novel-jete-jete-pothe

যেতে যেতে পথে, পূর্ণিমা রাতে
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়


১। জয়ন্তী

পদাতিক ঢুকল নিউ আলিপুর জংশনে। দেড় ঘণ্টা লেট। ট্রেন থামতেই এক যুবক উঠে এল ওদের এসি থ্রি টিয়ার ক্যুপেতে।
লিস্টে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘সার, আমি বিকাশ, ডুয়ার্স ট্যুর থেকে এসেছি। মোহন দাজু পাঠিয়েছে। আপনাদের গাড়ি রেডি সার।’
সুনন্দ-র মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘গুড গুড। বাবুন, একবার লাগেজগুলো চেক করে নে। আমি কাল স্টেশনে গুনেছি। ছোট বড় মিলিয়ে টোটাল নাইন।’

অহর্ষি বলল, ‘কিন্তু বিকাশ, তোমার দাজু নিজে এল না কেন? তার তো আমাদের রিসিভ করার কথা। সে কোথায়?’

‘সরি সার। দাজুকে হোম স্টের কাছাকাছি থাকতে হয়েছে, ও সবকিছু সেটিং করছে।’ বিকাশ বলল, ‘আজ সকালের ট্রেনে কয়েকটা বুকিং ছাড়া পার্টি এসে গেছে।’

প্ল্যাটফর্মের নীচে একটা জিপসি দাঁড়িয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ও তাঁর কিশোরী মেয়ে।

সুনন্দ সেইদিকে এগিয়ে গেল। নমস্কার করে বলল, ‘আমি সুনন্দ, আমার ওয়াইফ রুমকি, ছেলে সুজন আর আমার বন্ধু অহর্ষি, চারজন। আপনারাও কি জয়ন্তী যাচ্ছেন?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও জয়ন্তী, মোহন কারকির ডুয়ার্স ট্যুর। অ্যাকচুয়ালি মোহনই এখানে সবচেয়ে ডিপেন্ডেবল।’ মহিলাও হাতজোড় করলেন। হেসে বললেন, ‘আমি নূপুর, এই আমার মেয়ে মধুবনী।’

জিপসির মাথায় লাগেজ তুলে দেওয়া হয়েছে।

সুনন্দ বলল, ‘রাস্তায় এক ক্রেট ভালো ব্র‍্যান্ডের জল নেব। বড় স্টোর দেখে থেমো।’

‘জী সার।’ বিকাশ স্টার্ট দিল।
অহর্ষি সামনের সিটে বসেছে। ফিসফিস করে বলল, ‘বিকাশ ভাই, যেখানে গাড়ি থামাবে, সেখানে যেন জুতোর শোরুম থাকে।’
বিকাশ ঘাড় নাড়ল। সুনন্দ ঠিক শুনে ফেলেছে। বলে উঠল, ‘কেন রে? কী হল?’

‘সে আর বলিস না। ফাটা কেস।’ অহর্ষি বলল, ‘ভাগ্যিস স্লিপারটা ছিল। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনের আগে টয়লেট যাওয়ার সময়ে বাবুনকে বলে গেছিলাম, স্নিকারটা একটু খেয়াল রাখিস৷ ও বোধহয় ঠিক খেয়াল করেনি। ব্যস, সেই ফাঁকে, ঝাড়ুদার সেজে কেউ ঢুকে ঢুকে কাপড়ে জুতো মুড়ে নিয়ে নেমে গেছে। এই লাইনে এরকম আকছার হয়। আসাম রাজধানীতে দেখেছি।’

‘ছি ছি বাবুন!’ রুমকি ঝেঁঝে উঠল,’ ইউ আর সো ইরেসপন্সিবল। তোমার সামনে দিয়ে কাকুর দামি জুতোটা চুরি হয়ে গেল, দেখতে পেলে না। সারাক্ষণ শুধু মোবাইলে ঘাড় গুঁজে বসে আছ। আশ্চর্য।’

সুজন মুখ তুলে তাকাল, অহর্ষিকে ‘সরি কাকু’ বলল, ফের মোবাইলে ডুবে গেল।
নূপুর হেসে বললেন, ‘আর বলবেন না ভাই, এরা সব এক ছাঁচে তৈরি। আমার মেয়ে মান্টি, আই মিন মধুবনীকে দেখেছেন? গাড়িতে উঠেই কানে কর্ড গুঁজে নিয়েছে, দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। পিছনের সিটে পাশাপাশি দু’জনে বসে আছে, কেউ কারো সঙ্গে একটাও কথা বলছে?’

‘কথা বলার এনাফ টাইম পড়ে আছে মা।’ মান্টি শুনতে পেয়েছে, মুখ না তুলেই বলল।

তেলতেলে মসৃণ রাস্তা। দু’ধারে গাছপালা, জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে, ক্রমশ ঘন হচ্ছে। হাওয়া দিচ্ছে। বেতঝাড়, শাল, শিমূল, গামার, বড় বড় ঘাস। মাঝে মাঝে দু’একটা বাড়ি। ফ্রন্ট সিটে বসে মুগ্ধ হয়ে অহর্ষি সবুজ গিলছে।

নতুন জুতো কিনে পায়ে গলানোর পর থেকে তার বিগড়ে যাওয়া মন আপাতত সুস্থির। বলল, ‘আমরা কি ফরেস্টে ঢুকে পড়েছি বিকাশ?

‘জী সার। বক্সা ফরেস্ট অনেক বড়। রাজাভাতখাওয়া থেকে আসলি ফরেস্ট, যাকে বলে টাইগার রিজার্ভ, তারপর বাফার জোন শুরু হবে। তবে এদিকের গ্রামেও হাতি বেরোয়।’

রাজাভাতখাওয়া পেরিয়ে গেছে। গহন জঙ্গল, রাস্তার উপর ডালপালা মেলেছে গাছেরা। জিপসি ছুটছে। জনপ্রাণী খুব কম। আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে নীল পাহাড়ের সারি। কিছুটা জায়গা জুড়ে দোকানবাজার, ছোটবড় কিছু হোটেল, মানুষজন ঘোরাঘুরি করছে। বিকাশ গাড়ি থামাল। পাশের পান সিগারেটের দোকান থেকে একটা ছেলে ছুটে এল। বলল, ‘অর্জুন কাকা একটু শহরে গেছে, তিনটে ঘরের চাবি রেখে গেছে। এই নাও।’

‘ওহো, তাহলে কী হবে? গেস্টদের নাহানেকা পানি, লাঞ্চ?’

‘সব রেডি আছে। আন্টি আছে, কাজের লোক ফুলমতি, ধনা আছে। আধাঘন্টায় কাকাও চলে আসবে। তুমি নিয়ে যাও।’

‘আরে,ওঠো গো!’ রুমকি ঠেলা দিল,’ ঝাড়া দু’ঘণ্টা ঘুমোলে। পারোও বটে।’

‘অ্যাঁ- হ্যাঁ!’ ধড়মড় করে সুনন্দ সোজা হল, ‘এসে গেছি? কই? কই?’

‘না না, আরও খানিকটা যেতে হবে। এটা জয়ন্তী মোড়। ওই যে দেখছেন, পাহাড়ের পরে সাদা পাথুরে সমতল, ওটা আসলে জয়ন্তী নদীর খাত।’ নূপুর বললেন, ‘রিভার বেড পেরিয়ে আমাদের ওপারে যেতে হবে। পাহাড়ের কাছে ডিপ ফরেস্টের মধ্যে কয়েকটা ভুটিয়া বস্তি, তাদেরই গোটা চারেক হোম স্টে। তাই তো বিকাশ?’

‘জি ম্যাডাম। আপনারা অর্জুন রাইয়ের হোমস্টেতে থাকবেন।’

‘হ্যাঁ, মোহন বরাবর ওখানেই রাখে।’ নূপুর হেসে বললেন, ‘অর্জুন মোহনের ভগ্নিপতি।’

‘আপনি আগে এসেছেন নাকি দিদি?’ রুমকি বলে ওঠে।

‘হ্যাঁ ভাই, ফি বছরই এইসময় চলে আসি। ডুয়ার্সের জঙ্গল আমায় ডাকে।’

যেখানেই বেড়াতে যাক, রুমকির উৎসাহের অন্ত নেই। মাল নামিয়ে, সিকি বালতি গরমপানিতে শরীর ভিজিয়ে, লাঞ্চ শেষ করতে করতে পাঁচটা বেজে গেল।

সুনন্দ মনে মনে একটু গড়াবার তাল করছিল, সেই সুযোগ পেল না। বেড়াতে এসে রেস্ট-টেস্ট নেওয়া রুমকির ধাতে নেই, বেজায় হাঁকডাক জুড়ে দিয়েছে, এখনই নদীর পাড়ে হাঁটতে যাবে।

বাবুন আর মান্টিরও প্রবল উৎসাহ। ওদের মধ্যে বেশ তাড়াতাড়ি ভাবও হয়ে গেছে। দু’জনে তড়বড় করে বাঁধের উপর উঠে গেছে।

সুনন্দ কী আর করে! বাঁধের উপর দিয়ে ওদের সঙ্গে কয়েক পা হেঁটে বসে পড়েছে। এই বয়েসে এত পোষায় নাকি!

‘তোমরা যাও, আমি আর পারছি না।’

আকাশে সূর্য ডুবে গেছে মিনিট পাঁচেক, গোধূলির আলো কমে আসছে। নদীর ওপারে দিগন্ত জুড়ে ধূসর জয়ন্তী পাহাড়। আকাশ বেয়ে নীড়ের দিকে ছুটে আসছে হাজার হাজার পাখির ঝাঁক, তাদের কলরোলে কান পাতা দায়। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস, আরামের প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে।

নূপুর আসেননি। বাঁধে ওঠার আগে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ, তার একটায় বসে আছেন। রুমকি বারবার অনুরোধ করছিল, উনি ইশারায় হাঁটু দেখিয়ে না করে দিয়েছেন।
অহর্ষি আরও এককাঠি ওপরে, সে এক পাও হাঁটেনি। হোমস্টের বাইরে ভাঙাচোরা দুটো চেয়ার পড়েছিল, তার একটায় নিজে বসে অন্যটায় বসিয়েছে অর্জুনকে। তার সঙ্গে কথা বলছে, শুনছে ভুটিয়া বস্তির সমস্যা, জঙ্গল নদী বন্যার সঙ্গে ওদের লড়াইয়ের কথা।

অতএব জয়ন্তীর বাঁধের রাস্তা ধরে আপাতত হাঁটছে ওরা তিনজন—রুমকি, বাবুন আর মান্টি। অর্জুন বলে উঠল, ‘জাদা দূর যাইয়েন না। ঝপ কইরে আন্ধার নামি যাবে। ইসময় মহাকালরা বেরায়।’

ওরা কয়েক পা যেতে না যেতে অর্জুনের কথা মিলে গেল। সূর্য ডোবার পরেও এতক্ষণ চারিদিকে কালচে লাল আভা ছড়িয়ে ছিল। পাখিদের শোরগোলে জমজম করছিল।

আচমকাই যেন শেষ রঙটুকু মুছে গেল। থেমে গেল সব পাখিদের ডাক। ঝুপ করে অদ্ভুত শব্দহীন হয়ে গেল চরাচর।

দেখা গেল, অন্ধকারের চাদর ফুঁড়ে উঠে আসছে থালার মতো চাঁদ, আর একটু একটু করে সাদা মাখনের মতো জ্যোৎস্না গলে পড়ছে জঙ্গলের গাছে, পাতায়, ঘাসে। অজস্র জোনাকি ঝিকমিক করছে বনতল জুড়ে। আজ চতুর্দশী, কাল দোল পূর্ণিমা।

অহর্ষি স্তব্ধ, চেয়ে আছে বাহ্যজ্ঞানহারা। শরীরে কাঁটা ফুটছে। আগে কখনও সে এত রহস্যময় জঙ্গলের রাত দেখেনি। এখন আবার অদ্ভুত সব শব্দ উঠে আসছে। কালো কালো ভূতুড়ে গাছেদের ভিতর থেকে একটা রাতচরা পাখি ডেকে যাচ্ছে, কুউব কুউব…।

অর্জুন বলল, ‘সার, এরা নাইটজার পাখি। ওরা সারা রাত ডেকে যায়।’

আরেকটাও এবার দূরের কোনও গাছ থেকে ডাকতে শুরু করল। ক্যার ক্যার করে ডাকতে ডাকতে দুটো ছোট সাদা পাখি উড়ে গেল। অর্জুন বলল, ‘ছোট পেচা। অনেক আছে এ জঙ্গলে।

ও, এগুলোই তাহলে আউলেট! এবার আরম্ভ হয়ে গেল বুনো ঝিঁঝির তুমুল ঝঙ্কার।

ওরা তিনজন এখনও ফেরেনি। অর্জুন উঠে দাঁড়াল। বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেয়া করতা হ্যায়, হাঁ? মেরা বাত শুনাই নাহি দেতা? জলদি ওয়াপস আসেন। নাহিতো আভভি গেট বন্ধ করি দিব।’

হুমকিতে বেশ কাজ হল, ওরা হড়বড়িয়ে ফিরছে বাঁধ দিয়ে। সুনন্দ সত্যিই বেঁচে গেল।

হাঁকপাঁক করে অহর্ষির কাছে চলে এসেছে, ‘ভাই, উপরে চল, চটপট বোতল খোল। শালা শরীর পুরো ছেড়ে দিয়েছে।’

‘শ শ শ!’

হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল অহর্ষি, ঝিল্লির কলরব ছাপিয়ে ভারি মধুর গলায় একটা গান জেগে উঠেছে।

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম… নিবিড় নিভৃত পুর্ণিমা নিশীথিনী সম…।’ নূপুর গাইছেন।

নিমেষে কথাবার্তা থেমে গেছে। বাঁধের উপর থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে মান্টি আর বাবুন। মুশকিলে পড়ে গেছে বেচারি রুমকি। দু’হাত ডানার মতো ছড়িয়ে সে ব্যালান্স করে খাড়াই থেকে নামার চেষ্টা করছে।

‘বেশ হয়েছে! সবসময় নাচুনি, বয়েস হচ্ছে, কোনও আক্কেল নেই। সবসময় বাচ্চাদের সঙ্গে পাল্লা দেবে। যেমন হড়বড়িয়ে উঠেছে, এবার বোঝ ঠ্যালা!’ সুনন্দ বলল।

নূপুর চক্ষু বুঁজে গেয়ে চলেছেন, ‘জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি…’

‘ও মাগো! বাঁচাও, বাঁচাও।’ হঠাৎ রুমকির আচমকা আর্তস্বর ভেসে এল, ‘ও-ও অর্জুন ভাই, এ দুটো কেয়া হ্যায়? ওরা আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন… ওরে ব্বাবা, এগুলো যে নেকড়ে, নেকড়ে… ও অর্জুন, কোথায় তুমি? অ্যাই অ্যাই, হুশ হুশ যা — যাহ্’

মুহূর্তে নূপুরের গান থেমে গেছে। দুটো ছুঁচলো মুখ মস্তবড় লোমশ প্রাণী, এগিয়ে যাচ্ছে রুমকির দিকে। রুমকি প্রাণভয়ে চিৎকার করছে…

‘কুছ নাহি করেগা ম্যাডাম, ডরনা মত… কাঁহা সে আজ ফির আ গেইল!’ অর্জুন চিৎকার করতে করতে সেদিকে ছুটে গেছে। তার হাতে বড় বড় নুড়ির টুকরো, ‘যা শালে ভাগ, ভাগ হিঁয়াসে… ভাগ শালে…!’ বলতে বলতে ওদের দিকে টিপ করে ছুড়ছে নুড়ির টুকরো।

পাথর লাগতেই ওরা কুঁই কুঁই করে ছুটে পালাল। অর্জুন পৌঁছে গেছে রুমকির কাছে, ‘আসেন, চলে আসেন। এগুলান স্রিফ রাস্তার কুত্তা, গাঁওয়ের চারপাশ ঘুরে বেড়ায়। টুরিস্ট লোগদের পাকড়াও করে, আগর কুছু বিস্কিট কেক উক মিল যায়।’

নূপুর আস্তে আস্তে হেঁটে আসছেন বাড়ির দিকে। রুমকি লজ্জিতভাবে বলল, ‘সরি দিদি। কী ভালো গাইছিলেন, আসলে এমন ভয় পেয়ে গেছিলাম…।’

‘না না, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। চলুন, ভিতরে যাই।’

আবার সব শান্ত। শুধু ঝিল্লির ঐকতান আর কুউব কুউব, পাখির ডাক। রুপোলি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বনভূমি, বনস্পতিদের ফাঁকে ফাঁকে আলোর আলপনা। আকাশে জ্বলজ্বল করছে সোনার থালা।

বাবুন আর মান্টি গল্প করতে করতে রাস্তা পেরিয়ে শালবনের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল।কিছুটা দূরে আলো চিকচিক করছে, নিশ্চয়ই ছোট কোনও ডোবা আছে।

ওরা সেদিকেই হাঁটছিল। হঠাৎ বাবুন দাঁড়িয়ে পড়ল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, ‘অ্যাই, অ্যাই, দ্- দেখেছিস? ওই ঝোপের মধ্যে? তাকিয়ে আছে?’

‘হ্যাঁ দেখেছি।’ মান্টি হেসে বলল, ‘সবুজ রঙের চোখগুলো তো! ছোটখাট জন্তু-টন্তু হবে৷ শোন বাবুন, এটা জঙ্গল, ওদেরই জায়গা, তোর কলকাতা শহর নয়।’
‘নারে বাবা, আর এগিয়ে কাজ নেই।’ বলেই বাবুন অ্যাবাউট টার্ন। এক- পা দু’পা করে পিছন দিকে হাঁটছে…

দূর থেকে দেখে সুনন্দ চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘কী রে বাবুন? কী হল রে?’

‘মাই গুডনেস!’ অহর্ষি বলে উঠল, ‘ওই যে… কতগুলো চোখ? জ্বলজ্বল করছে? নির্ঘাত কোনও হিংস্র জানোয়ার! অর্জুন, ও অর্জুন …’

‘আঙ্কল, ডোন্ট ওরি।’ মান্টি হাসতে হাসতে বনের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি আছি। ওগুলো বন বিড়াল বা শিয়াল, হিংস্র কিছু নয়। মানুষের গন্ধ পেলেই খাবারের জন্য চলে আসে। জয়ন্তী ফরেস্টে প্রচুর। এখানে লেপার্ড আসে না। দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোদের মজা।’

বলতে বলতে নিচু হয়ে নুড়ি পাথর কুড়োতে শুরু করল। কিন্তু সে কিছু করার আগেই কোত্থেকে অর্জুন ঘরের ভিতর থেকে মস্তবড় একটা গুলতি আর নুড়ি ভর্তি থলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তির বেগে সে ছুটে গেল শালবনের দিকে।
কাছাকাছি গিয়েই গুলতিতে একটার পর একটা পাথর ঢুকিয়ে ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই করে ছুঁড়তে লাগল চোখগুলো লক্ষ্য করে।
চ্যাঁ চ্যাঁ চ্যাঁ…জান্তব আর্তনাদ! পরের কয়েক সেকেন্ডে চোখগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘বন বিলাই, আংরেজিতে ওয়াইল্ড ক্যাট বলে সার।’ ঘাম মুছে হাসল অর্জুন। ‘বহুত ফালতু জানবর। ঘর সে খানা ইয়া হাঁস মোরগা টাইনে লিয়ে যায়। আসেন আপনারা, দোতলার বারান্দায় আরাম কইরে বসেন। ফুলমতি আভি চিকেন পাকোড়া বানাইছে।’


২। অহর্ষির কথা


উপরের বারান্দায় ঝিম মেরে একা বসে আছে অহর্ষি। আর কেউ নেই। কাঠের টেবিলে একটা বোতল, জলের জাগ, কয়েকটা গ্লাস, প্লেট।

এখন ক’টা বাজল? ঢুলুঢুলু চোখে মোবাইল দেখল, রাত সাড়ে দশটা। ট্যুর অপারেটর মোহনের আসার সময় হয়ে এল। সে আজ নিজে এসে ওদের জাঙ্গল সাফারিতে নিয়ে যাবে, কোর এরিয়ায়। যেখানে জানোয়াররা জল খেতে, নুন চাটতে আসে।

সুনন্দ রুমকি দুজনের কেউই যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই। একটু আগে বন্ধুবর ঘরে ঢুকে গেল, ‘ চললাম রে, গুড নাইট। তোরা ঘুরে আয়, আমি যাচ্ছি না।’

‘যা ব্বাবা! জয়ন্তীতে এলি, আর তার ফরেস্টে ঘুরবি না? ‘

‘আরে ভাই, কানহা-করবেট সব আমার ঘোরা, সব জঙ্গলই একরকম। তুই যা ভাই।’

‘আমিও যাচ্ছি না অহর্ষিদা।’ ওর পিছনে টলতে টলতে এগোচ্ছে ওর শ্রীমতীও। হাত নাড়ল, ‘যাও, তোমরা ঘুরে এসো। শরীর আর দিচ্ছে নাগো।’

মান্টি – বাবুন আবার আলাদা গাড়িতে বক্সা, চিলাপাতা ফরেস্ট ঘুরতে গেছে। অর্জুন ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

আজ দোল পূর্ণিমা। মাথার উপর বিশাল চাঁদ। আজ আরও ধবধবে সাদা জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে জয়ন্তীর জঙ্গল, অনেক নাইটজার পাখি একসাথে ডেকে চলেছে — কুউব, কুউব কুউব…. বুনো ঝিল্লির ঝমঝম আওয়াজ। আজকের আবহাওয়াও অন্যরকম। এতোল বেতোল বাতাসে অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ।

অহর্ষির মাথাটা টলটল করছে। এখনও ও আচ্ছন্ন হয়ে আছে অদ্ভুত ভালো লাগায়। চলকে চলকে উঠছে দুপুরের টাটকা স্মৃতি।

হঠাৎ অলক্ষ্য থেকে যখন ঝরে পড়ে অযাচিত প্রাপ্তির ভাণ্ডার, তখন মনে হয় জীবন কত অচেনা। ক পেগ হল? সন্ধে থেকে তো চুমুক দিয়েই চলেছে। ধুস, এই সময় কি কেউ পেগ গোনে? আজ দুপুরের সেই নিভৃত মুহূর্তগুলো কি আর কখনও ফিরে আসবে? এখনও শরীরে মেখে আছে তার স্পর্শ…! কিন্তু…তারপর?

কোত্থেকে কিশোর আশা গুনগুনিয়ে উঠল, ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসম, নদীকা কিনারা ইয়ে চঞ্চল হাওয়া…’ আহা, কী সব কথা,’ কাহা দো দিলোনে কে মিল কর কভি হম না হোঙ্গে জুদা…’।

অহর্ষি বোতল থেকে রঙিন তরল ঢালল গ্লাসে। জাগ কাত করে জল মেশাল আবার লম্বা চুমুক দিল গ্লাসে… ফের ডুবে গেল দুপুরের মধুর মুহূর্তে…।

‘ আমি সিওর হয়ে গেছি, মাঝ চল্লিশেই তাহলে ডিমেনশিয়া ধরেছে। শেষ অব্দি সত্যিই চেনা গেল না!’

‘ক্–কে?’ চমকে রেলিঙের ডানদিকে ফিরেছে অহর্ষি।

নূপুর। রেলিঙে হাতের ভর দিয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ওর দিকে। দুপুরের উজ্জ্বল
আলো আর মৃদু হাসি ছড়িয়ে আছে তাঁর মুখের উপর।

অহর্ষি বিভ্রান্ত…এই হাসি, এই কথা বলার ভঙ্গি ওর বড্ড চেনা…কিন্তু…নাহ্, মনে পড়ছে না। অসুখটা পুরোনো স্মৃতিদের ঘষে দিয়ে গেছে, এখনও সব ফিরে আসেনি। কখনও সখনও বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো দু – একটা কথা ভেসে ওঠে, আবার সব অন্ধকার।

‘আপনি ওদের সঙ্গে মহাকাল যাননি?’

‘নাঃ! অনেকবার গেছি, শিবের মাথায় পুজো চড়িয়েছি। সব বোগাস। আমি বুঝে গেছি, শিব আল্লা গড কেউই কিছু করতে পারবেন না। তাঁরা মাথার উপর আছেন, থাকুন, অত ভক্তি টক্তি আর আসে না। মেয়েটার অবশ্য খুব বিশ্বাস, ও প্রতিবার নিয়ম করে যায়। তবে — ‘

‘তবে?’

‘তবে রাতের জঙ্গলে প্রতিবার যাই। এবারও যাব। আমার কথা তো বললাম। শ্রীমান অহোর মহাকাল দেখতে ইচ্ছে করল না?’

অহো! ওর কবেকার হারিয়ে যাওয়া নাম! সেই নাম বলছে এই মহিলা? বুকের মধ্যে ধাক্কা দিল। আপ্রাণ চেনার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘আমার অত ট্রেকিং পোষায় না। দিনহাটায় বারদুয়েক ব্যাঙ্ক অডিটে এসছিলাম, তখন মহাকাল, ভূটানঘাট, হাসিমারা, জলেশ্বর সব ঘুরে গেছি। তাছাড়া শরীরটা এখনও ঠিক ফিট হয়নি। কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভে বেশ বাড়াবাড়ি হয়েছিল, অনেক মেমোরি রিকভার হয়নি… আপনার চোখের দৃষ্টি, আপনার হাসি, সেই ট্রেন থেকেই বড্ড চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু …’

‘এই দেখুন! আমি আবার কীরকম হাঁদাস্য হাঁদা, নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছিলাম, আমার জন্যেই অহো মহাকাল দেখতে গেল না। আমি কিন্তু পরশু ট্রেনে তাকে ঠিক চিনে ফেলেছি।’ হালকা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ‘এই নামটাই তো সেসময় চালু ছিল। ঠিক বললাম?’

অহর্ষি বিহ্বল, ঘাড় নাড়ল। কিন্তু কে — কে এই নূপুর? কোথায়… কতদিন আগে দেখা হয়েছিল? স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে মুখটাকে হাতড়াচ্ছে … ছবি ফুটছে না, স্মৃতির সমুদ্রে ভেসে উঠছে না।

শালবনে একঝাঁক বক উড়তে উড়তে এসে নামল, জঙ্গলের ভিতর থেকে কত পাখি ডেকে যাচ্ছে, গাছের ভাঙা ডালের চারিদিকে পাক খাচ্ছে ভারি সুন্দর একজোড়া পাখি। একটুক্ষণ বসছে, সরু ঠোঁট দিয়ে ডাল ঠোকরাচ্ছে, পরক্ষণেই ঘুরে ঘুরে উড়ছে। উজ্জ্বল নীল আর সবুজ শরীর। নীলকন্ঠ নাকি? উঁহু, কাঠঠোকরাও হতে পারে।

‘বুঝেছি। আচ্ছা, এ.কে.সির কোচিং মনে পড়ে? ইলেভেন টুয়েলভ, দু দুটো বছর… পাইকপাড়া বাস স্টপ, কখনও টালা পার্ক। ঘন্টার পর ঘন্টা বকর বকর… পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দুজনের গান… জীবনানন্দ আবৃত্তি…’ নূপুরের মুখে অদ্ভুত আলো ফুটে উঠছে, ‘এ.কে.সির বাড়ির গলিতে দুটো খেঁকুরে নেড়ি শুয়ে থাকত। আমার কুকুরে তখন ভীষণ অ্যালার্জি। একবার অহো আসেনি, আমি একা একাই গলি দিয়ে ঢুকতে গেছি…’

‘নন্দিনী! নন্দিনী!’ চেঁচিয়ে উঠল অহর্ষি, ‘ওয়াহ্, সব মনে পড়ে যাচ্ছে। অমনি ওদের একজন ঘ্রাউ করে ডাক ছেড়েছে। এক লাফে তুই তখন… সরি, তুই বলে ফেললাম।’

‘বেশ করেছিস। তুই-ই তো বলবি । হ্যাঁ, আমি হুড়ুম করে পিছনে লাফ মেরেছি, ঠিক পিছনে তুই এসে পড়েছিলি, মাগো বাবাগো বলে তোকেই জাপটে ধরেছি। উহ, সে এক কাণ্ড!’

‘বাকিটা বল, হুঁ হুঁ!’ অহর্ষির চোখমুখ ঝলমল করে উঠেছে। ‘আমিও তোকে পেয়েছি, চেপে ধরেছি। সেই প্রথম তো, এখনও ভাবলে শরীর … তুই বলছিস, এ কী, ছাড় ছাড়… আমি তোকে বলছি, কী মজা, এবারে রোজ কুত্তা দুটোকে ঢিল মেরে রাগিয়ে দেব… তুই বলছিস, অসভ্য, স্যারকে কমপ্লেন করব… কিন্তু… কিন্তু… তুই তো নন্দিনী! নূপুর এল কোত্থেকে?

‘কোত্থেকে আবার আসবে! নূপুর আমার ডাক নাম। তুই জানতিস। তোকে ক্যামোফ্লেজ করতে ইচ্ছে করে এই নামটা বলেছিলাম। দেখলাম, ভুলে মেরে দিয়েছিস।’

মনে পড়ে যাচ্ছে, অহর্ষির সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘তুই… তুই এতটা বদলে গেছিস। শুধু তোর চোখ আর হাসি…’

‘পঁচিশ বছর কি কম সময় রে, অহো!’ ম্লান হাসল নন্দিনী, ‘তুইও কি কম বদলেছিস? সময় বড় ক্রুয়েল, কাউকে রেয়াত করে না। কিন্তু তুই একা এসেছিস কেন রে? বিয়েটিয়ে করিসনি?’

‘করেছিলাম, কিন্তু টিঁকল না!’

‘সে কী! বউ ছেড়ে চলে গেল?’

‘হ্যাঁ রে। পার্মানেন্টলি। আমাদের বাচ্চা নেওয়ার প্ল্যান হচ্ছিল। সময়ই দিল না রে। ফিফথ অ্যানিভার্সারির দশ দিনের মধ্যেই টা টা বাই বাই। হঠাৎ তলপেটে ব্যথা, ধরা পড়ল ফোর্থ স্টেজ, অথচ কোনও সিম্পটম ছিল না… ব্যস! ক্যান্সার হ্যাস নো অ্যান্সার।’ অহর্ষির স্বর বুঁজে এল।

একটু থেমে আস্তে আস্তে বলল, ‘বড় ভালো মেয়ে ছিল রে সুনন্দা। আমাদের সেম স্ট্রিম, জিওলজি। ও বছর তিনেকের জুনিয়র। চুপচাপ, মুখচোরা গোছের। আমার সঙ্গে তেমন আলাপও ছিল না৷ তখন আমি পিএইচডি করতে ঢুকেছি। সেবার রিইউনিয়নের পরে ঠিক হল, অ্যালামনাই আর প্রেসেন্ট স্টুডেন্টদের উইকএন্ড ট্যুর হবে মাইথনে। সুনন্দাদের ব্যাচের অনেকেই গেছিল। সন্ধে গড়াতে না গড়াতে গেস্ট হাউসের লনে পান ভোজন, নাচ গান আড্ডা।

‘আমার ফেভারিট সিঙ্গার শচীন কত্তা আর ফিরোজা বেগম। পানীয়ের প্রভাবে সেদিন খালি গলায় পরপর গেয়ে যাচ্ছিলাম, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা… শোন গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি… যবে এসেছিলে তুমি প্রিয়, জীবনে মম ছিল মধুর রাতি, ওগো সাথী… এমনই বরষা ছিল সেদিন, শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন, তব হাতে ছিল অলস বীণ…’

‘হ্যাঁ, তুই বড় ভালো গাইতিস অহো।’ আস্তে আস্তে বলল নন্দিনী।

‘সে তো তুইও। কাল সন্ধেবেলা গাইছিলি! কতদিন পরে!’ অহর্ষি ঘোরলাগা চোখে তাকাল ওর দিকে, তারপর বলল, ‘রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে একা একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম বরাকর ড্যামের দিকে। বেশিরভাগ বন্ধুরা অতিরিক্ত টেনে উল্টে পড়েছে বিছানায়। তখন রাত প্রায় বারোটা।

‘হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কানে ভেসে এল, কেউ গাইছে, এমনই বরষা ছিল সেদিন… দেখি, সুনন্দা। নদীর ধারের একটা গাছতলায় বসে বিভোর হয়ে গেয়ে যাচ্ছে… তব হাতে ছিল অলস বীণ, মনে কি পড়ে প্রিয়…। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ও প্রথমে চমকে উঠল। তারপর বলে উঠল, অহর্ষিদা! আজ কী ভালো গাইলে গো… আমার সব প্রিয় গান।… তারপর…

‘তারপর প্রায় সারারাত ধরে দুজনে একের পর এক ফিরোজা, শচীন দেববর্মন, মান্না, সন্ধ্যা, হেমন্ত, কিশোর …।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল অহর্ষি, ‘গানই সেই রাতে আমাদের দুজনকে বেঁধে দিল।… সুনন্দা বিদ্যাসাগর কলেজে চান্স পেয়ে গেল। তদ্দিনে আমি জিওলজিকাল সার্ভেতে জয়েন করে গেছি। উহ, সেইসব দিন এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়। ও যে চলে গেছে, নিমতলায় ছাই হয়ে গেছে, বিশ্বাস হতে চায় না রে।’

অহর্ষি থামল। নন্দিনী দেখল, ওর দুচোখ জলে ভরে এসেছে। ঝপ করে নৈ:শব্দ্য নেমে এসেছে। শুধু শোনা যাচ্ছে নীলকন্ঠ পাখি দুটোর একটানা ডাল ঠুকরোনোর শব্দ, ঠুক ঠুক ঠুক…।

দু-তিন মিনিট, অহর্ষি নিজেকে সামলে নিল, বলল, ‘ছাড়, বোর করছি তোকে। তোর কথা বল। শুধু তোরা দুজন, কত্তাকে নিয়ে এলি না, খুব ব্যস্ত মানুষ বুঝি?’

‘না না ব্যস্তট্যস্ত নয়।’ নন্দিনীর চোখমুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে উঠেছে, ‘লং স্টোরি। শুনবি? বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু বিশ্বাস করে না, হয়ত তুইও করবি না।’

‘না না, করব। তুই কি আমার কাছে সাধারণ কেউ? প্লিস বল।’


৩। নন্দিনীর কথা


‘তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, আমার বাবা ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ সার্ভিসে ছিলেন।’ নন্দিনী পাশের কাউচে এসে বসল।

‘হ্যাঁ, মনে আছে। আমাদের এইচ.এস ফাইনাল দেওয়ার আগে মেসোমশাই নর্থ বেঙ্গলে ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। শেষ দেখা হওয়ার দিন তুই বললি, কলকাতার পাট চুকে গেল। বাবা চলে গেছেন, আমাদেরও যেতে হবে।’

‘রাইট। বাবা অ্যাডিশনাল এস.পি হয়ে জলপাইগুড়ি জয়েন করেছিল। আমিও রেজাল্ট বেরোনোর পর ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম জলপাইগুড়ির আনন্দমোহন কলেজে।’

‘হ্যাঁ রে, সব মনে আছে। তুই চিঠি দিয়েছিলি, জলপাইগুড়ি বেড়িয়ে যেতে লিখলি। তখন কি আর এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো এত স্বাধীনতা ছিল!’ অহর্ষি বলল, ‘মোবাইল দূরের কথা, বাড়িতে ফোনই ছিল না। সব কেমন ভুলে যেতে বাধ্য হলাম। সেই টালা পার্কের লেকে বসে কতসব প্ল্যান… দ্যুৎ, তোকে ইন্টারাপ্ট করছি… সরি, বল বল।’

‘না না, ঠিকই তো বলছিস।’ নন্দিনী হাল্কা শ্বাস ফেলে বলল, ‘সে এক অন্য যুগ।…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, বাবার টেরিটোরি ছিল আলিপুরদুয়ার সাবডিভিশন। আলিপুরে বাবার আলাদা কোয়ার্টারও ছিল। পাশেই ডুয়ার্স, ভূটান পাহাড়, চালসা, মালবাজার। দুর্দান্ত সিনিক বিউটি, চমৎকার ওয়েদার। ছুটি পড়লেই আমরা তিনজন একসাথে ডুয়ার্স ঘুরতে চলে যেতাম। সত্যি বলছি, নর্থ বেঙ্গলে সেই বছরগুলো অসম্ভব ভালো কাটছিল। বি.এ পরীক্ষা দিয়ে তিন মাস টানা ছুটি। মা আর আমি সুটকেস গুছিয়ে চলে গেলাম আলিপুরে বাবার কাছে। সেই সময় –‘

একটু থেমে বলল, ‘বিমল সদ্য ফরেস্ট রেঞ্জার পোস্টে জয়েন করেছে। প্রায়ই বাবার কাছে নানান সমস্যা নিয়ে কথা বলতে আসত, পরামর্শ করত। ঝকঝকে তরুণ, টল হ্যান্ডসাম, ওয়েল বিহেভড। বাবা ওকে খুব পছন্দ করত। একদিন বাবার অফিসে গেছি, বাবা ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। বাবার কাছেই শুনলাম, বিমল অরফ্যান, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন হোমে মানুষ। ব্রাইট কেরিয়ার, নিজে প্রিপেয়ারেশন নিয়ে ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট সার্ভিসে চান্স পেয়েছে। ব্যস, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। মা’রও বিমলকে জামাই হিসেবে বেশ পছন্দ। তারপর আর কী — ‘

‘তোদের বিয়ে হয়ে গেল।’

‘হ্যাঁ।’ নন্দিনী হাসল, ‘পরের দু বছরের মধ্যে। নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ ফাইনাল দিলাম, তার এক মাসের মধ্যেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। অ্যান্ড আই মাস্ট সে, বিমল ওয়াস এ আইডিয়াল হাসব্যান্ড। সবদিক দিয়ে। হস্টেলে মানুষ, সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট — হোম ফ্রন্টের সব কাজ, ঘর গোছানো, রান্নাবান্না সব পারত। করতও। আমায় কুটোটা নাড়তে দিত না। এত কেয়ারিং, এত ভালোবাসত আমায়… আর তেমনই পজেসিভ। সে যে কী মারাত্মক, তোকে একটা ঘটনা বলি।

‘বিয়ের মাসদুয়েক পরে মহাকাল মন্দিরে গেছি। সঙ্গে মা বাবাও আছে। সেদিন বোধহয় শিবরাত্রি ছিল। মন্দিরে থিকথিকে ভিড়। বাবা আবার কখনও পুলিশি অ্যাডভান্টেজ নিত না। সেদিনও আমরা পরপর লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি, বিমল পিছন থেকে এসে আমার ডানপাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর পরেই দাঁড়িয়েছে ওর গার্ডটা। দুজনে পাশাপাশি, আমায় পুরো আড়াল করে। কী হল? পরে বলল, আমার ডানদিকে পাথরের উপর বসে ছিল একদল ইয়াং ছেলে। স্কাউন্ড্রেলগুলো নাকি আমায় ঝাড়ি করছিল।… কী অবস্থা, ভাবতে পারিস!’

‘কেয়া বাত! ইউ আর রিয়ালি ভেরি লাকি।’

‘অবশ্যই। বিমল যে কত ভালো আদর করতে জানত, কী বলব! কখনও তাড়াহুড়ো করত না। আবার এও হয়েছে, আমার শরীর খারাপ, মিলিত হতে ইচ্ছে করছে না, অথচ ও ডিউটিতে রাত কাটিয়ে এসেছে, ওর খুব ইচ্ছে করছে, আমি না বলতেই ছেড়ে দিয়েছে, একবারও জোরাজুরি করেনি। অথচ সেই মানুষটাই —‘ নন্দিনী থেমে গেল।

অহর্ষি জিজ্ঞাসুচোখে তাকিয়ে আছে।

‘হঠাৎ করে পাল্টে গেল। একটা মানুষ কখনও যে এইরকম হয়ে উঠতে পারে, দু:স্বপ্নেও ভাবা যায় না। মানুষটা আর মানুষ রইল না।’

‘মানুষ রইল না! মানে?’

‘সেটাই তো বলছি৷’ নন্দিনী কান্নাভেজা গলায় বলে চলে, ‘মান্টি তখন সবে জন্মেছে। বিমল প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট কনজারভেটর। ডুয়ার্স জুড়ে ওইসময়ে পোচিং খুব বেড়ে গেছিল। পোচাররা নির্বিচারে খুন করছিল হাতি, গণ্ডার, লেপার্ড, হরিণ… বনের জন্তুদের। কাজ সেরেই ওরা পালিয়ে যেত ভূটান, ধরা যাচ্ছিল না। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে তখন তেমন ট্রেনড কর্মী, আর্মসও ছিল না।

‘বিমল রোজ বাড়ি ফিরত বিধ্বস্ত, পরাজিত শরীর নিয়ে। ঠিকমতো খেত না, ঘুমোত না। কোনদিন হয়ত আমার ঘুম ভেঙে গেছে। দেখছি, বিমল জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে, শয়তান, বাস্টার্ড! তোদের আমি ছাড়ব না।

‘আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ওকে টেনে এনেছি, এসো, শোও। চিন্তা কোরো না, তুমি ঠিক পারবে।

‘ও দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, হ্যাঁ, আমায় পারতেই হবে’

‘কিন্তু পোচিং থামানো যাচ্ছিল না। একদিন বিমল বলল, এই পোচারদের ধরতে গেলে ওকে জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে, রোজ ফিরবে না, আমি যেন চিন্তা না করি। শুরু হল আরেক ফেজ। জঙ্গল জানোয়ার আর পোচার হয়ে উঠল বিমলের অবসেশন। রাতের পর রাত বাড়ি ফিরছে না। কখনও ফোর্স নিয়ে, কখনও একা একা জিপ চালিয়ে ঢুকে পড়ছে জঙ্গলের কোর এরিয়ায়, গুলি করে মারছে পোচারদের।
‘ফোনের মধ্যে ওর গলায় উল্লাস ঝরে পড়ছে, আজ অব্দি দশ দশটা কুত্তাকে মেরেছি, জানো! ওদের লাশগুলোকে খাবে বনেরই শেয়াল- কুকুরে। সবকটাকে খতম করে তবে থামব। তখনও ঘুণাক্ষরে বুঝিনি, জয়ন্তী ফরেস্ট ওকে একটু একটু করে গিলে নিচ্ছে।’

অহর্ষি স্তব্ধ, চেয়ে আছে নন্দিনীর দিকে।

‘বুঝলাম আরও বছর দুয়েকের মাথায়। এর মধ্যে বিমল মাঝেমাঝে বাড়ি এসেছে, সারাটা দিন কাটিয়েছে, কিন্তু রাত ঘন হতেই বেরিয়ে গেছে। কখনও আমি আহ্লাদ করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছি, কী গো, আজও তুমি থাকবে না? কতদিন আমায় আদর করোনি! ও অদ্ভুত হেসে বলেছে, করব, করব। আগে আমার মিশনটা শেষ হোক। রক্তবীজের বংশ প্রায় সাফ করে এনেছি। তারপর আসছি তোমার কাছে’

‘ হ্যাঁ, তারপর ও এল। সেই রাতে… এখনও মনে পড়লে… উহ!’

বলতে বলতে নন্দিনী শিউরে উঠল, ‘সেটা ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমার রাত। সারাদিন একটানা বৃষ্টির পরে আকাশ পরিষ্কার, সোনার থালার মতো চাঁদ উঠেছে, দুধসাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। আমার বিমলের কথা খুব মনে পড়ছিল। দিন পনেরো ও আসেনি, ফোন করলেও ধরেনি। ওর কথা ভাবতে ভাবতে ছোট্ট মান্টিকে জড়িয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি।

‘তখন কত রাত জানি না, আমার ঘুম ভেঙে গেল। নাকে এসে লাগল বুনো বোঁটকা গন্ধ, কানে এল অচেনা শব্দ। চেয়ে দেখি, সামনে বিমল। কিন্তু — কিন্তু ওর এরকম চেহারা কেন? ইউনিফর্মে ছোপছোপ কালচে রক্তের দাগ। শরীরটা টলমল করে কাঁপছে, চোখ দুটোয় অমানুষিক দৃষ্টি, ধকধক করছে’

ঘড়ঘড়ে অচেনা গলায় বলল, ‘এসে গেছি, আমি এসে গেছি নন্দিনী। সবকটা খতম, ফরেস্ট ক্লিয়ার’

‘কী হয়েছে তোমার? তুমি এরকম– আমায় বাকিটা বলতে দিল না, হ্যাঁচকা টান মারল, ওঠো, ওঠো শিগগির। বিছানা থেকে তুলল, টানতে টানতে নিয়ে গেল পাশের ঘরে।’

নন্দিনী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওর যেন তর সইছিল না। নাইটি ছিড়েখুঁড়ে আমায় সম্পূর্ণ নগ্ন করল, তারপর হিংস্র শ্বাপদের মতো আমার গালে, গলায়, বুকে, বগলে, নিতম্বে, ঊরুসন্ধি… নরম নরম জায়গাগুলোয় আঁচড়াতে কামড়াতে শুরু করল।

‘আমি ব্যথায় যত উহ্ আহ্ ছাড়ো ছাড়ো করছি, বিমল তত খ্যাকখ্যাক করে পিশাচের মতো হাসছে! আমি যেন ওর সেক্স টয়। তারপর —‘

যেন কোনও ভয়ের পর্ণো দেখছে, নন্দিনীর চোখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক, ‘তারপর বিমল আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বিছানায়। ওর শরীরে জান্তব শক্তি, আমায় উপুড় করে উপরে চেপে বসল সে। সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণায় আমি আর্তনাদ করে উঠেছি, উহ উহ! বিমল ওর অমানুষিক খেলা শুরু করে দিয়েছে পিছন দিক দিয়ে!

কয়েক মুহূর্ত। তার কাজ শেষ। সে দ্রুত ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে চলে গেল। আমি পড়ে আছি বিছানায়, রক্তে ভেসে যাচ্ছে খাট।’

‘চলে গেল!’
‘ইয়েস। হি ওয়েন্ট আউট আফটার দ্যাট ব্রুটাল রেপ।’ নন্দিনী কয়েক মুহূর্ত চুপ। বলল, ‘আমি কাতরাতে কাতরাতে উঠে নিজেকে সাফসুতরো করলাম, ছেড়া নাইটি ফেলে ফ্রেশ নাইটি পরলাম, এসে কোনক্রমে টান হয়ে পড়লাম আমার বাচ্চা মেয়েটার পাশে।

‘শরীর মন বিধ্বস্ত, দুচোখ ফেটে জল আসছিল, ঈশ্বরকে বলছিলাম, এ আমার কী করলে ঠাকুর! আমার প্রিয়তম মানুষটার এ কী হল, ওকে অমানুষ করে দিলে! কাঁদতে কাঁদতে কোনও একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি।

‘পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে গেল চেনা হাতের স্পর্শে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সামনে দাঁড়িয়ে বিমল। আমার প্রেমিক, আমার স্বামী বিমল। মিষ্টি হাসিমাখা মুখ, হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, আমার ফেভারিট দার্জিলিং টির খুশবু বেরোচ্ছে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘তুমি!’

‘সে হেসে বলল, হ্যাঁ গো, কাল রাত ২ টো নাগাদ ঢুকেছি। অঘোরে তোমরা ঘুমাচ্ছিলে, তাই আর ডাকিনি। আমি স্টানড! কোনটা সত্যি, এই ভালোবাসায় ভেজা চায়ের কাপ, না কাল মধ্যরাতের ধর্ষণ? এই দুজন কি একই লোক?

‘থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, তুমি কাল ঠিক কখন এসেছিলে বিমল? বিমল নিষ্পাপ মুখে বলল, কেন, বললাম তো, ২ টো নাগাদ। কিন্তু তার আগে? কোথায় ছিলে, কী করছিলে?’

‘জানি না। বিমল মাথা নেড়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।’

‘তারপর?’ অহর্ষি অস্ফুটে বলল।

‘তার আর পর নেই, নেই কোনও ঠিকানা।’ হতাশ সুরে বলল নন্দিনী, ‘সেই শুরু হল আমার জীবনে এক আতঙ্কের অধ্যায়। এর পর থেকে প্রতি মাসের পূর্ণিমার দিন বিমল আর মানুষ থাকত না। বেশ বুঝতে পারতাম, শুক্লপক্ষ যত পূর্ণিমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিমলের মধ্যে অ্যানিম্যাল ইন্সটিংক ফিরে আসছে, পাল্টে যাচ্ছে ওর হাঁটাচলার ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, শরীরে কোনও হরমোন সিক্রেশনের ফলে ওর গা দিয়ে উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে…।

‘তারপর… পূর্ণিমার রাতে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি… ভায়োলেন্ট একটা বিস্ট! ছিড়েখুঁড়ে খেত আমায়।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নন্দিনী, ‘ওকে থামাতে অনেকভাবে চেষ্টা করেছি, পারিনি। পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জঙ্গলের ডিউটি থেকে ফিরে এসে যেই বাথরুমে ঢুকেছে, অমনি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। লাভ হয়নি, ওর শরীরে তখন আসুরিক শক্তি, দরজা ভেঙে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার উপর। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কি জানিস, ঘটনার পরদিন সকালে যথারীতি বিমল আবার স্বাভাবিক, আগের মতো মানুষ। আগের রাতের কথা তার মনে নেই, শুধু শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেছে।’

‘স্ট্রেঞ্জ, স্ট্রেঞ্জ!’ বিড়বিড় করল অহর্ষি।

‘আমি আর এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছিলাম না। মা বাবাকে সব খুলে বলতেই হল, মান্টিকে নিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। বাবাও ততদিনে প্রমোশন পেয়ে ভবানী ভবনে ডিআইজি, সিআইডি। ডিগ্রির যোগ্যতা ছিল, কলেজ সার্ভিস কমিশনে এক্সাম দিয়ে বেথুনে লেকচারার পোস্ট পেয়ে গেলাম। বিমল তখনও আমাদের পিছনে পড়ে আছে। মাঝেমাঝেই হুটহাট কলকাতায় চলে এসেছে, দু তিন দিন আমাদের বাড়ি থেকেও গেছে। তখন সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বারবার হাতে পায়ে ধরে সাধছে, একবার চলো তোমরা, আমি বলছি, আর কিছু হবে না৷

‘এমন করে কাকুতিমিনতি করত, আমি দুর্বল হয়ে পড়তাম। যাব না যাব না করেও শেষ অব্দি একবার সামার ভ্যাকেশনের ছুটিতে মান্টিকে নিয়ে গেলাম বিমলের কাছে। দ্যাট ওয়াস আওয়ার লাস্ট মিটিং ইন হিস বাংলো।

‘নাহ, ভুল ভেবেছিলাম। জঙ্গল মানেই অন্য বিমল, যে মানুষ নয়। আবার পূর্ণিমা রাতে আমায় ব্রুটালি রেপ করল!’

‘ও মাই গড!’

‘অ্যাই, খালি গড গড করিস না তো! যত্ত বোগাস। গডদের কোনও ক্ষমতা আছে নাকি।’ নন্দিনী খেঁকিয়ে উঠল, ‘পরদিন সকাল হতেই কলকাতায় রওনা হলাম। সেই মুহূর্তে ফাইনাল ডিসিশন নিয়ে ফেললাম, এনাফ ইস এনাফ। আর কখনও বিমলকে ফরেস্টে মিট করব না।

‘বিমল অবশ্য তার পরেও কলকাতা এসেছে, দু মাসে তিন মাসে একবার। আমাদের সম্পর্কটা জোড়াতালি দিয়ে তখনও টিকে ছিল। যোগাযোগটা ওই রাখত, ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক… তারপর ওর কলকাতায় আসাও ইররেগুলার হয়ে গেল… ও ততদিনে জঙ্গলে আরও অবসেসড হয়ে পড়েছে… ওর গার্ড ছেত্রীর কাছ থেকে খবর পেতাম, সাহেব নাকি রাতের পর রাত ফরেস্টেই থাকে, কোয়ার্টারে ফেরে না।

‘তখনও কিন্তু মোটামুটি প্রতি সপ্তাহে বিমলের সঙ্গে মেসেজে কথা হত…। ওর প্রতিটা মেসেজে লাস্ট লাইন থাকত, প্লিস নন্দিনী, আমায় আরেকটা লাস্ট চান্স দাও… আমি মান্টি আর তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না, বিশ্বাস করো, পারছি না … প্লিস আমায় দয়া করো…!’

‘তুই কী লিখতিস?’

‘আমি? আমি লিখতাম, যা বলার বলে দিয়েছি। ইউ আর ওয়েলকাম ইন কলকাতা, কিন্তু তোমার ফরেস্ট বাসায় আর কিছুতেই যাব না। বেশি ঘ্যানঘ্যান করলে, এরপর আর রিপ্লাইই করব না।’

‘তারপর?’

‘ওর মেসেজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই এসে গেল আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন। বিমল হারিয়ে গেল!’
‘হারিয়ে গেল!’

‘হ্যাঁ, এই ডুয়ার্সেই মিশে গেল।’ আস্তে আস্তে বলল নন্দিনী, ‘আজ থেকে ৮ বছর আগে, সেও ছিল এক দোল পূর্ণিমার রাত। আমি কলকাতায়। রাত তখন ১ টা। শুয়ে পড়েছি। আমার মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল। প্রথমে দেখিনি, ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘণ্টা দুয়েক পরে বাথরুমে যাওয়ার সময় মোবাইলে আলো জ্বলতে দেখে কাছে তুলে দেখি, পরপর তিনটে মেসেজ এসেছে বিমলের কাছ থেকে।

‘আমি চলে যাচ্ছি।…পার্মানেন্টলি।…আর ফিরছি না’

‘আই ওয়াস প্যানিকড! এর মানে কী? সঙ্গে সঙ্গে ওকে কল করলাম। ধরল না। বিমল কি আমার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি? বিমল কি জঙ্গলে সুইসাইড করতে চলে গেল? তখন রাত প্রায় ৩টে। ওর গার্ড ছেত্রীকে ফোন করলাম, সেও ধরল না। অত রাতে কী করব, কাকে ধরব? সারাটা রাত আমার জানলার ধারে বসে কেটে গেল। ভোরের আলো ফুটতেই ছেত্রীকে আবার ফোন করেছি। সে ধরল, বলল, সরি ম্যাডাম, শো গয়া থা।

‘লেকিন তোমার সাব, সাব কাঁহা হ্যায়?’

‘সাব কাল রাতোমে পায়দল ফরেস্ট চলা গয়া, আভিতক নাহি লওটা।

‘ডিএফও সুনীল যাদব ছিল বিমলের খুব ন্যাওটা। ওর কাছে কাজ শিখেছে। ফোনে সুনীলকে সব বলতেই সে বলল, আমি দেখছি, ম্যাডাম। চিন্তা করবেন না। এ ফরেস্ট আমিও হাতের তালুর মতো চিনি। স্যারকে ঠিক পেয়ে যাব৷

‘আমি একমুহূর্ত দেরি করিনি, বাগডোগরার ইমিডিয়েট ফ্লাইট ধরলাম। জয়ন্তী পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর। ততক্ষণে ডিএফও সুনীল তার ফোর্স নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলেছে জয়ন্তীর জঙ্গল।

‘কিন্তু বিমল বা তার লাশ পাওয়া গেল না।’ নন্দিনী থামল।

অহর্ষি ড্যাবডেবে চোখে চেয়ে আছে, অস্ফুটে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ! কোনও চিহ্ন নেই?’

‘নাহ্।’ নন্দিনী বলল, ‘এখানেই শেষ নয়। তিন চারদিন বিমলের কোয়ার্টারে কাটিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। বাবা- মা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় সান্ত্বনা দিল, শোন মা, মনে হয়, ও সে রাতে কোনও বড় বাঘের খপ্পরে পড়ে গেছিল। টেনে নিয়ে গেছে।… কী করবি মা, সত্যিটা তো মেনে নিতে হবে। এখন ওর শ্রাদ্ধ শান্তি করা দরকার। হাজার হোক, অপঘাতে মৃত্যু তো।’
‘আমিও সেটাই ভাবছিলাম। অন্য কিছু হওয়া অসম্ভব। রাগের মাথায় জঙ্গলে গেছে… তারপর যা হওয়ার হয়েছে। আমার কপাল!

‘বিমলের শ্রাদ্ধের আগের দিন রাত ৮ টা। সব জোগাড়যন্তর, আত্মীয়দের জানানো শেষ। হঠাৎ আমার মোবাইলে বিমলের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ ঢুকল, আমি বেঁচে আছি। জঙ্গলেই আছি। কোনও পূর্ণিমা রাতে জঙ্গলেই দেখা হবে।’

‘ হোয়াট!’ অহর্ষি দাঁড়িয়ে পড়েছে, ‘বিমল মেসেজ করেছিল?’

‘হ্যাঁ, করেছিল। তুই বোস।’ নন্দিনী ম্লান হেসে বলল, ‘ইমিডিয়েটলি সব আয়োজন বন্ধ করা হল, রিলেটিভদের জানিয়ে দেওয়া হল। ডিআইজি বাবাকে নিয়ে ফের নেক্সট ডে মর্নিং ছুটলাম জয়ন্তী। সেই বিকেলেই বিশাল পুলিশ আর ফরেস্ট ফোর্স নেমে পড়ল জঙ্গলে। বিমলের নাম্বার ট্র‍্যাক করতে করতে সন্ধের পরে মোবাইলটা পাওয়া গেল। জঙ্গলের মধ্যে চুনিয়া ঝোরার কাছে একটা পাথরের উপর পড়ে ছিল। পুলিশের আইটি সেল কনফার্ম করল, ওই মোবাইল থেকেই মেসেজ ডেলিভার্ড হয়েছে।’

ধপ করে বসে পড়েছে অহর্ষি। বলল, ‘ওই মোবাইলটা এখন কোথায়? তোর কাছে?’
‘নাহ্। আমি রেখে কী করব?’ মাথা নাড়ল নন্দিনী, ‘ওদের বললাম, যেখান থেকে পেয়েছে, সেখানেই রেখে আসতে। বিমল যদি আবার কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, তাহলে ফোনটা ওর লাগবে।’

‘পরে কি আর বিমল মেসেজ করেছিল?’

‘নাহ্, করেনি। কখনও করবে হয়ত। সেই আশাতেই এত বছর ধরে এখানে আসছি।’

‘ইমপসিবল। ৮ বছর ধরে মোবাইলটা অ্যাক্টিভ আছে? তুই কি পাগল? এখনও বিশ্বাস করিস, বিমল বেঁচে আছে?’

‘হ্যাঁ রে, সত্যি বলছি, করি। বিকস আই লাভড হিম। বিমলকে ভুলতে পারি না। শুধু আমি কেন, মান্টিও পারে না। তবে হ্যাঁ, আমি এবার ঠিক করে ফেলেছি, দিস ইস মাই লাস্ট টাইম ইন জয়ন্তী … এর পরে আর কোনওদিন আসব না। বিমলের কথা ভেবে ভেবে আমি টায়ার্ড… একা একা আর পারছি না…!’

‘একটা কথা বলব?’ অহর্ষি বলল।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ বল না!’

‘বলছিলাম, আমরা কি দুজনে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারি না?… আমিও তো একদম একা… লোনার… তুইও তাই … এতদিন বাদে দু’জনকে যখন উপরওয়ালা দেখা করিয়ে দিলেন…!’ অহর্ষি চুপ করে গেল।

নন্দিনী গভীর চোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। ওর মুখে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠছে। বলল, ‘কী অদ্ভুত, কী অদ্ভুত অহো। বিশ্বাস কর, আমিও এই কথাটাই মনে মনে ভাবছিলাম, মুখ ফুটে বলে উঠতে পারছিলাম না। গতকাল তোকে দেখার পর… তারপর যখন তোর লাইফের ট্রাজেডির কথা শুনলাম, তখন থেকে … তবে…’ একটু থেমে বলল, ‘মান্টির সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে, ও তো বড় হয়ে গেছে… অবশ্য আজকালকার মেয়ে, মনে হয়, আপত্তি করবে না।’

অহর্ষির মুখ ঝলমল করে উঠেছে। খপ করে নন্দিনীর হাত চেপে ধরল, ‘উফ্, কী যে আনন্দ হচ্ছে, তোকে বোঝাতে পারব না। তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে কত কথা যে উথলে উঠছে বুকের মধ্যে…!’

‘উঠবেই তো অহো!’ নন্দিনী হাত ছাড়াল না। শ্বাস ফেলে বলল, ‘প্রথম প্রেম কি এত সহজে মুছে ফেলা যায় রে! সো মেনি চেরিশেবল মোমেন্টস… ভাবতে এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’

‘আমারও।’ অস্ফুটে বলল অহর্ষি৷

‘এনি ওয়ে, তোর কি মনে আছে, সেই পঁচিশ বছর আগে টালা পার্কের লেকের সামনে লাস্ট যখন আমাদের দেখা হয়েছিল… যতদূর মনে আছে, বিজয়ার পরে প্রণাম করতে গেছিলাম এ.কে.সিকে, তখন জাস্ট সন্ধে হয়েছে, তুই আমার কাছে একটা কিছু স্পেশাল চেয়েছিলি? আমি বলেছিলাম, এখন না, পরে?’

মুহূর্তে অহর্ষির চোখ বড় বড়, ‘মাই গুডনেস! তুই সব মনে রেখেছিস?’

‘অফ কোর্স!’ নন্দিনী মুখ টিপে হাসল। বলল, ‘তুই চাইলে অবশ্য আজ আমি পুরোনো দেনা মিটিয়ে দিতে — আফ্ফ !’

নন্দিনীর কথা শেষ হয়নি, ওর ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে অহর্ষির ঠোঁট। সে ঝাঁপিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে নন্দিনীকে, অস্ফুটে বলছে, ‘শুধু দেনা মেটালে তো হবে না মণি, সুদও যে দিতে হবে।’

অহর্ষির হাত খেলা করছে নন্দিনীর শরীরের নানা জায়গায়।

‘উহ উহ,’ নন্দিনী বেতের চেয়ারে এলিয়ে পড়েছে, ওর মুখ থেকে নানা শব্দ বেরিয়ে আসছে। ‘আহ, ইস উস… অ্যাই কী হচ্ছে… উহ, এবার ছাড়…।’

অহর্ষির মুখে কথা নেই, চেপে ধরে আছে নন্দিনীকে, আস্তে আস্তে টানছে।

‘আহ্ ওহ্ … কী করছিস… কেউ যদি এসে পড়ে…’

‘আরে বাবা, সেইজন্যেই তো…’ অহর্ষি ফিসফিস করে বলে, ‘ঘরে চল, ঘরে …’

ঘরের দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। খুব দ্রুত হাতে নন্দিনীর পোশাক খুলতে থাকে অহর্ষি… নন্দিনীও সাড়া দিচ্ছে… অহর্ষির পাজামা লুটোচ্ছে মেঝেতে… দুটো উপোসী নগ্ন শরীর শঙ্খ লাগা সাপের মতো দুলছে… দুজনেই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল…! পরক্ষণে শিউরে উঠেছে নন্দিনী, ‘এ কী, এ কী… এসে গেছে … উহ, সেই গন্ধ… বোঁটকা গন্ধ… ওই যে ওই যে…!’ সজোরে ধাক্কা দিল অহর্ষিকে, ‘ ছাড়, ছাড়… ও এসে গেছে।’

হড়বড়িয়ে উঠে বসেছে বিছানায়, তাড়াতাড়ি নেমে সালোয়ার কামিজ পরছে।

অহর্ষি হতভম্ব, ‘কী বলছিস? কে এসে গেছে?’

‘বিমল, বিমল… দেখছিস না, বাইরে, বাইরে কেমন কালো করে এসেছে…।’

অহর্ষি জানলা দিয়ে তাকিয়েই থরথর করে কেঁপে উঠল।

বাইরে সহসা নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। জানলা জুড়ে গ্রিলের উপর চেপে বসেছে মিশমিশে কালো একটা মুখ। তার চেরা চোখদুটো জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল, ছুঁচলো নাক ঢুকে এসেছে গ্রিলের ফাঁকে… করাতের মতো দাঁত… ঘ্রর… ঘ্রর…ঘ্রর রর… চাপা গর্জন করছে।

এ কে– কী জানোয়ার এটা? ও কি গ্রিল ভেঙে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসবে? তারপর… কী হবে? ওহ ওহ, কী ভয়ানক, মনে হচ্ছে প্রাণটা গলার কাছে উঠে এসেছে!

এইসময় কানে ভেসে এল কিছু মানুষের হইচই… তারা এদিকেই এগিয়ে আসছে। নন্দিনী ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
অহর্ষি ফের তাকাল জানলার দিকে। ভয়ংকর মুখটা অদৃশ্য! জানলার বাইরে এখন দিব্যি খটখটে দুপুরের আলো। তাহলে? সবটাই কি চোখের ভুল?


৪। সেদিন দুজনে


‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’ অহর্ষির মোবাইল বেজে উঠেছে।

এক ঝটকায় স্মৃতির সরণি থেকে ও ফিরে এল বাস্তবে। মোহন কারকি ফোন করছে।

‘হাঁ, মোহন, বোলো।… ঠিক হ্যায়। আমরা আধা ঘণ্টা বাদ মোড়ে পৌঁছে যাব।’
শ্লথ পায়ে উঠে দরজায় নক করল, ‘নন্দিনী, ঘুমিয়ে পড়লি?’

‘কেন রে? আমি কি তোর মতো বোতল টেনেছি?’

‘কী জানি বাবা! সন্ধেটা ঘরেই কাটিয়ে দিলি। একবার শুধু বেরিয়ে ডিনার নিলি, ফের ঢুকে গেলি। মোহন বলল, আধঘন্টার মধ্যে আসছে। একটু বাইরে আসবি?’
‘ওরা কোথায়?’

‘সুনন্দ-রুমকি? যাওয়ার মতো কন্ডিশনে নেই। শুয়ে পড়েছে।’

‘ছেলে মেয়ে দুটো?’ নন্দিনী বেরিয়ে এসে কাউচে বসল।

‘বাবুন-মান্টির কথা বলছিস? শুনলাম, রুমকিকে বাবুন বলেছে, ফিরতে দেরি হবে।’

‘হ্যাঁ, সমবয়েসি তো, বন্ধুত্ব হতে টাইম লাগে না। আমার মান্টি তো ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট, কারও সঙ্গে মেশে না। কিন্তু দ্যাখ… কেমন চট করে বাবুনের সঙ্গে জুড়ে গেল।’

‘আসলে এই বয়েসটাই এমন। আমরাও তো’ থেমে গিয়ে অহর্ষি বলল, ‘তুই… তুই ঠিক আছিস নন্দিনী?’

নন্দিনী গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। আস্তে আস্তে বলল, ‘জানি না।’

‘আচ্ছা, আজ দুপুরে ওই যে জানলায়… ওটা কি সত্যি? এখন কিন্তু হ্যালুসিনেশন মনে হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড … তারপর আর কিছু নেই।’

লম্বা শ্বাস ফেলল নন্দিনী, ‘না রে, হ্যালুসিনেশন নয়। ওটা বিমল। ‘

‘বিমল! কী বাজে বকছিস? ওটা কি মানুষ ছিল নাকি!’

‘সেটাই তো মিস্ট্রি অহো, কাউকে বিশ্বাস করাতে পারব না। আগেও এরকম ঘটেছে। আমি সিওর, বিমলই এইসব রূপ ধরে আসছে।’

অহর্ষি অবাক চোখে তাকাল।

নন্দিনী ফের শ্বাস ফেলল। বলল, ‘প্রথমবার হয় বছর চারেক আগে। কলিগদের সঙ্গে এসেছিলাম চিলাপাতা জঙ্গলে।

‘সেই ট্রিপে আমার এক কলিগের হাসব্যান্ড খুব ফ্লার্ট করছিল আমার সঙ্গে। ভদ্রলোক দারুণ হ্যান্ডসাম। আরে ম্যাডাম, আপনি এখনও এত অ্যাট্রাকটিভ, কেন একা একা দিন কাটাচ্ছেন! যেকোনও পুরুষ আপনার মতো মহিলার সঙ্গ পেলে বর্তে যাবে… কিছু একটা করুন… এরকম আর কী। আমার বেশ মজাই লাগছিল। আমিও বলছিলাম, একজন তেমন কাউকে জোগাড় করে দিন না! আমরা জঙ্গল সাফারিতে বেরিয়েছি। তখন রাত প্রায় ১০ টা। ভালোই জ্যোৎস্না ছিল। পিচরাস্তার দু’ধারে ডেন্স ফরেস্ট। মাঝে মাঝে কালভার্ট। নীচে দিয়ে ঝিরঝিরে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে। এইরকম একটা কালভার্টের সামনে এসে আমাদের ড্রাইভার জিপ থামাল। বলল, এই জায়গা দিয়েই বুনো জন্তুরা, পার্টিকুলারলি হাতি পারাপার করে। বাঁদিকের জঙ্গলের মধ্যে সল্ট লেক আছে। চুপ করে ওয়েট করুন। ভাগ্যে থাকলে কিছু না কিছু ঠিক দেখতে পাবেন।

‘তো ওই ভদ্রলোক ওভার স্মার্ট। হুট করে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ড্রাইভার হাঁ হাঁ করে উঠল, নামবেন না, নামবেন না, জায়গাটা খতরনাক। ভদ্রলোক বলল, উপায় নেই। আমার ব্লাডার ফেটে যাবে! জাস্ট মাইনাস করেই চলে আসছি।

‘বলেই ঢুকে গেছে কালভার্টের পাশ দিয়ে জঙ্গলের একটু ভিতরে। মিনিট খানেকও হয়নি, তার প্রাণফাটা আর্তনাদ! ড্রাইভারের সঙ্গে আমরাও চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলাম।

‘গিয়ে কী দেখলাম, জানিস! মানুষটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, সাড় নেই। ওর প্যান্ট শার্ট ছিন্নভিন্ন, সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। ধরাধরি করে ওকে তুলে নিয়ে আসা হল, ড্রাইভার ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল হাসিমারা টি- এস্টেটের একটা হাসপাতালে। বাগানে ডাক্তার ছিলেন। তখনই ওর ট্রিটমেন্ট স্টার্ট হল। আমরা সারা রাত ছিলাম।

‘জ্ঞান ফিরে আসার পরে ভদ্রলোক কী বলল, জানিস? বলল, জঙ্গলে সবে দাঁড়িয়েছে, হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বিশাল একটা প্রাণী এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চরম আক্রোশে ওকে আঁচড়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল। যদি ও প্রাণপণে না চেঁচাত, ড্রাইভার চিৎকার করে না ছুটে যেত, তাহলে নির্ঘাত মারা যেত। পুলিশ, ডাক্তার সকলেই জিগ্যেস করেছিল, কেমন দেখতে প্রাণীটাকে? সে বলেছে, ভালুকের মতো লোমশ শরীর, কিন্তু মুখের আদল নেকড়ে আর চিতাবাঘ মেশানো। সবাই হতভম্ব। ওরকম অদ্ভুত জানোয়ারের কথা কেউ শোনেনি।’

‘দুপুরে আমিও ওরকমই দেখেছি।’ অহর্ষি বিড়বিড় করল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! পরদিনই কলকাতা ফিরে এলাম। মাস তিনেক লেগেছিল ভদ্রলোকের সুস্থ হয়ে উঠতে।’

নন্দিনী একটু থামল। জাগ থেকে অনেকটা জল গলায় ঢেলে বলল, ‘নর্থ বেঙ্গলে থাকতে থাকতে এমন টান জন্মে গেছে যে, এখানকার জঙ্গলে বেড়ানোর কথা উঠলে নিজেকে সামলাতে পারি না। প্রতিবছর বিমলকে খুঁজতে এখানে আসছি, তবুও…। গতবছর অহনা যখন বলল, গুমটি বনবাংলোয় ওরা বেড়াতে আসার প্ল্যান করেছে, শুধু আমরা চার কলেজ ফ্রেন্ড, রেজিস্ট করতে পারলাম না।’

অহর্ষির ফোন বেজে উঠেছে, ‘হাঁ মোহন, আমরা রেডি। আচ্ছা, এসো।’ ফোন কেটে বলল, ‘মোহনের বাড়িতে গেস্ট এসেছিল। ১০ মিনিটে আসছে।… নন্দিনী, গুমটি জায়গাটা কোথায়?’

‘কার্সিয়াঙের কাছে, ঢুঙ্গে বস্তি এলাকায়। ফ্যান্টাস্টিক লোকেশন। পাহাড়ের খাঁজে দোতলা বাংলো। পাইন বন। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সামনে নির্জন পথ, পাহাড়ের সারি, ছোট ছোট ঘরবাড়ি। অক্টোবরের শেষ, তখন বিকেল। সূর্য নামছে, মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কী যে আনন্দ হচ্ছে! কলেজ লাইফের পর প্রথম চারজন একসাথে। শিল্পী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গেয়ে উঠেছে, এই তো ভালো লেগেছিল, আলোর নাচন পাতায়… ওর সঙ্গে সবাই গলা মিলিয়েছি। কিছুক্ষণ গান চলল, তারপর আমাদের আড্ডা আর পুরোনো গল্প… সে আর ফুরোয় না। হঠাৎ অহনা বলল, ফ্রেন্ডস, এই মুহূর্তগুলো আর ফিরে পাব না। সুতরাং যতক্ষণ পারি আজ জাগব, গান নাচ কবিতা হবে। সাক্ষী থাকবে এই পাহাড়, জঙ্গল। নীলিমা বলল, জানিস তো, আজ আবার চতুর্দশী। পাহাড়ি জঙ্গলে জ্যোৎস্না দেখব। চারজনে হাততালি দিয়ে উঠলাম।’

‘সত্যিই রে। পুরোনো বন্ধুরা একসাথে মানেই মজা আনলিমিটেড! আমরাও পেলিং-এ খুব ফূর্তি করেছিলাম।’

‘হ্যাঁ রে। গুমটির বাংলোয় তেমনই… ঠান্ডাও বাড়ছিল। চিকেন পকোড়া সহযোগে কেউ বাকার্ডি, কেউ রাম খাচ্ছিলাম। এইসময় থালার মতো চাঁদ উঠল। উহ্, অপূর্ব।

‘ডিনার শেষ, কেয়ারটেকার গণেশ নিয়ে চলে গেছে। ও থাকে কিছু দূরে ঢুঙ্গে বস্তিতে। কাল ভোরে চলে আসবে। নীচের ঘরে আমাদের ড্রাইভার লোকেশ থাকছে। রাত প্রায় দেড়টা। জলের প্রভাবে আমার চোখ টেনে আসছিল। বললাম, আমি একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আসছি। ওরা প্যাঁক দিল, কিন্তু আমি বসে থাকতে পারছিলাম না। বিছানায় পড়তেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।’ নন্দিনী থামল।

‘হঠাৎ …’ নন্দিনী বলল, ‘হঠাৎ মনে হল, আমার পাশে কেউ এসে চুপ করে শুয়ে আছে। সাড় আসতেই প্রথমে নাকে ধাক্কা মারল একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ! আর খুব অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। কে — কে ঢুকেছে? লাফিয়ে উঠে বসেছি। এ কী! খাটের পাশে অন্ধকারে দপদপ করছে দুটো সবুজ চোখ। সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছি, বাবা গো! বাঁচাও! বাইরে বন্ধুরা শুনতে পেয়ে গেছে, ওরা এদিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে একটা ধুমসো কালো ছায়ামূর্তি জানলা দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।’

‘জানলা দিয়ে বেরোল! জানলায় গ্রিল ছিল না?’

‘ছিল তো! যুক্তিতে সবকিছুর ব্যাখ্যা মেলে না! ওটাও বিমলই ছিল। আমায় যেই একা দেখেছে, অমনি চলে এসেছে।’

‘হুমম!’ অহর্ষির ফোন ফের বেজে উঠেছে। ‘হাঁ মোহন, তুমি মোড়ে দাঁড়াও, যাচ্ছি।’

আলোর চাদর মেখে শুয়ে আছে পাথুরে পথ। দু’দিকে বনস্পতিদের মাথাতেও অপার্থিব আলো। জিপসির সামনে মোহনের পাশে ওর এক সঙ্গী, পিছনে মুখোমুখি অহর্ষি আর নন্দিনী। ইঞ্জিন আর পাথরের একটানা ঘড়ঘড় শব্দ।

কিছুক্ষণ পরে অহর্ষি আস্তে আস্তে বলল, ‘আমার না সব কিছুই অবাস্তব মনে হচ্ছে। হঠাৎ পঁচিশ বছর পরে দেখা তোর সঙ্গে… তারপর সব…’

‘হ্যাঁ, আমারও। কী অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স! তুই বেড়াতে এলি বন্ধুর ফ্যামিলির সঙ্গে… তারপর আমরা আবার জীবন…’

মোহন সামনে থেকে বলে ওঠে, ‘দিদি, এই দাদাটো তুমার জানাচিনা লাগে?’

‘হ্যাঁ, অনেক পুরান দোস্ত।… আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি, মোহন?’

‘যিখানে হর বার যাই দিদি।’ মোহন বলল, ‘প্রথমে হাতিপোতা যাব, যিখানে জানবররা পানি খেতে আইলে দাদা দেখতে পাবে। ফির যাব তোমার চুনিয়া…।’

অহর্ষি বলল, ‘কয়েকটা প্রশ্নের জবাব খুঁজছি, লজিক খুঁজে পারছি না। ধর, এই যে তুই প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার রাতে বিমলের দেখা পেতে এই জয়ন্তীর জঙ্গলে আসছিস, ও কিন্তু সামনে আসছে না! অথচ সেই বিমলই আবার চিলাপাতা কি ফরেস্ট বাংলোয়… বা আজ দুপুরে… এর কারণটা কী?’

নন্দিনী রুদ্ধস্বরে বলল, ‘হয়ত বিমল আর… তাই লোকজনের মুখোমুখি হতে পারছে না।’

‘সেইজন্যেই কি ও অন্য অন্য জঙ্গলে… যেখানে তুই একা গেছিস, সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে?’

‘কী জানি, হতে পারে। ও যে কীরকম পজেসিভ ছিল, তোকে তো বলেছি। তাই জানাতে চায়, আমি কিন্তু রয়েছি, তুমি অন্য কারও সঙ্গে বাড়াবাড়ি কোরো না। এবারে তোর সঙ্গে যাচ্ছি, দেখি এবার কী হয়।’

হঠাৎ পথের একধার ঘেঁষে জিপসি দাঁড়িয়ে গেল। ইঞ্জিন, আলো সব বন্ধ করে দিয়েছে মোহন। ‘কী হল মোহন?’

‘দিদি, স্মেল আসছে। মহাকাল।’

এখানে অরণ্য আরও নিবিড়। দু’দিক থেকে গাছেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পথের উপর, চাঁদকেও দেখা যাচ্ছে না। ফোঁটা ফোঁটা জ্যোৎস্না আলপনা এঁকেছে পথে। বন্য গন্ধ দ্রুত এগিয়ে আসছে। ডালপালা মাড়ানোর আওয়াজ।

বনের ডানদিক থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটা চলন্ত টিলাপাহাড়। হেলতে দুলতে চলল সামনের দিকে। ছোট বড় আটজন। ধারের বড়গুলো শুঁড় দোলাচ্ছে, বাচ্চাগুলোকে লাইনে নিয়ে আসছে। মোহন কপালে হাত ঠেকাল, ‘জয় মহাকাল, জয় গণেশজী। হাওয়া উল্টোদিকে, আমাদের টের পায় নাই।’

হাতিবাহিনী কিছুটা গিয়ে বামদিকের বনের মধ্যে ঢুকে গেল। ঠিক তখনই পাশের গাছপালা থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাক, ‘টক- টক – টক — ট্রু ট্রু ট্রু… টক টক… ট্রুট্রুউউউউউউ…!’
অহর্ষি চমকে উঠেছে, ‘ক্—কী রে?’

‘কিছু না, তক্ষক — তক্ষক ডাকছে।’

‘স্ — সা — সাপ, সাপ! ওরে বাবা। ক্– কোথায়?’

‘ধুৎ — তুই একটা হাঁদা গঙ্গারাম, কিছুই জানিস না। তক্ষক কি সাপ নাকি? একজাতের লিজার্ড, গিরগিটির বড় এডিশন। জঙ্গলের মানুষদের খুব প্রিয়, ওদের কাছে খুব পয়া, অনেকে পোষেও।’

‘হাঁ দাদা, আমরা ওদের ঘরে পালি, পুষি। পোচারগুলো আদিবাসীদের লাখো রুপেয়া লোভ দেখায়।’ মোহন গাড়ি আবার স্টার্ট দিয়েছে, ‘চায়নায় উয়াদের খুন করে বডি থেকে মেডিসিন নিকলে নেয়।’

কথার মাঝেই অন্য কোনও গাছ থেকে আরেকটা তক্ষকের তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে এল, ‘ট্রুউউউ… টক- টক -টক -টক… ট্রু -ট্রু – ট্রু- ট্রু – উ উ উ —!’

‘এর অর্থ বুঝলি অহো? ও ডাকতেই এ সাড়া দিচ্ছে কেন?’

অহর্ষি মাথা নাড়ল, ‘নাহ্, কেন রে?’

নন্দিনী বলল, ‘তুই সত্যিই নাদান। এটা হল না-মানুষী প্রেম। এখন ওদের মেটিং সিজন। তাই প্রথমে ডাক দিয়ে প্রেম ছুড়ল পুরুষ, বুঝতে চাইল কাছেপিঠে সঙ্গিনী আছে কিনা। মেয়েটা সাড়া দিল। এবার প্রেম হবে, একটু একটু করে দুজনে কাছাকাছি আসবে।’

মোহন আর তার সঙ্গী খুকখুক করে হাসল। নন্দিনী বলল, ‘কী গো মোহন, হাতিপোতা আর কতদূর?’

‘বেশিদূর নাই, পন্দর মিনিট দাঁড়াইতে হল কিনা… বাবু, ওই দেখেন, দেখেন…!’

ঝোপের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা সবুজ চোখ। অহর্ষির ফের গায়ে কাঁটা দিল। আগে বারদুয়েক জয়ন্তীতে এসেছে, কিন্তু আজ জঙ্গলকে আরও ছমছমে লাগছে। ‘ওগুলো কী জন্তু মোহন?’

‘ছোটা জানবর, শিয়াল কি বন বিলাই।… এই যে এসে গেছি, হাতিপোতা। ইখানে নদীতে থোড়া পানি আছে।’

পাথর, নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে জল চিকচিক করছে। উপর দিয়ে ক্যারর ক্যারর ডাকতে ডাকতে কয়েকটা প্যাঁচা উড়ে গেল।

অহর্ষি ফিসফিস করে বলল, ‘নন্দিনী, একটা কথা বলব?’

‘বল।’

‘আমরা যদি কলকাতায় পার্মানেন্টলি থাকি, তাহলে তো আর সমস্যা নেই, তাই না?’

নন্দিনী ওর দিকে তাকাল।
‘মানে বলছি… শহর তো সেফ… যা বুঝেছি, জঙ্গল ছাড়া বিমল আসতে পারে না…।’

নন্দিনী মাথা নাড়ল। ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আজ সেজন্যেই তো এসেছি রে। শেষবার একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই, আমিও ফেড আপ, আর পারছি না।’

সামনে ধু ধু সাদা পাথরের রিভার বেড, ভূতুড়ে গাছেদের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে হেলে পড়া চাঁদ, একদিকে পাহাড়ের সারি৷ হাজির হয়ে গেছে মাথায় বড় বড় শিং, বড় বড় কিছু জন্তু। জলে মুখ ডুবিয়েছে।

মোহন বলল, ‘ বাবু, দেখে লিন। এরা বুনো মহিষ, আংরেজিতে গাউর বলে। লেপার্ড ভি এদের সমঝে চলে। এবার তবে এগোই, নাকি?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মোহন।’ নন্দিনী বলল, ‘দাদাকে সব দেখিয়ে দিয়েছ। আর নয়, এবার চুনিয়া চলো। এখন রাত কটা, জানো? একটা।’

‘জী, দিদি৷’ মোহন স্টার্ট করে হেডলাইট জ্বালাতেই গাউরের দল ঘোঁতঘোঁত ডাক ছেড়ে দৌড় দিল।

দুপাশে এখনও জমাট জঙ্গল, কিন্তু রাস্তা পিচের, আগের মতো নুড়ি পাথরের নয়।

কিছুটা এগোবার পরে বামদিকে অনেকখানি এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বাল্বের মিটমিটে হলদে আলো। অহর্ষি অতিকষ্টে পড়তে পারল, ফাঁসখাওয়া টি এস্টেট।

‘কী নাম রে বাবা! ফাঁসখাওয়া! এই জঙ্গলের মধ্যে চা বাগান?’

‘হাঁ বাবু, এরকম আরও আছে।’ মোহন বলল,’ সব আংরেজ জমানার। বাগানের মধ্যেই সবকুছ আছে — কোয়ার্টার, স্কুল, হসপিটাল, বাইরে বেরোবার জরুরত নেই। ইস কে বাদ শুরু ডেন্স ফরেস্ট। চুনিয়া তক অর কোই বস্তি নাহি হ্যায়।’

গাড়ি একটু স্লো করল মোহন, ওর সঙ্গী নামতে নামতে বলল, ‘আমি এই বাগানে কাম করি। ফির মিলেঙ্গে।’

জিপসি ফের ছুটে চলে।…

অহর্ষি ফিসফিস করে বলল, ‘কী যে হয়েছে আমার, দুপুরের ঘটনাটা থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছি না। প্রথমে ঠিক স্বপ্নের মতো… তারপরেই…’

‘শ্ শ্ শ্…! চুপ চুপ…!’ নন্দিনী ওর মুখে হাত চাপা দিল, ‘বারবার বলিস না। আমি তো তোকে কথা দিয়েছি, আজকের পরে আর…।’
গাড়ি থেমে গেছে। নন্দিনী অস্ফুটে বলল, ‘চুনিয়া এসে গেছি রে। এবার নামতে হবে।’

জলধারার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। অনেকখানি এবড়োখেবড়ো পাথুরে প্রান্তর, বামদিকে জমাট জঙ্গল, ডাইনে কিছু অংশ বাঁশবন, খালের মতো বড় একটা নালা, অল্প অল্প জল চিকচিক করছে।

দমকা হাওয়া দিচ্ছে, কী শীতল, শরীর জুড়িয়ে গেল। বাঁশবন দুলছে, পাতায় পাতায় শনশন শব্দ । চাঁদ ডুবে গেছে বনের আড়ালে, চরাচরে তামাটে জ্যোৎস্না। রাত ঝিমঝিম, নিস্তব্ধ, নিথর।
মোহন বোধহয় সিগারেট ধরিয়েছে, তার কটু গন্ধ অহর্ষির নাকে এসে লাগল। নন্দিনী উঠে দাঁড়িয়েছে। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কণ্ঠস্বর হঠাৎ পাল্টে গেছে।

‘মোহন, সিগারেট ফেক দো। আমাদের সঙ্গে তোমায় যেতে হবে।…কয়েকটা কথা আজ বলব তোমায়। কারণ এত বছর ধরে আমি যে কেন এখানে আসি, কোথায় যাই, একমাত্র তুমিই জানো। আজকের কথাও শুধু তুমিই জানবে। এই অহর্ষি দাদা আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড। ওর সঙ্গে অনেক বছর পরে দেখা হল। ওর বউ মারা গেছে, আমারও স্বামী হারিয়ে গেছে এই জঙ্গলে। আমি এতদিন বিশ্বাস করেছি, তোমার বিমলদাদা আছে। কোনওভাবে কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু আর একা জীবন টানতে পারছি না। এই দাদার সঙ্গে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চাই। বুঝতে পারলে মোহন?’
মোহন একবার নন্দিনী, একবার অহর্ষিকে দেখছে। বলল, ‘হাঁ দিদি।’

‘আজ তুমি, এই দাদা আর আমি, তিনজনে যাব চুনিয়া ঝোরার সেই পাথরটার সামনে, যেখানে তোমার বিমল দাদার মোবাইল পড়ে ছিল। তোমাকে সাক্ষি রেখে আমি ওখানে দাঁড়িয়ে যা বলার বলব। তুমি মোবাইল রেডি রাখবে, ফটো খিঁচবার জন্যে। ঠিক আছে?’

ঘাড় নাড়ল মোহন কারকি।

নন্দিনী অহর্ষির হাত ধরে টান দিল, ‘আয়, নেমে আয়। চল।’

‘ক্-কোথায়? মানে এই জঙ্গলে এত জন্তু জানোয়ার… লেপার্ড, গাউর… ‘

‘চুপ কর!’ ধমকে উঠল নন্দিনী, ‘ভিতুর ডিম একটা! এই সাহস নিয়ে তুই আমাকে… বলছি তো আমি আছি।’

নন্দিনী অহর্ষির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, ‘শুনলি না, কী বললাম মোহনকে?’

অহর্ষি শিউরে উঠল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে দুপুরের দৃশ্য, জানলার গ্রিলে মুখ চেপে থাকা জ্বলন্ত চোখের বীভৎস দর্শন এক প্রাণী। বিমল কি তবে আর মানুষ নেই, মনস্টার হয়ে গেছে?… এখানেই কি আট বছর আগে বিমল ফিরে এসে রেখে গেছিল মোবাইল? তার আগে সেই ফোন থেকে নন্দিনীকে মেসেজ করেছিল?
সব গুলিয়ে যাচ্ছে, আর ভাবতে পারছে না অহর্ষি। যা হয় হবে। এলোমেলো পায়ে চলেছে নন্দিনীর সঙ্গে।

‘জানিস অহো, এই যে, এই ঝোপের সামনে যে পাথরটা, ওর ওপর বিমলের মোবাইল পড়ে ছিল। সেখান থেকেই ও মেসেজ পাঠিয়েছিল। ওই প্রথম, ওই শেষ।’

ওরা তিনজন এসে পড়েছে নালার সামনে। নন্দিনী জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে। কাদাজলে লম্বা লম্বা ঘাস, প্রবল বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে।

‘ক্-কিন্তু মোবাইলটা কই? তুই তো রেখে গেছিলি।’ অহর্ষি অস্ফুটে বলল।

‘হ্যাঁ, রেখে গেছিলাম।… পরের বার এসে আর পাইনি। তার পরে কতবার এসেছি… ওকে কত ডেকেছি, ও সাড়া দেয়নি। অথচ… যাগ্যে, এবার শেষবার, আর না।’

বলতে বলতে মুখের কাছে দু’হাত জড়ো করে নন্দিনী চিৎকার করে উঠল, ‘বিমল, ও বিমল! বিমল, আমায় শুনতে পাচ্ছ? আমি কিন্তু এখানে শেষবারের মতো এসেছি। আর কখনও আসব না।’

কোনও সাড়া নেই। শিরশিরে বাতাস বয়ে গেল।

‘বিমল, তুমি যেখানে যেভাবেই থাক, জেনে রাখ, আমি আর একা নই। আমার প্রথম প্রেমিক অহর্ষিকে পেয়ে গেছি, ওকে নিয়ে এসেছি। এবার তুমি যা ভালো বুঝবে, তাই করবে।’

না, এবারেও উত্তর এল না। নিথর নিস্তব্ধ জয়ন্তী। নন্দিনী ফের চেঁচিয়ে উঠল, ‘বেশ বেশ, আমরা চলে যাচ্ছি। বিমল, আমি বুঝে গেছি, তুমি… তুমি আর কোথাও নেই! চল রে অহো, আমরা নতুন করে জীবন শুরু করব। আর জঙ্গলে আসছি না বিমল, তুমি আর আমাদের ভয় দেখাতেও যেতে পারবে না। আমি আজ বিবেকের কাছে ক্লিন। চললাম।’

ঢেউয়ের মতো হাওয়া দিচ্ছে। নন্দিনী নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে গাড়ির দিকে হাঁটছে, পাশে মোহন কারকি আর অহর্ষি।

‘সবই কি আমার মনের ভুল? কিন্তু তাহলে চিলাপাতায় লোকটাকে অ্যাটাক করল কে? সেই রাতে গুমটি বাংলোয় কে এসেছিল?’ অহর্ষি কান পেতে শুনতে পেল নন্দিনীর কথাগুলো, ‘অহো আর আমি যখন আজ ঘরের মধ্যে, জানলায় ওটাই বা কে ছিল? দুজনেই কি ভুল দেখলাম!’

গাড়িতে এসে উঠল ওরা। অহর্ষি এতক্ষণ দম আটকে ছিল, ওর শ্বাস পড়ার শব্দ পাওয়া গেল। মোহন জিপসি স্টার্ট দিল… এবার ফিরতি পথ। ম্লান জ্যোৎস্না, জনপ্রাণী নেই… নিস্তব্ধ রাত… অহর্ষির কেমন পাগল পাগল লাগছে। এই মধ্য চল্লিশে এসে সত্যি সত্যিই আবার নতুন জীবন হবে!

নন্দিনী অহর্ষির হাতের উপর হাত রাখল, ‘ব্যস, আর কী! বিমল এপিসোড ইস ওভার। কী বলিস অহো! আমি আজ থেকে মুক্ত, আমার সব বাধা আজ ছিড়ে গেল।’

‘এমন করে বলছিস কেন?’ অহর্ষির খচ করে বিঁধল, ‘তোর কি ভালো লাগছে না নন্দিনী? তুই কি সত্যিই খুশি নোস?’

‘জানি না রে, সত্যি বলছি, জানি না।’ নন্দিনী করুণ সুরে বলল, ‘একদিকে বুকের মধ্যে যেমন নতুন জীবনের কথা ভেবে খুশি ভরে উঠছে, অমনি আরেকটা মন বলে উঠছে, কী গো, তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে আজ হারিয়ে ফেললে, তারপরেও এত খুশি? এটা কি তুমি ঠিক করছ?’
‘এসব আপনি কী বলছেন দিদি? আজ তো সত্যিই আপনার বহোত খুশি হওয়ার কথা। বিমলদা আপনাকে ইতনা সাল ধরে স্রিফ দুখই দিয়েছে। আজ এতবার ওকে ডাকলেন, তবু সে এল না। আসবে কী করে? ও কব হি মর চুকা হ্যায়।’ গাড়ি চালাতে চালাতে মোহন বলে উঠল, ‘দাদা, আপনার কাছে আমার নম্বর আছে, প্লিস দাদা, আপনাদের শাদির ডেট জানিয়ে দেবেন। যত কামই থাক, আমি কলকাতা যাবই যাব।’

‘তুমি কি খেপেছ মোহন? আমি পার্টি দেব নাকি? আমার কতবড় মেয়ে আছে!’ নন্দিনী সঙ্কুচিত হয়ে বলল।

‘তো? এ কোনও কথা হল? বেটি কি জানে না, তার মা এতদিন কত কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে?’ মোহন ফুৎকারে উড়িয়ে দিল, ‘কী দাদা, আপনি তো কুছু বলুন। আমায় দাওয়াত দিবেন তো? এবার আমাদের পাড়ায় আপনার সঙ্গে দিদির আচানক দেখা হল বলেই না উনার মাথাটা ঠিক দিকে ঘুরল। বহোত বহোত বাধাই হো দাদা।’

অহর্ষি হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ও বুঝে উঠতে পারছে না, নন্দিনী কি সত্যিই ওর জীবনের সঙ্গে জুড়তে চাইছে, না এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে?

গাড়ি এসে থেমেছে মোড়ের কাছে। ওরা নেমে পড়ল।

মোহন অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়ে বলল, ‘চলি দাদা, দিদি। এনজয় করুন। কাল সুবে ফির আসছি। লেকিন দাদা, আমার কথাটা ভুলে যাবেন না, শিবজীর কসম। ডেট জরুর জানাবেন। গুডনাইট।’

ধোঁয়া উড়িয়ে জিপসি এগিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।

দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে, অহর্ষির হাতে নন্দিনীর হাত। একটু দূরে অর্জুনের দোতলা হোমস্টে। একটাও আলো জ্বলছে না, ভূতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ডানদিকে শালবন, মরা চাঁদের আলোয় ছায়া- ছায়া হয়ে আছে। কোথাও শব্দ নেই, দুয়েকটা রাতজাগা পাখি কখনও ডেকে উঠছে।

নন্দিনী ওর হাত ধরে টানছে। অহর্ষি তাকাল। নন্দিনী বলল, ‘চল না, একটু শালবনে ঘুরে আসি।’
তারপরেই মৃদুস্বরে গেয়ে উঠল, ‘যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে… দেখা হয়েছিল তোমাতে আমাতে কী জানি কি মহালগনে… চাঁদ উঠেছিল গগনে…।’

বিবশ অহর্ষি, কী অপূর্ব গাইছে নন্দিনী। এ গান কি ওদের জন্যেই লেখা হয়েছিল!

ওরা ঢুকে পড়েছে শালবনের মধ্যে, নন্দিনীর গান ছড়িয়ে পড়ছে নিস্তব্ধ বনে, ‘এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার– বাঁধিনু যে রাখী পরাণে তোমার… সে রাখী খুলো না, খুলো না…সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা…সেই স্মৃতিটুকু কভু খনে খনে যেন জাগে মনে—-‘

‘আর ভিতরে যাস না।’
অহর্ষি বলতেই নন্দিনীর গান থেমে গেল, ‘কেন রে?’

‘ওই দ্যাখ। দেখতে পাচ্ছিস?’

ওরা থেমে গেল। অহর্ষি আস্তে আস্তে বলল, ‘ওরা লজ্জা পেয়ে যাবে। আমরাও।’

বেশ কিছু দূরে সেই জলাশয়, আলোয় চিকচিক করছে। তার সামনে দুটো সিল্যুয়েট মূর্তি খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওরা কারা বলতো? এত রাতে বনের মধ্যে এসেছে?’
‘তুই কী রে, নিজের মেয়েকেই চিনতে পারলি না?’

‘হ্যাঁ তাইতো, আসলে ভাবতেই পারিনি। হ্যাঁ, মান্টি আর বাবুন। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে… নিশ্চয়ই চুমুও খাচ্ছে… ঠিক স্ট্যাচু মনে হচ্ছে… সত্যি অহো, এদের জেনারেশনটা কত বোল্ড… আমাদের সময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে… কে দেখে ফেলবে, ভয়েই মরতাম… এরা কাউকে পরোয়াই করে না।’

‘আসলে এই পূর্ণিমা রাত, জঙ্গল, এই বয়েস, এর এমন একটা মাদকতা —‘

অহর্ষির কথা শেষ হল না। হঠাৎ শালবন জুড়ে শনশন করে ঝড়ের মতো হাওয়া উঠল, অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক, দিকদিগন্ত কাঁপিয়ে একটা বিকট গর্জন! মিশমিশে কালো একটি পাহাড়ের মতো প্রাণী এসে ওদের মধ্যে লাফিয়ে পড়েছে।

পরক্ষণে তার রোমশ থাবা এসে সপাটে আছড়ে পড়ল অহর্ষির ঘাড়ে।
আহ্ — আহ্! আর্তনাদ করে অনেকটা দূরে ছিটকে পড়ল অহর্ষি।

জ্ঞান হারাতে হারাতে অহর্ষি শেষবারের মতো দেখতে পেল, নন্দিনীকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরেছে মনস্টার!

নন্দিনী ছটফট করছে আর ‘উহ্ উহ্’ — কাতরে উঠছে।

কয়েক মুহূর্ত! তারপরেই নন্দিনীর গোটা শরীর অদৃশ্য হয়ে গেল মিশমিশে কালো অন্ধকারের মধ্যে।

অহর্ষির আর কিছু মনে নেই।।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *