হয়ে বাঁয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে কোথায় যেন! সোঁতার দুপাশে ঝুপসি ঘন জঙ্গল। দুদিক থেকে ঝুঁকে পড়েছে জলের ওপর। ফলে দিনের বেলাতেও একটা আধো অন্ধকার আবছায়া ভাব ঘিরে থাকে এই জায়গাটাকে। আর রাতের বেলায় তো কথাই নেই। তবু গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে চলকে আসা আলোয় যদ্দুর চোখ যায় জনমনিষ্যির চিহ্নমাত্র নেই! শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক আর কুনো ব্যাঙের কটকট ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চরাচরে! তবে অন্ধকারে সাদা চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না মানে তো এমনটা নয় যে কেউ নেই। সোঁতা ধরে মাইলদুয়েক মত এগিয়ে গিয়ে ডান পাড়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে ভেতর দিকে একটু ভালো করে নজর চালালেই চোখে পড়বে একটা ভাঙাচোরা, প্রায় মাটিতে মিশে যাওয়া বিশাল ঢিবি মতো। আসলে ওটা একসময় এই গোটা অঞ্চলে সেন রাজাদের অসংখ্য কেল্লার মধ্যে একটা। কেল্লার ভাঙা পাঁচিলে বসা রাজা বিশ্বনাথ। বিশ্বনাথের পাশে ছেলেবেলার বন্ধু মেঘা শেখ। দুজনকে ঘিরে বসা বলা হাড়ি, ভগবান, পীতু, নোলে ডোবা…দলের আরও সবাই। বিষন্ন একটা হাসি হেসে সাথীদের দিকে তাকালো বিশ্বনাথ। “সেই কবেকার কথা! আজও ভেবে খুব খারাপ লাগে, সারাটা জীবন ধনীর ভান্ডার লুঠলাম আর গরীবের মধ্যে বাঁটলাম, নীলকর সায়েব, জমিদার, তাদের নায়েব, গোমস্তা, পাইক, লেঠেল আর কোম্পানির লালমুখো কর্তাদের ত্রাস এই আমি বিশ্বনাথ বাগদী, মা কালীর পাইক, গোটা চব্বিশ পরগণা, নদে, মুকসুদাবাদ (মুর্শিদাবাদ) জেলার গরীবগুর্বো মানুষ রাজা বিশ্বনাথ নামে ডাকতো আমায়। ওদিকে সায়েবসুবো আর জমিদারদের চোখে আমি ছিলাম বিশু ডাকাত, বিশে বাগদী, বিশে ডেকয়েট…বলতে বলতে ক্রমাগত চোয়ালজোড়া চেপে বসছিলো একে অন্যের গায়ে। “আসলে অনেকখানি ঘেন্না লুকিয়ে থাকতো ওদের ওইসব ডাকগুলোর মধ্যে। অথচ আশ্চর্য কান্ডটা দ্যাখ তোরা, আমি শয়তান লম্পটগুলোর মত গরীব প্রজার ঘর জ্বালাইনি, খাজনা আদায়ের জন্য হালের বলদ খুলে নিয়ে যাইনি, দিনের পর দিন গুমঘরে আটকে রেখে বাঁশডলা লাগাইনি, চাবুকপেটা করিনি, সোমত্ত মেয়ে বউদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাইনি, জুলুম আর লুটের টাকায় বাই নাচের আসর জমাইনি। সারা জীবন মেয়েদের মায়ের আসনে বসিয়েছি। তোদের সবাই জানিস সেটা। নারীজাতি মা কালিকার অংশ, তাদের গায়ে কখনোই হাত তোলা চলবে না। এই ছিলো আমার ফরমান। আর তোরা সবাই জানিস এই আদেশ অমান্য করার জন্য বোদেকে কি কঠিন সাজা দিয়েছিলাম আমি। তোদের মতই দলে ওর জায়গাও ছিলো অনেক উঁচুতে। তবুও তাকে ছাড়িনি আমি। কিন্তু খুব খারাপ লাগে ভেবে…” বলতে বলতে আরও বিষন্ন হয়ে উঠলো বিশ্বনাথের গলাটা, “সারাটা জীবন নীলকর সায়েব আর জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করলাম। টানা দুদিন ধরে এই কেল্লা আগলে কোম্পানির ফৌজের মুখোমুখি বুক চিতিয়ে লড়াই করে প্রাণ দিলি তোরা। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে লটকালো গোরা সায়েবরা…তবু আজও সব ভদ্দরলোক বাবুরা সেই কবে বৃটিশ সরকার আর জমিদারদের দেগে দেওয়া ‘বিশু ডাকাত’ বা ‘বিশে ডেকয়েট’ নামেই ডাকে আমাকে! এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে!”

“যাকগে, বাদ দে ওসব কথা।” পাশ থেকে বিশ্বনাথের কাঁধে হাত রাখলো মেঘা। “এবার বল, ওই যে এত্তেলাটা এসছে তার ব্যাপারে কি করবি?” “শোন, ওটা নানাসাহেবের এত্তেলা। সারা দেশ জুড়ে কোম্পানির বিদ্রোহী সেপাইদের লড়াইয়ের কথা তো তোরা সবাই জানিস। অনেক অত্যাচার চালিয়ে সেই মহা বিদ্রোহের আগুন নিভিয়েছিল লালমুখোরা। লড়াইয়ের নেতা তাঁতীয়া টোপি, ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ, সবাই শহিদ হলেও নানাসাহেবকে ধরতে পারেনি ইংরেজরা। সে পালিয়েছিল নেপালে। আজও সেখানে সে ভেসে বেড়াচ্ছে চিতওয়ানের জঙ্গলে! আর তার মত যোদ্ধা যখন ডাক পাঠাচ্ছে তখন সেই এত্তেলার একটা জোর তো অবশ্যই আছে। তাই আমার মত যদি শুনতে চাস তাহলে বলবো, আমি তো লড়তে এক পায়ে খাড়া। এবার তোরা তোদেরটা বল।” “আমরাও!” বিশ্বনাথের কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠলো সবাই! ব্যতিক্রম শুধু ভগবান। চোখে প্রশ্ন নিয়ে ওর দিকে তাকালো বিশ্বনাথ। “কি রে ময়রার পো? তুই যে কিছু বললি নে বড়?” জবাবে একটু দ্বিধা মাখা দৃষ্টিতে বিশ্বনাথের দিকে তাকালো ভগবান। “একবার তো সে চেষ্টা দিয়ে দেখলুম সবাই মিলে। সেই তো হারই হলো। আর এখন তো ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে গ্যাছে। আগে রাণীর সরকার কোম্পানির বানিয়াদের পুষতো, আর এখন তো উল্টে বানিয়ারাই রাজাদের পুষছে। তাই আমাদের বিপক্ষ দল আগের চাইতে অনেক বেশি তাকতদার এখন।” শোনার পর চোখে একটা চকচকে হাসি নিয়ে বন্ধুর দিকে তাকালো বিশ্বনাথ। “খালি একটা দিকই ভাবলি রে ময়রার পো। উল্টোটা ভাবলি নে? ভাবলি নে আমাদের দলটা এবার আগের চাইতে কত বড় হবে!” ভরা চাঁদের আলোয় লাগাতার ঝলসে উঠছিলো বিশ্বনাথের চোখদুটো! “আর সবচেয়ে বড় সুবিধের কথাটা মাথাতেই এলো না তোর!” লাফ দিয়ে উঠে ভগবানের পাশে গিয়ে বসলো বিশ্বনাথ। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে থরথরিয়ে! “আগে তো শরীরটা ছিলো। গুলি বিঁধতো, তলোয়ারের কোপে কাটা পড়তো, তোপের গোলায় উড়ে যেতো…আর এখন!” ঝলসানো চোখের দৃষ্টি সরাসরি বদলে গেছে আগুনে! “এখন তো সেটাই আর নেই! কাকে তরোয়ালে কাটবে ওরা! কাকে ফুঁড়বে গুলিতে! কাকে ওড়াবে তোপের গোলায়!” বলেই মেঘার দিকে ঘুরে তাকালো বিশ্বনাথ। “আমাদের ষোল দাঁড়ের বজরাটা গুছিয়েগাছিয়ে নে। আজ রাতেই পাল তুলে দেবো চূর্ণিতে। সিধে গিয়ে পড়বো গঙ্গায়। আদি সপ্তগ্রাম, চাঁদের নগর (চন্দননগর), শ্রীরামপুর হয়ে সিধে রিষড়া। সেখান থেকে তুলে নেবো কালো রায়, দমন রায় আর ওদের দলবলকে! ফের রওয়ানা দিয়ে শালিখা (সালকিয়া), কাসুন্দে, শিবপুর পেরিয়ে ভূকৈলাশ (খিদিরপুর) দইঘাট। নোঙর বাঁধবো ওখানে। পীতু আর বলা, ওরা যাবে রণপায়। জঙ্গলে জঙ্গলে। পথে ডেকে নেবে ওপরগস্তি আর শিকরে বাজের দলকে। সবাই মিলে এসে পৌঁছে যাবে দইঘাটে। কালীঘাট বুড়িগঙ্গা দিয়ে ছিপ বেয়ে চ্যালাচামুণ্ডাদের নিয়ে আসবে ভবানীপুরের মনোহর সর্দার। তারপর সবাই মিলে… জয় তারা! জয় কালী কলকাত্তাওয়ালি!” হাতের লাঠিটা শূন্যে তুলে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো রাজা বিশ্বনাথ বাগদী!

রাতের অন্ধকারে নারকেলবেড়িয়ার আকাশে ভেসে ভেসে ওই মাঠটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বাদুড়িয়ার সৈয়দ মীর নিসার আলি। আসলে রোজই খোঁজেন। এবং পান না যথারীতি। এত লোকবসতির ভীড়ে কোথায় যে হারিয়ে গেছে সেই বিশাল মাঠ! যে মাঠে তিনি বানিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা! সে এক দীর্ঘ ইতিহাস! কিন্তু আজও সবকিছু স্ফটিকের মত স্বচ্ছ তাঁর মনের আয়নায়। ‘মুসলমানদের দাড়ি রাখলে কর দিতে হবে।’ – এরকম ভয়ঙ্কর একটি আইন চালু করেছিলো গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। কৃষ্ণদেবের দেখাদেখি স্থানীয় আরো কয়েকজন জমিদারও এই একই পথ ধরে। এই শয়তানি কানুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। প্রথমে শুধু মুসলমানরাই এ লড়াইয়ে সামিল হলেও দেখতে দেখতে হিন্দুদের মধ্যে বিশেষ করে হাড়ি, মুচি, ডোম, বাগদি, কৈবর্ত… সমস্ত অন্তজ শ্রেণীর মানুষ দলে দলে এসে যোগ দিয়েছিল তাঁর এই আন্দোলনে। স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে গোটা উত্তর চব্বিশ পরগণা এমনকি তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই লড়াই। প্রাণের ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল জমিদারবাবুরা আর তাদের পোষা লেঠেলের দল। পিছনে চলে গিয়েছিল সৈয়দ মীর নিসার আলি নামটা। লড়াইয়ের সাথীরা আর গাঁয়ের গরীবগুর্বো মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তিতু মীর। এ লড়াইয়ের অবিসংবাদিত নেতা। দীনদুঃখীর মসিহা! কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এটাও বুঝেছিলেন, তাদের পা-চাটা দালাল জমিদারদের এই হেনস্থা কোম্পানি কখনোই মেনে নেবে না। আর সেটা বুঝেই প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। নারকেলবেড়িয়ার মাঠে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল সেই বাঁশের কেল্লা। কেল্লায় এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল তাঁর সেনারা। অন্তজ, দলিত, আদিবাসী, মুসলমান, কে নেই সেই সেনাবাহিনীতে? বাহিনীর সেনাপতি পদে নিজের ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে নিযুক্ত করেছিলেন তিতু। জমিদার মুক্ত উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ওয়াহবি নেতা মৈনুদ্দিন।

তিতুর ধারণাটাই কিন্তু সত্যি হয়েছিল। এক সকালে নারকেলবেড়িয়ার মাঠে এসে হাজির হয়েছিল কামান বন্দুকে সজ্জিত কোম্পানির বিশাল এক সেনাবাহিনী। তাতে দমে না গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। গোলবারুদে সজ্জিত বিশাল এক বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ। বন্দুকের গুলির বদলে তীর ধনুক, কামানের গোলার বদলে পাথর, কাঁচা বেল আর ঝুনো ডাব। তিতুর একের পর এক সেনা লুটিয়ে পড়ছিল মাটিতে তবু লড়াই ছাড়ছিলো না কেউ। কামানের গোলায় গোলায় একসময় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল তিতুর বাঁশের কেল্লা! আজও স্পষ্ট দৃশ্যটা দেখতে পান তিনি! চোখজোড়া শেষবারের মতো বুজে যাওয়ার আগে দেখেছিলেন, দাউদাউ জ্বলন্ত কেল্লা থেকে বেরিয়ে কোম্পানির ফৌজের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে আগুনে ঝলসে যাওয়া তাঁর যোদ্ধারা আর পরমুহূর্তেই গুলি খেয়ে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। মনে পড়েছে নিজেও ওই একইভাবে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে তাঁর সেনাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, তাঁদের এই লড়াই বৃথা যাবে না। ভবিষ্যতের স্বাধীনতা যোদ্ধারা এই লড়াই থেকেই শিক্ষা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় কি! – একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো তিতুর বুক চিরে! এ্যাতোগুলো বছর কেটে গেল! এ্যাতোবার এ্যাতো জায়গায় লড়াই হলো। তবুও গরীবগুর্বো মানুষের রাজ, ইনসাফের রাজ কায়েম হলো না আজও! কিন্তু এবার যে ডাকটা এসছে তাতে তো সাড়া পড়ে গেছে দেশের সব বিদ্রোহীদের মহলে। ভেসে ভেসে বিপুল এই মহাশূন্যের এদিকওদিক থেকে একটা প্রবল নড়াচড়া আর ব্যস্ততার ভাব বেশ অনুভব করতে পারছেন তিতু। অন্যায় আর জুলুমের খিলাফ জঙ্গ লড়নেওয়ালা দুনিয়ার যত বাগী, দ্রোহী মানুষের লড়াই। বিপুল ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে একজোট হওয়ার প্রখর সেই তাপটা বেশ অনুভব করতে পারছেন তিনি। কিন্তু এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভাগ্নে গোলাম আর মওলানা মৈনুদ্দিন সাহেবই বা কোথায়? কোথায় তাঁর সেই দুর্ধর্ষ হাড়ি, মুচি, ডোম, কৈবর্ত, বাগদি আর মুসলমান যোদ্ধারা? তবে তিনি নিশ্চিত, এ অপার মহাশূন্যে যেখানেই ভেসে বেড়াক না কেন, ডাকটা শুনতে পেয়েছে ওরা সবাই। এসে পড়বেই ওরা সবাই একজোট হয়ে। ততক্ষণ শুধু অপেক্ষা!

রাতের অন্ধকার আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় সভা বসেছে। সভায় উপস্থিত দাম্পারার জগন্নাথ সিং পাতর, রঘুনাথ সিং, কুইলাপালের সুবল সিং, বড়ভূম ধরকার সামান গুনজান, ধলভূমের রাজা জগন্নাথ ধল, বড়ভূম সাতারখানির লাল সিং, বিষ্ণুপুর রায়পুরের দুর্জন সিং, কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি, বিষ্ণুপুরের মাধব সিংহ দেব, ধলভূম দামপাড়ার বৈজনাথ সিং, বড়ভূমের গঙ্গা নারায়ণ। এদের প্রত্যেকেই খুব ছোট ছোট ভূখণ্ডে স্থানীয় গোষ্ঠী প্রধান বা অধিপতি। সেই ১৭৬৬ সাল থেকে আটষট্টি বছরেরও বেশি সময় ধরে ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছিলেন এরা প্রত্যেকে। কোম্পানির সাহেবরা যখন তাদের বশংবদ উচ্চবর্গের জমিদারদের সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলগুলোয় আসে এবং এইসব জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষদের পরিচয় জানতে চায়, জমিদার বাবুদের উত্তর ছিলো – “হুজুর মাই বাপ, এগুলো ছোটলোক চুয়াড় (চোয়াড়ে)। এই জমিদার বাবুদের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিলো স্থানীয় মানুষের ওপর যতটা বেশি সম্ভব খাজনা চাপিয়ে নিজেদের কোষাগার ভর্তি করা একইসাথে কোম্পানির ঘরে তার একটা বড়সড় ভাগ পৌঁছে দেওয়া। ওই অঞ্চল জুড়ে প্রবল দুর্ভিক্ষের সময়েও জমিদারবাবুরা তাদের খাজনা আদায় বন্ধ করেনি। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিলেন এইসব আদিবাসী গোষ্ঠীপতিরা। জমিদারবাবুদের ঘৃণা আর অবজ্ঞায় দেওয়া নামেই ইতিহাস হয়ে গেছিল চুয়ার বিদ্রোহ। যুগ যুগ ধরে চলা সে বিদ্রোহে একের পর এক ফাঁসিতে চড়েছেন, জেলখানায় পচেছেন, পাহাড় জঙ্গলে আত্মগোপন করেছেন এই সমস্ত গোষ্ঠীপতিরা। তারপর একদিন রক্তমাংসের খোলস ছেড়ে উঠে এসছেন এই মেঘমুলুকে মেঘের ভেলায়। কিন্তু সেই তীব্র দ্রোহের আগুনটা কারো মধ্যে নিভে যায়নি এতটুকুও।

সভা শেষে উঠে দাঁড়ালেন কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি। “সভার মতঠো তাহলে কি দাঁড়াইল বট্যে। আমার সবঠি মিইল্যে নানা সাহেবের লড়াইঠোয় যেইঞ্ছি কি নাই!” “লিয্যস যেইঞ্ছি!” গর্জে উঠে একযোগে জবাব দিলো সভা!

বিশাল এক সরোবর। রাত জোছনার আলোয় আলোয় ভেসে যাচ্ছে সেই মহা পুষ্করিণীর জল! সরোবরের পাড়ে জীর্ণ এক দেউল। বিশাল এক বটবৃক্ষের নামিয়ে দেওয়া অসংখ্য ঝুরির আড়ালে প্রায় ঢাকাই পড়ে গেছে ইটের দাঁত বেরিয়ে থাকা শরীরটা। অতি প্রাচীন এই দেউল ও বটবৃক্ষ। সময় এদের দুজনের বয়েসের হিসাব রাখতে ভুলে গেছে।

রাত দেঢ়টা মতো হবে। এই মুহূর্তে ভাঙাচোরা দেউলের অজস্র ফাটলওয়ালা বেদীটার একটা ফাটলের মধ্যে থেকে দুজনকে দেখছিল এ চত্বরে বহুকালের বাসিন্দা বুড়ো চাঁদবোড়া সাপটা। দুজনকেই চেনে ও। একটু রাতের দিকেই আসে ওরা। সাধারণ আর পাঁচটা দুপেয়ের মতো হেঁটে নয়। এই বটগাছটার পাকা ফলের মতোই কখন যেন টুপ করে খসে পড়ে বেদীর ওপর। ঠিক কোত্থেকে আসে ওরা? ব্যাপারটা ধরার চেষ্টা করেছে চাঁদবুড়ো বহুবার কিন্তু পারেনি। ঠিক খসে পড়াও যেন নয়। বরং হঠাৎ ফুটে ওঠাই যেন বলা যেতে পারে খানিকটা। আর যখনই বেদীর ওপর ফুটে ওঠে দুজন, তখন ধোঁয়া ধোঁয়া নরম একটা আলোর বলয় খেলা করতে থাকে ওদেরকে ঘিরে। হাজারটা জোনাকির আলো একজায়গায় জড়ো হলে যেমনটা হয় আর কি। নাঃ! কোনদিন চাঁদবুড়োর কোন ক্ষতি করেনি ওরা। চাঁদবুড়োও না। ওর মনে হয় ও যে এই খোঁদলটায় থাকে সেটা ওই দুজন ভালোমতই জানে। ঠিক যেমন জানে চাঁদবুড়ো। আসলে কেউ কাউকে বিরক্ত করতে চায় না। তবে যখনই আসে ওরা, ভারী কঠিন কঠিন সব কথাবার্তা বলে। চাঁদবুড়োর মাথায় ঢোকে না সেসব। আপাতত ওর দরকার বড়সড় একটা মেঠো ইঁদুর নিদেনপক্ষে পুকুরের ধারে কটকটানো একটা কুনো ব্যাঙ। বয়সের ভারে নড়বড়ে শরীরটাকে অতি কষ্টেসৃষ্টে ফাটল থেকে টেনে বার করলো চাঁদবুড়ো। তারপর বুকখানা ঘষটে ঘষটে নিঃসাড়ে নেমে গেল বেদী থেকে।

হাতদশেক দূরে বসে চাঁদবুড়োর বেদী থেকে নেমে যাওয়াটা দেখলেন পদ্মাসনে উপবিষ্ট ভবানীচরণ। একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তাঁর মুখে। একে অপরকে শ্রদ্ধা আর সম্মানের এই সম্পর্কটা চলে আসছে বহুকাল ধরে। ভবানীচরণ। বয়েস মাঝ সত্তরের কোঠায়। ঋজু, মেদহীন, গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় শরীর। বুক বেয়ে কোমর ছোঁয়া দুধ শুভ্র উপবীত। আজানুলম্বিত হাত দুটি হাঁটুর উপর রাখা। তাঁর একটু দূরে বসা এক রমণী। ত্রিশ উত্তীর্ণা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। পাকা পানপাতার মত মুখ। আর এসবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চোখজোড়া। গভীর, অন্তর্ভেদী! কিন্তু অহেতুক রুঢ়তার লেশমাত্র নেই কোথাও। অনেকটা সামনে ওই বিশাল সরোবরের মতোই।

বিষন্ন একটা হাসি চোখে নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালেন ভবানীচরণ। “কি দিনকালই না এলো রে বেটি! এই বর্ধমান জেলাতেই দ্বাদশ পুরুষের বাস আমাদের। কিন্তু হলফ করে করে বলতে পারি, দেশের এ অবস্থা আগে কোনদিন দেখিনি আমি। সেই কোন কৈশোরে সন্ন্যাসী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলাম। ইংরেজরা ছিলো বিদেশি শাসক। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে এদেশকে লুটতে এসেছিলো ওরা। আমাদের মত সন্ন্যাসী আর ফকিরদের চাষে চড়া হারে খাজনা বসিয়েছিল। হুবহু জিজিয়া করের মতই কর চাপিয়েছিল আমাদের সমস্ত তীর্থযাত্রার ওপর। ফকিরদের রেশম চাষের ওপরও চড়া হারে কর বসিয়েছিল ওরা। তাই আমরা বিদ্রোহ করেছিলাম। ধনী জমিদারের বাড়িতে ডাকাতি করেছিলাম। জীবন ধারণের প্রয়োজনে ন্যূনতম যেটুকু লাগে সেটা রেখে বাকিটা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলাম দরিদ্র বান্ধবের সেবায়। আর আজ দ্যাখ !” মেয়েটির দিকে তাকালেন ভবানীচরণ। “গোটা দেশটাই তো ডাকাতের হাতে। গুটিকয় মাত্র শ্রেষ্ঠী লুটছে দেশটাকে। এই অবস্থা চলতে পারে না! কিছুতেই না! ফলে একটু আগে যে আহ্বান এসেছে তাতে সাড়া দিতেই হবে আমাদের। এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই! কিন্তু মজনু তো এখনো এলো না?” বলতে বলতে অস্থির হয়ে উঠলেন ভবানীচরণ। “আপনি শান্ত হোন গুরুদেব, মজনু বাবার কানেও নিশ্চয়ই সে আহ্বান পৌঁছেছে। তাই…।” ভবানীকে শান্ত করতে চাইলো মেয়েটি। আর তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বেদীর অদূরে একটা সুড়ঙ্গ পথ। সেই একইরকম ধূসর মায়াবী আলোয় ভরে উঠলো অন্ধকার পথটা। এক দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ চেহারার পুরুষ। কালো আলখাল্লায় আবৃত শরীর গলায় কয়েক ছড়া রঙিন পুঁতি ও পাথরের মালা। ঘাড় ছাপিয়ে নামা চুল। একমুখ সাদা দাড়ি। হাতে বাঁকানো হেঁতালের লাঠি। আলোকবলয়কে সাথে নিয়ে উঠে এলেন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে। “সেলাম নাও বাবা ভবানী পাঠক! সেলাম মা দেবী চৌধুরানী! আসতে আসতে তোমাদের কথাগুলো কানে আসছিল আমার। ওই ডাকাতরা শুধু দেশ লুটছে না। সন্ন্যাসী আর ফকিরে লড়িয়েও দিতে চাইছে ওদের দোসর ওই রাজাগুলো। ওটা থামানোর জন্যও আমাদের এই শেষ যুদ্ধটায় নামা দরকার, ইনশাআল্লাহ!” “ঠিক বলেছো হে বাবা মজনু শা ফকির।” চরাচর কাঁপানো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন ভবানীচরণ। “আবার একটা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ না হলে এই লুটেরা আর দাঙ্গাবাজদের রাজত্ব শেষ হবে না!” রক্তবর্ণ চোখে দেবী চৌধুরানীর দিকে তাকালেন সন্ন্যাসী। “তোর দলবলকে খবর পাঠা মা! এখনি যেন চলে আসে এখানে! জয় মা জগদম্বে!” ফের একবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ভবানী পাঠক!

এলগিন রোডের মোড়ে বিশাল গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়িটার নীচে দাঁড়িয়ে নিজের মনে হেসেই চলেছেন আসফাকুল্লা খান। মাঝে মাঝেই ঘুরে দেখছেন এপাশওপাশে। কেউ দেখছে না তো? রাত প্রায় আড়াইটে। রাস্তাঘাট বেবাক ফাঁকা। উল্টোফুটে সার সার লক্ষী বাবু কা আসলি সোনা অওর চান্দি কা দুকান। ফুটপাতে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকা এক পাগল আর তার সঙ্গী নেড়ি কুকুরটা ছাড়া আর কেউ নেই গোটা চত্বর জুড়ে। পরমুহূর্তেই খেয়াল হলো, আরে ধুত্তেরি! কি সব উল্টোপাল্টা ভেবে চলেছেন তখন থেকে। তিনি কি আর আগের অবস্থায় আছেন নাকি। সেই কবেই তো পুরোনো খোলস ছেড়ে উঠে গেছিলেন ওই মেঘমুলুকে। ওখানকার পাকাপাকি বসিন্দা হয়ে। এলগিন রোডের মোড়ে নেমেছেন এই তো মুহূর্তকয়েক আগে। একটা বিশেষ প্রয়োজনে। ফিকফিক করে হাসার বদলে যদি গলা ফাটিয়েও হাসেন, সে হাসি শুনছে কে আর দেখতেই বা পাচ্ছে কোথায়?

ফের হাসতে শুরু করলেন আসফাকুল্লাহ। আসলে তাঁর হাসি পাচ্ছিল জেলার সাহেবের মুখটা মনে করে। ফৈজাবাদ জেলে ফাঁসির দিন একদম সকাল সকাল উঠে গোসলটোসল সেরে পাটভাঙা জামাকাপড় পড়ে অপেক্ষা করছিলেন। শুধু মনটা খুঁতখুঁত করছিল চিরুনিটার জন্য। সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না কোথাও। অথচ এরকম একটা দিনে…এইসব চিন্তাভাবনার মাঝখানেই বুটের আওয়াজ তুলে সেপাই সান্ত্রী নিয়ে কনডেমড সেলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন জেলার সাহেব। গার্ড সেলের তালা খোলামাত্র হেসে বাইরে বেরিয়ে এসছিলেন। “আপকে পাস কাঙ্গি (চিরুনি) হ্যায়?” সামনে দাঁড়ানো জেলার সাহেব। প্রশ্ন করেছিলেন তাকেই। শোনার পর বিস্ফারিত চোখে আসফাকুল্লাহর দিকে তাকিয়েছিলেন জেল অধিকর্তা। জীবনে বহু মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী দেখেছেন কিন্তু এরকমটা দেখেননি কোনদিন তাঁর এই জেলার জীবনে। “কিঁউ?” – বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে এটুকুই জিগ্যেস করতে পেরেছিলেন কোনমতে। “বাত অওর কুছ নহি জেলার সাহাব, আজ মেরা গওনা কা তারিখ থা। শোচা রহা থা কিঁউ না দুলহা বনকে হি চড় যায়ে।” বাকরুদ্ধ অধিকর্তা কোনমতে পকেট থেকে চিরুনিটা বার করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে গটগটিয়ে হেঁটে ফাঁসির মঞ্চে উঠে গেছিলেন তিনি। আসলে উত্তরপ্রদেশের বিপুল ধনী পরিবারের সন্তান। ওদের পরিবারে বেশ অল্পবয়সেই বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায়। সেই গওনারই তারিখ ছিল সেদিন। রাত আড়াইটের নির্জন এলগিন রোডের মোড়ে মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে এই মূহুর্তে একটা চোরা বিষন্নতার আভাস আসফাকুল্লাহর মুখে! কেমন দেখতে ছিলো সেই কিশোরী কন্যাটি! যার সাথে তাঁর জন্মের বন্ধনে বাঁধা পড়বার কথা ছিলো। সেও তো এতদিনে উঠে এসছে এই মেঘমুলুকে। এই বিপুল, অপার ব্রহ্মাণ্ডে চন্দ্র, সূর্য, তারাপুঞ্জ আর মেঘযূথের আঁকেবাঁকে বায়বীয় শরীরে ক্রমাগত ভেসে বেড়াতে বেড়াতে কখনও কি কোথাও কোন বাঁকে দেখা হয়ে গেছে? শুধু চোখের দেখাটুকু হয়নি বলে চিনতে পারেননি একে অপরকে! বলা হয়নি – “হাম তো তৈয়ার থেঁ সনম / সির্ফ হালাত দুশমন বন গয়ি!” হঠাৎই যেন সচকিত হয়ে উঠলেন আসফাক! এই ক্রান্তিকালে এসব কি ব্যক্তিগত সুখ চিন্তা এসে সওয়ার হচ্ছে তাঁর মাথায়! কত কাজ এখন? চিতোয়ানের জঙ্গল থেকে ডাক পাঠিয়েছেন নানাসাহেব ধুন্দুপন্থ রাও! সূত্রটা বেঁধে দিয়েছেন তিনি। মুল্কের তামাম ক্রান্তিকারীরা শুনেছে সেই ডাক! সুতোটাকে গিঁঠে গিঁঠে আরও মজবুত করে হাতে হাতে বেঁধে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে। এক আখরি ক্রান্তি! আখরি জঙ্গ! কিন্তু বিসমিল এখনও আসছে না কেন? ক্রমশঃ অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন আসফাকউল্লাহ! বাকি সবাই এতক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে ওখানে…আর ঠিক তখনই এক্সাইড মোড়ের দিক থেকে মিঠে সুরে ভেসে এলো গানটা! “শরফরোশি কি তমন্না আব হামারে দিল মে হ্যায় / দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু য়ে কাতিল মে হ্যায়!” মেট্রো রেল স্টেশনের গা ঘেঁষে গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে রামপ্রসাদ বিসমিল। এই গানটাই তো ফাঁসির আগের রাতে গোরখপুর জেলে সারারাত ধরে গেয়ে গেছিল ছেলেটা! ছুটে গিয়ে বিসমিলকে জড়িয়ে ধরলেন আসফাকুল্লা! “আ গয়েঁ কমরেড! “গাড়িবারান্দার এককোনায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পাগল আর কুকুরটা দেখলো নরম, ধূসর দুটো আলোকবলয় তীর গতিতে ছুটে গিয়ে মিশে গেল একে অপরের গায়ে। তারপর গতিটা আরো বাড়িয়ে উড়ে চলে গেল সামনে মোড়টার ওপর গুরুদোয়ারার দিকে!

গুরুদোয়ারার ঠিক গায়েই বলবন্তজীর লাইন হোটেল। সেই অগ্নিযুগে এখানেই তো গদর পার্টির সমস্ত মিটিংগুলো হতো। পরবর্তীতে তো তার নাম বদলে হলো হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান এ্যাসোসিয়েশন। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিবিহ্বল হয়ে পড়ছিলেন ওরা। ঘোরটা কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন দুজন। সদ্য বন্ধ হওয়া সরাইখানার ঘুমন্ত ও ভোরের শিফটের জন্য প্রস্তুত হওয়া চরম ব্যস্ত কর্মচারীরা, কেউই দেখতে পেলো না দুজনকে।

হোটেলের পিছনেই রসুইঘরের ছাদে ইতিমধ্যেই জমায়েতটা বেশ বড়। ভগত সিং, শুকদেব, রাজগুরু, অজয় ঘোষ, যতীন দাস, বটুকেশ্বর দত্ত, চন্দ্রশেখর আজাদ…কে নেই সেই ভীড়ে! ওদের দুজনকে ঢুকতে দেখে হইহই করে উঠলো সবাই! সুর তো মোটামুটি বাঁধাই ছিলো। এই মহা ক্রান্তিতে দল যোগ দেবে কিনা। তালি ধ্বনিতে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়ে গেল প্রস্তাব। মিটিংয়ের শেষে বলতে উঠলেন ভগত। বক্তব্য একটাই, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশের বিপ্লবী দলগুলোর সাফল্য না পাওয়ার অন্যতম বড় একটা কারণ তাদের একজোট না হতে পারা। ফলে স্বাধীনতা এলেও ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে দেশি শাসক আর পুঁজিপতি বানিয়াদের হাতে। কিন্তু এবারের এই মহা গদরে এই প্রথমবার দেশের সমস্ত ক্রান্তিকারিদের এক জোট হতে দেখা যাচ্ছে। হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান এ্যাসোসিয়েশন এই সর্বাত্মক বিপ্লবের সাথে থাকবে। সভার অনুরোধে ভগত, শুকদেব, রাজগুরুকে কোরাসে গাইতেই হলো ‘মোহে রঙ দে বাসন্তী চোলা।’ আর সবার শেষে অতি অবশ্যই রামপ্রসাদ বিসমিলের গলায় সেই ‘শরফরোশি কি তমন্না…’ যেখানে সে বারবার ঘুরেফিরে গাইবেই ‘আব তো মর মিটনে কা তমন্না দিল এ বিসমিল মে হ্যায়!’ সে সুরে গলা মিলিয়ে গাইতে গাইতেই ভোর রাতের আকাশে উড়ান দিলো সবাই। গায়েই পিজি হসপিটালের মর্গের করিডরে একটা বুড়ো সাধুর বোতল নিয়ে বসা নাইট ডিউটির দুই ডোম সুরজ আর রাজুয়া গুরুদোয়ারার পিছন থেকে উড়ে চলে যেতে দেখলো বিশল ধূসর, নরম আলোর বলয়টাকে। “হাম যো দেখল, তু কা ওহি দেখলি?” সুরজকে জিগ্যেস করলো রাজুয়া। “হাঁ, হাম ভি দেখল।” জবাবে ঘাড় হেলালো সুরজ। “লেকিন কিসি কো মত বতাইবি। মজাক করেগা কাল্লু, রমেশ…সবলোগ।” ফিসফিসে গলায় বললো সুরজ। তারপর ভোর রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বিলকুল থম মেরে বসে রইলো দুজন।

ঠিকানা ৭০ নম্বর পার্ক স্ট্রিট। জীর্ণ, প্রায় ভেঙ্গে পড়া দোতলা বাড়িটার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল দীনেশ আর বাদল। পাশে দাঁড়ানো সেই অনিন্দ্যকান্তি চেহারার মানুষটি। পালিশ করা গজদন্তের মত গাত্রবর্ণ। সরু ফ্রেমের চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুই চোখ। পরিধানে খাদির শ্বেতশুভ্র ধুতি পাঞ্জাবি আর চাদর। ইনিই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের প্রাণপুরুষ। যার উদ্যোগে হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল সংগঠন। সঙ্গে যোগ্য সহযোদ্ধা সুপতি গুহ, নেপাল নাগ, সুরেশবাবু… আরও অনেকে। ওরাই তো দলে এনেছিলেন দীনেশ আর বাদলকে। দলে সর্বকনিষ্ঠ বাদল। চিরকালই কথা কম আর কাজ বেশি – এই নীতিতে বিশ্বাসী, বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আবেগবিহ্বল সেও। ঝটিতি দীনেশের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে উঠলো – “মনে পড়ে, নশুদা? এই বাড়িতেই তো সুপতিদা নিয়ে এসছিলেন আমাদের দুজনকে। ওই তো দোতলায় দুই ডাক্তারবাবু হিমাংশু ব্যানার্জি আর অনিমেষ রায়ের চেম্বার। পিছনের ছোট ঘরটায় আমাদের শেল্টার…মনে পড়ছে নশুদা! মনে পড়ছে, রাইটার্স অভিযানে যাওয়ার আগে সারারাত রবি ঠাকুরের গান গেয়ে আর কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলে তুমি! ‘যত বড়ো হও / তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও / আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো’ এই শেষ কথা বলে / যাবো আমি চলে।।’… আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে নশুদা!” পাশ থেকে বাদলের কাঁধে হাত রাখলেন সেই অনিন্দ্যকান্তি পুরুষটি। “এইজন্যই তো তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি আমি। যাতে এই মহা ক্রান্তিকালের আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তোমাদের সেইসব বীরগাথা আর শাহাদাতের কথা মনে পড়ে যায়। তোমার মনে আছে দীনেশ, জেলখানার কনডেমড সেল থেকে ফাঁসির মাত্র কদিন আগে তোমার মাতৃসমা বৌদিকে চিঠি লিখেছিলে তুমি? লিখেছিলে – ‘ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া ওঠে। তবে আমাদের মরণের এত ভয় কেন? ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে ধর্মের নামে পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ দশ বছরের মেয়েকে বিবাহ করিতে পারে, সে দেশে ধর্ম কোথায়? সে দেশের ধর্মের মুখে আগুন। যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া উচিৎ। সবার চাইতে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সে বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিতেছি। একটা গরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্যি শুনিয়া আমরা ভাই ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ভগবান আমাদের জন্য বৈকুন্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না খোদা বেহস্তে আমাদিগকে স্থান দিবেন? যে দেশকে ইহজন্মের মতো ছাড়িয়া যাইতেছি,যার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পরম পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তাহার সম্বন্ধে এসব কথা বলিতে হইল!’…তুমি চলে যাওয়ার পর জেল থেকে তোমার মা, বোন আর বৌদিকে লেখা তোমার চিঠিগুলোর একটা সংকলন বার করেছিলাম। যদি পড়ে মানুষের বোধদয় হয়। তা আর হলো কই! উল্টে তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। আজ তো তোমার ভাষায় সেই ধর্মের নামে অধর্মের কারবারিদেরই রাজত্ব গোটা দেশ জুড়ে। এদের বিরুদ্ধেই তো একসময় দেশের মানুষকে লাঠি ধরার নিদান দিয়েছিলাম আমি। অথচ ঘটলো তার উল্টোটা। মন্দির, মসজিদ, কে কি খাবে পড়বে, এসবের ভিত্তিতে ভাগ করতে চাওয়া হচ্ছে মানুষকে!” বিষন্নতায় ভরে উঠছিল মানুষটার মুখনিঃসৃত একেকটা শব্দ! “তাই এদের বিরুদ্ধে আরেকবার রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন।” দীনেশের দিকে তাকালেন তিনি। “রাইটার্স অভিযানে যাওয়ার আগে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিড়িয়াখানার সামনে বিনয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে তোমরা, মনে আছে তো? এবারও ঠিক তাই। ওখানেই বিনয় অপেক্ষা করবে তোমাদের জন্য। হেমবাবু, সুপতিবাবু, নেপালবাবু, সুরেশবাবু…বিনয়ের সঙ্গে ওরাও সবাই থাকবেন ওখানে। আর দেরী না করে এবার রওয়ানা দাও দুজন।” “আপনি যাবেন না সর্বাধিনায়ক?” সামান্য বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলো দীনেশ। “যাবো।” দীনেশের চোখে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন মানুষটি। “তবে ঠিক এই মুহূর্তে নয়। তার আগে আমাকে যেতে হবে আমার আজাদ হিন্দ ফৌজ, আই এন এ-র সমস্ত বীর যোদ্ধাদের কাছে। প্রেম সায়গন, শাহনওয়াজ খান, রশিদ আলি…আমার আরও সব কমরেডরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ক্যাপ্টেন লক্ষী সায়গলের নেতৃত্বে অপেক্ষা করছে ঝান্সি রাণী ব্রিগেডের বীরাঙ্গনারা! ওদের সবাইকে সাথে নিয়ে যথাসময় তোমাদের প্রত্যেকের সাথে মিলিত হবো আমি। তবে যাওয়ার আগে তোমার কাছে একটি বিশেষ অনুরোধ আছে আমার। সেদিন রাইটার্স যাত্রার আগে শেষ যে রবিবাবুর কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলে তুমি, সেটি যদি আরেকবার শোনাও…ওই পাঠ শুনতে শুনতে কয়েক আলোকবর্ষ পথ আনায়াসে পেরিয়ে যাবো আমি। “অবশ্যই শোনাবো!” উদাত্ত কন্ঠে তার পাঠ শুরু করলো দীনেশ। “ঘরে ঘরে শূন্য হলো আরামের শয্যাতল / ‘যাত্রা করো যাত্রীদল’ / উঠেছে আদেশ, / ‘বন্দরের কাল হলো শেষ’ / মৃত্যু ভেদ করি / দুলিয়া চলেছে তরী / কোথায় পৌঁছিবে ঘাটে, কবে হবে পার / সময় তো নাই শুধাবার…” গলা ক্রমশঃ সপ্তমে ছড়ছিল দীনেশের!…” বাহিয়া চলিতে হবে তরী / এসেছে আদেশ / বন্দরের কাল হল শেষ…” শুনতে শুনতে অন্তরীক্ষে উড়ান দিলেন সর্বাধিনায়ক। পাশাপাশি হাতে হাত রেখে বাদল আর দীনেশও।

চট্টগ্রাম পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে কিছুটা দূরে তেকোনা বাঁধানো জায়গাটায় এককাত হয়ে শুয়ে রয়েছে রাণী। যখন একঘেয়ে আর আকাশে ভেসে ভেসে বেড়াতে ভালো লাগে না, তখন এভাবেই মাঝে মাঝে এসে শুয়ে থাকে এখানে। মসৃণভাবে ছাঁটা ঘাসজমির ওপর একটু দূরেই ওর স্মৃতি ফলক। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো রাণী। সেই কতকাল আগে ওর বীরগাথার কথা খোদাই করা রয়েছে ওই ফলকটায়। আজও সেই রাতটা ছবির মত স্পষ্ট ওর চোখে! মাস্টারদার নির্দেশে সদলবলে ওরা আক্রমণ চালিয়েছিল পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবে। উচ্চপদস্থ সব বৃটিশ অফিসারদের নৈশ পার্টি চলছিলো সেখানে। হামলায় হতাহতের সংখ্যা একাধিক। এ্যাকশন শেষে ইউরোপিয়ান ক্লাব জ্বালিয়ে দিয়েছিলো বিপ্লবীরা। দলের নেতৃত্বে ছিলো রাণী। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে অদূরে ওদের ঘিরে ফেলেছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী…ঘাসের বিছানায় ঘুরে শুয়ে অপরিসীম ক্লান্তি চোখে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো রাণী! বেঁচে থাকতে বৃটিশ পুলিশের কাছে কিছুতেই ধরা দেবে না, প্রথম থেকেই সিদ্ধান্তে অটল ছিলো ও। ফলে অকুতোভয় মুখে পুরে দিয়েছিল সায়ানাইড ক্যাপসুলটা। পরমুহূর্তেই বিদেশি শাসকের কোটালবাহিনীর নাগাল এড়িয়ে উড়ান দিয়েছিলো মেঘলোকে। তবে সেই তীব্র হলাহলের প্রভাব বোধহয় আজও রয়ে গেছে। সবসময় অসম্ভব ক্লান্ত লাগে। নরম ঘাসের বিছানায় আবার বুজে আসছে চোখজোড়া, ঠিক তখনই পিছন থেকে কাঁধে একটা ছোট টোকা, “বক্কা মেয়্যা, ইত্তে বড় ক্রান্তির সময় দেশের সব স্বাধীনতা সংগ্রামীরা একজোট হইছে তখন তুই বাঘের বেটি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, পড়্যে পড়্যে ঘুমাইছু। দ্যাখ বেটি! আমি তমলুকে পিছাবনি গেরামের গান্ধীবুড়ি মাতঙ্গিনী হাজরা, নিজে এত্তেদূর হেঁইটে আসিছু তকে সাথে নিয়ে যেইতে। চল উইঠে গা গতর ঝাড়ান দে! দ্যাখ আমার সাথে কারা এইসেছে।” আবেগে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল রাণীর। মাতঙ্গিনীর পিছনে দাঁড়ানো শান্তি, কল্পনা, বীণা, উজ্জ্বলা, লতিকা, প্রতিভা, ইলা, গীতা, অহল্যা মেঝেন …আরও অনেকে। এক ঝটকায় সব ক্লান্তি কোথায় উধাও হয়ে গেল। তার বদলে সেই বাঘিনী চোখের দৃষ্টি! যে চোখ সেই রাতে বিদ্যুত হয়ে জ্বলে উঠেছিল পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাবে! এগিয়ে এসে মাতঙ্গিনীর হাতটা চেপে ধরলো রাণী। আবেগরুদ্ধ গলায় বলে উঠলো “আমি প্রস্তুত, মা মাতঙ্গিনী! একবার শুধু বলো কোথায় যেতে হবে!”

ভোর রাতে ভগত, আসফাকুল্লাহ, যতীন, শুকদেব, বটুকদের সবাই মিলে বলবন্তজীর হোটেলের ছাদ থেকে মেঘলোকে ওই উড়ান দেওয়াটা দেখলেন কবি। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিগেড ময়দানে এই বড় বড় গাছগুলোর নীচে একইভাবে বসে রয়েছেন তিনি। আইসক্রিম গাড়িওয়ালা, খেলতে আসা ছেলেপুলেরা, প্রি ওয়েডিং শুটিং পার্টি, প্রেমিক প্রেমিকা, ঘোড়াওয়ালা, প্রাতঃভ্রমণকারী দল, ময়দান বেশ্যা, পুলিশ, মিটিংয়ে আসা লোকজন…কেউ দেখতে পায়না তাঁকে। কিন্তু গাছপালা, গাছে গাছে অজস্র পাখি, পথ কুকুর, রোঁয়া ওঠা বেড়াল, কাঠবেড়ালি, পিঁপড়ে, বক, পাঁজরা ঠেলে বেরোনো ঘোড়াগুলো…ওরা সবাই কিন্তু দেখতে পায়। পাশে এসে শুয়ে থাকে যত হাড় জিরজিরে কুকুর আর রোঁয়া ওঠা বেড়ালেরা। মাথায় এসে বসে দোয়েল, চড়াই, ফিঙে, ছাতারে, খঞ্জন। গা বেয়ে ওঠে পিঠে তিন ডোরা কাঠবেড়ালি। শীত আসার আগে খাবার মুখে নিয়ে পাশ দিয়ে সার বেঁধে গর্তের দিকে হেঁটে চলে যায় পিঁপড়ের দল। “আসি গো, ফের দেখা হবে গরমকালে” – যাওয়ার সময় ক্ষুদে ক্ষুদে শুঁড়গুলো নাড়িয়ে বলে যায় কবিকে। কাছে এসে দাঁড়ায় রোগাসোগা ঘোড়ারা, নিজেদের দুঃখের কথা, ক্ষিদের কথা বলে। ওদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন কবি। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আদর খায় ওরা। তারপর হঠাৎই একসময় খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে ময়দানের খোলা প্রান্তর ধরে ছুট লাগায় তীর গতিতে। ঘুরতে আসা মানুষ, ঘোড়াওয়ালা… সবাই ভাবে ওরা বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। “বিলকুল পাগলা গিয়া শালেলোগ!” – হা হা হেসে ওঠে ঘোড়াওয়ালা মালিক। এ অগোছালো, এলোমেলো এসব ছবি দেখতে দেখতেই বছরের পর বছর কেটে যায় কবির। সেই কবে এরকমই এক ভোর রাতে তাঁর অধ্যাপক বন্ধুর শরত বোস রোডের বাড়ি থেকে তাঁকে এই ব্রিগেড ময়দানে তুলে এনেছিলো এস বি-র কালো ভ্যান। কোমরে সার্ভিস রিভলবার ঠেকিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এই গাছগুলোর তলায়। দলটার নেতা টর্পেডো। চৌকোনা থ্যাকড়াটে মুখ, মুশকো চেহারা, নাকের নিচে মোটা শুঁয়োপোকা মোচ, ধূর্ত, ক্রুর চোখজোড়া নাচিয়ে জিগ্যেস করেছিল – “এখন কি ভাবছেন?” “বিপ্লবের মৃত্যু নেই!” – পাল্টা মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলেন কবি। পরমুহূর্তেই ভোর রাতের নিস্তব্ধতা চিরে ‘ফ্যাটাক!’ ‘ফ্যাটাক!’ কয়েকটা কালীপটকা ফাটার মতো শব্দ আর ছুটে আসা তীব্র আলোর ঝলকানি! মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন কবি। মহাশূন্যে উড়ান দিতে দিতে দেখেছিলেন তাঁর শরীরটাকে চ্যাংদোলা করে বড় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কালো ভ্যানটায় নিয়ে গিয়ে তুলছে ঘাতকেরা। মূর্খগুলো জানতো না, শরীরটাকে মেরে ফেলেও আদর্শটাকে ধ্বংস করা যায়না! ওটা অবিনাশী!

ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালেন কবি। অশথ গাছটার গুঁড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা সেই কবেকার মলিন, ফুটোফাটা কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা। ঝোলার মধ্যে রবি ঠাকুর, মায়াকভস্কি, গর্কি… ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে রবি ঠাকুরের বইটা বের করে আনলেন কবি। কয়েক পাতা ওল্টাতেই সেই অগ্নির আখর মালা! যা প্রায় একই সময়ে তাঁদের সর্বাধিনায়ককে পাঠ করে শোনাতে শোনাতে সাথী বাদলের হাত ধরে অন্তরীক্ষে উড়ান দিচ্ছে দীনেশ! “যাত্রা করো যাত্রীদল / উঠেছে আদেশ / বন্দরের কাল হলো শেষ…” পড়তে পড়তেই বাতাসের ডানায় সওয়ার হলেন কবি।

ভোরের শিশিরে জবজবে ভিজে পি জি হাসপাতালের লাল বাড়ির এ্যাজবেসটাস মোড়া ছাদ। গায়ে লাগা ময়দান আর ভিক্টোরিয়ার খোলা চত্বরের দিক থেকে ভেসে আসা শীতল কাকভোরের হাওয়া গায়ে মেখে ভাসতে ভাসতে ছাদে নেমে এলেন কবি। নীচে দোতলার ওয়ার্ডে লোহার বিছানায় শুয়ে রয়েছেন তাঁর নেতা। ঠেলে বের হওয়া কন্ঠার হাড়, পেথিড্রিন ইনজেকশন নিতে নিতে নীল হয়ে ফুলে ওঠা হাতের শিরা, অস্থিচর্মসার চেহারা। পরিধানে কনুই অবধি হাতা গোটানো মলিন আকাচা বাংলা শার্ট আর ঢোলা পাজামা। আর সে সবকিছুকে ছাপিয়ে মোটা ফ্রেমের চশমার কাচের পিছনে সার্চলাইটের মতো উজ্জ্বল একজোড়া চোখ! বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কবি। দু’হাতে চেপে ধরলেন রোগা রোগা আঙুলগুলো। সঙ্গে সঙ্গে পুরু কাচের আড়ালে যেন বিদ্যুৎ চমকালো চোখ দুটোয়! “আপনি এসে গেছেন কমরেড!” থরথর কাঁপছিল শীর্ষ নেতার শীর্ণকায় শরীরটা! “দেশ জোড়া এই বিপুল দ্রোহের পুনর্জাগরণ! সমস্ত দ্রোহীরা নিজেদের মধ্যে যত মতভেদ আর ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থ মুছে ফেলে একজোট হয়েছে এই প্রথমবারের মত, যা এদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। এই বিপুল ক্রান্তিলগ্নে আপনি সামিল হবেন না, এটা তো অকল্পনীয়! তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম আপনার আসার ব্যাপারে। সময়ের অপেক্ষা ছিলো কেবল। ফলে আর দেরী নয় কমরেড! বেরিয়ে পড়া যাক এই মুহূর্তে!” উত্তেজিতভাবে বিছানায় উঠে বসলেন শীর্ষ নেতা! জবাবে ঠোঁটের কোনে চির স্মিত হাসিটা নিয়ে নেতার দিকে তাকালেন কবি। “বেরিয়ে পড়তে তো হবেই। তবে এ নিয়ে একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে আমার। আপনিও ভেবে দেখতে পারেন প্রস্তাবটা।” “বলুন না কমরেড!” আগ্রহভরে কবির চোখে তাকালেন নেতা। “আমরা দুজনেই উত্তরদিকে যাবো। তবে একটু আলাদা আলাদাভাবে। আপনি যাবেন তরাইয়ে, আপনার ঘাঁটি এলাকায়। ডেকে নেবেন পুরোনো লড়াইয়ের সাথীদের, আর আমি যাবো উত্তর কোলকাতা। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে অনেককে একজোট করতে হবে ওদিকটায়। তারপর সবাই মিলে রওয়ানা দেব দক্ষিণে। আমি নিশ্চিত, ওখানেও অনেকে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য!” “এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব, কমরেড! কাজ অনেক তাড়াতাড়ি এগোবে।” মোটা চশমার কাচের পিছনে জ্বলজ্বল করে উঠলো নেতার চোখ দুটো!” “আর হ্যাঁ,” স্মিত হাসিটা ঠোঁটের কোনে রেখেই নেতার দিকে তাকালেন কবি। “যাওয়ার পথে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে তিমির, পবিত্র, শান্তি, কালাচাঁদ…ওদের সবাইকেও ডেকে নেবেন অনুগ্রহ করে। আজও ঠায় সেলের ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে আছে ওরা সবাই!” কবির হাসিমুখ বদলে যাচ্ছিল বিষন্নতায়! কবির কাঁধে হাত রাখলেন নেতা। “অবশ্যই কমরেড! চিন্তা করবেন না একদম! এবার চলুন, রওয়ানা দেওয়া যাক!” কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেবিন জুড়ে ধূসর আলোময় ঘূর্ণিঝড় উঠলো একটা। লোহার বেড, ঝুলন্ত স্যালাইনের বোতল, রক্তের পাউচ নড়ে উঠলো তার তোড়ে। ‘দড়াম!’ শব্দে কেবিনের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঝড়টা! বাইরে করিডরে ঝাড়ু দিতে দিতে বুড়ো জমাদার ঝগড়ু কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলো ঝড়টাকে। রিটায়ার হবে আসছে বছর। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে, এসব অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার মাঝেসাঝেই ঘটে এখানে। রামজীর নাম নিয়ে বারকয়েক কপালে হাত ঠেকালো ঝগড়ু। তারপর ফের লেগে গেল কাজে।

কাকভোরের এস এন ব্যানার্জি রোড। মেটে লাল রঙের প্রাচীণ পাড়ার মন্দিরে টুংটাং ঘন্টার শব্দ। ভোরের পুজোর প্রস্তুতি। একদম গায়েই তালতলা লেনের মুখে রেলিঙ ঘেরা শহিদ বেদীটার নীচে ক্রিকেট খেলছিল পুরো তালতলা টিম। কাজল, সাধন, কানু, অশোক…আরো অনেকে। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কবি। “আপাততঃ এসব তো একটু স্থগিত রাখতে হবে কমরেডস্! আবারও এর চাইতে অনেক বড় একটা ময়দানে খেলতে নামার ডাক এসে গেছে যে!” “ও, আপনি এসে গেছেন!” একমুখ ঝকঝকে হাসি নিয়ে সামনে এগিয়ে এলো টিম ক্যাপ্টেন কাজল ব্যানার্জি। বলেই পিছনে ঘুরে তাকালো দলের সবার দিকে “চল রে সবাই! ফের ডাক এসে গেছে!” শোনা মাত্র ব্যাট, বল, প্যাড, উইকেট, গ্লাভস ছেড়ে বেদীর তলা থেকে বেড়িয়ে এসে ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ান দিলো সবাই!

কাকভোরের হিম গায়ে মেখে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাদের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে নামলো পুরো দলটা। ভোরের কলেজ স্ট্রিট এখনো জাগেনি সেভাবে। প্রেসিডেন্সি, কফি হাউস আর হিন্দু স্কুলের গা ঘেঁষে সার সার বইয়ের দোকান, ভাতের হোটেল, শাড়ির দোকান, পাতিরামের স্টল, ফলের ডালা, বর্ণপরিচয়, ব্যান্ড পার্টি, পান গুমটি…সবার ঝাঁপ বন্ধ এই মূহুর্তে। মাঝে মাঝে কাকভোরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ছুটে চলে যাওয়া ট্রাম, বাস আর কিছুটা দূরে কলাবাগানের গলি থেকে হাল্কা ভেসে আসা ডাব পট্টির কোলাহল ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চরাচরে! মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে স্মৃতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলেন কবি। হিন্দু হস্টেল, কফি হাউস, মেডিক্যাল কলেজের পরিত্যক্ত ঘর, প্রেসিডেন্সির ল্যাব রুম…শৈবাল, সন্তোষ, অসীম, দীপাঞ্জন, সন্তোষ, রমেন, প্রদীপ, নির্মল, শক্তি, দোদুল…কত গোপন মিটিং আর পার্টি ক্লাসের স্মৃতি এই এলাকা জুড়ে! কলেজ স্ট্রিট মোড়ের গায়েই প্রেসিডেন্সির দেওয়াল ঘেঁষে ভবানী দত্ত লেন। বাঁকের মুখেই কোমর সমান উঁচু তোকোনা শহিদ বেদীটা। কালগ্রাসে জীর্ণ, অযত্নের ছোপ সারা গায়ে! প্রায় মুছে যাওয়া একদা অগ্নি আখরে লেখা কয়েকটা নাম! অজয়, অনুপ, বিধু, শঙ্কু, শেখর, গোবিন্দ, সুকুমার…তালতলা ক্রিকেট টিমকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন কবি। পা মুড়ে বসে ডাক দিলেন নরম গলায়। “ও ছেলেরা? শুনতে পাচ্ছো? সেই কবে থেকে ঘুমিয়ে রয়েছো সবাই। এবার একটু উঠতে হবে যে। সময়ের ডাক এসে গেছে!”

মূহূর্তকয়েক বাদে যেন হাল্কা নড়ে উঠলো জীর্ন বেদীটা। পরমুহূর্তেই সে কম্পন তীব্র হলো! একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ছেলেরা সবাই। অজয়, ধুতি পাঞ্জাবী, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, বিশালদেহী শঙ্কু, চির সপ্রতিভ বিধু, বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারার লাইট ওয়েট বক্সার সুকুমার, সদা হাস্যময় গোবিন্দ… সহযোদ্ধারা সব জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে। কতদিন বাদে দেখা! কথা আর ফুরোতে চায় না যেন! “আর দেরী করাটা ঠিক হবে না কমরেডস্। আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে আমাদের।” শোনামাত্র হাতে হাত বেঁধে নিলো সবাই। শ্যামবাজারের দিকে উড়ে চলে গেল ঝড়টা!

পাঁচমাথার মোড়ের আগেই ফড়িয়াপুকুর। হাত বিশেক দূরেই মোহনবাগান লেন। গলির মোড়েই প্রতীপের শহীদ বেদী। কবি অবাক হয়ে গেলেন দেখে, ডাকাডাকির আগেই বেরিয়ে এসে বেদীর গায়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে সে। ঠোঁটের কোণে সেই চির পরিচিত হাসি! হাওড়া জেলে পাঁচহাতি ডান্ডার মারে মারে থেঁতো হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও নাকি হাসিটা লেগেই থেকেছিলো মুখে। দলটাকে দেখামাত্র উঠে এগিয়ে এলো সামনে। “যাওয়া যাক তাহলে?” বললো একদম স্বাভাবিক গলায়। জানতোই যেন, যেতে হবে। তবে দ্বিতীয় ঘটনাটাও কিছু কম আশ্চর্যের ঘটলো না। উড়ান দেওয়ার আগের মুহূর্তে নেমে এসে সামনে দাঁড়ালো আরেকজন। ঠাসবুনোট একমাথা ব্যাকব্রাশ চুল। হাত মুঠো করে অভিবাদন জানালো সবাইকে। “আমি বঙ্কিম বিশ্বাস, বাবলা। কাশীপুর বরাহনগর জয়েন্ট এ্যাকশন স্কোয়াড লিডার।” পরিচয় দিয়ে তাকালো কবির দিকে। “আপনারা সবাই ওদিকেই যাচ্ছেন তো? চলুন, আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই আপনাদের।” উল্টোফুটে ট্রামলাইন লাগোয়া পুরোনো মসজিদটার মাথার ওপর দিয়ে মগরিবের আজান শুনতে শুনতে উড়ান দিলো দলটা!

রায় মুরারিচাঁদ চৌধুরী রোড। গঙ্গাকে একধারে শুইয়ে রেখে আলমবাজার থেকে বরাহনগর হয়ে সোজা চলে গেছে সেই কাশীপুর অবধি। গঙ্গার পাড়ে একের পর এক প্রাচীণ সব ঘাট। শিলাঘাট, কুঠিঘাট, ঠাকুর ঘাট, রতনবাবুর ঘাট, ডিমের কুসুম রঙা প্রথম সূর্যের আলো, গঙ্গার জলে ঘাই মেরে ওঠা শুশুকের পিঠে সেই আলোর ঝিলিক, ভাসমান বয়া, পাট, বাঁশ আর টালির নৌকো, ভোরের প্রথম যাত্রীবাহী স্টিমার, ভেসে যাওয়া ফুল, বেলপাতা, কচুরিপানা, পাড়ের গায়ে ছোট বড় মন্দির, মঠ, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কাঠামো, পলিপ্যাক, আধ ভাঙা বিয়ারের বোতল, ছেঁড়া কন্ডোম, ফেন্সিডিল, কোরেক্সের খালি শিশি, মড়া পোড়ার কটু গন্ধ, ওড়া ছাই, কবি তুষারের বাড়ি, রঘু ডাকাতের মন্দির…এই সবকিছুর অনেকটা ওপরে শূন্যে ভাসছিল পুরো দলটা। স্কোয়াড লিডার বাবলা, থেকে থেকেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল – “তোরা সব কোথায়? পাড়ে উঠে আয় তাড়াতাড়ি!” সে ডাকে সাড়া দিয়ে পচা ফুল, বেলপাতা আর কচুরিপানা দুহাতে সরিয়ে সরিয়ে জল থেকে উঠে আসছিল চিন্ময়, করুণা, অষ্ট, ভন, কেলুয়া, উৎপল, কেলেবাবু…আরও অনেক, অনেক সব ছেলেপুলেরা। চাকুর মার, বুলেটের ফুটো, ভোজালির কোপ, মুখে ঢেলে দেওয়া আলকাতরা আর এ্যাসিডের পোড়া দাগটাগ সব বিলকুল মিলিয়ে গেছে কোথায়! সাঁতরাতে সাঁতরাতে রতনবাবুর ঘাটে উঠে এলো সবাই। নীচে নেমে এলো ওপরে ভাসমান দলটা। বিশাল জমায়েত রতনবাবুর ঘাটে! ঘাটলার পাঁচিলে উঠে দাঁড়ালেন কবি। “আপনারা তো সবাই এতক্ষণে জেনে গেছেন দেশ জুড়ে এই শেষ যুদ্ধে যাওয়ার আহ্বানের কথা। ফলে অতিরিক্ত কথায় অযথা কালক্ষেপ করে আর লাভ নেই। এখনো অনেক জায়গায় পৌঁছোনো বাকি আমাদের। যেতে হবে আরো উত্তরে, তারপর দক্ষিণে। বারাসাত, ডানকুনি, শ্রী কলোনি, কসবা, ঢাকুরিয়া, হালতু, বেহালা, কালিকাপুর, পালবাজার…সমীর, শঙ্কর, জলিল, বুনো, সুদেব, শশী, গুরুদাস, শ্যামল, গোগনা, রন্টু, দিলীপ, আশু, অজিত, শিল্টু, ননী, শ্যামল, বাবলু, নীল, প্রবীর, প্রতীপ, পরিতোষ, ননী, খোকন…ওরা সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! লেট’স মার্চ অন কমরেডস্!” সেই সুরে সুর মিলিয়ে পিছন থেকে কে গেয়ে উঠলো – “আহ্বান, শোনো আহ্বান, / আসে মাঠঘাট বন পেরিয়ে / দুস্তর বাধা প্রস্তর / ঠেলে বন্যার মত বেরিয়ে…!” দেখতে দেখতে সগর্জন কোরাসে পরিণত হল সেই গান! রতনবাবুর ঘাট থেকে আরো উত্তরে ধেয়ে গেল ঝড়টা!

বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের ভ্যাপসা, দুর্গন্ধময় আলো আঁধারি সেলটায় ঘোলাটে হলুদ বাল্বটার নীচে শুয়ে ছিলো ওরা। ওরা বলতে তিমির, পবিত্র, শান্তি, কানাই, কালাচাঁদ। শুয়ে শুয়েই ওদের দিন কাটে এখানে। মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে কথা বলে ওরা। পুরোনো সেইসব ঝোড়ো সময়ের কথা। দ্রোহের দিনগুলোর কথা। সবশেষে অবধারিতভাবে এসেই পড়ে আঁধারের চেয়েও কালো রাতটার কথা। রাতের অন্ধকারে সেলে ঢুকেছিল ওয়ার্ডার, মেট আর সেপাইদের যৌথ ঠ্যাঙারে বাহিনী। হাতে হাতে পাঁচহাতি তেল খাওয়ানো ডান্ডা আর তীক্ষ্ণ বেয়নেট। সারারাত ধরে খুঁচিয়ে আর পিটিয়ে প্রায় মাংসপিণ্ড বানিয়ে ফেলা দেহগুলোকে তুলে নিয়ে গেছিল পরদিন ভোরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালতি বালতি জল ঢেলে ধুয়েমুছে সাফ করে ফেলা হয়েছিল থ্যাঁতলানো ঘিলু, হাড়ের কুচি, চাপ চাপ জমাট রক্ত…যাবতীয় প্রমাণ। কিন্তু খুনেগুলো খেয়াল করেনি, সেলের মেঝেয় তখনো শুয়েই আছে ওরা। আজও সেইসব গল্পই হচ্ছিল নিজেদের মধ্যে আর ঠিক তখনই ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। চোয়ালে ঢুকে যাওয়া মুখ আর মোটা ফ্রেমের চশমার পুরু কাচের পিছনে সার্চলাইটের মতো দুটো চোখ! বিস্ময়ে কথা সরছিল না কারো! “কমরেড আপনি!” বাকরুদ্ধ বিস্ময়ের বিপুল ধাক্কাটা কাটিয়ে অবশেষে প্রশ্নটা করতে পারলো তিমির। পাল্টা ওদের দিকে বিস্মিত চোখে তাকালেন শীর্ষ নেতা। “আমার অবাক লাগছে দেখে, দেশ জুড়ে এরকম উথালপাথাল এক দ্রোহের প্রস্তুতি চলছে অথচ সে আহ্বান আপনাদের কানে পৌঁছোয়নি!”

অতঃপর খুব সংক্ষেপে একটা ছোট গ্রুপ মিটিংয়ে সমগ্র পরিস্থিতিটা বর্ণনা করলেন নেতা। শোনার পর তরিতগতিতে মেঝে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই। পরমুহূর্তেই সেলের ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল আলোর বলয়টা। কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে বেহুঁশ কয়েদিরা, বাইরে করিডরে ঢুলতে থাকা রাত ডিউটি সেপাই, কেউ দেখতে পেলো না আলোর ঘুর্ণিটাকে।

ভারত নেপাল সীমান্তে মেচ নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো বলয়টা। আশপাশে কত চেনা গ্রাম। হাতীবিঘা, কাকরভিটা, খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, বেঙাইজোত, ঢাকনাজোত…আরো কত সব চেনা গ্রাম, জনপদ। শান্তি, তিমির, পবিত্র, কানাইদের চেনাতে চেনাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন নেতা। “দ্যাখো সবাই, এইসব জায়গাগুলোর নাম বুকে নিয়ে একদিন সেই জানকবুল লড়াইয়ে নেমেছিলে তোমরা। আজ আবার লড়াই শুরু। আগেরবারের মতই বিদেশি রাজা আর বানিয়াদের বদলে স্বদেশী রাজা আর বানিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই!” এসব কথাবার্তার মাঝখানেই প্রসাদুজোতের ফাঁকা ফসলকাটা মাঠটায় এসে নামলো আলোর ঘুর্ণিটা। ইতিমধ্যেই একটা বিশাল জমায়েত সে মাঠে। সেই ভিড়ে অনেককে দেখতে পাচ্ছেন নেতা। কানুবাবু, সৌরেন বাবু, খোকন মজুমদার, কদম মল্লিক, খুদন মল্লিক, বাবুলাল বিশ্বকর্মা, খড় সিং, প্রহ্লাদ সিং, ধনেশ্বরী দেবী, সরুবালা বর্মণ, গাউদ্রাউ শৈব্যানী, ফুলমতি সিং, নয়নেশ্বরী মল্লিক…আরও অনেকে। নেতাকে দেখে হইহই করে এগিয়ে এলো সবাই। চিৎকার, শ্লোগান, ভিড়ের একপাশে বিগুল কিষাণের কাঁধে হাত রেখে জঙ্গল সাঁওতাল। নেতার সামনে এসে দাঁড়ালো দুজনে। ঘোলাটে ছানিপড়া চোখে নেতার দিকে তাকালো বিগুল কিষাণ। “আমার জমিনের দখল ঠো লিয়্যে এত্তবড় কান্ড ঠো শুরু হল্যঁ, এত লড়াই হল্যঁ, হাজারে হাজারে ছেল্যেপুলেগুলান শহিদ ঠো হল্যঁ, লেকিন সি জমির দখল ঠো আজও মু পাই নাই বট্যে!” বলতে বলতে হাঁফাচ্ছিল বুড়া বিগুল। পাশে দাঁড়ানো জঙ্গল সাঁওতাল। সোল্লাসে একটা থাবড়া মারলো বুড়া বিগুলের কাঁধে। “ইবার পাবি রে বুড়হা! লিয্যস পাবি! ইবার তুয়ার জমিন ঠো ফিরত পাবি তুই। ইয়ার লেগ্যেই তো এতদিনের ঝগড়া বিবাদঠো মিটায়ে মোরা সবাই একজুট ঠো হইয়েছি বট্যে। আর শুধু কি মোরা, দেশের যত ক্রান্তিকারী, সবাই সামিল হইয়ে গেছে ই লড়াইয়ে। উ দেখ!” দূরে আঙুল দেখালো জঙ্গল। তার তর্জনীকে অনুসরণ করে পিছনদিকে তাকালো বিগুল। সাথে বাকিরাও। দিকচক্রবাল জুড়ে হাজার হাজার মানুষের এক মাইল মাইল লম্বা মিছিল। সোজা এগিয়ে আসছে আলপথ ধরে। দেখতে দেখতে মানুষের বন্যায় উপচে ভেসে বেরিয়ে গেল প্রসাদুজোতের আদিগন্ত ফসলকাটা মাঠ!

আবার সেই চিতোয়ানের জঙ্গল! আবার সেই বন জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া চাঁদ রাত! পাথরের ওপর উঠে দাঁড়ালেন নানা সাহেব। চার পা সামনে পিছনে বিস্তৃত করে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো দুর্জয়ও। ওর দিকে তাকিয়ে ভারী তৃপ্তির একটা হাসি হাসলেন নানা। “ওরা সবাই খবরটা পেয়ে গেছে! এবার তুই আরেকটা গর্জন তোল! এক আখরি দাহাড়! এ ডাক যাবে বোম্বাই আর কলকাতার বন্দরে। যারা শোনার ঠিক শুনে নেবে! তারাই নির্দেশ পাঠাবে লালকেল্লার ময়দানে সবাইকে চলে আসার। এবার চল! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছোতে হবে লালকেল্লায়!” দুর্জয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওর বিশাল পিঠে সওয়ার হলেন নানা। হাতে কোষমুক্ত তরবারি! এক লাফে মহাশূন্যে উড়ান দিলো নানাসাহেবের বাঘ!

মুম্বাই। কোলাবা বন্দর। রাতের ঘোর অন্ধকারে ফুঁসে উঠছিলো আরব সাগরের জল! জলের তলায় একটা বিপুল আলোড়ন! উত্তাল সেই তরঙ্গ, বিপুল জলরাশি ভেদ করে সগর্জনে মাথা তুললো নৌ বিদ্রোহের রণতরী এইচ এম আই এস হিন্দুস্তান! মুহূর্ত কয়েক বাদেই জল কাঁপিয়ে ভেসে উঠলো আরেক যুদ্ধ জাহাজ খাইবার! এইভাবে একের পর এক ভেসে উঠতে শুরু করলো অন্যান্য সব জাহাজগুলো। “ফায়ার!” – গর্জে উঠলেন ন্যাভাল কমান্ডার শার্দূল সিং। নৌবাহিনীর ভীমকায় সব কামানগুলোর সামনে ইতিমধ্যেই পজিশন নিয়ে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন আসাদ, ক্যাপ্টেন কেলকার, অমিয় বসু… এরকম আরো অনেকে। ‘বুম!’ ‘বুম! কমান্ডারের আদেশ পাওয়া মাত্র পাড়ে গিয়ে জলে আছড়ে পড়তে শুরু করলো একের পর এক গোলা! ঠিক ওই একই সময়ে কলকাতার খিদিরপুরেও ওই একই ধরণের সব ব্যাপারস্যাপার ঘটে চলেছিল। ঘটছিল কোচিন, মাদ্রাজ আর তুতিকোরিনের সব বন্দরগুলোতেও। গোলার পর গোলার আঘাতে একের পর এক কেঁপে উঠছিল বন্দর শহরগুলো!

ঠিক তখনই নিউ টাউনের মিয়াঁপোলিস আবাসনে কোটি দেড়েক টাকা দামের আলিশান থ্রি ভি এইচ কে ফ্ল্যাটটার ড্রয়িংরুমে বসে সিঙ্গল মল্ট অন রকস্ খাচ্ছিলো স্যাম আর রবস্। অবশ্য দুজন বললে ভুল হবে। সঙ্গে তাদের বউ রিটি আর এ্যারি মানে ঋতুপর্ণা আর আরাত্রিকাও ছিলো। লুকোনো সারাউন্ড ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমে কেনি জি বাজছিলো লো ভল্যুমে। দুজনের মধ্যে স্যাম মানে সমার্থক, বয়েস পঞ্চাশের কোঠায়। ঝকঝকে সুঠাম চেহারা। এদিকে রবস অর্থাৎ ররীন, গোলগান নাদুসনুদুস চেহারা। কমবেশি স্যামেরই বয়েসী। দুজনেই সেক্টর ফাইভে দুটো জায়ান্ট মাল্টি ন্যাশনাল আই টি কোম্পানির মেজো কর্তা ধরনের পজিশনে রয়েছে। মাসে মোটামুটি লাখ পাঁচেকের প্যাকেজ দুজনেরই। এদের মধ্যে রবীনের কাজই হচ্ছে অফিসে ঢুকেই আজ কজনের চাকরি খেলো সেই লিস্টটা বানিয়ে দিনের শেষে দিল্লি হেড অফিসে ওর বস চোপড়াকে মেইল করে দেওয়া। অবশ্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ থাকলেও বাড়িতে ল্যাপটপের সামনে বসে ওই একই কাজ করতে হয় ওকে। আবার উল্টোদিকে রবীনের সমস্যাটা একদমই অন্যরকম। হায়দ্রাবাদে ওর বস আয়েঙ্গার। বয়েস ষাট ছুঁই ছুঁই। কপালে মোটা শ্বেত চন্দনের প্রলেপ, ঘোরতর নিরামিষাশী। অফিসের ঘন্টাকয়েক সময় বাদ দিলে বাড়িতে তো বটেই, বাকি সর্বত্রও সাদা লুঙ্গি আর শার্ট। তবে অফিস ট্যুরে এলে রাতে নিজের সুইটে একটা ফুল চিকেন তন্দুরি আর জনি ওয়াকার ব্লু লেভেলের তিনটে লার্জ পেগ যাকে বলে মাস্ট। আবশ্যিক আরেকটা জিনিসও। একটি চাবুক ধরণের এসকর্ট গার্ল। গণহারে খেপ খাটা না হলেই ভালো হয়। আর এই কারণেই ওর পরিচিত টলি পাড়ার এক নামী সিরিয়াল স্ক্রিপ্ট রাইটারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতে হয় রবসকে।

তবে ঠিক এই মুহূর্তে চাষজমিতে ওই ফ্যাক্টরিটা না হয়ে বেঙ্গলের কি ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে গেল, ব্লাডি ইললিটারেট ফারমার্স! কেন ওরা সেসব বুঝলো না…হলে এমপ্লয়মেন্টর একটা নিউ হরাইজন খুলে যেত…কত ছেলের…এতবিধ বিষয়গুলো নিয়েই স্যামের ফ্ল্যাটে জবরদস্ত আলোচনা চলছিল দুজনের মধ্যে। রিটি আর এ্যারিও সমানতালে যোগ দিচ্ছিলো সেই আলোচনায়। ওদের সামনে বড় একটা সেন্টার টেবিলে রাখা চারটে বেলজিয়ান কাটগ্লাসের পানপাত্র। তার চারপাশে প্লেটে প্লেটে সেঁউভাজা, চিপস, গাঁঠিয়া, নাগেটস, কাবাব, বেকন, কালো আঙুর, আপেলের টুকরো, চিজ কিউব , আইস বোল আর জলের বোতল।

আড্ডা যখন তুঙ্গে, টেবিল থেকে রথম্যানসের প্যাকেট আর লাইটারটা তুলতে গিয়ে রবসের চোখে পড়লো কাটগ্লাসের পাত্রে সোনালী পানীয় থিরথির করে কাঁপছে। এর পাশাপাশি বহুদূর থেকে যেন খুব হাল্কা, শোনাই যায় না প্রায়, গুমগুমে আওয়াজ পরপর কয়েকখানা। উঠে বিশাল টু-পিস স্লাইডিং উইন্ডোটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রবস্। উনিশ তলার ওপর থেকে বহুদূরে রাতের দিগন্তরেখায় অতি ক্ষীণ আলোর ঝিলিক মাঝেমাঝেই। “স্যাম, কাম হিয়ার।” সোফা ছেড়ে উঠে এলো স্যাম। “কিছু শুনতে পাচ্ছিস? সাম থান্ডারিং সাউন্ড অর লাইটনিং ফ্ল্যাশ?” প্রশ্ন করলো রবস্। অবাক চোখে রবসের দিকে তাকালো স্যাম। “শীতের শুরু। কোথাও কোনরকম ফোরকাস্ট নেই! তুই কোত্থেকে এসব…!” “না রে, আয়াম মোর দ্যান সিওর।” রবসের কথা শোনার পর জানলা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো স্যাম। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বন্ধুর দিকে। “ডোন্ট মাইন্ড বস। আই থিংক ইউ আর হাই। চড়ে গেছে তোর। রিটি!” স্ত্রীর দিকে তাকালো স্যাম। “মেক সাম লাইম ড্রিংকস ফর রবস।” “বাট, স্যাম?” “নো, মোর বাটস এ্যান্ড ইফস, রবস্।” বলে বন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে সোফার দিকে নিয়ে গেল স্যাম।

রবসের দেখা আর শোনাটা ঠিকই ছিলো। মানুষের মধ্যে যা ব্যতিক্রমীই বলতে হবে। তুরীয় আনন্দের ঘোর অনেক সময় প্যারা নর্মাল বা ম্যাজিক রিয়েলিজম জোনের সন্ধান দিয়ে থাকে কাউকে কাউকে। সেই রাতে রবস্ ওই হ্যালোজেন বা কসমিক জোনটায় ঢুকে যেতে পেরেছিল। বাদবাকিরা নয়। কিন্তু যারা হামেশাই ওইসব জোনে অবাধ যাতায়াত করে, তারা কিন্তু সবাই সাক্ষী থেকেছিল অরোরা বোরিয়ালিসের মত অপার রহস্যময় ওইসব ঘটনার! কারণ ওরা সবাই বিশ্বাস করে, হোমো সেপিয়েন্সে পরিণত হওয়া এই আজব চিড়িয়া মার্কা প্রজাতিটা যা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে না তার মানে এটা নয় যে সেইসব ঘটনাগুলো কোথাও না কোথাও ঘটছে না। তাই সেই অদ্ভুত রাতে শহরের সমস্ত পথ কুকুরেরা একযোগে আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘ভৌউউউ!’ শব্দে ডেকে উঠেছিল! লোকালয়ের পর লোকালয় উচ্চকিত ‘কা কা’ স্বরে আলোড়িত করে গাছের পর গাছ থেকে ঝাঁক বেঁধে অন্তরীক্ষে উড়ান দিয়েছিল কাকেরা! এ সি আচ্ছন্ন গৃহস্থের গভীর নিদ্রার গুষ্টির পিণ্ডি চটকে দিয়ে সমবেত ‘মিঁয়াওও!’ সিম্ফনি সৃষ্টি করেছিল মার্জারকূল! কারণ সেই রাতে তারা সবাই দেখেছিল চন্দ্রাতপ আর পেঁজা পেঁজা তুলোর মত মেঘপুঞ্জের নরম ভিজে ভিজে ভাব গায়ে মেখে, ব্রহ্মাণ্ডে ভাসমান অযুতকোটি গ্রহ, তারা, নক্ষত্রের গা ঘেঁষে, উল্কাপিণ্ডের পর উল্কাপিণ্ডের পিঠে পা রেখে এগিয়ে আসছে মাইল মাইল লম্বা মিছিলটা! মিছিলের একদম সামনের সারিতে মঙ্গল পাঁড়ে, পাক মারা মোচ, হাতে ডাবল ব্যারেল উইনচেস্টার রিপিটার রাইফেল। প্রিয় ঘোটকি সারাঙ্গির পিঠে উন্মুক্ত তরবারি হাতে সওয়ার ঝান্সি কি রাণী মণিকর্ণিকা বাঈ। পাশে রাণীরই দেওয়া সাদা ঘোড়ায় তাঁতিয়া টোপি। কোষমুক্ত তরবারি তাঁরও হাতে। একদম ডানপাশে দুর্জয়ের পিঠে নানাসাহেব। সঙ্গে হাজার হাজার মারাঠা, পাঠান, আর দেহাতি সিপাহি! ‘চিঁহিঁহিঁ!’ – ভিড়ের মধ্যে সামনের দুই পা তুলে তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনি তুললো সারাঙ্গি আর শ্বেত ঘোটক, সঙ্গে সঙ্গে ‘ঘ্র্যাআআম!’ অন্তরীক্ষ কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো নানাসাহেবের বাঘ! ঠিক তার পিছনের দলটা প্রায় পঞ্চাশ জন। সিদো, কানহো, চাঁদ, ভৈরব, বিরসা ভগবান, রাণী শিরোমণি…ওদের ঘিরে নাচতে নাচতে আসছে অসংখ্য সাঁওতাল, হো, কোল, ভিল, মুন্ডারি, গোন্ড…অরণ্যের আদিম সন্তান সব! হাতে হাতে, টাঙ্গি, বল্লম, তীর ধনুক “হুল জোহার হুল!” ধামসা মাদলের তালে তালে মুহুর্মুহু গর্জন উঠছে ভিড়ের মধ্যে থেকে। এর পরের দলটার নেতা ভবানী পাঠক, সঙ্গে দেবী চৌধুরানী। দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে আসছেন দুজন। পাশেই তিতুমীর আর আর মজনু শা ফকির। দৃঢ়, সংঘবদ্ধ চোয়াল! শরীরি ভাষায় যুদ্ধের আহ্বান স্পষ্ট! “জয় তারা!” হুঙ্কারে চরাচর বিদীর্ণ করে এগিয়ে আসছে রাজা বিশ্বনাথ! সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে নলে ডোবা, পীতু, বলা হাড়ি, ভগবান, মনোহর সর্দার…পুরো দলটা। ওদের সবার মাথায় ছায়া দিতে দিতে যাচ্ছে বি টি রোড, যশোর রোড, ঝাড়খণ্ড আর ডুয়ার্সের জঙ্গলে কেটে ফেলা কয়েক লক্ষ গাছ। পুণ্য বারি ছিটিয়ে দিচ্ছে যত বুজিয়ে দেওয়া পুকুর আর বাঁধে শুকিয়ে আসা নদী। অবাক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলো নক্ষত্রমালা, চন্দ্রাতপ আর পেঁজা মেঘের দল! ওই তো আসছে আজাদ হিন্দ ফৌজের বাহিনী। সামনে সর্বাধিনায়ক। সেদিনের ধুতি পাঞ্জাবি পরিধানে নেই আর। তার বদলে পুরোদস্তুর সেনা ইউনিফর্ম। পিছনে কুচকাওয়াজে মেঘলোক মথিত করে এগিয়ে আসছে আই এন এ সেনাদল। নেতৃত্ব দিচ্ছেন চার ক্যাপ্টেন। প্রেম সায়গল, শাহনওয়াজ খান, গুরবক্স সিং ধিলোঁ আর রাণী ঝান্সি ব্রিগেড নেত্রী লক্ষী সায়গল। সমস্বরে গাইছে সবাই – ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা / খুশি সে গীত গায়েঁ যা / ইয়ে জিন্দেগী হ্যায় কওম কি / তু কওম পে লুটায়ে যা!…পিছন থেকে ছুটে এসে গলা মেলাচ্ছেন রশিদ আলি, পিছিয়ে থাকছে না ভগত, অজয়, বটুক, যতীন, চন্দ্রশেখর, আসফাকুল্লাহ, রামপ্রসাদ, রাজগুরু, শুকদেবরাও। এতজন সুগায়ক। আই এন এ, হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি…সব মিলেমিশে একাকার। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই মিছিলের সাথে সাথে গানও এগোচ্ছে। ‘’তু শের এ হিন্দ আগে বঢ় / মরনে সে ফির ভি তু না ডর / উঢ়াকে দুশমনোঁ কা শর / জোশে ওয়াতন বঢ়ায়ে যা!…” দেখতে মেঘ গর্জনে পরিণত হচ্ছে সে গান! ‘’চলো দিল্লি পুকার কে / কওমি নিশান সামহাল কে / লাল কিল্লে পে গাড় কে / লহেরায়েঁ যা, লহেরায়েঁ যা… কদম কদম…” শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না সেই মরন জয়ী, অবিনাশী গান! পরমুহূর্তেই আরেক গানে বদলে যাচ্ছে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্যদের মুখে মুখে। “আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে / আমার ভয় ভাঙ্গা এই নায়, আমি মারের সাগর পাড়ি দেব…” মেঘের ভেলায় চড়ে উদাত্ত কন্ঠে গাইতে গাইতে চলেছে দীনেশ। সে ভেলার সওয়ার তো আরো অনেকে। বিনয়, বাদল, হেমচন্দ্র, সুপতি, দোস্ত মহম্মদ, সুরেশ…দীনেশের গলায় গলা মেলাচ্ছে সবাই। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে মেঘের নাও…পিছনে আরেকটা। সেখানে প্রীতিলতা, শান্তি, সুনীতি, বীণা, উজ্জ্বলা, মণিকুন্তলা, ইলা, গীতা…গান ঘুরছে সেখানেও। “ওরে রে ওরে মাঝি কোথায় মাঝি / প্রাণপণে ভাই ডাক দে আজি, / তোরা সবাই মিলে বৈঠা নে রে / খুলে ফেল সব দড়াদড়ি…” গলা ছেড়ে গাইছে অগ্নিকন্যারা! শুনতে শুনতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছেন মাস্টারদা, লোকনাথ, গণেশ, অনন্ত, রামকৃষ্ণ…সামনে এগিয়ে এলো টেগরা, টাইগার বল … দলে সবচেয়ে কমবয়েসী। সেদিন জালালাবাদের পাহাড়ে বৃটিশ মিলিটারির তিনটে বুলেট এসে লেগেছিল বুকে। তারপরেও হাসছিলো। এখনও হাসছে। “কি? বলেছিলাম না মাস্টারদা, একদিন না ফিরে আসবো আমরা সবাই! দেখলেন তো” কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেল দলটা। পিছনে মিছিল এখনও বিশাল! হাতে হাত বেঁধে পথ হাঁটছেন শীর্ষ নেতা, কবি, সৌরেন, কানু, জঙ্গল, বিগুল, বাবুলাল, কদম, খুদন। সঙ্গে সাথী সরুবালা, ধনেশ্বরী, ফুলমতি, নির্মলা, অহল্যারাও। সেই তরাই, তেভাগা আর তেলেঙ্গানার বাঘিনীর সব! পিছন থেকে ছুটতে ছুটতে কবির সামনে এসে দাঁড়ালো ডানকুনির সুদেব। “আপনাকে আজ আপনার ওই কবিতাটা আবৃত্তি করতেই হবে!” “করতেই হবে!” সগর্জনে পিছন থেকে সুদেবকে সমর্থন জানালো সবাই! সুদেবের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন কবি। তারপর উদাত্ত কন্ঠে শুরু করলেন কবি – “দুঃসাহসী বিন্দু আমি / বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা!” শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল হর্ষধ্বনি আর করতালি পিছন থেকে। চলে যাওয়ার আগেই সুদেবের হাতখানা চেপে ধরলেন কবি। “তোমার সাথে এর আগে কোনদিন দেখা হয়নি আমার। শুনেছি ইশকুলে আবৃত্তি কম্পিটিশনে বরাবর ফার্স্ট হতে তুমি। কাজী সাহেবের একটা কিছু পাঠ করে শোনাতেই হবে তোমাকে।” শোনার পর মুহূর্ত কয়েক চুপ করে রইলো সুদেব। তারপর খোলা হাওয়ার মতো গলায় শুরু করলো – “আয় রে আবার আমার চির তিক্ত প্রাণ! / গাইবি আবার কন্ঠ ছেঁড়া বিষ অভিশাপ সিক্ত গান! / আয় রে চির তিক্ত প্রাণ! …” মিছিল চলছে। চলছে উদাত্ত কন্ঠে কবিতা পাঠ! “এবার গান হোক! সেই গানটা!” হেঁকে উঠলেন শীর্ষ নেতা! শোনার সঙ্গে সঙ্গে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো পবিত্র! “হাম ভুখ সে লড়নেওয়ালে / কেয়া মওত সে ডরনেওয়ালে…আজাদি কা ডংকা বাজাও!”…সে সুরে সুর মিলিয়ে সমস্বরে গেয়ে উঠলো আশু, তিমির, করুণা, শক্তি, পরিতোষ, নীল, বাবলু, ননী, গোগনা, বিপ্লব, শঙ্কু, বিধু, অজয়…প্রত্যেকে! এগিয়ে চলেছে মিছিল। পাল্টাচ্ছে গান। গানের পর গান। মেঘলোক, নক্ষত্রলোক…অপার এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে সেইসব সুর আর আগুনে মাখামাখি কথাগুলো। “তু জিন্দা হ্যায় তো জিন্দেগি কে জিত সে ইয়াকিন কর / স্বর্গ্ আগর কহিঁ পে হ্যায়, উতার লা জমিন পর!” এগোচ্ছে মিছিল, এগোচ্ছে গান। সে গান বলছে – “হাজারোঁ ভেষ ধরকে আয়েঁ / মওত তেরে দ্বার পর / মগর তুঝে না ছল সকা / চলি গয়ি ওহ হার কর!” মুহূর্তে মুহূর্তে আরও আলোকবর্ষ দূরে পাড়ি দিচ্ছে সেই দ্রোহ গান! “হামারেঁ কারবাঁ কো / মঞ্জিলোঁ কা ইন্তেজার হ্যায় / ইয়ে আঁধিয়োঁ, ইয়ে বিজলিয়োঁ কি / পিঠ পর সওয়ার হ্যায়!” সে গানের কথায় সুরে উন্মাদ হয়ে গর্জে উঠছে মেঘ! ঈশান কোণে বিজলি হানা দিয়ে যাচ্ছে বারবার! এবার শেষ বার্তা পাঠাচ্ছে গান! “বুরি হ্যায় আগ পেট কি / বুরে হ্যায় দিল কি দাগ ইয়ে / না দাব সকেগেঁ একদিন / বনেগে ইনকিলাব ইয়ে / গিরেগি জুল্ম কি মহেল / বনেঙ্গে এক নবীন ঘর / স্বর্গ আগর কহিঁ পে হ্যায় / উতার লা জমিন পর!” আকাশ কাঁপানো বজ্রগর্জন! বিশ্ব সংসার ওলটপালট করে ছুটে আসা ঝোড়ো হাওয়া! এসবের মধ্যে দিয়ে গানের পিছনে মিছিলের একদম শেষে ভাসতে ভাসতে আসছিলো নৌ বিদ্রোহের রণতরীগুলো! ধীরে ধীরে কমছিল ঝড়ের তেজ আর বজ্রের দাপট। একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছিল আকাশ। দূরে লালকেল্লার মিনার! প্রথম ভোরের লাল টুকটুকে সূর্য উঠছে কেল্লার ঠিক পিছনে। “সিংজী! জঙ্গ কা এলান কিয়া যায়ে!” হাতে কোষমুক্ত তরবারি। মিছিলের পুরোভাগ থেকে পিছন ঘুরে হেঁকে উঠলেন নানাসাহেব ধুন্দুপন্থ রাও! “ফায়ার!” সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন কমান্ডার শার্দূল সিং! নির্দেশ শোনামাত্র ছুটে গিয়ে হাউইটজার কামানগুলোর ফায়ারিং পয়েন্টে পজিশন নিলেন ক্যাপ্টেন গুরবক্স সিং, ক্যাপ্টেন আসাদ, ক্যাপ্টেন অমিয় নাথ বসু। ‘বুম!’ ‘বুম!’ ‘বুম!’ একের পর এক তিন তিনটে গোলার ভীমনাদ! পরমুহূর্তেই লাখো সমুদ্রের গর্জন তুলে দৌড় শুরু করলো মিছিলটা!



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *